তন্ময় কবিরাজ

আঙ্কল পোজার-কে মনে আছে? জেরোম কে জেরোমের কমিক চরিত্র। খবরের কাগজে উপর বসে নিজেই বেমালুম ভুলে গেছে কাগজ কোথায়। শৈশবের পুজো নিয়ে লিখবো, কিন্তু কী লিখবো? চলে গেলাম ফ্রয়েডের আনকনসাস গলিতে। ছোটোবেলায় মামার বাড়িতে থাকতাম। বাড়ির পাশেই গুপ্তদের পুজো হতো। ছোটোমাসি এসে আপডেট দিত—আজ কাঠামো হলো, কাল মাটি পড়বে, পরশু রঙ হবে, ইত্যাদি-ইত্যাদি। আমরা অপেক্ষা করতাম, কখন চোখ বসবে? মহালয়ার পর আর তর সইতো না। পঞ্চমী চলে এল যে! রাত পেরোলেই কাল ষষ্ঠী। দিদা একটা কাঁচের গ্লাস দিয়েছিল। ওখানে শিউলি ফুল রাখতাম। জলে ভাসতো। তখন বাড়িতে ফুলদানি ছিল না। পুজো মানে নাড়ু, চালভাজা, ঘরে আমতেল। অষ্টমীতে ভোগ খাওয়ানো হতো। সারা গ্রাম ভোগ খেতো। বাড়ি-বাড়ি চাল তুলতো।যার যা ক্ষমতা, সবই দিতো। সেদিনের উত্তেজনা আজও অনুভব করি। তখনও অপু-দুর্গা পড়া হয়নি। তবে শরতের হিমেল হাওয়ায় কাশের বেলি ড্যান্স। শালুকের উপহার দিয়েছি ভালোবাসার কাছে। সে-সব ফ্যান্টাসি যৌবনের ডিপ্রেশন। শুধু ভাবি, ভনের কবিতার সেই লাইন হ্যাপি ডেজ। কবিতার নাম 'দ্য রেট্রিট'।

কবি জয় গোস্বামী লিখেছিলেন, ঘুমিয়ে আছে ঝাউপাতা। রবিঠাকুর কাব্য করেছিলেন, রাতের সব তারাই আছে দিনের আলোর গভীরে। অ্যালবামে ফিরে দেখা শৈশবের পুজো। দেখি, অবনী বাড়ি আছে কিনা? গুপ্তদের কর্তা মরে যাবার পর, বাড়ির মতো পুজোও ভাগ হয়ে গেল। চার ছেলে। বাবা মারা যাবার আগে সবাই একসঙ্গে পুজো করতো। এখন যার পালা, শুধু সে-ই থাকে। পাড়ার ক্লাবের ছেলেরা এসে যোগ দিল। বড়ো ছেলে বললে, "এভাবে পালা করা যায়? খরচ বাড়ছে। পুজো বন্ধ করে দেবো।" ক্লাবের মাথা পাঁচু এল। সাহস দিল। বললো, "নো চাপ, বস। দাদাকে বলে দেবো, সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে। টেনশন লেনে কা নেহি, দেনে কা।" দাদা হলো পার্টির নেতা। দাদা এসেই আমাদের ভাগিয়ে দিল। আমাদের আর রাত জেগে কাগজ কেটে টুনিবাল্ব লাগাতে হয় না। পরিবর্তে দেখলাম, প্যান্ডেলে পার্টির পতাকা। অ্যাড। বিড়ি-সিগারেট থেকে বিমল, পেপসি—সব। লোক খেতে এল। দাদা ঠাকুরের সামনে বসে। গলা জোরে বলছে, "তোমরা যদি আমাকে দ্যাখো, পরেরবার পোলাও হবে।" 'দ্যাখো' মানে পরে বুঝেছি আমি। ভোট দেওয়া। শুধু সুনীল গাঙ্গুলির কিছু কথা মনে পড়ে যায়—কেউ কথা রাখেনি, কেউ কথা রাখে না।

পুজোতে গল্প হতো। গোল হয়ে বসে। সবাই আসতো। তবে চন্দন দেরি করে আসতো। ও যোগ দিত অষ্টমীতে। অপু সুমনের মতো আমিও একদিন জিজ্ঞেস করলাম, "তোদের দোকানে কি অষ্টমীতেও বিক্রি হয়?" চন্দনের বাবার কাপড়ের দোকান। চন্দন উত্তর দিয়েছিল, "আমাদের তো ছোটো কাস্টোমার। মালিক টাকা দিলে তবে আসবে। মাঠে কাজ করে ওরা। ছেলেমেয়ের জন্য একটা করে কেনে।" অপু, সুমন, চন্দন, আমি। আড্ডা চলতো। কারও কোনো স্বপ্ন নেই। একটা কাজ পেলেই হবে। আড্ডাটা নষ্ট হতো যখন কাকু এসে বলতো, "বুবাই আসছে। ও তো খুব বড়ো স্কুলে পড়ে।" বুবাই সেবার আমাদের সঙ্গে ঠাকুর দেখতে যাবে। অপু বারণ করলো, "তুমি ভালো ছেলে। আমাদের সঙ্গে মিশবে না।" বর্ধমান গেলে উল্লাসে নামতাম। তারপর হাঁটা। খুব সুন্দর লাগতো। মানুষের আবেগ। চারদিকে এগরোল, চাউমিন, ফুচকার গন্ধ। প্যান্ডেলে-প্যান্ডেলে মানুষের লাইন। আমরা কোনোদিন লাইনে দাঁড়াইনি। কারও পকেটে তেমন পয়সা নেই। ঝেড়ে খাওয়ায় প্ল্যান। কতবার ভিড়ে ঝেড়ে খেয়ে পালিয়ে গেছি! তবে বর্ধমান গেলে সিঙারা খাবোই। তাও চাঁদা তুলে। স্টেশনটা খুব সুন্দরভাবে সাজায়। পাঁচ কিলোমিটার হেঁটে বসে পড়তাম। দেখতাম, ভিখারি ছেলেগুলো মারামারি করছে। খাবার কাড়াকাড়ি করছে। গায়ে কাপড় নেই। চুলে তেল নেই। অনেকটা 'ম্যাকবেথ'-এর ডাইনিদের মতো। ওরা মানুষ তো? কিছুজন দেখতাম, প্যাকেটের ভিতরে গন্ধ শুঁকছে। পরে জেনেছি, ওটা ডেনড্রাইট। ওরা নেশা করে। পুলিশ তাড়া করছে। কেড়ে নিল ওদের সবকিছু।

মামার বাড়িতে ভোগ খাওয়ায় খুব ক্রেজ। আমরা বালতি করে জল ভরতাম। তখন সবার বাড়িতে পাম্প ছিল না। ভোর থেকে জল তুলতে হতো। আকবর একবার সাহায্য করেছিল। তাতে অবশ্য লাভ হয়নি। পরে পুরোহিত বলেছিল, সব জল ফেলে আবার ড্রাম ভর্তি করতে হবে। কারণ জানতে চেয়েছিলাম। বলেনি। বাজনদার থাকতো নাটমন্দিরতলায়। কাকুর সঙ্গে ওর ছেলেটাও আসতো। আমাদের একই বয়স। নাম—রাম। সুমন একবার বাড়িতে ডেকেছিল লুচি খেতে। কাকিমা রাগ করেছিল। রাম আর আসেনি তারপর। রাম এখন রেলের অফিসার। রামের বোনের সঙ্গে অপুর বিয়ে হলো। আমরা সবাই গিয়েছিলাম। খুব মজা হলো।

অষ্টমীতে খুব  ভিড় হতো। মহিলারা আসতো। আমাদের মনে রাখতে হতো, কোনটা কার ডালা। যার বেশি ফল-মিষ্টি থাকতো, বামুনঠাকুর তার সঙ্গে বেশি গল্প করতো। আশীর্বাদও বেশি করতো। রাতে খেলা হতো। হাঁড়িভাঙা, মোমবাতি জ্বালানো। আমরা নাম দিতাম। কিছু হতাম না। পরে শুনতাম, ক্লাবের দাদার বাড়ির লোকেরাই হবে, কারণ ওরা বড়োলোক। টাকা বেশি দেয়। অপুর বাবার পুজোতে শরীর খারাপ করলো। কলকাতায় ভর্তি হলো। খুব মনখারাপ হয়েছিল সেবার। কাকা আর নেই।

'ডোভার বিচ'-এ পড়ে আছে উলঙ্গ নুড়ি। এলিয়টের মতো বিশ্বাস হারিয়েছি। সুনীলের মতো মন ভালো নেই। ইয়েটসের মতো পালিয়ে যেতে চাই। শৈশবে অনেক দেখেছি। আজ বুঝতে পারি। তাই পুজো মানে এখন বই পড়া আর বেড়াতে যাওয়া। কত মানুষের কষ্ট! মাইকের আওয়াজে চাপা পড়ে যায়। বিবেক ফিরবে না আর। মনে পড়ে শুধু মগনলাল মেঘরাজ কিন্তু পুজোর সময় চুরি করেছিল শিল্প। শিল্প তো আসলে চেতনা। তাই সমারসেট মমের উইলসনের মতো লোটাস এটার্স হতে চাই। ভাগ্যে কী আছে, সে তো টমাস হার্ডি জানে!

Comments