"মরুবিজয়ের কেতন উড়াও শূন্যে হে প্রবল প্রাণ।” সঙ্গীতভবনের ছাত্রছাত্রীদের সমবেত কণ্ঠে গানটির সাথে নৃত্যের তালে-তালে যখন ছোট্ট ফুলের মতো শিশুরা বাসন্তী শাড়িতে, ফুলের অলঙ্কারে সেজে আম্রকুঞ্জ দিয়ে এগোতে থাকে; তখন আমরা যারা দর্শক, পড়ে যাই ভারি মুশকিলে। একে তো শ্রাবণধারায় সিক্ত শান্তিনিকেতনের স্নিগ্ধ অপরূপ প্রকৃতি আর তার মাঝে এই দেবশিশুদের দেখবো নাকি তাদের সদ্য শেখা নাচ দেখবো, না তাদের পুষ্প-সজ্জা দেখবো! নাম-না-জানা পত্র-পুষ্প দিয়ে যে অমন অপূর্ব নকশার কানের দুল, মালা, টিকলি, মাথার মুকুট, বাজুবন্ধ গাঁথা যায়; শান্তিনিকেতনের বৃক্ষরোপণ উৎসবে না-এলে তা আমদের অজানাই থেকে যেত।
প্রতি বছর বাইশে শ্রাবণ, কবির প্রয়াণদিবসে শান্তিনিকেতনের বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজস্ব রীতি ও ঐতিহ্য মেনে পালিত হয় বৃক্ষরোপণ উৎসব। শান্তিনিকেতনের একান্ত নিজস্ব এই উৎসবের মাধ্যমে কবিকে স্মরণ করা হয় ভিন্ন আঙ্গিকে, অনেক বেশি নিবিড়তায়। আজ যে আমরা সারা দেশজুড়ে পরিবেশ দিবস, অরণ্য সপ্তাহ, বনমহোৎসব পালনের আয়োজন দেখি; সামাজিক বনসৃজনের এই প্রথার অন্যতম পথপ্রদর্শক হলেন আমাদের প্রাণের কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
এই অনিন্দ্যসুন্দর অনুষ্ঠানটি আমাদের প্রত্যক্ষ করার সুযোগ ঘটেছিল ২০১৯ সালের বর্ষণমুখরিত ৮ আগস্ট, বাইশে শ্রাবণ। সেদিন সকালে অবিরাম বৃষ্টিধারার মাঝেই আমরা চারজন কলকাতা স্টেশন থেকে হলদিবাড়ি এক্সপ্রেসে পৌঁছলাম বোলপুর। একটা টোটোয় ভুবনডাঙার হোটেলে পৌঁছে, লাঞ্চ সেরে সোজা বিশ্বভারতী ক্যাম্পাস। কলাভবনের সামনে তখন তুমুল ব্যস্ততা। ছাত্র-ছাত্রীরা শেষমুহূর্তে মন দিয়ে ফুলের অলঙ্কার তৈরিতে ব্যস্ত। উপকরণ বলতে, অতি সামান্য। ঝরে পড়া অসংখ্য ফুল, যেমন লাল, হলুদ রঙ্গন, মালতী, চাঁপা, কুন্দ, টগর ফুলের কুঁড়ি; কাঁঠালপাতা, চন্দনের বীজ, বুনো লতা, ঘাস প্রভৃতি। একটি মেয়ে মধুমঞ্জরী ফুলের বিনিসুতোর মালা গেঁথে ফেললো আঙুলের অসাধারণ কারিকুরিতে। এ এক ঐতিহ্য, যা আজও আশ্রমিক পরম্পরায় বহমান। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই শুরু হয়ে যাবে অনুষ্ঠান। বেশ কয়েকটি ছাত্রী মেক-আপ নিয়ে চলেছে অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে। আমরাও তাদের সঙ্গী হয়ে পৌঁছলাম শান্তিনিকেতন ভবনের পেছনদিকের মাঠে। সেখানে তখন সাজোসাজো রব। ছোটো ছেলের দল সাদা পাজামা, পাঞ্জাবি, রঙিন উত্তরীয় কোমরে বেঁধে তৈরি আর ছোটো মেয়েরা লালপেড়ে বাসন্তী শাড়ি, হাতে-গলায়-মাথায় ফুলের গয়নায় সেজে প্রস্তুত। শিক্ষক-শিক্ষিকারা ব্যস্ত তাদের দুটি সারিতে বিন্যস্ত করতে। একটু পরেই দূরের মঞ্চ থেকে ভেসে এল ““মরু বিজয়ের কেতন উড়াও শূন্যে, হে প্রবল প্রাণ” গানটি। সকলে নাচের তালে-তালে এগোতে শুরু করলো। শোভাযাত্রার একেবারে সামনের সারিতে পঞ্চকন্যার দল। এই পঞ্চকন্যা হলো জল, বায়ু, অগ্নি, মৃত্তিকা ও প্রাণ—এই পঞ্চভূতের প্রতিনিধি। এরপর খোল, করতাল-সহ ভবনের খুদে ছাত্ররা। তারপরের সারিতে দুই ছত্রবাহক, যাদের মাঝখানে সুসজ্জিত চতুর্দোলা কাঁধে ছেলেরা, যাতে রয়েছে সেই বিশেষ চারাগাছটি, যাকে আনুষ্ঠানিকভাবে রোপণ করা হবে।আর এই পালকিটিকেও সাজানো হয়েছে ভারি চমৎকার ভাবে। ঐতিহ্যবাহী এই পাল্কি কাঠের তৈরি এবং ছত্রটি বেতের, যা নব-নব সাজে সজ্জিত হয়ে ওঠে প্রতি বাইশে শ্রাবণে।
একটু যদি পুরনো দিনের কথায় ফিরে যাই, তবে জানা যায়, শান্তিনিকেতনে বৃক্ষরোপণ উৎসবের সূচনা করেছিলেন স্বয়ং কবি ১৯২৫ সালে অর্থাৎ ১৩৩২ বঙ্গাব্দের পঁচিশে বৈশাখ; কবির ৬৪ বছরের জন্মদিনে, উত্তরায়ণের উত্তরে পথের ধারে 'পঞ্চবটী’ প্রতিষ্ঠা করে— অশ্বত্থ, বট, বেল, অশোক ও আমলকী গাছের চারা রোপণের মাধ্যমে। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে বৃক্ষরোপণ শুরু হয় ১৯২৮ সালের ১৪ জুলাই। সেদিন কবি পিয়ার্সন পল্লিতে নিজের হাতে বকুলগাছের চারা রোপণ করেছিলেন। কেন এই বৃক্ষরোপণ উৎসব সে-বিষয়ে কবি তাঁর মনোভাব স্পষ্ট করে জানিয়েছিলেন ১৯৩৯ সালে। তিনি বলছেন, “পৃথিবীর দান গ্রহণ করার সময় মানুষের লোভ বেড়ে উঠল। অরণ্যের হাত থেকে কৃষিক্ষেত্রকে সে জয় করে নিলে, অবশেষে কৃষিক্ষেত্রের একাধিপত্য অরণ্যকে হটিয়ে দিতে লাগল। নানা প্রয়োজনে গাছ কেটে কেটে পৃথিবীর ছায়াবস্ত্র হরণ করে তাঁকে নগ্ন করে দিতে লাগল। তার বাতাস হল উত্তপ্ত, মাটির উর্বরতার ভার নিঃস্ব হল। এই কথা মনে রেখে কিছুদিন পূর্বে আমরা যে অনুষ্ঠান করেছিলুম সে হচ্ছে বৃক্ষরোপণ, অপব্যয়ী সন্তান কর্তৃক মাতৃভার পূরণ করবার কল্যাণ-উৎসব।“ আবার ১৯৩২ সালের অনুষ্ঠানে ছিল নতুনত্বের ছোঁয়া। সেবার ভুবনডাঙার গ্রামে গ্রামবাসীদের সহযোগিতায় জলাশয় পরিষ্কার করে তার তীরে কবি কৃষ্ণচূড়া গাছের চারা রোপণ করে উৎসবের সূচনা করেন।
শোভাযাত্রার সাথে পা মিলিয়ে আমরাও এগোলাম আম্রকুঞ্জ সংলগ্ন সন্তোষালয় প্রাঙ্গণে তৈরি অনুষ্ঠানমঞ্চ অভিমুখে। একদিকে দর্শকবৃন্দের জন্য নির্দিষ্ট আসন আর এক দিকে বৃক্ষরোপণের জন্য নির্দিষ্ট স্থান, আলপনা দিয়ে সুন্দর সাজানো। একসময় এই আলপনা আঁকতেন নন্দলাল বসু, অসিত হালদারের মতো শিল্পীরা। পরবর্তীতে গৌরী ভঞ্জ, যমুনা সেনের হাতে সেই আলপনা প্রাণবন্ত হয়ে উঠতো। বর্তমানেও সেই ধারাবাহিকতা মেনে পাঠভবনের ছাত্রছাত্রীরাই সেই আলপনা আঁকে। এত সুন্দর আলপনা শান্তিনিকেতনের উৎসব ছাড়া আর কোথাও দেখা যায় কিনা সন্দেহ! শুরু হলো মূল অনুষ্ঠান। একে-একে পরিবেশিত হলো বৃক্ষরোপণের অন্যান্য গান—“আয় আমাদের অঙ্গনে”, “আহ্বান আসিল মহোৎসবে”, “নীল- অঞ্জনঘন পুঞ্জছায়ায়”, “কোন্ পুরাতন প্রাণের টানে”। এছাড়া পঞ্চভূতের আবাহন এবং পঠিত হলো “প্রাণের পাথেয় তব” (বনবাণী) কবিতা। এরপর শঙ্খধ্বনি সহযোগে, মাঙ্গলিক মন্ত্র উচ্চারণধ্বনিতে বৃক্ষরোপণের মধ্য দিয়ে সমাপ্তি ঘটল সর্বাঙ্গীণ-সুন্দর এই অনুষ্ঠানের। এই উৎসব নিছকই গাছ লাগানোর নয়, এখানে বরণ করে নেওয়া হয় প্রকৃতিকে, নতুন প্রাণকে। এই উৎসব চিরায়ত ঐতিহ্যের এক বহমান ধারার উদযাপন।
আর সেই প্রচলিত ধারা মেনেই শান্তিনিকেতনে বৃক্ষরোপণ অনুষ্ঠানের পরের দিন শ্রীনিকেতনের হলকর্ষণ উৎসব। রবীন্দ্রনাথ শিক্ষা, সমবায়, কৃষি, চারুকলা-চর্চার সাথে চাইতেন প্রকৃতির মেলবন্ধন ঘটাতে; চাইতেন বাংলার কৃষকদের প্রকৃত মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হোক, প্রকৃতির দান সম্বন্ধে মানুষ সচেতন হোক। ১৯২২ সালে গ্রামীণ মানুষের জীবনচর্চা ও কৃষির উন্নতিতে শান্তিনিকেতনের অদূরে কবি স্থাপন করেন শ্রীনিকেতন। আর ১৯২৮ সালে শ্রীনিকেতনের মানুষদের কৃষিকাজে উৎসাহ দিতে শুরু করলেন হলকর্ষণ উৎসব। এই উৎসবের সূচনায় পণ্ডিত বিধুশেখর শাস্ত্রী সংস্কৃতে কৃষিপ্রশস্তি পাঠ করেছিলেন আর রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং হলচালনা করেন। নন্দলাল বসু কৃষিজাত নানা সামগ্রী, শস্যদানা দিয়ে আলপনা এঁকে গোটা সভামণ্ডপ সাজিয়েছিলেন। হলকর্ষণ উৎসবের দিনটিকে চিরস্মরণীয় করে রাখতে নন্দলাল বসু সেদিন শ্রীনিকেতনের একটি প্রাচীরের গায়ে ফ্রেস্কো করেছিলেন, যা আজও এক অমূল্য সম্পদ হিসেবে রয়ে গিয়েছে।
সেই উৎসবের আকর্ষণে আমরাও পরদিন হাজির হলাম শ্রীনিকেতন মেলার মাঠে। সেখানে পৌঁছে দেখি হলুদ কাপড়ে মোড়া অনুষ্ঠানমঞ্চ আর একপাশে সবুজ মাঠের উপর ত্রিপল পাতা দর্শকাসন। স্থানীয় মানুষদের উৎসাহ দেখার মতো। ছাত্রছাত্রীদের সমবেত কণ্ঠে তখন শুরু হয়েছে “ফিরে চল্, ফিরে চল্, ফিরে চল্ মাটির টানে—”। লালপেড়ে বাসন্তী শাড়ি আর কোমরে সাদা উত্তরীয় বাঁধা ছোটো মেয়ের দল আর পেছনে সাদা পাজামা, পাঞ্জাবি, কোমরে লাল উত্তরীয়, বাসন্তী পাগড়ি মাথায় সজ্জিত ছোটো ছেলের দল সে-গানের সাথে শোভাযাত্রা করে মঞ্চের দিকে এগিয়ে একে-একে নিজেদের আসন গ্রহণ করে বসে পড়ছে। কোথাও এতটুকু বিশৃঙ্খলা নেই। মাঠের একপ্রান্তে সুন্দর নকশাকাটা চাদর পিঠে দুটি বলদ রাখা রয়েছে, পাশে একটি হলুদ রঙ করা হাল বা লাঙল শায়িত।
অনুষ্ঠান শুরু হলো বৈদিক মন্ত্রপাঠে। রবীন্দ্রনাথের রচনা থেকে পাঠ করা হলো। কৃষির সমৃদ্ধির প্রার্থনা করে একে-একে পরিবেশিত হলো "আমরা চাষ করি আনন্দে", "এসো হে তৃষ্ণার জল", "কোন্ পুরাতন প্রাণের টানে" প্রভৃতি সঙ্গীত। এরপর কৃষিক্ষেত্রে অবদান রেখেছেন, এমন চারজন স্থানীয় কৃষককে সংবর্ধনা দেওয়া এবং গ্রামের মানুষদের মধ্যে গাছের চারা বিলি করা হলো। সবশেষে “আমরা চাষ করি আনন্দে” গানের তালে-তালে নানা রঙের আলপনায় সাজানো নির্দিষ্ট জমির উপর একজোড়া সুসজ্জিত বলদ নিয়ে হাল চালনা করলেন স্থানীয় এক কৃষক।
রবীন্দ্রনাথের যে-কোনো সৃষ্টিতে, শিল্পচেতনায় প্রকৃতির স্থান সর্বাগ্রে। তাঁর নানা প্রবন্ধে আমরা পাই প্রকৃতি ও পরিবেশের কথা। আজ যখন সারা বিশ্ব জুড়ে পরিবেশ নিয়ে নানা চিন্তাভাবনা তখন মনে হয়, এই বাংলারই এক কবি কত আগেই-না বুঝেছিলেন পরিবেশ রক্ষার গুরুত্ব। শতবর্ষ আগেই তিনি এ-বিষয়ে তাঁর সুগভীর চিন্তা ও উদ্যোগের নানা দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন তাঁর সাহিত্যে ও কর্মে। কবির প্রিয় ঋতু বর্ষা। আর বর্ষাস্নাত শান্তিনিকেতনে প্রকৃতির সান্নিধ্যে প্রকৃতিবন্দনার এমন নান্দনিক, মনোজ্ঞ উপস্থাপনা দেখে দুটো দিন যেন কোথা দিয়ে কেটে গেল! এত ফাঁকায়, ঘরোয়া পরিবেশে ভীষণভাবেই উপভোগ্য হয়ে উঠেছিল শান্তিনিকেতন আশ্রমের এই ঐতিহ্যবাহী উৎসব।
বৃক্ষরোপণ
ছোটোদের দল
শ্রীনিকেতন
হলকর্ষণ
Comments
Post a Comment