মহুয়া গাঙ্গুলি

'বনেদি' কথাটার মধ্যেই যেন ধূপ-ধুনো-চন্দন লুকিয়ে থাকে। বুনিয়াদি ব্যাপারটা প্রকাশ পায়। যদি সেইভাবে ভাবি, বুনিয়াদি হলো একটা নিজস্বতা, একটা সামাজিক শিক্ষা; বনেদি হলো ঠিক সেরকমই রাজকীয় আর আভিজাত্য বজায় রাখার একটা আলঙ্কারিক বিশেষণ-বোধের অনুভূতির সংস্কৃতি। সুতরাং তার মধ্যে একটা স্বতন্ত্রতা বিরাজ করবেই।

হ্যাঁ, শুরুতেই সেরে ফেললাম আমার অভিব্যক্তি তথা মতামত ইত্যাদি দ্বারা বনেদি বিশ্লেষণ। আমি এরকমই মফস্বল অঞ্চল শ্যামনগরের বনেদি বাড়ির মেয়ে বলে জেনে এসেছি নিজেকে জন্মসূত্রে। কিন্তু প্রথমেই বলে রাখি, এই বনেদিয়ানা বাড়ি নয়, পুরো পাড়া ঘিরে বজায় থাকার মতো একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য ও আনন্দবার্তা বহন করে থাকে। নিজের পাড়া মানেই নিজের গ্রাম তথা বাড়ির পুজো বলেই মনে করতাম। কারণ, আমাদের বাড়ির লাগোয়া আমাদের পাড়ার নাটমন্দির। স্বাভাবিকভাবেই বাড়ির সকলে আমরা নিজেদের পুজো মনে করেই ভীষণ আনন্দ করতাম। যাবতীয় জোগাড় হোক আর পুজোর ভোগ রান্না...প্রতিদিন সকাল থেকে প্রায় সারারাত। মহালয়ার পর থেকেই একটা তোড়জোড় শুরু হতো আমাদের ব্যানার্জিবাড়ির উঠোনেই, আর চারিদিকে শুধু পুজো-পুজো গন্ধ। সাবেকিয়ানার ছোঁয়াটা যেন আজও মনকেমনের জানলা বেয়ে শঙ্খ-উলু-ঢাকের আওয়াজকে বড়ো টানে। ষষ্ঠীর বোধন, বেলতলার পুজো থেকে আমার দাদা-কাকাদের হাত ধরেই পুজো শুরু হতো প্রতিবছরই। আবার সপ্তমীর ভোর। কখনও কাকা, কখনও দাদা বা ছোটোভাইদের কাঁধে চেপে কলাবউ মুখ ঢেকে চলেছে গঙ্গাস্নানে। বাদ্যির আওয়াজ গগনভেদী হয়ে মন তখন আশ্বিনের শিউলিগন্ধে ভরপুর, শিশিরেভেজা ভোর যেন সত্যি এক সাক্ষাৎ দেবীকে সামনে আনার উপকরণের যত উপাচারে ব্যস্ত সময়ের আনন্দ-অনুষ্ঠানের দোলনায় ভাসিয়ে রাখতো আমাদের মনপ্রাণ। আসলে মনের কথাগুলো প্রাণের সাথে আজও এতটাই জড়িয়ে, সেটুকুই মনে হয় আজন্ম এক স্বর্ণস্মৃতি বয়ে বেড়াচ্ছে। যাকে ভাবতে ভালো লাগে, দেখতে ভালো লাগে আর সেই দিনগুলো ফিরে পাবার জন্য আকুলতা জাগে প্রাণে। কিন্তু এখন আমি কলকাতা শহরের আশেপাশে একটু শহুরে জীবনে মানাতে বাধ্য হয়েছি সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে।

হয়তো পুজোতে এখন অনেক থিম নিয়ে মা দুর্গা বসেন। সেখানে যেন প্রাণের ছোঁয়া বড়ো কম। আধুনিক প্রযুক্তির বাহুল্য আর প্রতিযোগিতার বিড়ম্বনা। হ্যাঁ, প্রতিযোগিতাও খুব মজার হয়, যখন সেখানে নিজেদেরকে খুঁজে পাই। এই যেমন ঢাক বাজানো, ধুনুচি নাচ, শঙ্খে ফুঁ....এ তো একদমই পুজোর উপচারে মাখামাখি। এরকম অনেক প্রতিযোগিতার সাক্ষী হতে পেরে আজও কিছু গল্প যেন সত্যের মণিকোঠায় আনন্দ দেয়।

অষ্টমী-নবমীর সন্ধিলগ্নে মায়েদের চোখের জল এক দেখার মতো দৃশ্য। মায়েদের মুখে শুনতাম আর সত্যি-সত্যি মনে হতো, মা দুগ্গার চোখেও জল! এ যেন এক অন্যরকম স্বাদ। অঞ্জলিতে ছেলেদের ওই একদিন কসরৎ চলতো ধুতি নিয়ে আর আমাদের শাড়ি; তবু ওটাই বনেদি পরিবারের এক সাবেকি রীতি। ওইটে‌ ছাড়া অষ্টমীর সকাল ঠিক জমে না।
 
বিসর্জনের দিন যেন ঘরের মেয়ে চলে যাবে বলে কান্নাকাটি— এটাও এক অন্যরকম অনুভুতি। সিঁদুরখেলার দৃশ্য দেখার মতো। পাড়া, পাশের পাড়া‌র যত মেয়ে-বউরা একজায়গায় হওয়া, আর ওই সিঁদুরখেলায় যেন‌ পুরোনো রাগ-অভিমান সব বিসর্জন দিত হাসিমুখে সিঁদুর মেখে।
আসলে আমরা পুজোকে ফেস্টিভ্যাল না-ভেবে, বাড়ির এক উৎসব-অনুষ্ঠান আকারে পালন করতাম। এটাই মনে হয় বনেদিয়ানার বিশেষ বৈশিষ্ট্য।

Comments