শংকর ব্রহ্ম


এক

রবীন্দ্রনাথ আমার কাছে গোপন অহংকার। তাঁর কথা বলবো কত আর? সে-কথা নয় যে ফুরাবার। দুই ভুবনে বাস আমার। একটি কায়ার অন্যটি মায়ার। কায়ার জগৎ ছন্দহীন, ছায়াহীন, রৌদ্রে পুড়ে খাক; না-হয় এসব কথা এখন থাক। রাত্রে হিংস্র অন্ধকার। সে-সব কথা বলবো কত আর?

প্রেমহীন, নির্জীব, রুক্ষ মরুভূমি, নিষ্প্রভ কঠোর কঠিন বাস্তব জগৎ। যেখানে অবাঞ্ছিত আগাছার বাড়বাড়ন্ত খুব। যেখানে লালসা জীবনের তীব্র উদ্দীপক হয়ে ওঠে। হিংসা হৃদয়ের প্রায় সবটাই জুড়ে থাকে, আর ভোগবাদই জীবনের শেষ কথা বলে। আর আমার মায়ার জগৎ জুড়ে কতশত ফুলমেলা, লুকোচুরি খেলা, রবীন্দ্রনাথের সাথে কেবল একেলা অপূর্ব এক আনন্দধারায় অবগাহন শুধু। এত গাঢ় আঁধারেও আমার ভুবন আলোকের ঝর্নাধারায় উৎসবমুখর।

দুই

রবীন্দ্রনাথের ছবির সামনে দাঁড়ালে, বুকটা গর্বে ফুলে ওঠে, মনটা ভরে যায় আনন্দে; কিন্তু মাথা আপনিই নত হয়ে আসে। তাঁর কথা ভাবলে নিজেদের ক্ষুদ্রতা প্রকট হয়ে পড়ে। রবি ঠাকুর তুমি আমাদের প্রেম, তুমি আমাদের মুক্তি, তুমি আমাদের শান্তি। তোমাকে নিয়ে যত কথাই বলি-না কেন, মনে হয় বলা হলো না কিছুই। তোমাকে যতই জানি, মনে হয়, জানা আরও রয়ে গেল কত বাকি। তোমাকে বুঝতে-বুঝতে একটা জীবন অনায়াসে ফুরিয়ে যাবে আমাদের, কিন্তু তোমাকে জানা আমাদের ফুরাবে না কিছুতেই, কোনোদিন।

তিন

আজ আপনি ইহলোকে না-থাকলেও, সর্বদাই আমাদের হৃদয় জুড়ে আছেন, থাকবেন। তাই আপনাকে আমার হৃদয়ের গোপন আক্ষেপের কথা জানাই একটা। আজ থেকে প্রায় বিরানব্বই বছর আগে 'বেশ্যাসংগীত' নামের একটি গানের বই প্রকাশিত হয়েছে, অক্ষয় লাইব্রেরী থেকে। সম্পাদনায় নন্দলাল শীল। বইটির শেষ কভারের বিজ্ঞাপন থেকে জানা যায়, অক্ষয় লাইব্রেরী ধর্মশাস্ত্র বিষয়ক কিছু বইয়ের প্রকাশক। বইটি কলকাতার ৫০ নং গরাণহাটা স্ট্রিট থেকে প্রকাশিত এবং অক্ষয় প্রেস ২৭/৫ নং চাটুজ্যে লেন থেকে মুদ্রিত। প্রকাশকাল সন ১৩৩৮। দাম ছ'আনা। যদিও গানগুলির উপর আপনার নাম কোথাও স্বীকার করা হয়নি। গানগুলির উপরে লেখা "বেশ্যাসঙ্গীত"। গানগুলি হলো—"এখনো তারে চোখে দেখিনি"( ইমন কল্যাণ কাওয়ালি), "কেন যামিনী না যেতে জাগালে না"(ভৈরবী একতাল), "চিনি গো চিনি তোমারে ওগো বিদেশিনী"( সিন্ধু রাগে গাওয়া)। 

অনুমান করা যায়, আপনার মূল সুরটুকু নিয়ে যেমন-তেমনভাবে পতিতালয়ে গানগুলি গাওয়া হতো। প্রকাশ্যে বইটি বিক্রি হয়েছে, নন্দলাল শীল অর্থবান হয়েছেন। অথচ, তখনও আপনি জীবিত। নিশ্চয়ই আপনার পক্ষে তা জানা সম্ভব হয়নি। কিন্তু আপনার অনুরাগীরা, আপনার ভক্ত-পূজারীরা, ভাবতে আশ্চর্য লাগে, এই নির্লজ্জ অবমাননার ব্যবস্থার কোনোরকম কোনো প্রতিবাদ করেননি সেই সময়। সেটা বড়ো আফসোস ও লজ্জার ব্যাপার আমার কাছে।

আমার এই অভিযোগ—মনের ক্ষোভ, জ্বালা, লজ্জা; আমি আপনাকে ছাড়া আর কাকে জানাবো, বলুন তো? ভালোবাসার মানুষের কোথাও কোনোরকম অবমাননা দেখলে, মন ব্যাকুল হয়ে পড়ে বইকি। গর্জে ওঠে হৃদয়।

Comments