শিল্পী নাজনীন


বাইশে শ্রাবণ। উজ্জ্বলতর এক নক্ষত্রপতনের দিন। এই দিনে দীপ্ত এক সূর্যের মহাপ্রয়াণের অনন্তশোকে শ্রাবণ কাঁদে অবিরাম, কাঁদে বাংলা, কাঁদে বাঙালি, কাঁদে বিশ্বসাহিত্যপ্রেমী প্রতিটি হৃদয়। 

"শ্রাবণের   ধারার মতো পড়ুক ঝরে, পড়ুক ঝরে

তোমারি   সুরটি আমার মুখের 'পরে, বুকের 'পরে।।"

আহা শ্রাবণ। "আজি   ঝরো ঝরো মুখর বাদরদিনে…" অবিরাম বর্ষণে উথলে পড়া শ্রাবণ। বাংলা ও বাঙালির অশ্রুজলে ধোয়া শ্রাবণ। বর্ষার অবিশ্রাম ধারায় সিক্ত এই শ্রাবণ একদিকে যেমন গেয়ে চলে মেঘমল্লার, অন্যদিকে বিরহ-ব্যাকুল এই বর্ষার মেঘমালার কাছেই অব্যক্ত কথামালার ডালি সাজিয়ে বিরহী যক্ষ আকাশে ভাসিয়ে দেয় মেঘদূত, প্রিয়ার উত্তরের জন্য ক্ষণ গোনে অধীর অপেক্ষায়। তবু আজ এই বাইশে শ্রাবণে বাজে অন্য সুর, অন্য কোনো তান। না, এ-তো সুর নয়, শোক; তান নয়, অবিরাম কান্নার তানপুরা! শ্রাবণের অঝোর কান্নায় যে শোক মোছে না, শাঙনের নিরবধি বারিধারায় যে তাপ ঘোচে না। আজ আকাশে ভাসে রাশিরাশি বেদনার মেঘ, ওড়ে পেঁজা-পেঁজা শোকের তুলো। ভাসতে-ভাসতে, উড়তে-উড়তে ক্লান্ত হয়ে তা ঝরে পড়ে কান্নায়, ভেঙে পড়ে অবিরাম বেদনাধারায়।

কেন এত কাঁদে আকাশ? কী শোকে সে ঝরে এমন আকুল হয়ে? আজ যে বাইশে শ্রাবণ! আজ রবিবাবুর চলে যাওয়ার দিন। আহা রবি! আমার রবি! জীবনের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, আনন্দ-বেদনা, আলিঙ্গন-আঘাত, উপেক্ষা-অপমান, অবহেলা-অসম্মান, হৃদয় উতল করা যত অনুভূতি, মন বিকল করা যত অনুভব, সব নিয়ে বিহ্বল-বিপর্যস্ত আমি ভিক্ষের ঝুলি নিয়ে দাঁড়াই তোমার কাছে প্রতিদিন, প্রতিক্ষণ। কখনও ফিরিয়ে দাও না, কখনও নিরাশ করো না।

আমি পূর্ণ হয়ে ফিরি, আমি ঋদ্ধ হই প্রতিবার, ঝরিয়ে ফেলি মনের যত জরা, জীর্ণতা, গ্লানি। প্রতিদিন, প্রতিবার তোমার বিপুল স্নেহধারায় সবুজ করো আমায়, বাঁচিয়ে তোলো ভালোবাসার অমিয়সুধায়। আমার মরে যাওয়া মন সজীব হয় তোমার আশ্রয়ে। যাপিত জীবনের প্রেমে, ঘামে, আঘাতে, অপমানে, বেদনায়, বিষে যতবার নীল হই, জীবনের বিষ কণ্ঠে ধারণ করে নীলকণ্ঠ হই যতবার, ততবার শরণাপন্ন হই তোমার। তোমার কবিতায়, কাব্যে, সুললিত গদ্যে পাই মায়াময় জীবনস্পন্দন আর অনিবার্যভাবে স্নাত হই তোমার হৃদয় শীতল করা সুরের ঝর্নাধারায় আমার তপ্ত হৃদয় উজ্জীবিত হয়, শীতল হয়, ফিরে পায় নবতর স্পৃহা—বাঁচার, যাপনের, পথ চলার। প্রকৃতির খরতাপে তৃষিত মন নিয়ে, জীবনের রুদ্ররূপে হাঁপিয়ে ওঠা প্রাণ নিয়ে যতবার দাঁড়িয়েছি তোমার বিশাল রচনারাজির ছায়ায়; যতবার হাত পেতেছি তোমার কাছে, মন বেঁধেছি তোমার সাথে, বটবৃক্ষ হয়ে ততবার ছায়া দিয়েছো আমার তৃষা-জর্জর মনে, মায়া হয়ে ছড়িয়ে গেছ আমার নিভৃত অন্তরে। বর্ষার অঝোর কান্নায় আমি তোমার সুরে সুর মিলিয়ে বেসুরো গলায় গেয়ে উঠেছি যতবার "আজি    ঝরো ঝরো মুখর বাদরদিনে…" ততবার মনের ভেতর আনন্দ হয়ে ময়ূর হয়ে পেখম তুলেছো তুমি, বেজে উঠেছো মধুরতর সুরবীণায়। শরতের নীল-সাদা আকাশ দেখে মাতাল আমি তোমার আশ্রয়ে গেয়ে উঠেছি, "আজ ধানের ক্ষেতে রৌদ্রছায়ার লুকোচুরি খেলা... নীল আকাশে কে ভাসালে সাদা মেঘের ভেলা"।এভাবেই ছড়িয়ে থাকো তুমি অন্তরজুড়ে, প্রতিদিন, প্রতিক্ষণ।

প্রতি হেমন্তের ভরা ফসলের মাঠে সোনাধানের সোনালি আভায় মনের ভেতর অনিবার্য বেজে ওঠে তোমার 'সোনার তরী'। শীতজর্জর হৃদয়, জীর্ণ সংসারভারে ক্লান্ত অবসন্ন মন তোমার পরশে উদ্দীপ্ত হয়, প্রাণ পেয়ে নেচে ওঠে মুহূর্তেই। গেয়ে ওঠে তোমার সুরে, তোমার বাণীতে—"শীতের হাওয়ার লাগল নাচন লাগল নাচন আমলকির এই ডালে ডালে।

পাতাগুলি শিরশিরিয়ে শিরশিরিয়ে ঝরিয়ে দিল তালে তালে।।"

বিরহকাতর মন মরে যায় যেন। ঠিক শীতপ্রকৃতির মতো সে গুটিয়ে যেতে চায়। ব্যাকুল দীর্ঘশ্বাসে তখন গেয়ে উঠি আবার তোমার সুর, আকুল হয়ে আঁকড়ে ধরি আবার তোমার বাণী।

প্রেমে যখন কানায়-কানায় পূর্ণ হয় হৃদয়, প্রকৃতি যখন হেসে ওঠে বসন্তের নবকিশলয়ে, ফুলে-ফুলে ভরে ওঠে প্রকৃতির আঁচল, কোকিলের গানে মুখরিত হয়ে ওঠে যখন চারদিক, তখনও তুমিই হয়ে ওঠো পরম আশ্রয় আমার। তোমার সুরে গেয়ে উঠি, "আহা, আজি এ বসন্তে কত ফুল ফুটে…"।

গ্রীষ্মে, বর্ষায়, শরতে, হেমন্তে, শীতে, বসন্তে, ষড়ঋতুর ষড়রঙে তুমি দখল করে রাখো বাংলার প্রকৃতি আর আমার হৃদয়। আমার অন্তরের নিভৃত কন্দরে মিশে থাকো তুমি, হয়ে ওঠো আত্মার আত্মীয়; আমার দুঃখ-বেদনার, আনন্দ-অনুভবের একান্ত আশ্রয়। তোমাকে আশ্রয় করে যেমন বাঁচি প্রতিদিন, তোমাকে অবলম্বন করে প্রতিনিয়ত মরিও তেমন। তুমি একান্তই আপনার আমার, আমার রবীন্দ্রনাথ।         

নশ্বর জীবনে এই অবিনশ্বর এক আলোক-উৎস তুমি, তুচ্ছ জীবনে তুমি অসামান্য এক ঝর্নাধারা। তোমাকে প্রণাম।

 

 

 

 

 


Comments