মধুপর্ণা রায়


আমার খুব রাজার দিকে প্রাণের ঝোঁক। যে-রাজার চিঠির জন্যে অমল বসে ছিল। তারপর মরে গেল। চলে গেল। মরণাতীত প্রতীক্ষাটুকু ফেলে রেখে গেল চৌকাঠে। কার জন্যেই বা কে প্রতীক্ষা করলো এ জীবনে? মরণেই বাঁচতে চাইলো বারবার? অনেকেই। হয়তো অনেক। হাহাকারে খুঁড়িয়ে ভেঙে এইসব অনেকেরা হাতে-হাতে কিছু একটা চাইবার হিসেব করলো। একটা উপকার অন্তত। লেনদেন গোছের হবে নিশ্চয়। ওসবে কে কবে 'রাজা'-কে পায়? রাজা যে আছেন, সে-খবর ইতিহাসের মতো ইতিহাস বলে গিয়েছে। রাজায়-রাজায় যুদ্ধ হয়। কারা যেন মরে। রাজারা সব সাম্রাজ্য বিছায়। এ-রাজ্যের রানি, দাসী, বেগম, বাইজি ও-রাজ্যে প্র‍্যাকটিক্যাল ইউজ-জাতীয় টানাটানির পর ক্ষান্তি দেয় সেই ইতিহাসই। সক্কলে থমথমে শ্বাস ফেলে ভাবি, এই-ই নিয়তির খেলা। 

আমরা শুধু রূপটুকু দেখি। আর ইঙ্গিতটুকু যে দেখে ফেলেছিল, তার নাম অমল। সে, পণ্ডিতির কোষ্ঠকাঠিন্যের হাত থেকে স্রেফ বাঁচতে চাইলো। যে 'অমলকান্তি' রোদ্দুর হতে চেয়েছিল, সে আর জীবনের সঙ্গে মরণের একটিমাত্র বুকে একই স্পন্দনে শুধু জানলার কোলে বসে থাকা রুগ্ন 'অমল' ছেলেটি কিছুতেই যেন এক নয়। 'অমলকান্তি' কত্তকিছু পেরিয়ে, মূলত অগ্রাহ্য করে সুদ্দু একরাশ উষ্ণতা হবে বলে মরেই গিয়েছিল নিশ্চয়? আমার প্রেমিক অমল...বসে থাকে। যেন, জীবনের বাঁশের বাঁশি আর মৃত্যুর মৃদঙ্গ-ঝড়, মেঠো-ফুল...কী মিষ্টি সুধা...সব মিলিয়ে 'অমল'। রবিঠাকুর সে। অনিবার্য মৃত্যুর সঙ্গে রোজ দিব্যি কথা বলতে পারে। জীবনের প্রবাহে খণ্ড-খণ্ড সব চরিত্রের সঙ্গে। মরণ সেখানে জীবন হয়ে বিভ্রান্তি আনে না। জীবনেও থাকে এক মস্ত জোর। অমল ইঙ্গিতটুকু নিতে জানে। হায় মা! অতটুকু ছেলে? ছাই অতটুকু। ও তো রবিঠাকুর গো। স্বয়ং। মৃত্যু মুখোশ নয়। জীবন স্টাইল নয়। শুধুই দুই বৃহত্তর রিয়েলিটি। তাই নালিশ নেই। অভিযোগ নেই। প্রতীক্ষা যে চিরন্তন। কুয়াশার আলোতে বসে রইলেন যেন এক বাউল ক্ষ্যাপা। 

আর রাজা? যাকে এ-যাবৎকাল আমিও চাইলাম মাত্র একবার দেখবো বলে? একটা চিঠি। একটা ফোনকল। সে? কে সে? আমিও তো জানলার গরাদে দাঁড়িয়ে পার করে দিচ্ছি প্রবাহের কতকিছু! আসলে যা পেয়েছি, তার অধিক পেতে চাই আমি। যা হয়েছি, তার বেশি কিছু হতে চেয়েছি। এই না? এই-ই তো? এর কাছে তার কাছে হাত পাতবো না আমি। আমি রাজার কাছে নতমুখ হবো। দুঃখ-দ্বন্দ্ব-দুর্ভাবনা নিয়েই হবো। এ-পৃথিবীর মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছেন রাজা। প্রখর রৌদ্র তিনি। তাকে রোদ্দুর বলা চলে না। দুঃখে করুণ। সুখেও করুণ। যে-সমুদ্র দেখতে চেয়েছি, সে নিরবধি এক কালপ্রবাহ। প্রাণের ভাষার মতো বইছেন। আমি একবার তাঁর ললাটের দিকে তাকাতে চাইবো। মাত্র একবার। প্রশান্ত পরিণতি। তিনি রাজা। রাজার রাজা তিনি। তাঁর আগে কিছু ছিল না। পরে কিছু নেই। 

অন্ধকার আমি ভালোবাসি। দীপ জ্বলে। তাই ভালোবাসি। লক্ষ ফুঁ-তেও শিখাটি নিভে যায় না। সূর্য তার সঙ্গে জয়- পরাজয়ে নামেনি। সেই দীপের আলোতে আমি সেই রাজার চিঠি পড়বো বলে জেগে থাকি কত রাত্রি! কবিঠাকুরের চিঠি কি? আমি তবে ভয় পাই না। চিঠির জুতসই জবাব দেবো। রাজা তবে আসছেন না কেন? একটা সমুদ্র, একমাইলের বেলাভূমি, তিনটে মাঠ...পেরোলেই তো আমি!


Comments