নিতাই ভট্টাচার্য


—বাড়িতে একবার যেতে হবে ডাক্তারকাকা। মামা বিছানা নিয়েছে বেশ কয়দিন। দেখে আসবে গিয়ে।
সাতসকালে মানিক ডাক্তারের চেম্বারে এসে দাঁড়ায় সুজিত। বাইরে ধকধক করে শ্বাস নিচ্ছে সুজিতের বাইক। সুজিত ব্যবসায়ী মানুষ। ভীষণ ব্যস্ত।
— কী হয়েছে তোর মামার? জিজ্ঞাসা করে মানিক। 
— অতকথা কি জানি! অনেক রোগ নাকি বাসা বেঁধেছে। তুমি ছিলে না। শহরের ডাক্তার দেখেছিল দিন দশেক আগে। ওষুধ খাচ্ছে। অবস্থার উন্নতি নেই কোনো। কাল রাতে শুনলাম, তুমি ফিরেছো। তাই এলাম। এই নাও রিপোর্টস আর প্রেসক্রিপশন। সময়মতো যেও, আমি চললাম। কাজ আছে।
বাইকের শব্দ তুলে চলে যায় সুজিত।
সুজিতের মামাকে কখনও দেখেছে মানিক। তবে আলাপ-পরিচয় হয়নি। খুব প্রয়োজন ছাড়া বাড়ির বাইরে পা রাখেন না ভদ্রলোক। দুলেবুড়োর কাছে ওঁর কথা শুনেছে মানিক। সুজিতের রেখে যাওয়া কাগজপত্র থেকে প্রেসক্রিপশনটা হাতে নেয়। নাম— কৈলাস সাহা। বয়স তিয়াত্তর। রিপোর্টস আর প্রেসক্রিপশন একপাশে রেখে দেয় মানিক। বেলায় যাবে সুজিতের বাড়ি।

সংবাদপত্রে চোখ রাখে। বিমর্ষতার কালি আঁধার করে মানিকের মন। কী দিন এল! দাঙ্গা আর দাঙ্গা। ধর্ম-ধর্ম করে সব শেষ হয়ে গেল। দেশে যেন দু'টিই শব্দ— হিন্দু আর মুসলমান। অদ্ভুত!
আজ দিন দশ ধরে এপারের সংবাদমাধ্যম গরম হয়ে রয়েছে বাংলাদেশের খবর নিয়ে। ঘটনাটা টাঙ্গাইলের ক্ষিরপাই গ্রামের। পুজোমণ্ডপে বসে গল্পগুজবে মশগুল ছিল জনাকয় বয়স্ক লোক। হঠাৎ বিকট শব্দে বাজি ফেটে ওঠে। আচমকা এমন জোরালো শব্দ শুনে অসুস্থ হয়ে পড়ে গোবিন্দ নামের এক ভদ্রলোক। পাশেই ছিল সত্তরোর্ধ্ব ইয়াসিন। প্রতিবাদ করে। সমস্যা সেখানেই। হিন্দুদের পুজো। ইয়াসিন বলার কে! তাছাড়া প্যান্ডেলে মুসলমান কেন থাকবে! ব্যস। আগুন লাগে মণ্ডপে। সে-আগুন দাবানল হয়ে ছড়িয়ে পড়ে গোটা বাংলাদেশে। 
মানিক টাঙ্গাইলের মানুষ। ক্ষিরপাই গ্রাম সে যায়নি কখনও। কোন ছেলেবেলায় এদেশে এসেছে। তবে সম্পর্কের শিকড়টুকু আজও সরস ও সতেজই আছে। আত্মীয়স্বজন আছে সে-দেশে। যোগাযোগ নিবিড়। প্রতিবছর পুজোর সময় টাঙ্গাইল যায় মানিক। পুজোর কয়টা দিন সেখানে কাটিয়ে ফিরে আসে। এই বছরেও গিয়েছিল। দাঙ্গার জন্য ফিরতে পারেনি সময়ে। আরও কয়দিন থেকে গতকাল বিকেলবেলায় ফিরেছে। 

দিন পনেরো বন্ধ ছিল চেম্বার। সকাল থেকেই রোগীদের ভিড়। সবই জ্বর-সর্দিকাশি। সিজন চেঞ্জ। এর জন্যও ওষুধ খাবে! মানিক রেগে যায় ভীষণ। কেন, গরম জল খাও বারবার। ভেপার টানো। তুলসীপাতা আর মধু খাও। তাতেও না-কমলে, তারপর না-হয় দেখা যাবে। দুটো দিন ধৈর্য ধরো না বাপু। সুস্থ হবার অত কিসের তাড়া! সে-কথা কি শুনবে লোকে! ওষুধই যদি না-দিলে, তুমি কিসের ডাক্তার! সত্যি, লোকজনের মানসিকতা ভেবে অবাক হয় মানিক।

চেম্বার ফাঁকা হয়েছে। কৈলাস সাহার রিপোর্টস দেখতে মনোযোগী হয় মানিক। ইসিজি, সুগার, থাইরয়েড, ইউরিন, লিপিড প্রোফাইল— গুচ্ছের টেস্ট! রিপোর্টে কোনো সমস্যা নেই। বয়স্ক মানুষের যেটা যেমন থাকা উচিত, তেমনই আছে সব। প্রেসক্রিপশনে নজর দেয়। পাতাজুড়ে ওষুধের নাম লেখা রয়েছে। অ্যাংজাইটি কমানোর ওষুধ। ঘুমের ওষুধ। অ্যান্টি-ডিপ্রেশনের ওষুধ। কম ডোজের প্রেসারের ওষুধও দিয়েছে। গ্যাসের ওষুধ। একটা মাল্টিভিটামিন। রোগটা আসলে কী? ভাবে কিছুক্ষণ। না, এইভাবে কি রোগ বোঝা যায়! প্রেসক্রিপশনটার দিকে চেয়ে থাকে মানিক। বড়ো-বড়ো করে ছাপানো রয়েছে ডাক্তারের নাম। ডিগ্রি। 
আজকাল ডাক্তারদের কাণ্ড দেখে হাসে মানিক। ডাক্তার নয় তো, সব এক-একটা পায়রা। সারাদিন উড়ে বেড়াচ্ছে ফড়ফড় করে। এই চেম্বার, সেই চেম্বার, নার্সিংহোম। সময় আছে রোগীকে দেখবার! রোগী এল আর গতের ওষুধ লিখে দিলে। আর সঙ্গে কতগুলো টেস্ট। আরে, কত বড়ো ডাক্তার তুমি! জানো, কত রোগ ওষুধ ছাড়াই ভালো হয়? আগে দু-চারটে কথা বলো রোগীর সঙ্গে। ভেবে দ্যাখোই-না, রোগটা আসলে কোথায়। উপসর্গ দেখে কি সবসময় ওষুধ দিতে লাগে! সব ব্যবসা। পয়সাই শেষ কথা। চিকিৎসা করবার মানসিকতাই নেই।

মানিক অন্যধাতের ডাক্তার। চিকিৎসা করাতে হলে, তোমাকে হাতে সময় নিয়েই আসতে হবে। তিরিশ বছর ধরে এমনটাই চলছে। একটার পর একটা প্রশ্ন ধেয়ে যাবে রোগীর দিকে। কী-কী সমস্যা, ব্যথা কোথায়, ঘুম হচ্ছে কিনা, কী খেতে ভালোবাসে, কী দেখতে ভালোবাসে, পরিবারের সবাই কেমন আছেন, শেষবার জ্বর কবে হয়েছিল, ইত্যাদি। উত্তর শুনবে মানিক। তারপর ওষুধের কথা। তাতে তোমার না-পোষায়, এসো না। এর জন্য মানিককে আড়ালে-আবডালে লোকে 'উকিল-ডাক্তার' বলে। মানিক বলে, "এটাই আমার চিকিৎসার পদ্ধতি।" প্রশ্ন করেই মানুষের মনের খবর পায় সে। চিনতে পারে রোগীকে। নো ইওর পেশেন্টস। সংক্ষেপে কে ওয়াই পি। এমন কত নজির আছে। উপসর্গ নিয়ে রোগী এসেছে। ওষুধ ছাড়াই সুস্থ হয়েছে। বিশ্বাস হচ্ছে না, তাই তো? তাহলে শোনো।
এই তো মাসখানেক আগে গ্রামের দুলেবুড়ো এসেছিল মানিকের কাছে। বলে—"ডাক্তার আর বোধহয় বাঁচবো না গো! বুকের মধ্যে কেমন যেন ধড়ফড় করে। মনটা নেতিয়ে পড়ে আছে। ভালো লাগে না কিছুই। গায়ে বল পাই না। মনে হয়, শুয়েই থাকি। ওষুধ দিয়ে সোজা করে দাও ডাক্তার।"
মানিক হাসে। শুরু করে প্রশ্নপর্ব। কে ওয়াই পি। একটার পর একটা প্রশ্ন ধেয়ে যায় দুলেবুড়োর দিকে। ফাটল ধরায় বুড়োর মনকলসে। কথায়-কথায় ধরা দেয় রোগ। উপসর্গ শরীরে, আর রোগ বর্ধমানে। বোঝো! মেয়ের ঘরের নাতনিকে বড্ড ভালোবাসে বুড়ো। কাছে রেখে মানুষ করেছে ছোটো থেকে। সেই মেয়ের বিয়ে হবে। জামাই নিয়ে গেছে নিজের বাড়ি বর্ধমানে। অভিমানে মন কালো দুলেবুড়োর। গুমরে মরে তাই। সেই থেকেই শরীরে সমস্যা।
মানিক বলে, "দু'দিন নাতনির কাছে থেকে তার বিয়ে দেখে এসো। তারপর যদি প্রয়োজন পড়ে, ওষুধ দেবো।"
বেশ কয়দিন পরে দুলেবুড়ো এসেছিল মানিকের কাছে। বলে, "নাতনির জামাই বেশ ভালো হয়েছে ডাক্তার। সুখী হবে মেয়েটা। তবে কী জানো, পালা গরুর জ্বালা বেশি। নাতনিকে কি ঘরে বসিয়ে রাখলে চলবে!" বুড়ো বুঝেছে।
"কী, লাগলো তোমার ওষুধ?" 
ইতিমধ্যে আরও কয়েকজন রোগী এসে হাজির। একে-একে রোগী দেখা শেষ করে মানিক। এইবার যাবে সুজিতের বাড়ি। ঠিক এইসময় ফোন বেজে ওঠে। কাজের সময় ফোন এলে ভীষণ বিরক্ত হয়। নাঃ, এই ফোন ধরতেই হবে। বাংলাদেশ থেকে মানিকের খুড়তুতো ভাই ফোন করেছে। গতকাল এদেশে পৌঁছানোর পর থেকে, ওদেশের সঙ্গে যোগাযোগ করে উঠতে পারেনি মানিক। তাই খবর নিচ্ছে। কথা বলা শেষ করে রওনা দেয় সে।

বেলা গড়িয়ে এসেছে। লম্বা-লম্বা পা ফ্যালে মানিক। পথে দেখা দুলেবুড়োর সঙ্গে। "কোথায় যাবে, ডাক্তার?" জিজ্ঞাসা করে দুলেবুড়ো। সুজিতের মামার শরীর খারাপের কথা বলে মানিক। "জানি ডাক্তার, জানি। আমার সঙ্গে পরিচয় আছে গো। বড্ড কম কথার মানুষ। এখন কথা বলাও বন্ধ। থম মেরে বসে থাকে। মনে হয়, কে যেন বুকে পাথর চাপিয়ে দিয়েছে। অনেক কথা জিজ্ঞাসা করার পরে আমাকে বলে, বুকে বড্ড জ্বালা। আগুন লেগেছে যেন। মানুষটা ভালো।" চলে যায় দুলেবুড়ো। পা বাড়ায় মানিক।
 
সুজিতের বাড়ি পৌঁছায় মানিক। বিছানায় শুয়ে কৈলাস। নিজের পরিচয় দেয় মানিক। অনিচ্ছায় উঠে বসে কৈলাস। মানিক জানে, শুরুতেই রোগের কথা পাড়লে সমস্যা অজানাই থাকবে। শুরু করে গল্প। খুবই সামান্য কথায় উত্তর দেয় কৈলাস। বাড়ি বাংলাদেশ। অকৃতদার। দিব্যি ছিল সে-দেশে। জমিজমা-পুকুর-বন্ধু—এই নিয়েই কেটেছে জীবনের বাহাত্তরটা বছর। হঠাৎ করেই সুজিতের দুশ্চিন্তা হয় মামার জন্য। বিষয়সম্পত্তি বিক্রি করে এদেশে এনে রেখেছে। এই বয়সে নিজের দেশ ছেড়ে কেউ কি বাঁচে! ধীরে-ধীরে মনের কথা বাইরে আসে। মানিক জানে, আন্তরিকতার পরশে সবকিছুই জানা যাবে। শুরু করে প্রশ্নপর্ব। মানিকের দরদি কথায় বেশ কিছুটা সহজ হয় কৈলাস। 
কৈলাসের নাড়ি দেখে মানিক। প্রেসার মাপে। স্বাভাবিক সব। আলতো করে কৈলাসের হাত ধরে জিজ্ঞাসা করে মানিক, "সমস্যাটা কোথায়, দাদা?"
মনের কথা দু'চোখের ধারাপাতে বাইরে আসে। হাতে হাত রাখে মানিক। ভালোবাসার ছোঁয়ায় গলে মনের বরফ। 
"দেশের কথা ভেবে কষ্ট হচ্ছে, দাদা?" এ-প্রশ্নের উত্তর হয় না। দুইচোখ বানভাসি হয়। কাঁদে কৈলাস। বলে, "দ্যাশে দাঙ্গা লাগসে ডাক্তার। আমার ইয়াসিন আর গোবিন্দ ক্যামনে আছে, কে জানে!" বন্ধুদের চিন্তায় কাতর কৈলাস।
সমব্যথী মানিক। অবাক হয়ে চেয়ে থাকে মানুষটার দিকে।
অশ্রুসিক্ত দৃষ্টি জানালার ওপারে আশ্বিনের নীল-সাদা মেঘের উদাসী আনাগোনা দেখে। বাষ্পরুদ্ধ-কণ্ঠে বলে, "জানো ডাক্তার, মনি হয় আমি, গোবিন্দ, ইয়াসিন, লকাই—সবাই মিইল্যা দুগ্গামণ্ডপে বইস্যা পূজা দেখত্যাছি। তাস পিটত্যাছি। নাড়ু ..."
কত কথা বলে চলে কৈলাস! শোনে মানিক।
"ডাক্তার টিভিতে আমি সব..."
টাঙ্গাইলের সব ঘটনা টিভিতে দেখেছে কৈলাস। ক্ষিরপাই তার নিজের গ্রাম। গোবিন্দ, ইয়াসিন তার পরম আপনজন। দেশের আগুনে মন পুড়ছে কৈলাসের। তাই...
"আপনার বন্ধুদের খবর আমি এনে দেবো। ওদেশে আমার আত্মীয় আছে।" বলে মানিক। 
মানিকের হাত চেপে ধরে কৈলাস বলে, "আমি দ্যাশে ফিরুম ডাক্তারবাবু।" আকুতি কৈলাসের।
"সামনের অগ্রহায়ণ মাসে আমার ভাইপোর বিয়ে আছে। দেশে যাবো। আপনিও যাবেন আমার সঙ্গে।" বলে মানিক।
খুশি কৈলাস। জড়িয়ে ধরে মানিককে। বলে "তইলে আমি আবার বাঁচুম। আর হ্যাইখানে ফিরুম না ডাক্তার, দ্যাশে গোবিন্দ আর ইয়াসিনের কাছে..." 
চোখমুখের চেহারা বদলে যায় কৈলাসের। নিজের দেশ ফিরে পাবার আশা নবপ্রাণ সঞ্চার করে তার মনে। বন্ধু গোবিন্দ আর ইয়াসিনের কাছে বাকি জীবন থাকবে, এইকথা ভেবে শেষ কয়দিনের যন্ত্রণা স্তিমিত হতে উন্মুখ বুঝি। খুশি, ভীষণ খুশি কৈলাস। মানিকের সঙ্গে পায়ে-পায়ে এগিয়ে আসে সদর দরজা পর্যন্ত। 
"আজ চলি। আবার আসবো দাদা। চিন্তা করবেন না। ব্যবস্থা হবে।" বাড়ির পথ ধরে মানিক। 
অকৃত্রিম হাসির রেশ কৈলাসের মুখে। কে বলবে বিছানায় কয়টা দিন মন মুষড়ে পড়ে ছিল মানুষটা! নাও, লাগবে তোমার ভিটামিন, প্রেসার, নার্ভ আর ঘুমের ওষুধ? আরে বাপু, সময় দাও রোগীকে। চেনার চেষ্টা করো।অনেক রোগ এমনিই ভালো হয়। দেশের ডাক্তারদের বলো, নো ইওর পেশেন্টস। কে ওয়াই পি।

Comments