শিল্পী নাজনীন

এক.

আজ এই বৃষ্টির কান্না দেখে মনে পড়লো তোমায়...

দূর থেকে গানটা ভেসে আসছে। কে গাইছে? গলাটা চেনা লাগছে খুব। কার যেন? কী যেন নাম মেয়েটার? দারুণ গায়। কিন্তু নামটা? না। মনে পড়ে না কিছুতেই। মাথাটা ভারী লাগে ভীষণ। কী যেন একটা কথা মনে পড়তে গিয়েও পড়ে না, মুছে যায় স্মৃতি থেকে, ফুড়ুৎ করে উড়ে যায় দূরে। কী যেন একটা ছবি স্মৃতিতে ভাসতে গিয়েও ডুবে যায় আবার। মহুয়ার মুখটা মনে পড়ে। হঠাৎই। মহুয়া! কোথায় এখন? কী করছে? দূর! কে মহুয়া! বিস্মৃতি আবার জট পাকিয়ে দেয় সব। মন থেকে আবার সব মুছে যায় জিতুর। ভীষণ শীত করে তার। অসাড় লাগে শরীর। সে কি মারা যাচ্ছে? অথবা মারা গেছে? ঠিক বুঝতে পারে না জিতু। মাথার ভেতরটা ভীষণ ফাঁকা-ফাঁকা লাগে আবার। আবার গানটা এসে তুমুল বাজতে থাকে মাথার ভেতর।

দুই.
আজ এই বৃষ্টির কান্না দেখে মনে পড়লো তোমায়...

কাকে মনে পড়লো, কার?

সে জিতু, তার কি কখনও মনে পড়েছিল কাউকে, কোনো অঝোর বর্ষায়? কোনো অকূল শ্রাবণে? প্রশ্নগুলো মাথার ভেতর ধাক্কা দিয়েই সরে যায়, গানটা পুরোপুরি আবার দখল নেয় সেখানটায়। একসময় গান থামে। অফিসে জিতু। পরিপাটি। বসের সামনে বসে মন দিয়ে অ্যাসাইনমেন্টটা বুঝে নিতে ব্যস্ত। জয়ী পাশের চেয়ারে। যৌথভাবে কাজটা করতে হবে তাদের। আড়চোখে জয়ীকে একবার দেখে জিতু। মন দিয়ে নখ খুঁটছে জয়ী। গাঢ় রঙের নেইলপলিশে ঢাকা তার লম্বা নখগুলো দেখতে ভালো লাগছে। কিন্তু এখন ওদিকে নজর দিলে চলবে না জিতুর। বসের নির্দেশনাগুলো পইপই করে বুঝে না-নিলে তাকেই পস্তাতে হবে পরে। জয়ী সঙ্গে থাকবে নামমাত্র। যে-কোনো কাজে সহকর্মীকে ডুবিয়ে দিতে অফিসে জয়ীর জুড়ি নেই। তবু কীভাবে যে চাকরিতে বহাল আছে জয়ী! আশ্চর্য।

কী ব্যাপার? আনমনা যে?

ক্যান্টিনে জয়ীর গায়ে পড়া আলাপের চেষ্টায় খানিকটা বিরক্তই হয় জিতু। তবু ভদ্রতার মুখোশটুকু চাইলেই ছুঁড়ে ফেলা যায় না সহজে। জিতু অন্তত পারে না। মুখে তাই হাসির আলগা পরত রেখেই বলে, না-না। আনমনা নই তো।

তাহলে নীরব কেন? মুখটাও শুকনো লাগছে ভীষণ!

শালা! তোমার মতো একজনকে আমার অ্যাসাইনমেন্টের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হলো! মুখ শুকনো থাকবে না তো কি ফুর্তিতে কদম ফুটবে মুখে!

মনে-মনেই উত্তরটা দেয় জিতু। মুখে রা কাড়ে না। বলা যায় না। মুখের ওপর কত কী-ই যে বলা গেল না একজীবনে! বসকে যেমন আজ খুব বলতে ইচ্ছে করেছিল, আপনার পরকীয়ার জের কেন বেচারা আমার ওপর চাপিয়ে দিচ্ছেন, স্যার! কাজটা আমি একাই করি বরং! জয়ীকে আপনি আপনার কাছেই রাখুন!

কিন্তু বলা গেল না। যায় না। তাই জয়ীর দিকে অন্যমনে তাকিয়ে সে উত্তর দেয়, এমনিই জয়ী আপা। মনটা ভালো নেই। একটু একা থাকতে চাই।

জয়ী ভ্রূ কুঁচকে তাকে দেখলো কিছুক্ষণ। পাত্তা দিল না জিতু। মোবাইলে মনোযোগ আটকে রাখলো নির্বিকার। অতঃপর ক্যান্টিন থেকে একটা স্যান্ডউইচ নিয়ে জিতুকে বিলটা ধরিয়ে দিয়ে কেটে পড়লো জয়ী। ধান্দাবাজ মেয়েছেলে!

বিড়বিড় করে কথাটা বলেই জিভ কাটলো জিতু। ভাগ্যিস মহুয়া আশেপাশে নেই। শুনতে পেলে তুলকালাম করে ফেলতো। ‘মেয়েছেলে’ শব্দটা একদম পছন্দ নয় তার। ওতে নাকি মেয়েদের অসম্মান করা হয়, তুচ্ছ করা হয়। কীসে যে সম্মান বাড়ে মহুয়ার আর কীসেই-বা কমে, সে-সব ব্যালান্স করতে গিয়ে তালগোল পাকিয়ে ফেলে আজকাল জিতু; খেই হারিয়ে ফেলে একদম। বাসায় সে মহুয়ার সঙ্গে কথা বলে মেপে, সারাক্ষণ তটস্থ থাকে ভয়ে। ফলে, মহুয়ার সঙ্গে প্রেমটা এখনও তেমন একটা জমলো না তার। মা বলতেন, কাঙালের কথা বাসি হলে ফলে রে জিতু। মহুয়া বড়লোকের আহ্লাদী মেয়ে, ওর সঙ্গে তোর বনবে না কোনোদিন। তাল মেলাতে পারবি না, উষ্টা খাবি প্রতি পদে। ও মেয়েকে ভুলেও বিয়ে করিস না কিন্তু।

মায়ের কথায় কান দেয়নি তখন জিতু। কাঙালের কথা বাসি হলে ফলেছে, ফলছে এখন প্রতিদিন। উষ্টাও খাচ্ছে সে প্রায় প্রতি পদেই। কাঁঠালের আঠা পিরিতি তবু মন থেকে সরাতে পারেনি সে কিছুতেই। মহুয়ার নেশায় মাতাল এখনও জিতু।

জয়ী চলে গেছে। একমনে মোবাইলে সেভ করে রাখা মহুয়ার ছবিটা দেখতে থাকে জিতু। জয়ী যাওয়ার সময় ফোড়ন কেটে যায়, হুঃ! কী যে এক সুন্দরী বউ তোমার! ওতেই মজে আছো সারাক্ষণ! বউ যেন আর কারও নাই দুনিয়ায়!

সবাই কি আর বসের মতো! ঘরে সুন্দরী বউ রেখে অফিসে এসে নারী স্টাফদের দেখে ছোঁকছোঁক করবে, সুযোগ পেলেই দামি গিফট দিয়ে পটিয়ে লংড্রাইভে যাবে! কথাগুলো বলতে গিয়েও মুখে আটকে যায় জিতুর। নিজেকে অতিকষ্টে থামায় সে। বসের নতুন টার্গেট মাহী। ব্যাপারটা এখনও আঁচ করতে পারেনি জয়ী। নিজেকে সে এখনও বসের প্রিয়জন ভেবে মহানন্দে অফিসে বসে বগল বাজাচ্ছে আর সুযোগমতো কলিগদের পকেট কাটছে। নতুন অ্যাসাইনমেন্টটায় জিতুর সঙ্গে জয়ীকে ভিড়িয়ে দিয়ে বস আসলে মাহীকে বাগে পাওয়ার মওকা খুঁজতে চাইছে। অফিসের সবাই মোটামুটি এটা বুঝে গেছে এখন, শুধু জয়ী আর মাহী বাদে। জয়ী বুঝছে না, কারণ সে এখনও বসের দামি গিফট আর লংড্রাইভের মোহ কাটিয়ে উঠতে পারেনি। মাহী বুঝছে না, কারণ সে অফিসে নতুন। অফিসের হাল-হকিকত একেবারেই জানা নেই তার। জয়ীর চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে মুখ টিপে হাসলো জিতু। অফিসের সবাইও তার মতোই মুখ টিপে হাসছে ব্যাপারটা নিয়ে। তাদের অতিচালাক বস যদিও ব্যাপারটা ধরতে পারছে না এখনও, নিজের ছাড়া আর কারও বুদ্ধিতে লোকটার মোটেই আস্থা নাই বলে। মহুয়ার ছবিটা দেখতে-দেখতেই হুট করে চিত্রটা পাল্টে গেল আবার। মাথাটা ঝাপসা হয়ে এল, ভারী। আবার কোথাও বৃষ্টির শব্দ বাজল ঝমঝমিয়ে। গানটাও।

তিন.
ঝুম বৃষ্টি। দূরের দৃশ্যগুলো ঝাপসা এখন, অস্পষ্ট। টিনের চালে বৃষ্টির ঝমঝম শব্দটা নেশা ধরিয়ে দিচ্ছে। মাথার কাছে বাঁশের চাটাইয়ের বেড়া দিয়ে বৃষ্টির ছাঁট এসে পড়ছে মুখে, গায়ে। জিতুর আবার শীত করে ভীষণ। পাশে শুয়ে থাকা পলাশকে জড়িয়ে ধরে খানিকটা উষ্ণতা পেতে। কিন্তু পলাশের গা-টা ভীষণ শীতল। সাপের গায়ের মতন। কেঁপে ওঠে জিতু। আষাঢ়ের বৃষ্টিতে কি এত শীত নামে? এতটাই ঠান্ডা হয় কারও শরীর! পলাশ! এই পলাশ! ওঠ! ভিজে যাচ্ছিস তো, জমে যাচ্ছিস যে শীতে!

পলাশ ওঠে না। সামান্য নড়াচড়াও করে না। বৃষ্টিটা আরও জোরে নামে। এত বৃষ্টি কেন আজ? পৃথিবীর এত কী দুঃখ জমেছে এই রাতে? কথাটা মনে করে জিতুর কপাল কুঁচকে ওঠে হঠাৎ। আচমকা তার মাথার ভেতর আরেকটা বাদলা বিকেল জেগে ওঠে। তুমুল বৃষ্টিতে ভেসে যায় পৃথিবী। তাদের গ্রামের পাশের বিস্তীর্ণ সবুজ মাঠটায় জল থইথই করে। ঘোষেদের ছেড়ে যাওয়া পাঁচবিঘার ক্ষেতটা একহাঁটু জলে হাবুডুবু খায়। সেই একহাঁটু জলে জিতু আর তার হাফপ্যান্ট পরা বন্ধুরা বড়ো একটা জাম্বুরা নিয়ে ফুটবল খেলে। খানিক দূরের দৃশ্যও ঝাপসা তখন। বড়ো-বড়ো বৃষ্টির ফোঁটা পিঠে বিঁধছে সূঁইয়ের মতো, মাথা বেয়ে নামা জলের ধারা ভিজিয়ে দিচ্ছে চোখ। তবু খেলা চলছে বিপুল উৎসাহে। কিছুক্ষণ পর-পর চিৎকার উঠছে, গোল, গোল, গোওওওল…

ভিজে চুপসে গিয়ে জিতু শীতে কাঁপছে ঠকঠক, দাঁতে-দাঁতে বাড়ি খেয়ে শব্দ উঠছে জোর, তবু খেলা ছেড়ে যেতে তার ইচ্ছে করে না একদম। সে দলের একমাত্র স্ট্রাইকার, তাকে ছাড়া খেলা জমবে না কিছুতেই; সে চলে গেলে খেলাটাই মাটি! বল নিয়ে সে তুমুল গতিতে ছোটে, বৃষ্টির ঝাপটা তার শরীরে আছড়ে পড়ে মুহূর্মুহূ।  ক্ষিপ্রগতিতে তবু জিতু দৌড়ায়। হঠাৎ পায়ে নরম কী একটা বস্তু পেঁচিয়ে যায় তার। পায়ে কামড় টের পায়, ব্যথা। বল ছেড়ে, মাঠ ছেড়ে, চিৎকার করতে-করতে ডাঙায় ওঠে জিতু। পায়ে পেঁচিয়ে যাওয়া বস্তুটা দেখা যায় এবার। সমস্বরে চিৎকার ওঠে, সাপ! সাপ! পালা জিতু! পালা!

কোথায় পালাবে জিতু? সে যত দৌড়ায়, পায়ের সঙ্গে পেঁচিয়ে থাকা সাপটাও তার সঙ্গে-সঙ্গেই যায়! মিঠু দারুণ সাহসী। সে কোত্থেকে দৌড়ে এসে পেঁচিয়ে থাকা সাপটার লেজ ধরে টেনে ছাড়িয়ে নিল জিতুর পা থেকে। পা বেয়ে তখন রক্ত ঝরছে জিতুর। সবাই তবু হেসেই উড়িয়ে দিল ব্যাপারটাকে, আরে দূর! ও তো ঢোঁড়া সাপ! ওতে বিষ নেই। কিচ্ছু হবে না, দেখিস!

ততক্ষণে মা এসে গেছেন সেখানে। জিতুর মাথাটা বুকের মধ্যে চেপে সে কী কান্না মায়ের! বাড়িতে নিয়ে কত ডাক্তার-বদ্যি! জিতুর জ্বর তখন একশো-তিন! পলাশ পাশে শুকনো মুখে বসা। কিন্তু বৃষ্টিটা তো ততক্ষণে থেমে গেছে একদম! এখন তাহলে কেন বৃষ্টির শব্দ বাজে অবিরাম? কোথায়? বৃষ্টির শব্দটা জিতুর মাথার মধ্যে সেঁটে বসে আবার। শীতল বোধে আবার জমে যেতে থাকে জিতু।

চার.
এবারের অ্যাসাইনমেন্টটা শেষ করতে দূরে যেতে হলো। অন্য শহরে। একই হোটেলে উঠলো জিতু আর জয়ী। আলাদা-আলাদা রুমে। সন্ধ্যা নাগাদ সব কাজ সেরেসুরে রুমে ডিনার সার্ভ করার অর্ডার দিয়ে সবে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছে জিতু; অমনি দরজায় ঠকঠক। এত তাড়াতাড়ি ডিনার দেয়ার কথা বলেনি সে। তাহলে কে এল এখন?

কাম ইন, প্লিজ! বলে দরজায় উৎসুক চোখ রাখলো সে। জয়ী! বিরক্ত, সন্ত্রস্ত জিতু তড়াক করে বিছানায় বসলো উঠে।

কী ব্যাপার, আপা? কোনো সমস্যা?

আমি এক্ষুনি ফিরে যেতে চাই জিতু। তুমি আমাকে কক্সবাজারের কোনো একটা বাসে তুলে দাও, প্লিজ!

কেন আপা? কোনো সমস্যা হয়েছে কি? জরুরি কিছু?

তোমার বসের বসগিরি ছুটাবো এবার। আমাকে এখানে পাঠিয়ে সে মাহীকে নিয়ে ফুর্তি করতে কক্সবাজার যাচ্ছে! আমাকে তুমি কক্সবাজারের কোনো একটা বাসে তুলে দাও জিতু।

কষ্টে হাসি চাপলো জিতু। নিরীহ মুখে বললো, বলেন কী আপা! এত কাহিনি! কিন্তু আপনি কক্সবাজার গিয়ে করবেন কী, আপা? বস কোথায় উঠবে সেটা তো আপনি বা আমি কেউই জানি না!

তাহলে কী করবো, তুমিই বলো! কাঁদো-কাঁদো কণ্ঠে বললো জয়ী, চোখে জল।

এককাজ করুন আপা, অ্যাসাইনমেন্টটা সেরে একবারে যান। একসঙ্গে পরশুই ফিরে যাওয়া যাবে তাহলে!

আরে! রাখো তোমার অ্যাসাইনমেন্ট! চাকরিটাই আর করবো না আমি। এইরকম লুচ্চা বসের আন্ডারে আমি চাকরি করবো না। চাকরি না-পাই না-পাবো, তবু এই অফিসে আর থাকবো না আমি।

কিন্তু আমাকে তো চাকরিটা করতে হবে, আপা। কাজটা শেষ না-করে তো ফিরতে পারবো না আমি।

তোমাকে তো যেতে বলছি না। তুমি আমাকে একটা বাসে তুলে দাও, আমি এখানে থাকবো না আর। বাসায় চলে যাবো।

ন্যাকা! সব একা পারে, এখন আবার ভং ধরেছে! বাসে তুলে দিয়ে আসতে হবে তাকে! যত্তসব। রাগে গজগজ করতে-করতে জয়ীকে ঢাকার বাসে তুলে দিয়ে তবে শান্তি জিতুর। পরের দিন একাই কাজটা গুছিয়ে ফেললো জিতু। বসের চালাকিটা আগেই বুঝেছিল সে। কাজটা একদিনেরই ছিল। স্রেফ জয়ীকে এদিকে আটকে রাখার ফন্দি হিসেবে সময় বাড়িয়ে জিতুর সঙ্গে মেয়েটাকে জুড়ে দিয়েছিল লোকটা। জীবন যে কত বিচিত্র! কত যে জটিল হিসেব জমা থাকে তার প্রতি পরতে! ভাবতেও ক্লান্ত লাগে জিতুর। পরদিন ফেরার কথা ছিল যদিও, তবু শুধু-শুধু হোটেলে পড়ে থাকারও কোনো অর্থ হয় না। বিকেল নাগাদ সব গুছিয়ে নিয়ে তাই সন্ধ্যার বাসে উঠে বসলো জিতু। সব ঠিকঠাক থাকলে এগারোটার মধ্যে বাসায় পৌঁছে যাবে সে। মহুয়াকে আর জানালো না কিছু। বরং বাসায় পৌঁছে চমকে দেয়া যাবে তাকে।  মহুয়া! মহুয়া! বৃষ্টির শব্দের সঙ্গে নামটাও ঝমঝমিয়ে বাজতে থাকে জিতুর মাথার ভেতর। বাজতে থাকে গানটাও, আজ এই বৃষ্টির কান্না দেখে মনে পড়লো তোমায়…


(এই গল্পের শেষাংশ প্রকাশিত হবে আগামী সংখ্যায়)

Comments