এক-একটা বই থাকে, হাতে নিয়েই তার নির্মাণশৈলী দেখে বলে উঠতে ইচ্ছা করে—বাঃ! 'শেষের রূপকথা' নামক কবিতার বইটি ঠিক সেইরকম। কবির নাম— পারমিতা নাগ দে। যদিও তিনি শুধু 'পারমিতা' নামেই লিখতে পছন্দ করেন। এবং তিনি শুধু কবিই নন। আসামের এই বাঙালি কন্যা, যাঁর জন্মশহর শিলচর এবং বর্তমানে যিনি গুয়াহাটির বাসিন্দা; তিনি রবীন্দ্রসঙ্গীতে, বাচিকশিল্পে, সঞ্চালনায়, উপস্থাপনায় এক বিপুল বিস্তারে ছড়িয়ে রেখেছেন নিজের সাংস্কৃতিক জীবন।
'শেষের রূপকথা' একটি ৮৪ পাতার বই। এই বইয়ে ৭৩টি কবিতা আছে। কিন্তু কোনো কবিতারই শিরোনাম নেই। তার বদলে আছে কবিতাগুলোর শুরু ও শেষে দুটি করে পদচিহ্ন, স্বভাবতই নারীর, যে-চিহ্নের সঙ্গ ধরে অনুভবী পাঠকেরা এই বইয়ের শিরোনামহীন কবিতাদের মধ্যে যোগসূত্র খুঁজে পাবেন। তাই হয়তো বইয়ের শুরুতে 'আত্মকথন' শীর্ষক সংক্ষিপ্ত বয়ানে পারমিতা লিখেছেন, "'শেষের রূপকথা'য় ছড়ানো চিরকুটগুলো বেনামী হলেও জারজ নয়। 'অনি' হৃদয়ের অন্তস্থল থেকে আলোর মতো উৎসারিত।" হ্যাঁ, এই বইয়ের অনেক কবিতার উদ্দিষ্টের নাম অনি; হয়তো-বা সব কবিতারই। কোথাও উচ্চারিত, কোথাও অনুচ্চারিত ভাব ও ভঙ্গিমায় অনির সঙ্গে নিরন্তর কথোপকথন লিখতে থাকেন কবি। ঠিক যেমন একটি কবিতায় পারমিতা লিখেছেন : "তুই সোনালি নূপুর বলেছিলি/ আমি গনগনে আগুনের শেকল বেঁধেছি/ শ্যামলা পায়।/ বল দেখি.../মেঘমল্লার কি করে ভেজাবে আমায়?/ দেখে যা অনি.../আমিও কেমন বিদ্যুৎ এঁকে দিতে পারি/ তোর কালো আকাশের গায়।" কোনো প্যাঁচ-পয়জার নেই, শব্দের অহেতুক ভারে পাঠককে ভারাক্রান্ত করার চেষ্টা নেই; শুধু এক আন্তরিক অনাবিল স্রোতে লিখিত হয়েছে এইসব কবিতারা। এই আন্তরিকতা ছড়িয়ে আছে বইটির পাতায়-পাতায়, এবং এই আন্তরিক কথন-ই পারমিতার কবিতার মূল সম্পদ।
'শেষের রূপকথা'-য় অনেক মনে রাখার মতো পঙক্তি লিখেছেন পারমিতা। যেমন, "ভালো আছে নীল চিঠিগুলো/ আর নির্ঘুম পায়রা চোখ।/ ভালো আছে বুকের ভেতরের/ খুব স্থায়ী একটি অসুখ।।" আরও লিখেছেন—"নীড়ে ফেরা পাখির মতো লিখে রেখো/ একখানি ফেরার গান.../ আশ্বিনের উৎসব নামবে সেদিন/ সবাই জানুক।।" অথবা ধরা যাক, "কিছু আগুন ভীষণ শীতল/ পুড়ে গিয়েও সুখ।" এবং "আর কিছু প্রেম গভীর ভীষণ/ তাই বিরহ বারোমাস।।"
প্রেম-ই নিঃসন্দেহে 'শেষের রূপকথা'-র প্রধান উপাদান। কখনও আবেগে-উচ্ছ্বাসে, কখনও বিরহে-বিষণ্ণতায় সেই প্রেম ধরা পড়ে পারমিতার এইসব কবিতায়। কিন্তু লক্ষ করার মতো বিষয়, প্রেমের উচ্ছ্বাসও এখানে যেন হালকা বিষাদের একটা চাদর গায়ে আলতো করে জড়িয়ে থাকে। আমরা পড়ি, "মুছে যাক আলোর তরলতা.../ ডুবে যাক অসীম আকাশ/ কৃষ্ণগহ্বরের কোলে.../ ভাটিয়ালি গাইতে গাইতে/ একটা আস্ত চাঁদ গিয়ে নেওয়া যায়..."।
কাগজ, ছাপা ও বাঁধাই খুব ভালো হলেও এই পেপারব্যাক বইটির দুর্বলতা হলো, বেশকিছু মুদ্রণপ্রমাদ। এছাড়া, আধুনিক বাংলায় অপ্রচলিত হয়ে গিয়েছে, এমন বানানের উপস্থিতিও আছে কিছু। নয়নজ্যোতি শর্মা-র করা প্রচ্ছদ চলনসই; তবে আরও অনেক ভালো হতে পারতো। কিন্তু এইসব ত্রুটিকে ঢেকে দেয় পারমিতার ওই নির্ভার আন্তরিক কথন—" সবুজ পেরিয়েছিতো সেই কবেই/ এখন বোধহীন নীল বসন্ত অসাড়.../ ক্ষত এঁকে দিয়েছে প্রান্তিক বৈভব/ তবু আরো আরো ভালোবাসতে চাই.../ আরো একটা জীবন দেবে ধার?" এবং বিষাদের সেই আলতো চাদর জড়ানো প্রেমকে দিয়েও পারমিতা উচ্চারণ করিয়েছেন মনে থেকে যাওয়ার মতো আশাবাদী পঙক্তি : "পায়ের পাতা পুড়ে যেতে যেতে/ চোখের আঙিনায় চলো লিখে রাখি/ তোমার আমার একটা/ ফুরিয়ে না যাওয়া গল্প।।"
'শেষের রূপকথা' তাঁর প্রথম বই। এরপরে সম্ভবত তাঁর একটি উপন্যাসও প্রকাশিত হয়েছে। সেইদিক থেকে ভাবলে তো বটেই; এই বইয়ের কবিতাদের পড়তে-পড়তেও মনে হয়, শেষ নয়। এই বই আসলে পারমিতার প্রথম রূপকথা।
শেষের রূপকথা | পারমিতা | ভিকি পাবলিশার্স, গুয়াহাটি | প্রথম প্রকাশ : ২০২১ | ১০০ টাকা
Comments
Post a Comment