প্রাণেশ সরকার

এই স্মৃতিকথা লিখতে বসে কত কথা, যাপিত জীবনের অগণন দৃশ্যপট আমার মাথায় এসে ধাক্কা দিচ্ছে। যেভাবে সে-সবের অভিঘাত অনুভব করছি, তাতে ঘটনার পরম্পরা, যাকে বলে ক্রোনোলজিক্যাল অর্ডার, তা হয়তো রক্ষিত হচ্ছে না; কিন্তু সার্বিকভাবে ফেলে আসা সে-সব দিনের নির্দিষ্ট একটা অবয়ব ফুটে উঠছে নিশ্চয়ই। এই লেখা ধীরে-ধীরে গড়ে উঠছে ১৪৩০-এর আষাঢ় মাসে (জুলাই ২০২৩)। মনে পড়ছে বাল্যকালের এক আষাঢ়ের কথা। সেকথাও অঞ্জনাকে ঘিরেই। প্রবল বরিষণ সেবার। ক্লাস সিক্সে পড়ি তখন। অবিশ্রান্ত বৃষ্টি পড়ছে কয়েকদিন ধরে। অঞ্জনার কাঠের সাঁকো প্রায় ডুবুডুবু। সাঁকোর নিচে জল ধাক্কা মারছে সাঁকোর ভিতরের দু'দিকের দেওয়ালে। গ্রামের পুকুর, নয়ানজুলি সব উপচে উঠেছে। সব জল এসে মিশছে অঞ্জনা নদীতে। স্রোতে চলে আসছে কত মাছ। সাঁকোর কাছে হাঁটিহাঁটি পায়ে গিয়ে দেখি, সুকুদা (মাস্টারমশাই কৃষ্ণেন্দু দাসের বড়ো ছেলে সুখেন্দু) এক অদ্ভুত পদ্ধতিতে মাছ ধরছেন। বড়ো একটি ছাতা খুলে নিচে মেলে ধরছেন। সাঁকোর দেওয়ালে বড়ো-বড়ো রুই-কাতলা ধাক্কা খেয়ে লাফিয়ে উঠে ছাতার মধ্যে এসে পড়ছে। সুকুদা সঙ্গে-সঙ্গে ছাতা বন্ধ করে উপরে নিয়ে এসে ধরা পড়া মাছ একটা বড়ো স্টিলের বালতিতে রাখছেন। দেখতে-দেখতে বালতি ভরে গেল। সুকুদা চিৎকার করে বলছেন, "খোকন (আমার ডাকনাম), আমাদের বাড়ি থেকে পাটের বস্তা নিয়ে আয়।" আমি একদৌড়ে স্যারের বাড়ি থেকে ডালিমগাছের কাছে পড়ে থাকা দুটো ভিজে বস্তা নিয়ে সুকুদাকে দিয়ে আসি। তারপর সুকুদার নির্দেশে আর এক দৌড়ে আমাদের বাড়ি থেকে ভাঙা একটা টিনের বালতিও নিয়ে আসি। আধঘন্টার মধ্যেই বস্তা ও বালতিতে মাছ ভরে যায়। আমার ভাঙা বালতি দেখিয়ে সুকুদা বলেন, "যা, এ-মাছ তোর। বাড়ি নিয়ে যা।" আমি তো অবাক। এত মাছ আমার! কী করবো এত মাছ দিয়ে! যাইহোক, মাথায় মানকচুর পাতা, হাতে বালতিভর্তি মাছ। শ্রীমান বাড়ি হাজির।  মা, দিদি ও টুনু তো সে-মাছ দেখে অবাক। মা কিছুক্ষণের মধ্যেই নিজেদের জন্য দু-তিনটে মাছ রেখে, বাকি সব মাছ পাড়াপড়শিদের মধ্যে বিলি করে দেয়। সরকারবাড়ির দিদিমাকেও দিয়ে আসি কিছু মাছ।

যেভাবে একটানা অবিশ্রান্ত ধারায় দু-তিনদিন ধরে বৃষ্টি হয়ে চলেছে, তাতে বাদকুল্লায় বন্যার পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। আমাদের বাড়ি গগনবাবুর বাজার ও হাট সংলগ্ন অপেক্ষাকৃত একটু উঁচু জায়গায়। তাই এখানে এখনও জল জমেনি। কিন্তু আমরা আশঙ্কা করছি, অঞ্জনায় জল যেভাবে বেড়ে চলেছে, বৃষ্টি যদি আরও দু'দিন এভাবে চলতে থাকে তাহলে উপচে ওঠা নদীর জল বাজারে উঠে আসবে এবং আমাদের বাড়িও ডুববে। যা-হোক, ভরসা দিদিমা। তিনি ছাতা মাথায় আমাদের বাড়ি এসে মাকে বলেই গিয়েছেন—"স্নেহ, জল ওঠার আগেই ছেলেমেয়ে নিয়ে আমার কাছে চলে আসবি।" সরকারবাড়ি পুরোনো আমলের, খুবই শক্তপোক্ত, উঁচু ভিতের। চুনসুরকিতে গাঁথা দ্বিতলবিশিষ্ট অট্টালিকা। একতলা-দোতলা মিলিয়ে কুড়ি-পঁচিশটা ঘর। দোতলার উপরে চিলেকোঠা এবং প্রশস্ত ছাদ, যেখানে ব্যাডমিন্টনের সাত-আটটা কোর্ট হতে পারে। 

আমি, কেনা আর পূর্ণেন্দু— থ্রি মাস্কেটিয়ার্স বাড়ি থেকে বেরিয়ে জল দেখে বেড়াচ্ছি। বেলা এগারোটা মতো হবে হয়তো; পূর্ণেন্দু বেরোনোর আগে ওদের বাড়ির দেওয়াল-ঘড়িতে সময় দেখে এসেছে। বড়দি (আইভিদি, কৃষ্ণেন্দুবাবুর বড়ো মেয়ে) পূর্ণেন্দুকে (ওরও ডাকনাম খোকন) পইপই করে বলে দিয়েছেন বারোটার মধ্যে বাড়ি ফিরতে, না-হলে নাকি লাঠিপেটা করে ওর পিঠের হাড়গোড় একজায়গায় করবেন! যে যাইহোক, পূর্ণেন্দু যেন কত কথা শোনার ছেলে; দিদি বলেছে, ভালো কথা, ও জলটল মেপে ধীরেসুস্থে ফিরলেই হলো। "পেটে তো সকালে দানাপানি পড়েছে, সে বেলা বারোটার এখনও কয়েক ঘন্টা দেরি আছে; কী বলিস প্রাণেশ?" এই বলে সে আমার দিকে তাকিয়ে ডানচোখ মেরে দেয়। চোখ মারায় সে ওস্তাদ। রেলক্রসিং-এর এপারের রাস্তার উপর দিয়ে জল বয়ে যাচ্ছে। বোঁচকা-বুঁচকি নিয়ে, বাচ্চাদের কোলেকাঁখে নিয়ে প্রচুর নারীপুরুষ আমাদের হাইস্কুলের দিকে যাচ্ছে। সেখানে নাকি ত্রাণশিবির খোলা হয়েছে। স্কুলে পৌঁছে তো আমাদের চক্ষু চড়কগাছ! একতলা, দোতলার সব ঘরে লোক বোঝাই। বারান্দাতেও ভরে এল বলে। বাপুজিনগর, মামজোয়ান, গড়ুয়াপোতার লোকজন প্রধানত। চূর্ণি নদীর উপচানো জল তাদের ঘরবাড়ি ডুবিয়ে দিয়েছে। কেউ-কেউ গরু-বাছুর, ছাগল, মুরগিও নিয়ে এসেছে। আহা, মা ষষ্ঠীর ধন, তারাই-বা যাবে কোথায়! দুর্গন্ধে টেকা দায়। এরই মাঝে স্কুলের পুবদিকের বারান্দায় বড়ো-বড়ো কালো কড়াইয়ে খিচুড়ি রান্না হচ্ছে, বন্যার্ত বুভুক্ষু মানুষের জন্য। দোতলার একটা জানালায় হঠাৎ তাকিয়ে দেখি, একটা বাচ্চা ছেলে হালখাতার রঙিন চিঠি আড়াআড়ি কেটে যে চাকা-ঘূর্ণি হয় না সেই চাকা জানালার শিকে বেঁধে দিয়েছে। হাওয়া লেগে বিষ্ণুর সুদর্শনচক্রের মতো তিনি ঘুরতে লেগেছেন। কেনা তা দেখে বলছে, "যাই দেওয়াল বেয়ে উঠে চাকা খুলে নিয়ে আসি।" আমি কেনাকে বলছি, "যাঃ, বাচ্চা ছেলে, ঘোরাচ্ছে ঘোরাক, ওরটা নিবি কেন!" আমার কথায় ক্ষান্ত না-হলেও, পূর্ণেন্দুর গুঁতোয় কেনা আর এগোয় না। পূর্ণেন্দু বলছে, "হ্যাঁ রে প্রাণেশ, এখানে ক্লাস করবো কী করে আমরা, দুর্গন্ধে অন্নপ্রাশনের ভাত উঠে আসছে মাইরি!" কেনা বলছে, "ধুস, বন্যা কি চিরকাল থাকবে নাকি! জল নামলেই ওরা চলে যাবে। গরমেন্টের লোক এয়ে সব ঘরবারান্দায় বিলিচিন ছেটাবে না?" পূর্ণেন্দু বলছে, "গোমুখ্যু কোথাকার! বিলিচিন না; ব্লিচিং, ব্লিচিং পাউডার।" কেনা বত্রিশ পাটি বের করে বলে, "নে হলো, আমি তোর মতো অত ইনজিরি জানি নাকি! এক ক্লাসে দু'বছর আছি না?" এইসব মুখরোচক জ্ঞানগর্ভ আলোচনা করতে-করতে আমরা তিন বন্ধু জল ঠেলতে-ঠেলতে যে-যার বাড়ির দিকে রওনা দিই। বৃষ্টি আবার তেড়েফুঁড়ে নামলো। আকাশে ঘন কৃষ্ণকালো মেঘের সারি, ময়ূরপঙ্খী নাও যেন সব, পাল তুলে ভেসে-ভেসে চলেছে। বাড়ি ফিরে স্নান-খাওয়া সেরে মন্দিরের পুবদিকের লাল বারান্দায় গিয়ে বসি বইখাতা নিয়ে। অঙ্ক কষার আগে রাফখাতায় একটা ছড়া না-লিখলে চলে! সারাদিনের এত জিয়ন্ত অভিজ্ঞতা। সব মাঠে মারা যাবে নাকি!

ক্লাস সিক্সে ওঠার পর থেকেই সেই বিএ-র তৃতীয় বছর অর্থাৎ পার্ট-টু পরীক্ষা পর্যন্ত রাধাগোবিন্দ মন্দিরের সেই পুবদিকের ঢালু লাল বারান্দা হয়ে ওঠে আমার লেখাপড়ার জায়গা। আর ক্লাস নাইনে যখন পড়ি, তখন থেকে আমি ওই বারান্দায় নিচু ক্লাসের ছাত্রও পড়াতে শুরু করি। একটাকা, দু'টাকা, বড়োজোর পাঁচটাকা প্রতি মাসে পাই ছাত্রপিছু। হাতে কিছু টাকা আসে। মা-কে দিই। সংসারের একটু সুরাহা হয়। নিজের বই, খাতা, কলম ইত্যাদি কিনতে পারি। এই যে টিউশনি পড়াতে শুরু করলাম, তা শেষ হলো স্কুলে শিক্ষকতা করার প্রায় শেষ পর্বে, যখন রাজ্য সরকার (বামফ্রন্ট) আদেশ জারি করলেন যে, স্কুলে কর্মরত কোনো শিক্ষক প্রাইভেট টিউশনি করতে পারবেন না। আমার স্কুলের প্রধানশিক্ষক মহাশয় সেই সরকারি নির্দেশনামার উপরে শিক্ষকদের স্বাক্ষর গ্রহণ করলেন। পরের দিন সকালে ক্লাস ইলেভেনের ছাত্রছাত্রী ছয়-সাতজন পড়তে এল। আমি ওদের বিষয়টি স্পষ্ট করে জানিয়ে বললাম, "তোমরা আর পড়তে এসো না। তবে হ্যাঁ, যখন কোনো অসুবিধা হবে, আমার কাছে এসে বুঝে নিও। পারিশ্রমিকের বিনিময়ে আমি আর পড়াতে পারবো না। মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য-র স্বাক্ষরিত সেই সরকারি নির্দেশনামার ফলে আমার সুবিধাই হলো। আমি সারাজীবন বাড়িতে ছাত্রছাত্রী পড়িয়েছি। তাদের অনেকেই এখন শিক্ষক, অধ্যাপক, বিজ্ঞানী অথবা সরকারি আধিকারিক। কৃতী সবাই। এদের কারও-কারও সঙ্গে আমার এখনও যোগাযোগ আছে। পড়াতে আমার ভালো লাগতো। আমি যে-স্কুলে ২৯ সেপ্টেম্বর ১৯৮৪ থেকে একটানা ৩০ জুন ২০১৩ পর্যন্ত পড়িয়েছি, সেই কালীনগর উচ্চবিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদেরও খুব যত্ন করে ইংরেজি পড়িয়েছি— একথা সবাই স্বীকার করে। কিন্তু ওই যে আমাকে আর প্রাইভেট টিউশনি করতে হলো না, তার ফলে আমি যেন এক নতুন স্বাধীনতা লাভ করলাম! আমার লেখালেখি ও পড়াশোনার জন্য অনেক বেশি সময় পেলাম। এটা খুব সদর্থক ব্যাপার হলো আমার জীবনে। 

কৈশোরকালে অনেকের বাড়ি গিয়েও টিউশনি পড়িয়েছি। একজন অভিভাবক একবার আমার বাড়ি এসে বললেন, "আমার বড়োমেয়ে ক্লাস ফোরে পড়ে। বাংলা ও ইংরেজিতে খুব কাঁচা। তুমি আমার বাড়ি গিয়ে সকালবেলা সপ্তাহে তিনদিন দু'ঘন্টা করে ওকে যদি পড়াও তো ওর উপকার হবে।" আমি রাজি হলাম। মেয়েটিও ওই দুটি বিষয়ে বেশ দ্রুত উন্নতি করলো। সে ক্লাস টুয়েলভ পর্যন্ত আমার কাছে পড়েছিল। পরবর্তী জীবনে সে একটি স্কুলের প্রধানশিক্ষিকা হয়। শিক্ষক হিসাবে চাইতাম, শিক্ষার্থীরা টেক্সট খুঁটিয়ে পড়ে নিজেরা লিখুক। বলেই দিতাম—"নিজেরা লেখো। আমি সেই লেখা সংশোধন করে দেবো, পরিমার্জন ও সংযোজন করবো, কিন্তু লিখতে তোমাদেরই হবে।" মনে হয়, এর ফলে শিক্ষার্থীদের লাভই হয়েছিল। আমি ছাত্র হিসাবে নিজেও তো এই কাজটাই করতাম। কোথাও-কোথাও অবশ্যই সংশ্লিষ্ট শিক্ষকের সাহায্য নিতাম।

আমার বাল্য-কৈশোরে দুর্গোৎসবে আনন্দ হতো খুব। বালকবয়সে আমাদের বাদকুল্লায় মাত্র দুটো বাড়িতে দুর্গাপূজা হতো— সুরভিস্থানে সূর্য ভট্টাচার্যদের বাড়িতে আর পূর্ব বাদকুল্লায় পাঁচু ঘোষের বাড়িতে। ভদ্রলোক কলকাতায় বেশ কিছু সরকারি হাসপাতালে রোগীদের খাবার সরবরাহ করতেন বলে শুনেছি। দুর্গোৎসবে বাড়ি এসে ধুমধাম করে পুজো করতেন। তাঁর দিদি পুঁটি গয়লানি। তাঁর কথায় পরে আসছি। তৃতীয় পুজোটি হতো পূর্ব বাদকুল্লার বারোয়ারিতলায়। খুব প্রাচীন পুজো। ঠাকুরের মূর্তি গড়ার জন্য খড় বাঁধা, তারপর একমাটি, দোমাটি, রঙ লাগানো, বস্ত্র- অলংকার-সাজসজ্জা পরানো, মায়ের চক্ষুদান— সব ক'টি ক্ষেত্রে দর্শক হিসাবে হাজির থাকা আমার, কেনার, পূর্ণেন্দুর ও মহাদেবের অবশ্যকর্তব্য ছিল। 

পুজোয় দিদি আমার ও টুনুর জন্য নতুন জামাকাপড় আনতো। ষষ্ঠী-সপ্তমীতে না-হলেও অষ্টমীতে নিয়ে আসতো দিদি। প্রেসের সপ্তাহান্তিক পারিশ্রমিক পেলে, তবে তো কিনবে! মনে আছে, ক্লাস থ্রি-তে পড়ি যখন, সেবার দিদি আমার জন্য টেরিলিনের সুন্দর একটা হাফশার্ট এবং রেয়নের হাফপ্যান্ট, আর টুনুর জন্য সিল্কের একটা ফ্রক কিনে এনেছিল। বোনকে তো পরির মতো সুন্দর দেখাচ্ছিল সেই ফ্রক পরে! সেবারই বাজারে প্রথম টেরিলিন এসেছে। সেই টেরিলিনের শার্ট পরে মনের আনন্দে অষ্টমী-নবমীতে ঠাকুর দেখতে বেরিয়েছিলাম বন্ধুদের সঙ্গে। দশমীর দিন ওই শার্ট পরিনি। বিজয়াদশমীর আড়ং (মেলা)-এ খুব বাজি পুড়তো বাদকুল্লা বাজারে, যেখানে সব প্রতিমা জড়ো হতো। বাজির আগুনে আমার সাধের জামা পুড়ে যায় যদি, তাই বিজয়াদশমীর বিকালে পুরোনো জামা-ই পরতাম। দশমীর দিন দিদিমা (শৈবলিনী সরকার) নিয়ম করে প্রতিবার আমাকে আর টুনুকে একটা করে চকচকে রুপোর টাকা দিতেন। একটাকায় কতকিছু হতো তখন! আমি সেই টাকা ভাঙিয়ে দু'আনা (একটাকার ১/৮ ভাগ) দিয়ে একঠোঙা গরম জিলিপি কিনে বাড়ি নিয়ে যেতাম। টুনু কাচের চুড়ি, সাজগোজের সামগ্রী কিনতো মেলায়। আড়ং-এর মাঠে ঠাকুরগুলো একটা বৃত্তাকারে বসানো হতো। তার চারপাশে মেলা। কত দোকান!  মনোহারি সামগ্রী, মাটির পুতুল, লক্ষ্মীর সরা, হরেক মিষ্টির দোকান, পাঁপড়ভাজা, খেলনা বন্দুক, ছুরি-কাঁচি, খাপের মধ্যে সত্যিকারের তলোয়ার। লোকে লোকারণ্য! বেলুন উড়ছে। ভেঁপু বাঁশি, আড়বাঁশি বাজছে। একটা লোক মুখ দিয়ে আগুন বের করছে। কী প্রাণবন্ত মেলা! বিজয়াদশমীর মেলা খুব বিখ্যাত ছিল আমাদের বাদকুল্লায়। মা ও দিদি এসে লক্ষ্মীর সরা, শোলার ফুলমালা ইত্যাদি কিনতো এই মেলায়; সামনেই কোজাগরী লক্ষ্মীপুজো হবে বাড়িতে, তাই। দাদাবাবু পাটভাঙা ধুতি-শার্ট পরে মেলায় আসতো ও বাড়ির জন্য মাটির হাঁড়িতে করে রসগোল্লা-পানতোয়া নিয়ে যেত। দুর্গাপ্রতিমা বিসর্জনের পরে এবং পরের ক'দিন দু-একজন লোক যারা বাড়িতে আসবে, তাদের মিষ্টি দিতে হবে তো।

প্রতিমাকে ঘিরে হরেক বাজি পোড়ানো হতো। হাউই, তুবড়ি, রঙমশাল, চকলেট, দোদমা, কালীপটকা বা ধানিপটকা, ছুঁচোবাজি ইত্যাদি। মুগরাইলের নমঃশূদ্ররা তাঁদের প্রতিমার সঙ্গে লাঠি ও সড়কি নিয়ে আসতেন এবং বাজি পোড়ানোর আগে ধুতিতে মালকোঁচা মেরে, কপালে সিঁদুর লেপে, ঝাঁকড়া বাবরি চুল ঝাঁকিয়ে লাঠি ও সড়কি খেলায় ভয়ঙ্করভাবে মেতে উঠতেন। রক্তারক্তি কাণ্ডও হয়ে যেত কখনো-কখনো। দশমীর আড়ং যাঁরা পরিচালনা করতেন অর্থাৎ ব্যবসায়ী সমিতির কর্মকর্তাগণ, তাঁদের মধ্যে মেজোকাকাও থাকতেন— তাঁরা খুব কষ্টে লেঠেলদের নিবৃত্ত করতেন। তারপর গ্যাসলাইট, হ্যাজাক, কার্বাইডের বড়ো-বড়ো ল্যাম্পগুলো জ্বালানো হতো এবং একচালার প্রতিমাগুলো কাঁধে করে সংশ্লিষ্ট পুজোর লোকেরা অঞ্জনার দিকে যেতেন। সঙ্গে সেইসব আলো এবং ঢাক-ঢোল-কাঁসির সম্মিলিত বাজনা। "জয় মা দুর্গা", " দুর্গা মাইকি জয়" ইত্যাদি ধ্বনি দিতে-দিতে নদীতে প্রতিমা বিসর্জন দেওয়া হতো।

বিসর্জনের আগে সিঁদুরখেলা হতো। গ্রামের এয়োতিরা মা দুর্গাকে বরণ করতেন টুল বা স্টিলের মইয়ের উপরে দাঁড়িয়ে। বাড়ি থেকে প্রত্যেকে বরণডালায় সন্দেশ, ফল, সিঁদুরের পাতা বা কৌটোয় সিঁদুর নিয়ে আসতেন। কেউ-কেউ রুপোর সিঁদুরদানিও আনতেন। মা দুর্গাকে সিঁদুর পরাতেন সিঁথিতে এবং মুখে। তারপর মুখে একটুকরো করে সন্দেশ গুঁজে দিতেন। পানের খিলিও দিতেন। অনেক সময় ধরে বিবাহিতা রমণীদের এই সিঁদুর পরানো চলতো। তারপর মা-র সিঁথিতে ছোঁয়ানো সিঁদুর একে অপরকে পরাতেন, সিঁথিতে ও মুখাবয়বে। মা দুর্গার মুখমণ্ডল ও এয়োদের মুখমণ্ডল, সত্যিই সে এক দেখার মতো ব্যাপার হতো বটে! এয়োরা প্রায় সবাই লালপাড় গরদের শাড়ি পরে আসতেন। স্বর্ণালঙ্কারে ভূষিতা সুসজ্জিতা মহিলাদের মা দুর্গার মতোই দেখাতো! এর নাম সিঁদুরখেলা। এই ব্যাপারটা ছিল এক্সক্লুসিভলি মহিলাদের। পুরুষদের কোনো ভূমিকাই ছিল না এখানে। অত্যুৎসাহী দু-একজন তরুণ কখনো-কখনো কোনো মহিলাকে 'কাকি' বা 'বৌদি' সম্বোধনে হয়তো-বা বলে উঠতো, "অল্প করে সিঁদুর পরাও না মাকে। মাকে তো চেনাই যাচ্ছে না!" কে শোনে কার কথা! খিলখিল হাসিতে ভরে যেত জায়গাটা।

কাঁধে করে প্রতিমা নিয়ে গিয়ে নিরঞ্জন প্রক্রিয়া শেষ হতো। জল ছেটাতে-ছেটাতে লোকজন নদী থেকে উঠে আসতো। অতি সাহসী দু-একজন বালক-কিশোর নদী থেকে ঠাকুরের অস্ত্র, সাজসজ্জা দুটো-একটা নিয়ে আসতো। প্রতিমা নিরঞ্জনের পরে শুরু হতো বিজয়ার প্রীতি ও শুভেচ্ছা বিনিময়, কোলাকুলি আর মিষ্টিমুখ। ছোটোরা বড়োদের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতো। আমি মেলাপ্রাঙ্গণ থেকে বাড়ি ফিরে মা, মায়োইমা, দাদাবাবু ও দিদিকে প্রণাম করে সোজা সরকারবাড়ি চলে যেতাম। দিদিমা ও অন্যান্যদের প্রণাম করে বিশাল রোয়াকে বসে কলাপাতায় গরম-গরম ফুলকো লুচি, মিষ্টি কুমড়োর ছক্কা, আলুর দম, ছোলার ডাল, বোঁদে ও রসগোল্লা পেট পুরে খেতাম। কয়েকশো লোকের পাত পড়তো সরকারবাড়িতে ওই বিজয়াদশমীর সন্ধ্যায়। বছরের পর বছর চলতো এটা। সে এক স্বপ্নের মুহূর্ত আমার কাছে। জাতিধর্ম নির্বিশেষে, শ্রেণি নির্বিশেষে মানুষ আনন্দ করে খেতেন। সরকারবাড়ির মেয়ে-বউরা সানন্দে পরিবেশন করতেন। রোয়াকের নিচে কোণায় হালুইকরের লোকজন ময়দা মাখছে, লেচি বানাচ্ছে, বেলছে আর হালুইকর কড়াইভর্তি ফুটে ওঠা ডালডায় লুচি ভেজে চলেছে ঘন্টার পর ঘন্টা। বোঁদে ও অন্যান্য মিষ্টিও হচ্ছে। বড়ো-বড়ো নৌকায় ডাল, কুমড়োর ছক্কা, মিষ্টি পরপর সাজানো রয়েছে। পিতলের বালতিতে ঢেলে নিয়ে পরিবেশনকারীরা পরিবেশন করছে। যে যত পারো, খাও। গোনাগুনতি নেই। দাদু (নলিনীমোহন সরকার) ও তাঁর ছেলেরা, জামাইরা তদারকি করছেন। বলছেন, "এই এখানে লুচি দাও...কুমড়োর ছক্কা চাইছে ওই ছেলেটা; দুলালি ছক্কা নিয়ে আয়।" হ্যাজাক জ্বলছে গোটা দশেক। সারাবাড়ি ঝলমল করছে আলোয়।
[ক্রমশ]




★ প্রথম পর্বটি পড়তে হলে, যেতে হবে এই লিঙ্কে— 
https://www.muktadhara.co.in/2023/08/blog-post_73.html

Comments