শর্মিষ্ঠা মুখোপাধ্যায়

সৃষ্টি যে সুখেরই হবে এ-ধারণা ভ্রান্ত। সৃষ্টিতে অপূর্ণতা কিছু থেকেই যায়। ডানায় উড়াল দেওয়া সেই স্বপ্ন পূরণে সপ্তকে জমা হয় অনেক  আলোড়ন। আপন হতে বাহির হয়ে নিজেকে সম্পূর্ণ প্রকাশ করতে লাগে সীমার বাইরের সীমাহীনতা, যা ভাব ও সত্যের মতো তত্ত্বকথা নয়। সৃজনীশক্তি যে-সম্মোহনী দৃষ্টিকোণ রচনা করে, ভিজে মেঘের দুপুরে তার দিকে ছুটে আসে লুসিফেরিন রোদ। রেটিনা ভেদ করে অলকানন্দা ডুবে যায় ভালোবাসার সৃষ্টিসুখে।

মিহি জ্যোৎস্না আমাকে ছুঁয়ে যায়। আমি পারি না ওকে ছুঁতে। মিষ্টি গন্ধ বাতাসে ভাসে। আঘ্রাণ নিই বুক পেতে। দিতে পারি না তাকে কিছুই। অপ্রাপ্তির অনুষঙ্গে দুঃখগুলোকেই কেন জানি না খুঁজতে থাকি। ওদিকে আমার দুঃখগুলো ছড়িয়ে পড়ে থাকে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত! তার খোঁজ কেউ রাখে না।

শান্তিপ্রিয় বলে সুনাম কুড়োনো রাত্রি প্রলয় গাঁথে। শ্যাম রাখতে তার ভয়, কুল রাখাই জন্মান্তরের বিধান। ভুলগুলো জমে-জমে পাথর হয়; পাথর কেটে পুরুষ নারী বানায় আর যখন সেই নারীর চোখে জলের রেখা দেখা যায়, সেই জলে ভেসে যায় মিশর ব্যাবিলন হয়ে গোটা আর্য সভ্যতা। অন্তর্নিহিত এই ইতিহাস ক'জন পড়ে! দেখার চোখ নিয়ে ক'জন দেখে! দেখা আর হৃদয়ঙ্গম করা এক নয়, তাই শিকড়ের গন্ধ লেগে থাকে তার বাড়তি জীবনের ভুল পাঠ নেওয়া দীপ নিভে আসা মনে।

ক্লিশে বিদ্বেষ চিরবুভুক্ষু করে রাখে আত্মচেতনা। প্রাণোচ্ছলতার অপূর্ব ছন্দের কণ্ঠরোধ করে যে-কাপুরুষতম দুর্বলতা, তার প্রবৃত্তি জুড়ে মনখারাপের দীর্ঘতম শ্বাসের শব্দ বইয়ে দেয় কোনো এক অনির্দেশ্য বেদনা। প্রদাহ ছড়িয়ে যায় প্রাদেশিক অসন্তোষ ঘিরে। সৃষ্টির ভাবাবেগ বাউলগীতিকা রচনা করে পথে-পথে খুঁজে বেড়ায় আপন মনের মানুষকে! আপেক্ষিকতা তখন মনখারাপ ও খুশি— দুই গোলার্ধে হয়ে ভাগ হয়ে যায় আর খাঁচার ভিতর অচিন পাখি তার ধৈর্যচ্যুতি দেখে যায় বিষুবরেখার বিহনবেলায়।

মুহূর্তের ইচ্ছাগুলোকেই বলা চলে সেই সময়ের আমাদের শেষ ইচ্ছা। জীবন যদি সুযোগ দেয় আবার সাজিয়ে নেওয়ার, ভালো। নইলে গাঁথা মালা অনেক আলোকবর্ষ পরে উত্তর প্রজন্মের সঙ্গে সমুদ্রের মিলন ঘটায়। যদি তখনও বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়তে পারো শুষ্ক এ-বুকে, নিশ্চিত জানি আমার গতায়ত জীবন উৎসারিত প্লাবনে তখন ভাসিয়ে দেবে পারমাণবিক এই পৃথিবীর শোক।

Comments