সুদেষ্ণা মুখোপাধ্যায়

"চাঁদের আলো ম্লান হয়ে যায়
আঁধার মেঘের বিষণ্ণতায়
মর্ত্যে আমি নেশার ঘোরে
মেঘের প্রাণের কান্না শুনি।“
ওয়াচ টাওয়ারের ওপর থেকে জঙ্গল দেখতে-দেখতে এমনটাই মনে হচ্ছিল সায়নীর। আকাশের মেঘের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তার মনের কোনাতেও জমেছে ঘন কালো মেঘ, চাপচাপ অন্ধকারের মতো। সত্যি-মিথ্যে, ঠিক-ভুল সম্ভব-অসম্ভবের দোলাচলে দুলছে সে। কী করবে, কিছুই বুঝতে পারছে না! অস্ট্রেলিয়ায় আর কাউকেই চেনে না। কী করে সৃজককে ফিরে পাবে?

সৃজক সেনগুপ্ত, ইসরো-র ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট। রেডিও অ্যাকটিভিটি নিয়ে গবেষণার কাজে অস্ট্রেলিয়া এসেছিল। সায়নীর সঙ্গে নয়-নয় করে ছয় বছরের সম্পর্ক। আগামী মাসের কুড়ি তারিখ বিয়ে। তাই সৃজক যখন সঙ্গে যেতে বললো, আর না করতে পারেনি। কিন্তু এখন কোনমুখে একা ফিরে যাবে? যা ঘটেছে, সেটাও কেউ বিশ্বাস করবে বলে মনে হয় না! জেরেমি অ্যান্ডারসন, রিসার্চ সেন্টারের হেড। তার ফোনও সুইচ অফ বলছে।

কাল রাতের ঘটনাগুলো এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না। মনে হচ্ছে, ভয়ানক এক দুঃস্বপ্ন। এখুনি সৃজক এসে বলবে, "এককাপ কড়া কফি কর তো।" 
অথচ কী সুন্দরভাবে দিনটা কেটেছিল। সন্ধেটাও শুরু হয়েছিল চাঁদের রুপোলি আলো ঘেরা স্বপ্নরাজ্যের মধ্যে হাঁটতে-হাঁটতে। অস্ট্রেলিয়ার এমনিতেই লোকসংখ্যা কম, আর এই রিসার্চ সেন্টারটা লোকালয় থেকে বেশ খানিকটা দূরে। তাই লোকজন প্রায় ছিল না। বাতাসে ভাসছিল নাম না-জানা ফুলের সুগন্ধ। কুয়াশার চাদর জড়িয়ে গল্পে মশগুল হয়ে কখন জঙ্গলের কাছে চলে এসেছে, খেয়াল করেনি। হঠাৎ জঙ্গলের মধ্যে একসঙ্গে প্রচুর পাখি ডেকে উঠলো। সঙ্গে আরও কিছু জীবজন্তুর আওয়াজ প্রকৃতির নিস্তব্ধতা ভেঙে খানখান করে দিল। সায়নী একটু ভয় পেয়েই বললো, “চল ফিরে যাই”। তখুনি সায়নী দেখলো মটিতে কী যেন চকচক করছে।তুলে দেখলো, ছোট্ট দুটো মেটালের ক্যাপসুল। সৃজক-কে দেখাতেই, চমকে উঠলো। বললো, “কোথায় পেলি?”  সায়নী বললো, “এখানেই রাস্তায়”। আর কোনো কথা না-বলে সৃজক সায়নীর হাত ধরে প্রায় ছুটতে-ছুটতে পৌঁছলো ইনস্টিটিউটের রুমে। ঢুকেই চারদিকের জানালা-দরজা বন্ধ করে দিল। ভীষণ অস্বাভাবিক লাগছিল ওর আচরণ।  চোখে-মুখে স্পষ্টত ভয়ের ছাপ।
সায়নী জিজ্ঞেস করলো, “এতো ভয় পাচ্ছিস কেন?  ওগুলো কী?”
সৃজক যেন কোনো কথাই শুনতে পাচ্ছিল না। শুধু নিজের মনে বিড়বিড় করছিল, “ওগুলো কীভাবে ওখানে গেল? কীভাবে?”
তারপর জেরেমিকে ফোন করলো। উনি একটা সেমিনার অ্যাটেন্ড করতে সিডনি গিয়েছেন। অনেকক্ষণ কথা বলার পর ফোন রেখে সায়নীকে বললো, "বোস। তোর সঙ্গে জরুরি কথা আছে। আজকে তোকে যে-কথাগুলো বলবো, তুই কাউকেই কখনও বলবি না প্রমিস কর।"
সায়নী বললো, “তিনসত্যি করছি, বলবো না। এবার বল।“
সৃজক চারপাশটা একবার দেখে নিয়ে বলতে শুরু করলো—“ওই ক্যাপসুলগুলো  রেডিওঅ্যাক্টিভ ক্যাপসুল। ওগুলো যে-কোনো প্রাণীকে মিউটেট করতে পারে। তার মানে সেই প্রাণীর শরীরর কোষের গঠন পরিবর্তন করতে পারে। এর ফলে সেই প্রাণীটি হয়ে যেতে পারে সাংঘাতিক শক্তিশালী এবং বিশালাকৃতি। তাই এই ক্যাপসুলগুলোর দাম বিশ্বের বাজারে বিলিয়ন ডলার। প্রতিটা দেশ চাইছে ওগুলো অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে। যদিও মানুষের ওপর এখনও কোনো  এক্সপেরিমেন্ট  করা হয়নি। কারণ, এখনও পর্যন্ত সেই রূপান্তরিত প্রাণীটিকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনার কোনো উপায় আবিষ্কার হয়নি। তাই এই আবিষ্কারের কথা জনসমক্ষে আনা হয়নি। আর ওই ক্যাপসুলগুলো রাখা হয় একটা ভল্টে, যার কম্বিনেশন শুধু টিম মেম্বাররাই জানে।” 
“কীরে? শুনেছিস? ” সৃজকের ডাকে চটকা ভাঙলো সায়নীর। এতক্ষণ মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনেছিল কথাগুলো। বলল “একটা কথা আমি কিছুতেই বুঝলাম না। এত গোপনীয়তা সত্ত্বেও কী করে ওগুলো রাস্তায় পাওয়া গেল?”  
সৃজক চিন্তিতমুখে বললো “সেটাই তো ভাবাচ্ছে!” 
ওদের টিমে মোটেই পাঁচজন মেম্বার।  উইলিয়াম ব্রাউন, লি শেন, অলিভার স্মিথ, সৃজক আর ওদের টিমলিডার  জেরেমি। সবাই ভীষণ দায়িত্বশীল আর সৎ। টাকার জন্য মানুষের ক্ষতি করার কথা ভাবতেই পারে না। শুধু একটাই খটকা আছে। লি শেন দু'দিন হলো ল্যাবরেটরিতে আসছেন না। শুধু মেসেজ পাঠিয়েছেন, অসুস্থতার জন্য আসতে পারছেন না।

এমন সময় দরজায় তিনবার বেল বাজলো। সৃজক বললো, “নিশ্চয় বাকিরা এসে গিয়েছে।” 
দরজা খুলতেই উইলিয়াম আর অলিভার ঢুকে পড়লো। বললো, "লি-র দরজা লক করা আছে। ফোনেও পাওয়া যাচ্ছে না।" 
বলতে-না-বলতেই বাইরে এক তীক্ষ্ণ জান্তব আওয়াজ শোনা গেল, আর কিছু মানুষের পরিত্রাহি চিৎকার। পর্দা সরাতেই সায়নীর শিরদাঁড়া বেয়ে ঠান্ডা স্রোত নেমে গেল। এটা কি সত্যি নাকি চোখের ভুল! বাইরে দাঁড়িয়ে আছে অতিকায় এক মানুষ। চাঁদের আলোয় তার সাদা চামড়া রূপোর মতো চকচক করছে। বিশাল বড়ো কপালের নিচে দুটো হিংস্র চোখ জ্বলজ্বল করে জ্বলছে।
সৃজক বললো, "আর কোনো উপায় নেই। যা সর্বনাশ হওয়ার, হয়ে গেছে। লি মানুষের ওপর এই ক্যাপসুলের প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য নিজেকেই বেছে নিয়েছেন।"
উইলিয়াম আর অলিভার বললে “লেট আস গো। উই হ্যাভ দ্য ইনকমপ্লিট মেডিসিন ইন দ্য ল্যাবরেটরি।"  সৃজক বললো, “দেন হু উইল প্রোটেক্ট দ্য পিপল? আই হেভ টু ডু দ্য অড যব। ইউ প্লিজ গো অ্যান্ড ফেচ দ্য ড্রাগ অ্যাজ সুন অ্যাজ পসিবল।" তারপর সায়নীর দিকে তাকিয়ে বললো, “আসছি...অপেক্ষা করিস।" 

সেই শেষ দেখা। তারপর আর কাউকেই দেখতে পায়নি সায়নী। না, সৃজক-কে না-নিয়ে সে ফিরবে না। কিছুতেই না! অপেক্ষা করবে। দরকার হলে, সারা জীবন।

Comments

  1. খুব ভালো লাগলো । টানটান উত্তেজনা ।

    ReplyDelete

Post a Comment