ছোটোবেলায় রবীন্দ্রনাথ মানে বুঝতাম, একটা দাড়িওয়ালা মানুষ। বিশিষ্ট কেউ একজন। যাঁর ছবি ঘরে-ঘরে থাকে। বাবার মুখে ওঁর কবিতা আওড়ানো কিম্বা ছোড়দিকে আবৃত্তি শেখানো। দেওয়ালে সারি-সারি রবীন্দ্র রচনাবলী, 'সঞ্চয়িতা'। আমার হাতে নতুন 'সহজ পাঠ' এলে একে-একে মিলিয়ে দিতেন বড়রা, ইনিই তিনি।
যেদিন তিনি রোদ্দুর হয়ে এলেন আমার কাছে, তখন আমি নবম শ্রেণি। বাইশে শ্রাবণের জন্য স্কুল থেকে ভার পড়লো "আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু" গাইবার। ওই সময় আমি তুমুলভাবে খেয়াল, নজরুলগীতি, গুরুজিকে লুকিয়েচুরিয়ে মান্না দে, আশাজি গাই। মোদ্দা কথা, ওই রাগরাগিণী-বেষ্টিত গান ছাড়া অন্য কিছু মাথাতেই ছিল না। আরও ভালো করে বললে, ওগুলো গান বলে তেমন মনে হতো না। এদিকে দিদিমণির নির্দেশ, গাইতেই হবে। দ্বারস্থ হলাম প্রবীরকাকুর। যিনি কিনা রিসেন্ট হয়ে যাওয়া স্টার জলসা সুপার সিঙ্গারের ফাইনালিস্ট অভিষেক সিংহচৌধুরীর বাবা এবং নিজেও দক্ষ সঙ্গীতশিল্পী। আমায় অসম্ভব স্নেহ করতেন। কাকু শুনে চক্ষু চড়কগাছ—"সব্বোনাশ! এ-গানের মানে তুই জানিস?" সত্যি বলতে কী, রবীন্দ্রনাথের ওই দর্শন, চেতনা আমার বোঝারও কথা নয় তখন ওই অপরিণত মননে। তাঁকে বুঝতে কয়েক জন্ম লাগে। আমি তো কলি মাত্র। সেই সন্ধ্যায় বাবার হাত ধরে আমার কাছে এল 'গীতবিতান'। সেইদিন থেকেই একটু-একটু করে প্রবেশ করতে শুরু করলেন রবীন্দ্রনাথ আমার মজ্জায়, শিরায়। সেইযাত্রায় কাকুর তালিমে গেয়ে ফেলেছিলাম গানটা।আজও প্রতিমুহূর্তে অব্যর্থ হয়ে ওঠে ওই অমোঘ দুটো লাইন, জীবনের সারসত্য—"তরঙ্গ মিলায়ে যায় তরঙ্গ উঠে, / কুসুম ঝরিয়া পড়ে কুসুম ফুটে।" মাঝেমাঝেই চলতে থাকে 'গীতবিতান' নেড়েচেড়ে দেখা, চেনাকথায় গলা মেলানো। প্রায় গানই চেনা ছিল, কারণ দিদি ছিল রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী। বীরেন্দ্রপ্রসাদ হাজারী ও পরবর্তীকালে পূরবী মুখার্জির ছাত্রী। যার কাছেই আমার হাতেখড়ি।
পিওর ক্লাসিক্যাল শিখতে-শিখতে বাবা হঠাৎ বললেন, রবীন্দ্রনাথ না-শিখলে পরিশীলিত হওয়া যায় না, মনন শুদ্ধ হয় না; অতএব রবীন্দ্রনাথ শিখতে হবে। এবং এটা আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধেই। এলেন শঙ্করদা, শঙ্করনাথ রায়। সেইসময় রবীন্দ্রভারতীর ছাত্র। সাগর সেন, পূরবী মুখার্জির প্রিয় ছাত্র। এসে প্রথমেই বললেন, "একটা গান শোনা দেখি।" আমি গাইলাম "একি লাবণ্যে পূর্ণ প্রাণ, প্রাণেশ হে"। কিন্তু গাইলে কী হবে, ওই সময় আমার পকড়বিশিষ্ট গলা। মীড়ের তেমন ছোঁয়া নেই বললেই চলে। আর রবীন্দ্রনাথের গানে মীড়ের প্রয়োগ ভীষণরকম। কথার প্রাধান্য। শব্দ-বর্ণ উচ্চারণের আধিক্য। "আজ শ্রাবণের পূর্নিমাতে" গাইতে গিয়েই প্রথম শিখলাম 'ফ' উচ্চারণ করতে গেলে দুটো ঠোঁট ছোঁয়াতে হয়। ঠোঁট ফাঁক করে হাওয়ায় 'ফ' বলা নয়। "ফুল-ফোটানোর খেলায় কেন ফুল-ঝরানোর ছল। / ও তুই কী এনেছিস বল্।।" তো, গান শুনেই শঙ্করদা বলেছিলেন, "তুই তো লালুদার কাছেই ঠিক, আবার আমার কাছে কেন এলি?" শুনেই পাশের ঘর থেকে বাবা বলে উঠলেন, "ওর মধ্যে রবীন্দ্রচেতনা আসুক। তুমি ওকে গড়ে দাও শঙ্কর।"
ব্যস, শুরু হলো। ব্রহ্মসঙ্গীত, টপ্পা, বিভিন্ন পর্যায়, ভানুসিংহের পদাবলী; সঙ্গে যাবতীয় টেকনিক্যাল দিক— রবীন্দ্রনাথ গাইতে গেলে যা-যা লাগে। যেমন জিভ, ঠোঁট, দাঁতের ব্যবহার। বাক্যে শব্দের ব্যবহার ইত্যাদি। টানা দু'বছর তালিম নিয়েছিলাম রবিবাবুর গানে। কারণ, তারপরেই আমি নজরুল এবং ধ্রুপদী অঙ্গে চলে যাই।
রবিবাবু?
আজ্ঞে হ্যাঁ, রবীন্দ্রনাথকে আমি এভাবেই দেখি। তাঁকে আমি প্রতিষ্ঠান, ঈশ্বর বা শ্রদ্ধাভাজনেষু—এমন করে ভাবি না। বরং তিনি আমার বন্ধু। আমার জাপটে ধরা মানুষ, সুখে-দুখে আনন্দে-উৎসবে। প্রবল সঙ্কটে, অসম্মানে, অবসাদে ওই 'গীতবিতান' আঁকড়ে দিন যাপিত হয়েছে। বুকের ভেতর থেকে কে যেন গেয়ে উঠেছে, "আমি মারের সাগর পাড়ি দেব বিষম ঝড়ের৷ বায়ে"।
বন্ধু না-হয়ে উপায় আছে? এতবড়ো বন্ধু দার্শনিক, ভবিষ্যৎদ্রষ্টা আর ক'জন আছেন? যিনি মেয়েদের মনের কথা বুঝতেন তাদের মতো করে। ওই সময়ে দাঁড়িয়ে 'চিত্রাঙ্গদা' লিখতে পারেন! যিনি 'সাধারণ মেয়ে' লিখতে পারেন! যিনি 'নষ্টনীড়' লিখতে পারেন! এমন বন্ধু একজন মেয়ের আর কেই-বা হতে পারেন। যিনি বলে যেতে পারেন "আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহদহন লাগে / তবুও শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে।।" আর কেই-বা বলে যেতে পারেন "পুষ্প বনে পুষ্প নাহি / আছে অন্তরে।"
প্রতিদিন রবীন্দ্রনাথ অভ্যাসে থাকলে যাপনে চৈতন্য আসে। মনন-মেধা উর্বর হয়। রবীন্দ্রনাথ একটা প্রবাহমান ধারার নাম। আমার রবীন্দ্রনাথ আমার পরম বন্ধু, পরমাত্মীয়।
"জীবনমরণের সীমানা ছাড়ায়ে
বন্ধু হে আমার, রয়েছো দাঁড়ায়ে।।"
Comments
Post a Comment