প্রাণেশ সরকার


শৈশবের একটা ঘটনা এখনও আমার মনের দৃশ্যপটে মাঝেমধ্যেই ভেসে ওঠে। আমার বাবার মৃতদেহ একটা ছোটো বাঁশের সঙ্গে খেজুরপাতার পাটিতে মুড়ে কাতার দড়িতে বেঁধে "বলো হরি, হরি বোল" বলতে-বলতে কাঁধে করে শ্মশানবন্ধুরা, অর্থাৎ ইউনাইটেড ক্লাবের সদস্যরা, শ্মশানের দিকে চলেছে। বাড়ি থেকে মিনিট পাঁচেকের মধ্যে ওরা মৃতদেহ নামায় ঝাঁকড়া নিমগাছটার নিচে, খোঁয়াড়ের পাশে। ওদের মধ্যে একজন এক বান্ডিল পাটকাঠির মুখে আগুন ধরিয়ে আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে, তার একটা হাতে আমার হাত চেপে ধরে বাবার মুখে ছুঁইয়ে দেয়। পরে জেনেছি, এর নাম 'মুখাগ্নি'। আমাকে ওই নিমগাছের নিচে একজন বয়স্ক সদস্যের কাছে রেখে শবদেহ নিয়ে ওরা শ্মশানে চলে যায়। আমি ছোটো, পাঁচ বছরের বালক, শবানুগমনে ও শ্মশানের প্রজ্জ্বলিত চিতা দেখে ভয় পেতে পারি—এই যুক্তিতে ওরা আমাকে রেখে দিয়ে, শবদেহ কাঁধে হরিধ্বনি দিতে-দিতে চলে যাচ্ছে। আমি বাড়ি ফিরে আসছি। শ্মশানবন্ধুরা সৎকার শেষে মাটির হাঁড়িতে অস্থি নিয়ে আসার পরে আমাকে স্নান করিয়ে নতুন কোরা কাপড়ের ধরাকাছা পরিয়ে দেওয়া হয়। আমার মা আমাকে প্রস্তুত করেন আগামী ১৩-১৪ দিন নিষ্ঠার সঙ্গে শোকপালন করার কাজে। নবদ্বীপে গিয়ে গঙ্গায় অস্থি বিসর্জন দিই। যথারীতি নমো-নমো করে শ্রাদ্ধশান্তি ও আঁশমুক্তি ইত্যাদি পালন করা হয়। বনগাঁ গোপালনগর থেকে দিদি-জামাইবাবু মৃত্যুর পরের দিনই চলে আসেন। কমলাপুরের ছোটোমাসি শ্রাদ্ধের দিন এসে, দুই-তিনদিন থেকে ফিরে যান। দিদি আমাদের সঙ্গেই থেকে যায় বেশ কিছুদিন। এতবড়ো একটা বিপর্যয় ঘটে গেল সংসারে, আমার ছোটো বোন টুনু (ভালো নাম—প্রতিমা) মায়ের কোলে-কোলেই থাকলো; কিছুই বুঝলো না হয়তো! শুধু মা যখন কেঁদে উঠতো, টুনু ফ্যালফ্যাল করে মা-র মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতো। আর আমার ঠাকমা, আমার পিতামহী তাঁর ছেলের অকালমৃত্যুতে ওই যে চুপ হয়ে গেলেন, আর স্বাভাবিক জীবনে ফিরতেই পারলেন না।

সরকারদের (প্রয়াত নলিনীমোহন সরকার) দয়ায় একটা কুঁড়েঘর পেয়েছিলাম আমরা। পূর্ববঙ্গের ফরিদপুর থেকে বিহারের পূর্ণিয়া, পূর্ণিয়া থেকে পশ্চিমবঙ্গের রানাঘাটের কুপার্স ক্যাম্প (যেখানে রক্ত-আমাশার মহামারিতে ৫৬টি শিশুর মধ্যে আমার তিন জ্যেষ্ঠ শিশু-সহোদরের মৃত্যু হয়, দু'দিনের ব্যবধানে), কুপার্স থেকে বাদকুল্লা; পূর্ব বাদকুল্লায় ক্ষুদিরাম বিশ্বাসের মাটির বাড়িতে ভাড়ায় ছিলেন আমার বাবা পঞ্চানন সরকার। মা স্নেহলতা সরকার। এই ভাড়াবাড়িতে আমার জন্ম হয় পৌষ-সংক্রান্তির রাতে, ১৬ ডিসেম্বর ১৯৫১। হায়ার সেকেন্ডারির অ্যাডমিট কার্ডে আমার জন্মতারিখ নথিবদ্ধ হয় ১৮ জুন ১৯৫৩; কীভাবে হয় জানি না! যাইহোক, সরকারিভাবে ওই ১৮ জুন ১৯৫৩-ই আমার জন্মতারিখ। এই পরিবর্তনে আমার কোনো ভূমিকা ছিল না।

বাবা অবিভক্ত বঙ্গের ফরিদপুর জেলার রাজবাড়িতে থাকতেন। শহর থেকে কিছুদূরে ছিল বাড়ি। রাজবাড়িতে এক মারোয়াড়ি ভদ্রলোকের কাপড়ের দোকানে সেলসম্যান ছিলেন। বিশ্বস্ত পুরোনো কর্মচারী, তাই ভদ্রলোক ১৯৪৬-এর গোড়ায় যখন সিদ্ধান্ত নিলেন, ব্যবসাপত্তর গুটিয়ে তাদের পূর্ণিয়ার ভদ্রাসনে চলে আসবেন ও সেখানকার সুবৃহৎ পৈতৃক বস্ত্রবিপণির দেখভাল করবেন; তিনি বাবাকে বললেন, "আপনি সপরিবারে আমার ওখানে চলুন, আমার দোকানেই কাজ করবেন। আপনার দায়িত্ব আমার। এদেশে আমরা সুরক্ষিত নই।" বাবা দ্বিরুক্তি না-করে আমার দিদি, ঠাকমা ও মা-কে নিয়ে পূর্ণিয়ায় এসে থিতু হলেন। ভদ্রলোক থাকার ঘরও দিয়েছিলেন। ১৯৪৮-এ পূর্ণিয়ার প্রচণ্ড ঠান্ডায় বাবার নিউমোনিয়া হয়। কিছুটা সেরে ওঠার পরে আবারও নিউমোনিয়া হয়! বাবার চূড়ান্ত ভগ্নস্বাস্থ্য তখন। ইতিমধ্যে মারোয়াড়ি ভদ্রলোকও মারা যান। ওঁর ছেলেরা তখন ব্যবসার মালিক। ওদের কাছে বাবার কদর কমে যায়। বাবা তাঁর জ্ঞাতিভাইদের সঙ্গে রানাঘাটে, পোস্টকার্ডের মাধ্যমে যোগাযোগ করে, কুপার্সে আসেন। মাস ছয়েক ছিলেন কুপার্সে। তারপরেই তো ওই মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। বাবা বাদকুল্লায় চলে আসেন। 

বাদকুল্লা বাজারের আটচালার নিচে বাবা মাটিতে চট পেতে কাটা সুপুরি, চুন, মতিহারি তামাক ইত্যাদি বিক্রি করতেন। খুবই কষ্টে সংসার চলতো, যাকে না-চলা বলাই ভালো। যাইহোক, নলিনী সরকার অবস্থাপন্ন সজ্জন; তিনি বাবাকে বলেন, "আপনি আমার স্বজাতি (মাহিষ্য)। এত কষ্ট করে ক্ষুদিরামের বাড়িতে ভাড়ায় আছেন, আপনি আমার খামারবাড়ির কাছে আমার মূল বাড়ির প্রাচীরসংলগ্ন একটা কুঁড়েঘরে সপরিবারে চলে আসুন। আমার রাধাগোবিন্দ মন্দিরের টিউবওয়েল ব্যবহার করবেন। আপনাকে ভাড়া দিতে হবে না।" তো, বাবা সকৃতজ্ঞচিত্তে সেই ঘরে চলে আসেন। বেশ বড়ো একটা উঠোনও ছিল সেখানে। মোটামুটি বড়ো একটা ঘর। বাবা সেটাকে দুটো ঘরে রূপান্তরিত করেন। সামনে একটা বারান্দা। উপরে শনের চালা। আর দেওয়াল বলতে, কঞ্চি ও বাঁশের চটা দিয়ে বেঁধে তার উপরে মাটির মোটা প্রলেপ। যাকে বলে, কাঁচা ঘর। ওখানে খাসা ছিলাম আমরা। মাটির মেঝেতেই টুনু খেলা করতো। বারান্দায় মাটির হাঁড়িতে কাঠকুটো জ্বালিয়ে ভাত রাঁধতেন মা। আর আমি মাটিতে একটা বস্তার উপর বসে আদর্শলিপি পড়তাম। উঠোনের এককোণে তুলসীমঞ্চ করেছিলেন মা। আর বেগুন, পালং, ঢ্যাঁড়স, পুঁই ইত্যাদির সবজিখেত। সীমাহীন দারিদ্র্য, কিন্তু মনে আমাদের সুখ ছিল। প্রতিদিন ঘরে লক্ষ্মীপুজো করতেন মা। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় পুজো শেষে লক্ষ্মীর পাঁচালি পড়তেন। সুর করে-করে কখনো-সখনো পাঁচালি পড়তাম আমিও। বাবার আকস্মিক মৃত্যুতে সবকিছু কেমন ওলোটপালোট হয়ে গেল। 

কিন্তু বাবার মৃত্যুর একটা গল্প আছে। আমি একটু বড়ো হলে, মা আমাকে বলেছিলেন। বাদকুল্লায় বাবা যখন আসেন, তাঁর কাছে একটা কাপড়ের থলিতে পাঁচশো রুপোর টাকা ছিল। বাবা বিশ্বাস করে তাঁর বহুকষ্টে সঞ্চিত ও রক্ষিত ধন তুলে দিয়েছিলেন আমার কমলাপুরের ছোটো মেসোমশায় কানাইলাল সিকদারের হাতে। মেসোমশায় বাবাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, সেই টাকায় আড়ংঘাটায় কিছু জমি কিনে দেবেন বাবার নামে, আর কমলাপুর গ্রামে বেশ ক'বিঘে মাঠান জমিও কিনে দেবেন আমার মা-র নামে। নিজের ছোটো ভগ্নিপতিকে কে-না বিশ্বাস করবে, বিশেষত আমার মাসি কাননবালার এবং আমার মা স্নেহলতার সামনেই যখন হস্তান্তরিত হয়েছিল সেই টাকা—বাবার শেষ সম্বল। 

এরপর অনেকদিন চলে যায়। মেসোমশায় জমি বা টাকাপয়সা নিয়ে কোনো কথাই বলেন না! প্রায় একবছর পরে একদিন সন্ধ্যায় মেসোমশায় মাসিকে সঙ্গে নিয়ে আমাদের বাদকুল্লার বাসায় এলেন। রাতে খাওয়াদাওয়া করলেন। পরদিন সকালে বাজারে দোকান পাততে যাবেন বাবা। মা চা করছেন। বাবা মেসোমশায়কে বললেন, "কানাই, আমার জমি কেনা হয়ে থাকলে আমাকে দলিল দাও। একবছর হলো, তুমি কতটা কী করলে বলো।" এর উত্তরে মেসোমশায় বাবাকে বলেন, "দাদা, আপনি তো আমাকে জমি কেনার টাকা দেননি!" এইকথা শুনে বাবা স্তম্ভিত হয়ে গিয়ে কোনোমতে বললেন, "তুমি কী বলছো কানাই! আমি কাননের সামনে, তোমার দিদির সামনে তোমায় টাকা দিলাম; এখন বলছো টাকা দিইনি! কী রে কানন, কিছু বল!" অদ্ভুতভাবে মাসি কোনো কথাই বললেন না। নীরবে অশ্রুপাত করতে লাগলেন। আমার মা কাঁদতে লাগলেন। আমি তুলসীমঞ্চের কাছে আদর্শলিপি পড়ছিলাম। বাবা যেন কেমন হয়ে গেলেন। ধীরে-ধীরে মাথায় দোকানের সামগ্রীর চটে বাঁধা বোঝা তুলে নিলেন। মা বললেন, "চা খেয়ে যাও", বাবা মা-র দিকে একবার তাকিয়ে মন্থরগতিতে বাজারের উদ্দেশে যাত্রা করলেন। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে বাবাকে ধরাধরি করে বাজারের কয়েকজন দোকানদার বাড়িতে নিয়ে এলেন। দোকান পাততে গিয়ে বাবা মাটিতে পড়ে যান। পরে আমি বুঝতে পেরেছিলাম, ওটা ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক— এতবড়ো মিথ্যাচার ও প্রতারণার আকস্মিক ধাক্কা বাবা সামলাতে পারেননি। মনোমোহন চৌধুরী ডাক্তারবাবু এলেন। আমি তাঁকে জেঠু বলতাম। ডাক্তারজেঠু বাবার নাড়ি দেখে বললেন, সব শেষ। লোকে বলাবলি করতে লাগলো, সন্ন্যাস রোগ। মা তো আছাড়িপিছাড়ি করছেন। আমি অঝোরে কাঁদছি। পাড়াপড়শি সব মেসোমশায়কে চেপে ধরলো, " কী ব্যাপার? পঞ্চাননবাবু সৎ ও ধার্মিক মানুষ, কী করেছেন ওঁর টাকা নিয়ে? জমি দিতে হবে না, টাকা ফেরত দিন।" অত্যন্ত ধুরন্ধর সেই ব্যক্তি মচকাবেন তবু ভাঙবেন না, কিছুতেই স্বীকার করেন না টাকার কথা। শেষ পর্যন্ত সবার চাপে পড়ে সাদা কাগজে লিখে দেন যে, আমার মা-র নামে কমলাপুরের মাঠে জমি কেনা আছে। একথা বলে, মাসিকে নিয়ে তিনি চলে যান। বাড়িতে পড়ে থাকি ঠাকমা, মা, টুনু আর আমি। শোকার্ত, অসহায়, কিংকর্তব্যবিমূঢ়। পাড়াপড়শি, ইউনাইটেড ক্লাবের যুবকেরা বাবার সৎকারের ব্যবস্থা করেন। মৃত্যুর বছর দেড়েক আগে, বাদকুল্লা রেল স্টেশনের কাছে এক বিঘে ও বরিশালপাড়ায় আর এক বিঘে জমি মাত্র দুশো টাকায় বিক্রি করে বাবা দিদির বিবাহ দিয়ে গিয়েছিলেন। আমার জামাইবাবু অর্জুন সিকদার নম্রভাষী ও প্রকৃত সজ্জন মানুষ। তাঁকে আমি 'দাদাবাবু' বলে ডাকতাম। বাবার মৃত্যুর পর আমি তাঁর মহৎ হৃদয়ের পরিচয় পেয়েছিলাম। যাইহোক, বনগাঁ গোপালনগরে বাবার মৃত্যুর খবর পৌঁছে দেন আমাদেরই এক প্রতিবেশী। পরের দিন দুপুরেই দিদিকে নিয়ে জামাইবাবু বাদকুল্লায় চলে আসেন এবং নিজে পরের দিন চলে যান। কামানের আগের দিন জামাইবাবু আবার চলে আসেন। শ্রাদ্ধশান্তি পর্ব মিটে যাবার পর তিনি দিদিকে নিয়ে গোপালনগরে ফিরে যান।

বাবার মৃত্যুর একবছরের মাথায় ঠাকমার মৃত্যু হয়। সে বড়ো মর্মান্তিক মৃত্যু। বাবার হঠাৎ চলে যাওয়া ঠাকমা কিছুতেই যেন বুঝে উঠতে পারছিলেন না। কেমন যেন থুম মেরে গেলেন। একেতেই কথা কম বলতেন তিনি। এখন আরও চুপচাপ হয়ে গেলেন। একটা পিতলের ঘটি হাতে, অন্যহাতে লাঠি, প্রায়ই তিনি পথেপ্রান্তরে খুঁজে ফিরছেন তাঁর সন্তানকে। অকালবিধবা ও শোকস্তব্ধ তাঁর পুত্রবধূর পক্ষে দুটি শিশু পুত্রকন্যা ও হতদরিদ্র সংসার সামলে সবসময় সম্ভব হতো না, আমার সেই লোলচর্ম ও মানসিক অবসাদগ্রস্ত ঠাকমাকে খুঁজে আনা প্রতিদিন। অথচ একাধিক অন্ধ প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে মা ঠিক তাঁকে ফিরিয়ে আনতেনও রোজ। একদিন আর পারলেন না ফেরাতে। খুব ভোরে সবার অজান্তে বেরিয়ে আর ফিরলেন না তিনি।

একদিন, দু'দিন, তিনদিন...এভাবে মা, আমি ও শুভাকাঙ্ক্ষী পড়শিরা হন্যে হয়ে এ-গ্রাম সে-গ্রাম কত তাঁকে খুঁজলাম। পেলাম না কোথাও।অবশেষে সে এক কোজাগরী পূর্ণিমার কালো রাত ঘনিয়ে এল আমাদের জীবনে। পুরন্দরপুর গ্রামের চৌকিদার বাড়ি এসে খবর দিলেন, পুরন্দরপুরের খাঁ-খাঁ শূন্য মাঠে তিনি আবিষ্কার করেছেন পিতলের ঘটি, কাপড়ের পুঁটলি, লাঠি আর হাড়গোড়, করোটি। আমরা উদভ্রান্তের মতো ওই চার-পাঁচ মাইল পথ প্রায় দৌড়ে গিয়ে খুঁজে পাই তাঁর দেহাবশেষ। 

আমার আর মা-র চোখে সেই মুহূর্তে জল ছিল না কোনো। ফাঁকা মাঠ, সাদা জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে চরাচর। আর সেই মাঠে ইতস্তত ছড়ানোছিটানো আমার পিতামহীর হাড়গোড়। ছেলেকে খুঁজতে এখানে এসেছিলেন সেই বৃদ্ধা? ক্ষুৎপিপাসায় কাতর অশক্ত দেহে ঢলে পড়েছিলেন মৃত্যুর কোলে? মৃত্যুর পর শিয়াল, কুকুর বা বুনো কোনো পশুর দল তাঁর মাংসমজ্জা ভক্ষণ করে হাড় ও করোটি রেখে গেছে ওখানে? সাদা জ্যোৎস্নায় ভেসে যাওয়া এক প্রাগৈতিহাসিক মাঠের মধ্যে দাঁড়িয়ে ছ’বছর বয়সের বালকের সমগ্র সত্তায় অন্ধ করোটির রেখা ছড়িয়ে গিয়েছিল সেই মুহূর্তে? জ্যোৎস্নাপ্লাবিত মাঠ, ছড়ানোছিটানো হাড়ের পাশে পিতলের ঘটি, লাঠি ও ছিন্ন পরিধান, এসবের মাঝে এক বৃদ্ধার হাড় উন্মুখ খুঁজে ফিরছে মৃত পুত্রকে। আমাকে আমৃত্যু বহন করতে হবে এই দৃশ্য। 

আমার প্রথম কবিতাগ্রন্থ অন্ধ করোটির রেখা -য় (১৯৯২) এই মর্মন্তুদ ঘটনার অভিঘাত ধরা পড়েছে। এ-প্রসঙ্গে বিস্তারিত বিশ্লেষণ করেছেন লেখক সুধীর চক্রবর্তী, কথাসাহিত্যিক আনসারউদ্দিন, কবি কমলেশ পাল ও কবি-প্রবন্ধকার সুব্রত পাল, আমার কাব্যকৃতি প্রসঙ্গে তাঁদের লেখায়।

আমার শৈশবে আমার খুব ভালো কিছু সঙ্গী ছিল। মুচির ছেলে মহাদেব দাস, বাগদিপাড়ার কেনা বাগ, আর আমার হাইস্কুলের মাস্টারমশাই কৃষ্ণেন্দু দাসের ছেলে পূর্ণেন্দু—আমরা ছিলাম হরিহর আত্মা। পূর্ণেন্দু আর কেনা ছিল খুব দুরন্ত, ডানপিটে। মহাদেব শান্তশিষ্ট ভোলানাথ। আমি ধীরস্থির, স্বভাবভীরু ও ভাবুক প্রকৃতির। বর্ষাকালে আমাদের এই থ্রি-মাস্কেটিয়ার্সের (কেনা, পূর্ণেন্দু আর আমি) অভিযান আর আনন্দ ছিল লাগামছাড়া। বর্ষাকালে কচুপাতা মাথায় দিয়ে আমাদের গ্রামের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত অঞ্জনা নদীতে ছিপ দিয়ে মাছ ধরা; সাঁকোর নিচে জল কতটা বাড়লো, পাঠকাঠি দিয়ে তা মেপে দেখা; কখনো-বা অতি ভোরে নদীর পাড় ঘেঁষে পুবদিকে ওই চন্দনদহ গ্রাম পর্যন্ত হেঁটে যাওয়া—এসবই ছিল আমাদের পবিত্র নিত্যকর্ম। ছিপ দিয়ে কত যে মাছ ধরতাম—পুঁটি, সরপুঁটি, ট্যাংরা, বেলে, ল্যাটা, শোল, রুই-কাতলা-মৃগেলের চারাপোনা। অঞ্জনায় কত যে প্রজাতির মাছ ছিল তখন! সারা বছরই জল থাকতো প্রায়। চোত-বোশেখে জলে টান ধরতো। নদীর কিনারে জলকাদার মধ্যে নেমে নানা উপায়ে ল্যাটা, শোল, চিংড়ি, কাঁকড়া, কখনো-বা বোয়াল মাছও ধরতাম আমরা। মাছধরায় সবচেয়ে পারদর্শী ছিল কেনা আর পূর্ণেন্দু, কিছুটা মহাদেবও। আমি প্রায়ই ওদের হাত থেকে মাছ নিয়ে মাটির হাঁড়িতে ঢুকিয়ে রাখতাম। কচুরিপানার নিচে ঝাঁকেঝাঁকে কাঁকড়া ও চিংড়ি পেতাম। অত মাছ কী করবো! আমার ভাগে যা পেতাম, তাও তো কম কিছু নয়! বেশি মাছ বাড়িতে নিয়ে গেলে, মা তো বকবে! বলবে, "তেল কোথায়? মাছ কি জল দিয়ে ভাজবো!" কেনা আর মহাদেবকেই বেশি মাছ দিয়ে দিতাম আমরা। শুবলিবুড়িকেও দিতাম। তাকে আমি অবশ্য পিসি বলেই ডাকতাম। লোকে বলতো 'শুবলিবুড়ি'। কেন তাকে ওইনামে ডাকতো সবাই, তা জানি না। সে ছিল সরকারবাড়িরই মেয়ে। তিনটে আস্ত ইট দিয়ে উনুন করতো সে। বাজারের কাগজ, পিচবোর্ড তার মধ্যে গুঁজে আগুন ধরাতো আর এনামেলের তোবড়ানো কালোকুষ্টি এক বাটিতে জল দিয়ে মাছ সেদ্ধ করতো পিসি। সেদ্ধ মাছ বেশ তারিয়ে-তারিয়েই খেত। পুজোর সময়ে নতুন শাড়ি পেত সে। সেই শাড়ি পরে তার কী আনন্দ! ভাঙা একটুকরো আয়না সামনে রেখে সিঁদুর পরতো, আলতা পরতো; দু'হাতে রঙিন কাচের চুড়ি। শুনেছিলাম, বিয়ে হয়েছিল তার। বিয়ের কিছুদিন পরে তার স্বামী তাকে বাপের বাড়ি রেখে যায়। আর নিতে আসেনি। এ-বাড়ি থেকে পাঠালেও, তৎক্ষণাৎ তাকে ফিরিয়ে দিত। সেই লোক আবার বিয়ে করেছিল। এই হলো শুবলিপাগলির গল্প।

বর্ষায় কত মহাজনি নৌকো ভিড়তো নসু ঘোষের খোঁয়াড়-সংলগ্ন ঝাঁকড়া নিমগাছের গোড়ায়। ওই খোঁয়াড়ে গরু, মোষ, ছাগল জমা পড়তো ও বাঁধা থাকতো; কারণ ওরা নাকি ফসলের ক্ষতি করেছে। তাদের মালিকরা জরিমানা দিয়ে তাদের বাড়ি নিয়ে যেত। এই ছিল তখনকার পঞ্চায়েতের নির্দেশ। কত ডিঙিনৌকো ভেসে বেড়াতো অঞ্জনায়। ডিঙিনৌকোয়, ছিপনৌকোয় জেলেরা মাছ ধরে বেড়াতো।

শুধু মাছের জন্যই নয়, অঞ্জনা খুব টানতো আমাকে। নানা ঋতুতে তার নানা রূপ। পাড়ে-পাড়ে সবুজে সবুজ কত গাছগাছালি; হরেকরকমের পাখি সে-সব গাছে। সারস, কোঁচবক, চিল হঠাৎ ছোঁ মেরে রুপোলি মাছ তুলে নিয়ে গাছে বসে ছিঁড়ে-ছিঁড়ে খেতো। নসু ঘোষের খোঁয়াড়ের পাশ থেকে শুরু করে সেই চন্দনদহ গ্রাম পর্যন্ত কোনো-কোনো শীতের ভোরে আমি আর কেনা গায়ে-মাথায় পাটের বস্তা জড়িয়ে (দু'জনেই খুব গরিব ছিলাম, শীতবস্ত্র কোথায় পাবো!) অঞ্জনার পাড় ধরে-ধরে হেঁটে যেতাম। কোনো উদ্দেশ্য ছিল না, নিছক হাঁটার আনন্দে হাঁটতাম। আহা, রুপোলি অঞ্জনার পাশ দিয়ে হাঁটছি, সূর্য উঠি-উঠি করছে, আকাশের কী রঙ, নদীর জলের কী রঙ, নদীপাড়ের মানুষজন জেগে উঠছে; কেনা আমাকে বলছে, "ওই দ্যাখ একঝাঁক বক আকাশে উড়ে-উড়ে কোথায় চলে যাচ্ছে" —সে-সব মুহূর্ত কীভাবে অনুবাদ করি আমি? কীভাবে বোঝাই! অঞ্জনা আমাকে কতকিছু দিয়েছে, একেবারে উজাড় করে তার মণিমুক্তো বিলিয়েছে—আর সেই অঞ্জনা ধীরে-ধীরে কীভাবে আমার চোখের সামনে লুঠ হয়ে গেল, মুমূর্ষু হয়ে গেল—মানুষের লোভ আর অবহেলা শেষ করে দিল নদীটাকে! নদীর মধ্যে ইটভাটা, চাষবাস, এক-একটা এলাকা ঘিরে ভেড়ি তৈরি—এইসব আর কী! 

আগেই বলেছি, বাঁশের কঞ্চির ঝুড়ি নিয়ে নদীর পাড় ধরে হেঁটে-হেঁটে চন্দনদহ, মুগরাইল, বাগরাইল গ্রামে গিয়ে চাষির খেত থেকে শাকসবজি, পাতিলেবু তুলে ঝুড়ি মাথায় করে বাদকুল্লা বাজারে নিয়ে এসে বিক্রি করতাম। দু-চার পয়সা লাভ থাকতো। চাষিকে পরের দিন পয়সা দিতাম। এই দয়া, এই করুণা ভোলার নয়! নদীর পাড় ধরেই আসা-যাওয়া করতাম। অঞ্জনা যেন আমায় অভয় দিত। শীতের ভোরে সস্তার একটা সুতির চাদরে কান-মাথা ঢেকে, গায়ে জড়িয়ে, অঞ্জনার কাঠের সাঁকোর উপরে রেলিং-এ ভর দিয়ে পুবদিকে তাকিয়ে থাকতাম, কখন সূর্য ওঠে তা দেখার জন্য। ঘন কুয়াশায় ঢাকা থাকতো নদীর উপরিভাগ, নবারুণ এসে কুয়াশা সরিয়ে দিত; জল হয়ে উঠতো রঙিন। পাখিরা উড়ে যেত নদীর উপর দিয়ে, দু-একটা মাছ লাফিয়ে উঠতো। দু'চোখ ভরে এসব দৃশ্য উপভোগ করতাম। 

স্পষ্ট মনে আছে, হাইস্কুলে পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি হলাম। সারা দেশে চালের সংকট দেখা দিল। আসলে চাল দেশে ছিল না, তা তো নয়! একশ্রেণির অসৎ ব্যবসায়ী তাদের গুদামে চাল মজুত করে রেখে, বাজারে কৃত্রিম অভাব তৈরি করলো। ফলে, চালের দাম আমাদের মতো গরিবগুর্বোদের কাছে আকাশছোঁয়া হয়ে গেল। দিনের পর দিন ভাতের মুখই দেখতাম না আমরা! চালের বিকল্প হিসাবে গরিব ও নিম্ন-মধ্যবিত্তদের জন্য বাজারে ভুট্টার দানা, মাইলোর ভুসি, যবের আটা—এসব এল। ভুট্টা ভাঙিয়ে, তার ভাঙা দানা দিয়ে খিচুড়ি করে খেতে শুরু করলাম আমরা। আর মাইলো (একধরনের ঘাসের বীজ, যা আমেরিকা জাহাজ করে পাঠাতো এদেশে) ভাঙিয়ে ভুসি করে তার চাপাটি (তেলবিহীন) এবং কখনো-বা যবের আটার রুটি (যা কিনা ফেটে-ফেটে যেত) খেয়ে প্রাণধারণ করতে লাগলাম। এসবও যখন জুটতো না, মা তখন কচুর ডগা, সজনে পাতা বনবাদাড় থেকে সংগ্রহ করে সেদ্ধ করতেন। তাই খেয়ে বেঁচে ছিলাম। ভাইবোন করুণস্বরে মাকে বলতাম, "ভুট্টাদানার খিচুড়িতে দুটো চাল মিশিয়ে দাও।" মা চাল কোথায় পাবে! বলতেন, "সোনামুখ করে এই খেয়ে নে বাবা।" আর সোনামুখ! ওইসব ছাইভস্ম খেয়ে সেই যে পেটের গণ্ডগোল হলো, সারাজীবন তার রেশ থেকে গেল। পাকস্থলী কমজোরি হয়ে গেল। দাদাবাবুর ব্যবসায় মন্দা। তিনিও অসহায়। কিছু চাল কোনোভাবে সংগ্রহ করতে পারলে, টুনুকে শুধু দুটো ভাত ফুটিয়ে দেওয়া হতো। আমরা বাকি সবাই ওইসবই খেতাম। এরপর ১৯৬২ সালে খাদ্য আন্দোলন শুরু হলো। নদীয়া জেলায় আন্দোলন মারাত্মক আকার ধারণ করলো। আন্দোলনকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ গুলি চালালো। কৃষ্ণনগরে আনন্দ হাইত ও অর্জুন বিশ্বাস পুলিশের গুলিতে নিহত হয়ে শহিদ হলেন। বাদকুল্লায় ক্রোধী যুবকেরা ইএমইউ কোচের ট্রেনে আগুন ধরিয়ে দিল। স্কুলের দোতলার বারান্দা থেকে আমরা সেই দাউদাউ করে জ্বলতে থাকা ট্রেন দেখলাম। স্টেশনচত্বর, রাস্তাঘাট রাইফেলধারী পুলিশে-পুলিশে ছয়লাপ! সারা পশ্চিমবঙ্গে খাদ্য আন্দোলনের আগুন ক্রমশ তীব্র থেকে তীব্রতর হলো। কোথাও-কোথাও মজুতদারদের চালের গুদাম লুঠ হলো। আন্দোলনকারীদের উপর পুলিশের হিংস্র লাঠি ও রাইফেল গর্জে উঠলো। অনেকে শহিদ হলেন। তৎকালীন খাদ্যমন্ত্রী মাননীয় প্রফুল্লচন্দ্র সেন জনগণকে পরামর্শ দিলেন, চালের বিকল্প হিসাবে আনাজের খাদ্যাভ্যাস গড়ে তুলতে। কাঁচকলা খেতে বললেন তিনি! প্রফুল্ল সেন-কে নিয়ে আঁকা ব্যঙ্গচিত্রে গ্রাম ও শহরের দেওয়ালগুলো ভরে উঠলো। এই আন্দোলনকে কেন্দ্র করে এ-রাজ্যে বামপন্থী রাজনীতি পায়ের নিচে শক্ত মাটি পেয়ে গেল। তাদের রাজনৈতিক কার্যকলাপ ও আন্দোলন তীব্র হয়ে উঠলো। কিছুদিনের মধ্যেই সাধারণ মানুষ নির্বাচনে কংগ্রেসকে হারিয়ে বামপন্থী ও অ-কংগ্রেসি দলগুলোকে সরকার গঠনের সুযোগ করে দিল। প্রথমে যুক্তফ্রন্ট ও পরে বামফ্রন্ট সরকার গঠিত হলো। সে অন্য ইতিহাস। আমার কৈশোরে ও প্রথম যৌবনে এসব ইতিহাস সংঘটিত হলো। আমার মনে ও হৃদয়ে তার সুগভীর ছাপও পড়লো। কৈশোরকাল থেকেই আমি কবিতা লিখতে শুরু করি। তার অনেক-অনেক পরে লেখা আমার আগুন এখনও নেভেনি  শীর্ষক কবিতাটিতে আমার প্রথমজীবনের সংগ্রাম ও খাদ্যসংকটের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার কথা ফুটে উঠেছে। 
"আমি হাট থেকে হাটে ছেঁড়া মাদুর আর চাটাই পেতে
যত হাড়হাভাতে চাষীর কাঁড়া-না-কাঁড়া চাল
দুএক মুঠো যা কিনেছি তা আবার বিক্রি করে 
দুচার পয়সা যা পেয়েছি তা দিয়ে কিনেছি আমার 
ফুটো শিশিতে এক ছটাক তেল এক পয়সার নুন
                                  আর আমার হাত ছড়ে গিয়েছে
হাত ছড়ে গিয়েছে আমার দূর দূর গ্রামে গিয়ে 
যখন নিজের হাতে তুলে নিতে হয়েছে কাঁটায় ভরা বেগুন আর পাতিলেবু;
সেই ফাঁকে কখনও দুএকমুঠো ঘাস, আকাশের একচিলতে রঙ
শীতনদীর উপর জমে থাকা ভোর আর সন্ধ্যার কুয়াশা 
...........................................................................
জ্বলন্ত সূর্যের চারপাশে গোল হয়ে বসে ভুট্টা আর মাইলোর
রুটিও আমি তুলেছি আমার মুখে, আমার চমকে ওঠা গ্রাস
এসবই আমি করেছি শুধু নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যই নয়
তোমাকেও বাঁচিয়ে রাখার জন্য পৃথিবী..."

প্রসঙ্গত বলি, দাদাবাবু যখন কিছুদিনের জন্য তাঁর মা-র কাছে গোপালনগরে যেতেন, সেই সময় মঙ্গলবার ও শনিবার হাটে চাটাই পেতে, দাঁড়ি-বাটখারা নিয়ে আমি গৃহস্থ-চাষির কাছ থেকে খুচরো দু-একসের করে চাল কিনতাম। এভাবে পনেরো-কুড়ি সের চাল কিনে, তা বিক্রি করে সামান্য কিছু লাভ হতো। সংসারের কাজে লাগতো। দাদাবাবু ফিরে এসে এসব শুনে বলতেন, "বাঃ হাবলা, ভালো খুব ভালো।" হ্যাঁ, তিনি আমাকে মাঝেমাঝে 'হাবলা' বলে ডাকতেন। এরপর দাদাবাবু তাঁর মা-কে (আমার মায়োইমা) পাকাপাকিভাবে বাদকুল্লায় নিয়ে এলেন। আমাদের ঘর-সংলগ্ন আর একটা ছোটো ঘর হলো তাঁর থাকার জন্য। মায়োইমা আমাকে আর টুনুকে খুব ভালোবাসতেন। মুখে নস্যির গুঁড়ো নিতেন। বাজার থেকে সে-নস্যি আমিই তাঁর জন্য কিনে আনতাম। 

সরকারবাড়ির গিন্নি (প্রয়াত নলিনীমোহন সরকারের ধর্মপত্নী) শৈবলিনী সরকার আমার মা-কে মেয়ে বলে ডাকতেন। মা তাঁকে মা বলতেন। আমি ডাকতাম দিদিমা। দিদিমাদের বিশাল ফলের বাগান ছিল আমাদের কুঁড়েঘরের সামনে। প্রচুর আম, কাঁঠাল, জাম, সবেদা, আঁশফল, জামরুল, নারিকেল। ফলবাগানের শেষে বিশাল বাঁশবাগান। বাঁশবাগানের মধ্যেই বেতের ঝাড়। তার আগে বেশ কয়েকটি তালগাছ। এসব ঝোপঝাড়ের মধ্যেই বিশাল একটা আপা (ছোটো ডোবা); কালো জল, প্রচুর মাছ আর জলঢোঁড়া সাপ। কেমন যেন আদিমতার গন্ধ মাখানো। এই আপার উপরেই ছিল খুব বড়ো একটা ল্যাংড়া আমগাছ।

ওই বাগানে শীতের সকালে একটা আমগাছের নিচে বস্তা পেতে পড়তে বসতাম। মা হয়তো বাটিতে গুড়-মুড়ি দিয়ে গিয়েছে। আমি পড়ছি, বাটির খেয়াল নেই; বাঁশবন থেকে শেয়াল এসে সে-বাটি মুখে নিয়ে পালাচ্ছে। সম্বিত ফিরতেই বাঁশের লাঠি নিয়ে শেয়ালকে তাড়া করে বাটিটা অন্তত উদ্ধার করতাম। সাপ ছিল প্রচুর, বেজিও ছিল। আর ছিল কুমিরের মতো বিশাল সব গোসাপ। একবার তো লোকে বলাবলি শুরু করলো, বাঁশবাগানের গভীরে হায়েনাকেও নাকি দেখা গিয়েছে! আমাদের বাড়ির সবাই বেশ কিছুদিন হায়েনার ভয়ে সিঁটিয়ে ছিলাম। সন্ধ্যা হলেই দরজায় খিল। 

রাধাগোবিন্দ মন্দিরের সামনেও ছিল বিশাল আমের বাগান। হিমসাগর ও বোম্বাই আমের বড়ো-বড়ো গাছে অজস্র আম ফলতো। কালবৈশাখির ঝড়বাদলে আম কুড়ানোর কী মজাই-না হতো! বস্তা বোঝাই করে আম দিদিমাকে দিয়ে আসতাম। দিদিমা আমাকে প্রচুর আম দিতেন। মন্দিরের চারপাশে যথাক্রমে ভোগের ঘর, অতিথিশালা, রন্ধনশালা, ভাঁড়ারঘর—মোট চারটে বড়ো-বড়ো ঘর, পাকা মেঝে ও দেওয়াল, উপরে টালি। উৎসবের সময় ভিড়ে অতিথিশালা উপচে পড়তো। চব্বিশ ঘণ্টা নামসংকীর্তন চলছে, ওদিকে ভাঁড়ারঘর থেকে চাল-ডাল-আনাজ-মশলাপাতি চলে যাচ্ছে রন্ধনশালায়। ভাঁড়ারঘরে মাটির বড়ো-বড়ো কালো জালায় পক্কানো (ঝুরিভাজা দিয়ে গুড়ে মাখা একধরনের গোলাকার মিঠাই); আহা কী তার স্বাদ! আমরা পোড়োর দল উৎসবের কাজ পরিশ্রম করতাম খুব। আমরা ভলান্টিয়ার। টিফিনে মুড়ি-মুড়কি-নাড়ু আর সেই অমৃত—পক্কানো দেওয়া হতো আমাদের। প্রতিদিন প্রায় একহাজার ভক্ত, সাধু ও কীর্তনিয়ার পাত পড়তো দু'বেলা। আমরাও পরিবেশনে হাত লাগানোর সুযোগ পেতাম। মহোৎসবের দিন তো দু-তিন হাজার লোক অন্নসেবা গ্রহণ করতো! খুব আনন্দ হতো আমার। প্রসঙ্গত বলি, এই মন্দিরেই সম্বৎসর একাদশী ও পূর্ণিমায় কীর্তন হতো। চরণকাকা খোল বাজিয়ে নামগান করতেন সন্ধ্যায়। চরণকাকার ছেলে খঞ্জনি বাজাতো। আমিও ওদের সঙ্গে কীর্তন করতাম। করতে-করতে মন্দির প্রদক্ষিণ করতাম। সংকীর্তন শেষে হতো হরির লুঠ। প্রসাদবিতরণও হতো। মাখাসন্দেশ, ফলমূল, কত কী! এসবই দাদু (নলিনীমোহন সরকার) বেঁচে থাকার সময়ের কথা। দাদুর মৃত্যুর পরে ক্রমশ ঝিমিয়ে পড়লো সবকিছু। তাঁর ছেলেরা অবশ্য কিছুদিন চালিয়েছিলেন সেই অনুষ্ঠান। কিন্তু যা হয় আর কী! ক্রমশ স্তিমিত হয়ে গেল এই উৎসব উদযাপনের সদিচ্ছা। ওই রাধাগোবিন্দ মন্দিরের অনুষ্ঠানে আমি নিজেকে যতটুকু সংযুক্ত করতে পেরেছিলাম, তাতে আমার অর্জন যা হয়েছিল, তা হলো— এই আমি অদ্যাবধি শ্রীচৈতন্যদেব ও বৈষ্ণবধর্মকে নিজের অন্তরের গভীরে স্থাপন করতে পেরেছি। আমার সুর চলেছে আলোর সাথে  শীর্ষক গীতিকবিতার ক্ষুদ্র গ্রন্থটি (প্রকাশক : মুক্তধারা ) তার সাক্ষ্য বহন করে বলেই আমার বিশ্বাস। 
[ ক্রমশ ]

Comments