রাহুল ঘোষ

দেবাশিস মুখোপাধ্যায়ের কবিতা পড়তে গেলে, প্রথমেই যে-কথাটা পাঠকের মনে হবে, তা হলো, এর থেকে কম শব্দ ব্যবহার করে বোধহয় এই কবিতাটি লেখা সম্ভব ছিল না। এতটাই পরিমিত তাঁর শব্দের ব্যবহার! এবং তেমনই কুশলী তাঁর শব্দচয়ন। এই কবির নবম কাব্যগ্রন্থ 'অন্তর্বাসের রিংটোন'-ও পাঠকের মনে একই অনুভূতি এনে দেবে। প্রকৃতপক্ষে ৬৪ পৃষ্ঠার এই বইটিতে তাঁর নিজস্ব কবিতাভাষার এক সুললিত উপস্থাপন করেছেন দেবাশিস মুখোপাধ্যায়; যে-ভাষা আসলে সহজ, কিন্তু বহুমাত্রিক। এমন ভাষা অর্জন করা সহজ নয়; কিন্তু কঠিন কথাগুলো খুব সহজ শব্দে লিখে ফেলতে না-পারলে আর কবিজন্মের অর্থ কী! 

'অন্তর্বাসের রিংটোন'-এ দেবাশিস মুখোপাধ্যায় রেখেছেন বৃত্তখেলা, অন্তর্বাসের রিংটোন, বর্ষাকালীন লেখা, তিন রঙা কবিতা, কবিতাপাড়ায় কিছু হত্যাদৃশ্য, কবিতায় এখন, বসন্তের বেরং ও রঙ্গোলি শীর্ষক সাতটি কবিতাগুচ্ছ এবং সর্ট-কার্ট  নামের একটি একক কবিতা। কবিতাগুচ্ছদের মধ্যে আছে যথাক্রমে ২০, ১০, ৫, ৩, ৩, ৪ এবং ১০টি কবিতা। প্রতিটি কবিতাগুচ্ছই আলাদা মনোনিবেশ দাবি করে। বৃত্তখেলা (দুই)- য় তিনি লিখেছেন, "লেখাকে কি দেব বলো!/শীত এসে বসে গেছে অক্ষরের গায়ে/গান তাকেও বুঝি শ্লেষ্মায় ধরেছে"। ওই গুচ্ছের চার নম্বরে লিখেছেন, "এই দ্যাখো সাঁতার না জানার ফল/ডুব ডুব বেজে যাচ্ছে বুকের/গুপী যন্ত্র"। সাত নম্বরে লিখেছেন, "কে শিশ্নরক্ত ফেলে গেছে/নয়নতারার ছায়ায়/শূন্য শূন্য মজনুর খাতা/রোগাক্রান্ত গোলাপের কথা ভেবে" এবং একটি স্পেস দিয়ে লিখেছেন, "নিব ভেঙে দেয়"। পাঠক নিশ্চয়ই গড়ে নিচ্ছেন একটি আশ্চর্য চিত্রকল্প, এবং এইরকম চিত্রকল্প দেবাশিস মুখোপাধ্যায়ের কবিতায় ছড়িয়ে আছে। আর আছে এমন কিছু পঙক্তি, যাদের পৃথকভাবে পড়লেও গভীর অনুভূতির পরশ লাগে। ঠিক যেমন, ওই কবিতাগুচ্ছের আট নম্বরে লিখেছেন, "তমায় তমায় মা নেই কোথাও"। অথবা উনিশ নম্বর কবিতায় " কান্না এতো বিবস্ত্র তারও কি জানা ছিল!" এই পর্বের ষোলো নম্বর কবিতাটি তিনি শেষ করে এনেছেন এইভাবে—" নেই নেই বলে তোমার লুকোনো ব্যথা/অন্ধ রাতের চোখে ধরা পড়ে যায়" এবং একটি স্পেস দিয়ে শেষ করেছেন "মাপতে পারি না" লিখে। এখানে শেষ ও তার আগের লাইনের মধ্যবর্তী স্পেসটুকু যেন এক অসীম শূন্যতাকে দেখিয়ে দিচ্ছে, যাকে সত্যিই মাপা যায় না!

অন্তর্বাসের রিংটোন  কবিতাগুচ্ছেও এমন অনেক আপাত-সরল অথচ গভীর কবিতার উপস্থিতি। এই গুচ্ছটির প্রকাশভঙ্গি কিঞ্চিৎ আলাদা; যদিও তাতে অন্তর্লীন বিষাদের সুরটিকে আগের মতোই চেনা যায়। যেমন, চার নম্বর কবিতায় "যমুনার জলে তাজের শ্রমিকের/কাটা আঙুলের আর্তনাদ। ফ্যাকাশে/মার্বেলের মুখ জোছনার গা ছুঁয়ে।" অথবা সাত নম্বরে "শীতের পোশাক হেঁটে যায় কিছুটা/ফিকে। ভাঙা স্বরে ভরে আছে বাতাস। বসন্তের দেবীটি গলে জল।/বাঁশবনে পড়ে থাকা তার ছেঁড়া/ ওড়নায় হুমড়ি খেয়ে পড়ে ভাঙা/ঘট। ঘটনা যাই হোক না কেন যেন/আজ পাড়ায় অরন্ধন"। কী দারুণ দক্ষতায় কবি এখানে অল্প কয়েকটি শব্দে একটি হৃদয়বিদারক ঘটনার ছবি এঁকে দিলেন, ভাবলে অবাক হতে হয়! এই পরিমিতিবোধ, এই মিতকথনই দেবাশিস মুখোপাধ্যায়ের কবিতার আসল শক্তি। আপাত-বিপরীত সুরের কবিতার ক্ষেত্রেও সেই শক্তি তাঁর সঙ্গ ছাড়ে না। এই গুচ্ছের দশ নম্বর কবিতায় তাই তিনি লিখতে পারেন "খেয়ালে বেখেয়ালে চাঁদ বারান্দায়/ভালোবাসা। তরুণীর সে পসরায়/হাত রাখি। খিদে চাগিয়ে ওঠে। ঠেলে দি ক্রমশ নিম্নাঙ্গ। গমনের/এই পথ বর্ণাঢ্য।..."

আগেই বলেছি, বইটির পাতায়-পাতায় এমন পঙক্তি ছড়িয়ে আছে, যাদের আলাদা করে পড়লেও মনে থেকে যাবে। যেমন, তিন রঙা কবিতা  গুচ্ছটির তিন নম্বর কবিতায় "কুড়িয়ে পাওয়া আপেল শুধু পতন জানে" এবং কবিতায় এখন  গুচ্ছটির প্রথম কবিতায় " খুব জোকার উঠেছে চারপাশে"-র মতো পঙক্তি। এইসব পড়তে-পড়তে বইটির শেষদিকে এসে বসন্তের বেরং ও রঙ্গোলি কবিতাগুচ্ছের এক নম্বর কবিতাটি পড়ে আমি চমকে উঠি—"বসে থাকি মৃত পাখিটির পাশে।/শুকনো পাতায় সামগান বাজে।/পালকের ঘুম ভাঙে না। সূর্যাস্ত/কালীন রঙ বেশ গম্ভীর। ভিড়/ফিকে হয়ে এলে কান্নায় পাখি ধুই/আর ক্রমশ পৃথিবী ভাঁজ হয়ে আসে"। প্রিয় পাঠক, "কান্নায় পাখি ধুই" পড়ে আপনারও কি বুকের ভিতরে মোচড় দিয়ে উঠবে না? অথবা "ক্রমশ পৃথিবী ভাঁজ হয়ে আসে" পড়ে আপনিও কি একইসঙ্গে চমকিত এবং বিষাদ-আচ্ছন্ন হয়ে পড়বেন না? এখানেই পরিমিত শব্দব্যয়ী এই কবির সাফল্য। 

'অন্তর্বাসের রিংটোন' বইটির কাগজ, ছাপা, বাঁধাই উন্নতমানের। বইটিতে সামান্য কিছু মুদ্রণপ্রমাদ আছে। সমীরণ ঘোষের করা প্রচ্ছদটি কিঞ্চিৎ বিবর্ণ, কিন্তু অত্যন্ত ব্যঞ্জনাময়। সব মিলিয়ে বইটি কবিতাপ্রেমী পাঠকের সংগ্রহে রাখার এবং কিছুদিনের ব্যবধানে ফিরে-ফিরে পড়ার মতো বই।
অন্তর্বাসের রিংটোন | দেবাশিস মুখোপাধ্যায় | কবিতিকা ★ রাঙামাটি, পশ্চিম মেদিনীপুর | ডিসেম্বর ২০১৮ | ১২০ টাকা 














Comments

  1. তবে কবিতার লাইনগুলো পর পর বই এর মতো করে দিলে ভালো হত। বেশ ভালো। দারুণ অনুভূতি।

    ReplyDelete
    Replies
    1. রিভিউ-তে কবিতার লাইন এইভাবে দেওয়াটাই সুপরিচিত ও প্রচলিত পদ্ধতি। লেখক এবং পাঠক, উভয়েই এর সঙ্গেই অভ্যস্ত। এখানে / চিহ্ন দেখে বুঝতে হয় যে, পরের লাইনে যাওয়া হচ্ছে। যাইহোক, পাঠ-প্রতিক্রিয়ার জন্য ধন্যবাদ।

      Delete

Post a Comment