'ছিন্নপত্র' খুলে শিলাইদহ কথা পড়ছিলাম। কী চমৎকার একটি লাইনে চোখ আটক আছে। "প্রকৃতির কার্যপ্রণালীর মধ্যে দয়া জিনিসটা কোনো এক জায়গায় আছে অবশ্য, নইলে আমরা পেলুম কোথা থেকে-কিন্তু সেটা যে ঠিক কোনখানে আছে খুঁজে পাওয়া শক্ত।" ৪ঠা জুলাই ১৮৯৩ সাল৷ প্রচন্ড বৃষ্টি হচ্ছিল। চাষিরা কাঁচা ধান কেটে আনছিল। বৃষ্টি আজও হচ্ছে৷ আজও চৌঠা জুলাই। এখানে চাষিরা কীভাবে চাষ করে, আমি জেনে উঠতে পারিনি৷ দেশ অর্থাৎ গ্রামের বাড়ি থেকে বোন বলে, মাঠে জল নেই৷ চাষ শুরুই হয়নি৷ এখন এই লাইনটি পড়ে ভাবছি, প্রকৃতির ঠিক কোথায় দয়া-মায়া লুকোনো আছে? তার ভাগ-বাঁটোয়ারা কেমন?
বেশ কয়েকবছর আগে এমনই এক বর্ষায় লিখেছিলাম রবিঠাকুর আশ্চর্য উঠোনের নাম, মাথার পাশে রাখা গীতবিতান—সেইসব হঠাৎ-হঠাৎই মনে পড়ে যায়৷ হয়তো চরম বৃষ্টি হচ্ছে আর আমার বিরক্তির জগৎ থেকে নিজেকে আনমনা করতে চাইছি৷ আবার পরক্ষণেই বৃষ্টির দিকে হাত বাড়িয়ে দিচ্ছি। কখন যে কী মনে হয়! এই যেমন লিখতে বসে ভাবছি দেশ-বিদেশের যুদ্ধের কথা। এত সৃজন এত উচ্ছাস তাও রক্ত তাও অস্ত্র। কিসের যে প্রয়োজন আর কিসের অপ্রয়োজন, বুঝে আমার দিন ফুরিয়ে যাবে৷ যেমন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অসম ও বিষণ্ণ সময়ে রবিঠাকুর ১০৩টি শান্তি, সুর, ছন্দ ও কবিতা নিয়ে অতিথি ছিলেন ইউরোপে। বলেছিলেন—
"আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার চরণধুলার তলে।
সকল অহঙ্কার হে আমার ডুবাও চোখের জলে।।"
থেমে ছিল কিছু? না। পরবর্তীতে থামলেও কয়েকবছর পর শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ৷ আজও সেই হানাহানির বিরাম নেই। চিৎকার করে বলতে পারি না, আমার একটু স্বস্তি চাই। এত হানাহানিতে ভয় করে। তোমরা থামো। উপায়হীন হয়ে ঈশ্বরের কাছে বলি "আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার..."
আমাদের কলেজের দিনগুলোতে 'গানের ওপারে' বলে একটি বাংলা সিরিয়াল চলতো, সেখানে ঋতুপর্ণ ঘোষ ডায়লগ লিখেছিলেন—আমাদের খিদে পাক ঘুম পাক প্রেম পাক কিংবা বিরহ, রবিঠাকুরই পারেন সর্বত্র সাবলীলভাবে অধিনায়ক হয়ে যেতে৷ এ যেন অদ্ভুত এক যাপন। সেই কথা বলা থেকে, সেই "জল পড়ে, পাতা নড়ে" থেকে। আজকাল রোজ সকাল হলেই সাউন্ড বক্সে চালিয়ে দিই "মহারাজ একি সাজে"। 'এক যে ছিল রাজা' সিনেমাতে শোনার পর সাহানার কন্ঠে কী অপূর্ব লাগতো! মোহময়ী হয়ে পড়ে থাকতাম। গানের ভাষা মাথায় ছেপে গেলেও কথাগুলোর পাশে বসিনি৷ যতবার বিরহ আসে, কাছের মানুষটিকে আঁকড়ে ধরি, ততবার এই গানটি শিরদাঁড়া শক্ত করে আমার হাত ধরে বলে৷ এই তো কয়েকদিন আগে বৃষ্টির মধ্যে মেঘ ছোটাছুটি করছে। আর শব্দগুলো কানে অনুরণন হচ্ছে..."গর্ব সব টুটিয়া, মূর্ছি পড়ে লুটিয়া" সব শেষে আসছে "পলক নাহি নয়নে, হেরি না কিছু ভুবনে—নিরখি শুধু অন্তরে সুন্দর বিরাজে।।"... মহারাজ তবে কে? আমার ভেতর কি ছিঁটেফোঁটাও তাকে পুষতে পেরেছি?
বলতে দ্বিধা নেই। আজ আমার অনন্য গন্তব্য 'মহারাজ', কবিতার পথে, শব্দের পথে, একান্ত গদ্যের পথে তাঁকেই যাপন করছি। পরম আশ্চর্যের মতো সমস্ত আলগা অভিমান জমে পাহাড় হলে অভিজাত গন্ধের ঝর্না নেমে আসে। জলের ভেতর জল। আয়নামুখের ধ্যান। পাথর ধসে পড়ে, বিদ্যাপতি নড়েচড়ে বসেন রবিঠাকুরের হাত ধরে। চব্বিশ মাস আগে তাঁদের ছুঁয়ে ছিলাম৷ জনসমক্ষে উপহার পেলাম 'ভরা বাদর মাহ ভাদর'। সেই সফর আমায় কোথা থেকে কোথায় নিয়ে চলেছে। আজ যেন আমিই 'নৌকাডুবি'-র নায়িকা। ফ্রিল দেওয়া ব্লাউজ মাথায় বান খোপা বাঁধছি, আর দূরে অনেক দূরে আমার প্রিয় নলিনাক্ষ হয়ে উঠছেন মহারাজ। তাঁকে ছুঁয়ে আছি অসম্ভব অন্তরে, চোখে আছড়ে পড়ছে মুক্তির আলো।
অত্যন্ত সুন্দর হয়েছে।
ReplyDeleteবাহ্ খুব সুন্দর ❤
ReplyDelete