সুদেষ্ণা মুখোপাধ্যায়

"অস্ট্রেলিয়ার এই আউটকাস্টে মানুষ তো দূরের কথা, কোনো বড় প্রাণীরও দেখা মেলে না। যেদিকে তাকাই, শুধু ধূ-ধূ বালিয়াড়ি আর কাঁটাঝোপ। যা খাবার মজুত ছিল, সব শেষের মুখে। এখান থেকে লোকালয়ে গিয়ে খাবার সংগ্রহ করে আবার ফিরে আসতে, প্রায় এক সপ্তাহ লাগবে। ভাগ্যিস গুহার ভিতরে একটা পুরোনো নদীখাতের সন্ধান পেয়েছি; তাই তৃষ্ণার জলের অভাব হয়নি। লোকালয় থেকে নির্বাসিত হয়ে পৃথিবীর সবার আড়ালে যে-গবেষণা আমি করছি, তা প্রায় সফল হবার মুখে। এই চরম মুহূর্তে লি শেন-কে চোখের আড়াল করার অর্থ—নিজের পায়ে নিজে কুড়ুল মারা। এখন উপায় একটাই। ছোটোখাটো কোনো জীবজন্তু শিকার। অবশ্য, লি-র যা অবয়ব আর গতি! যে-কোনো সাধারণ মানুষের প্রায় দশগুণ বেশি। ওর পক্ষে শিকার করা কোনো ব্যাপার না। সমস্যা একটাই। এতে ওর ভেতরের দানব যদি একবার জেগে ওঠে, স্বয়ং রাদারফোর্ডেরও সাধ্য নেই তাকে কন্ট্রোল করার; আমি তো কোন ছার! কারণ রেডিয়ামের প্রভাবে ওর শরীর এবং মন দুটোরই সাংঘাতিক পরিবর্তন ঘটেছে। লি-র শরীর যেখানে দশগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে, মনটা হয়ে গেছে শিশুর মতো। আর সবচেয়ে চিন্তার ব্যাপার হলো, এই অসামঞ্জস্য উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে।"

সায়নী ডায়েরিটা হাতে নিয়ে চুপ করে বসে রইলো কিছুক্ষণ। সাউথ অস্ট্রেলিয়ার একটা গুহা থেকে এই ডায়েরিটা পাওয়া গেছে। সৃজকের নাম লেখা। হাতের লেখাটাও যে সৃজকের, সে-ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু ও যদি অ্যান্টিডোট আবিষ্কার করেই ফেলেছিল, তাহলে প্রফেসর জেরিমি-র সঙ্গে যোগাযোগ করলো না কেন? এক-দু'বার সে টেলিফোনে যোগাযোগ করেওছে প্রফেসরের সঙ্গে। মূলত সেই কারণেই সায়নী আবার ছুটে এসেছে এখানে। নইলে তাকে তো ইন্ডিয়া ফিরে যেতে হয়েছিল, ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার কারণে। সৃজকের খোঁজ পেয়েই জেরিমি সায়নীকে জানান। সব কীরকম তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে সায়নীর। ডায়েরিটা ফেলেই-বা গেল কোথায় সৃজক?

এরপরে আর কিছু লেখা নেই ডায়েরিতে। তার আগে কীভাবে ছয়মাস ধরে লি শেন-কে অনুসরণ করে লোকালয় থেকে যোজন-মাইল দূরে এই গুহায় আশ্রয় নিয়েছে, কীভাবে লি শেন-কে খাবার ও জল দিয়ে ওর সঙ্গে নতুন করে বন্ধুত্ব পাতিয়েছে, তার বর্ণনা আছে। কত কষ্ট করে যে ছেলেটা একটা-একটা যন্ত্রপাতি যোগাড় করেছে তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ লেখা আছে ডায়েরিতে। 

কিছুতেই ঘুম আসছিল না সায়নীর। বিছানায় শুয়ে শুধু এপাশ-ওপাশ করছে। হাজাররকম চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে মাথায়। ওকে একবার ওই গুহায় যেতেই হবে। পরেরদিন সকালবেলা সায়নী স্থানীয় এক ক্যাব-চালকের সঙ্গে কথা বলে রাজি করালো সেই গুহায় যাওয়ার জন্য। বুদ্ধি করে লোকাল পুলিশকেও একটা খবর দিয়ে রাখলো। কী জানি, বলা তো যায় না; ঠিক কী ঘটেছিল ওই গুহায়, কেউ জানে না। ইন্সপেক্টর একজন স্থানীয় গাইড আর একজন আর্মড অফিসার সঙ্গে নিয়ে যেতে অনুরোধ করলেন। সায়নীও 'না' করতে পারলো না।


প্রায় একশো কিমি দূর থেকে গুহাটা দৃষ্টিগোচর হলো। বেশ বড়ো আর আশেপাশে কোনো গাছপালা নেই। দূর থেকে গুহাটা দেখেই মনটা কেমন যেন চঞ্চল হয়ে উঠলো সায়নীর। কী ঘটেছে ওই গুহায়? এক অদৃশ্য সুতো যেন টানছে ওকে। গুহার মুখে বালির উপর নানান জুতোর ছাপ। যারা সৃজকদের খোঁজে এসেছিল, তাদের নিশ্চয়ই। গুহার মুখটা বেশ চওড়া; উচ্চতা একজন ছয়ফুট লম্বা মানুষের ঢোকার উপযুক্ত। কিছুদূর গিয়ে গুহার দু'পাশে আরও তিন-চারটে সরু-সরু গলির মতো মুখ দেখা গেল। একটা মুখ একটু চওড়া: বাকিগুলোতে কোনো মানুষ সোজা হেঁটে প্রবেশ করতে পারবে না। সায়নীরা প্রথমে বড়ো মুখ দিয়ে ঢুকলো। ভিতরে যদিও পুরো অন্ধকার; তাদের কাছে দুটো সার্চলাইট থাকায় সামনের একশো মিটার রাস্তা পরিস্কার দেখা যাচ্ছিল। একটু গিয়েই ওরা বেশ বড়ো একটা হলঘরের মতো জায়গায় উপস্থিত হলো। নানারকম যন্ত্রপাতি আর টিউব সাজানো রয়েছে একটা বড়ো পাথরের ওপর। কিন্তু তন্নতন্ন করে খুঁজেও কোনো ক্লু পাওয়া গেল না সৃজকদের।

বাকি ছোটো-ছোটো গুহামুখ দিয়ে ঢুকেও খোঁজা হলো। নাঃ, কোথাও কাউকে পাওয়া গেল না। সায়নীর মনে পড়লো, সৃজক ডায়েরিতে একটা পুরোনো নদীখাতের কথা উল্লেখ করেছিল। সায়নী গাইডকে বললো, "প্লিজ শো মি দ্য ওয়ে টু ওল্ড রিভারবেড।" গাইড ভীষণ অবাক হয়ে বলল, "সরি ম্যাম, আই ডোন্ট নো এনি রিভারবেড হিয়ার।" 

সায়নী একটু অবাক হলো। যাইহোক, খুঁজে দেখতে তো অসুবিধা নেই! শুরু হলো খোঁজা। দুটো টিমে ভাগ হয়ে গেল ওরা। সায়নী আর লোকাল গাইড আবার বাঁদিকের গুহাগুলো সার্চ করতে শুরু করলো। সেই পুলিশ অফিসার আর গাড়ির চালক ডানদিকের গুহার ভিতরে খোঁজ শুরু করলো। ছোটো গুহাগুলো একটু গিয়েই বন্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু ল্যাবরেটরির বড়ো পাথরের নিচে একটু ভেজা বালি দেখতে পেল সায়নী। নিচে তাকাতেই দেখলো, বেশ সরু মুখের একটা গর্ত। টর্চ দিয়ে সেরকম কিছুই দেখা গেল না। শেষে গাইডের সাহায্যে একটা ফোল্ডিং সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে গিয়ে দেখলো, একটা সুতোর মতো জলের স্রোত বয়ে চলেছে। এটাই তাহলে সেই নদীখাত। জলের ধারা অনুসরণ করে প্রায় এক কিমি চলার পর তারা একটা অদ্ভুত জায়গায় এসে পৌঁছালো। এখানে গুহার হাঁটারাস্তা শেষ। এরপর এক বিশাল বড়ো খাদ; কিন্তু মাথার ওপর পাথরের ছাদ। খাদের নিচে একটা নীল সুতোর মতো জল দেখা যাচ্ছে।কেউ যদি একবার নিচে পড়ে, তার বাঁচার আশা নেই বললেই চলে। ততক্ষণে ড্রাইভার আর সেই পুলিশ অফিসারও এসে গেছেন সেখানে। ঘড়িতে সময় দেখাচ্ছে সন্ধ্যা সাড়ে-সাতটা। সবাই মিলে ঠিক করা হলো, সেদিনের মতো খোঁজা বন্ধ করে গুহার মুখের কাছাকাছি একটা সমতল জায়গা দেখে রাত্রে ঘুমোনোর ব্যবস্থা করা হবে।


পাথরের ওপর ম্যাট পেতে বিছানা করে হয়েছে। গুহামুখে একটু আগুনের ব্যবস্থাও করা হয়েছে, ফর সেফটি। সারাদিনের ক্লান্তির পর শরীর আর দিচ্ছিলো না। কিন্তু সায়নীর মাথায় চিন্তাগুলো সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছিলো। কোথায় গেল ওরা? কোথায়? ভাবতে-ভাবতে কখন চোখ লেগেছে, বুঝতে পারেনি। হঠাৎ একটা বিকট জান্তব চিৎকারে ঘুমটা ভেঙে গেল সায়নীর। একটা গোঁ-গোঁ আওয়াজ প্রতিধ্বনিত হচ্ছে পাথরের দেওয়ালে। বাকিরাও উঠে পড়েছে। আওয়াজটা সেই গুহার শেষপ্রান্ত থেকে আসছে, যেখানে জলের ধারা খাদের থেকে নিচে পড়ছে। আবার সবাই ছুটলো আওয়াজ অনুসরণ করে। কিন্তু খাদের কিনারা অব্দি পৌঁছাবার আগেই সবার পা মাটিতে যেন গেঁথে গেল!

খাদের কিনারার ওপর থেকে দুটো মাথা দেখা যাচ্ছে। দু'জনেই দু'জনের দিকে হিংস্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আর মুখ দিয়ে বার করছে অদ্ভুত আওয়াজ। সেই হাড় হিম করা অতিপ্রাকৃতিক আওয়াজ শুনে ভয় পাবে না, এমন মানুষ পাওয়া দুষ্কর। সেই মুখগুলো যদিও মানুষের, কিন্তু আকারে মানুষের থেকে দশগুণ বড়ো। একটা তো সায়নী আগেই দেখেছে—লি শেন। আরেকটার চোখ দুটো ভীষণ চেনা। সায়নীর মুখ দিয়ে অস্ফুটে বেরিয়ে এল, "সৃজক!"

Comments