জয়া ঘটক

শরৎকাল। বাতাসে পুজোর আমেজ। মা আসবেন। পুজো মানেই স্মৃতির কোলাহল। দেখতে-দেখতে জীবনের অর্ধেকের বেশি সময় কাটিয়ে দিলাম। এখন আর পুজোর জন্য আনন্দ হয় না আর আগের মতো। এখন শুধু স্মৃতির বাক্স খুলে বসা। ছেলের আনন্দ দেখে মনে পড়ে ফেলে আসা দিনগুলোর কথা।

মহালয়ার দিন থেকেই শুরু হয়ে যেত পুজোর জামাকাপড়ের তালিকা তৈরি করা। কোন-কোন পোশাক কোনদিন পরবো, তা নিয়ে তুমুল আলোচনা হতো ভাইবোনদের মধ্যে। বন্ধুরাও থাকতো সে-সব আসরে। আমরা ছয় ভাইবোন। মহালয়ার দিন অন্ধকার থাকতেই সবাই ঘুম থেকে উঠে পড়তাম। যে-বাড়িতে ভাড়া থাকতাম আমরা, সেটা ছিল বিশাল প্রাসাদের মতন। এগারো ঘর ভাড়াটে ছিল সেই বাড়িতে। সকলের সঙ্গেই সম্পর্ক খুব ভালো ছিল। সব ভাই-বোন-দিদি-দাদা-বন্ধুদের সঙ্গে মহালয়ার দিন বের হয়ে পড়তাম। গন্তব্য ছিল ব্রহ্মপুত্র নদের পাড়ে যাওয়া। কোঁচড় ভরা থাকতো শেফালি ফুল দিয়ে। মনে থাকতো অদ্ভুত এক আনন্দের রেশ। যেটা আজ শুধুই স্মৃতির কোলাহল মাত্র!

আমার শহর ধুবড়ির তিনদিক ঘিরে ছিল ব্রহ্মপুত্র নদ আর গদাধর নদী। একটা দিক ছিল শুধু স্থলপথ। নদের পাড়ে গিয়ে দেখতাম, যেন মেলা বসে গেছে! কত মানুষ! অনেকেই তর্পণ করতেন নদের মধ্যে নেমে। আমরা সিঁড়িতে পা ঝুলিয়ে বসে সবকিছুই পর্যবেক্ষণ করে যেতাম। তুমুল আড্ডার পর বাড়ি ফিরে আসতাম। সঙ্গে থাকতো রেডিও। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের চণ্ডীপাঠ না-শুনলে, কিসের আবার মহালয়া! তখন থেকেই শুরু হয়ে যেত পুজোর তোড়জোড়। স্কুলেও ক্লাসের ফাঁকে-ফাঁকে চলতো আলোচনা— কে কী শাড়ি পরবে অঞ্জলি দেওয়ার জন্য। কী-সব দিন ছিল তখন! আজকাল শুধুমাত্র স্মৃতির বাক্স খুলে বসা।

বাবার রোজগার ছিল খুব কম। তবুও ধারদেনা করে সবাইকেই পুজোতে কাপড়, জুতো আর অন্যান্য দরকারি জিনিস সব কিনে দিতেন। মা-র সঙ্গে যেতাম পুজোর বাজার করতে। একবার দোকানদার কাপড় কেনার পর, টাকা পরে দেওয়া হবে শুনে আমাদের ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। মা-র মুখ থমথম করছে। আমাদের চোখ সজল। বাবা সব শুনে কীভাবে যেন টাকা এনে দিলেন মা-র হাতে। মা-র সঙ্গে গিয়ে কাপড়ের দোকান থেকে নিয়ে এসেছিলাম সব কাপড়ের প্যাকেট। শুধু মা-র একটা হাত খুব খালি-খালি লাগতো। দোকানের মালিক মা-র কাছে ক্ষমা চেয়েছিলেন হাতজোড় করে।

যে-পাড়াতে থাকতাম, তার নাম ছিল শান্তিনগর। খুব বড়ো করে দুটো পুজো হতো। একটা পুজো হতো আমাদের স্কুলের সামনে। ক্লাস কী করবো! পুজোর প্যান্ডেল তৈরি করার দিকেই চোখ আর মন পড়ে থাকতো। স্যারের হাতের বেতের মারের দাগ মনে হয় এখনও লেগে আছে! মুছে গেলে যদি সেই দিনগুলোও মুছে যায়, তাই মনের মধ্যেই রেখে দিয়েছি সে-সব দাগ।

এরপর ধুমধাম করে শুরু হয়ে যেতো পুজো। ষষ্ঠীর দিন থেকেই পুজোর মণ্ডপে বসে থাকতাম। কোনো কিছুই যেন মিস না-হয়। মাঝেমাঝে দৌড়ে চলে যেতাম বাড়ি। পেটের ডাক তো ছিলই; তার সঙ্গে ঠাকুমা আর মা-কে সব বলার ইচ্ছেটাও। না-হলে যেন মন ভরতো না!

সন্ধ্যার পর বাবা-মায়ের সঙ্গে আমাদের সব ভাইবোনদের পুজো দেখতে যাওয়ার পালা। বাবা খুব জোরে হাঁটতেন। আমরা পিছিয়ে পড়তাম। নতুন জুতোতে পায়ে ফোস্কা পড়ে একেবারেই যা-তা অবস্থা হতো। তবুও পরেরদিন আবার নতুন উদ্যমে বের হতাম পুজো দেখার জন্য। ধুবড়িতে অনেক পুজো হতো, এখনও হয়। সব না-দেখলে বন্ধুদের কাছে গল্প করবো কীভাবে?

মা দুর্গার হাতভর্তি গয়না দেখে আমার মার শুধু শাঁখা-পলা পরা খালি-খালি হাতটা চোখে ভাসতো। এরপর মা-র হাতে চুড়ি, বালা সবই জায়গা পেয়েছে; কিন্ত সেইসব দিনে আমাদের নতুন কাপড়ের জন্য মার হাত, কান খালি হয়ে যেত—এটা এখনও যেন বুকে গেঁথে আছে।

পুজোতে নতুন কাপড়ের সাথে খাওয়াদাওয়াও হতো হরেকরকম। নানানধরনের মোয়া, নারকেলের নাড়ু, সন্দেশ তো ছিলই; তার সঙ্গে পোলাও, মাংস, পায়েস, আরও কত খাওয়ার জিনিস যে ছিল; বলে বোঝাতে পারবো না! বাবা-মা কোনোদিন আমাদের খাওয়ার আর পড়ার খামতি রাখেননি। দেখতে-দেখতে কেটে যেত পুজোর দিন আর রাতগুলো। অষ্টমীর দিন শাড়ি পরে অঞ্জলি দেওয়ার হিড়িক পড়ে যেত। মা-র শাড়ি, ব্লাউজ ছিল সম্পদ আমাদের। শাড়ি তো পরতাম, কিন্তু সামলানোর ঠ্যালা আমরাই বুঝতাম। দশমীর দিন ছিল পুজোর বাটা ছোঁয়ানোর পালা। কে ভিড় গলে সকলের আগে মা দুর্গার কপালে থালা ছোঁয়াবে, সেটা রীতিমত যুদ্ধের মতন ছিল। সরস্বতীর পায়ে বই ছুঁইয়ে ফুল-বেলপাতা সংগ্রহ করা, তাও সকলের জন্য, সেটা রীতিমতো বীরত্বের কাজ ছিল। মা পারতেন না। আমরা ছোটোরা ঠিক ভিড়ের ভেতর গলে পৌঁছে যেতাম দেবীর কাছে। 

পুরোহিত যখন দর্পণ বিসর্জন দিতেন, তখন কেঁদে দিতেন। মা দুর্গার চোখও যেন ছলছল করতো। মা-র ছেলেমেয়েদের চোখেও জল দেখতাম। কথিত আছে, মা দুর্গার দুইগালে পান ছুঁয়ে সেই পান খেলে মুখ খুব সুন্দর হয়। পান ছোঁয়ানোর জন্য যুদ্ধ লেগে যেত মেয়েদের মধ্যে। কী-সব দিন গ্যাছে আমাদের তখন, আজকালকার ছেলেমেয়েরা তা বুঝতেই পারে না! বিকেলবেলা সবাই বড়োরাস্তার মোড়ে এসে দাঁড়িয়ে থাকতাম। একশোটার মতো পুজো হত ধুবড়িতে। বিসর্জনের দিন দুপুর থেকেই ট্রাকের লাইন পড়ে যেত। প্রত্যেকটি ট্রাকের আগে ক্লাব বা পাড়ার ছেলেমেয়েরা ঢাকের সাথে সাথে নাচতে-নাচতে যেত। গন্তব্য পাহাড়ঘাট। ব্রহ্মপুত্র নদের পাড়কে তখনকার লোকরা পাহাড়ঘাট বলেই জানতো। সবাই যেতাম নদের পাড়ে। এই সেই নদ, যেখানে 'মনসামঙ্গল'-এর নেতা ধোপানি কাপড় কাচতেন। কথিত আছে যে-বিশাল পাথরটির ওপর তিনি কাপড় ধুতেন সেটা সোনা, মণিমাণিক্য দিয়ে বাঁধানো ছিল। এখন শুধু বিশাল সেই পাথরটিই শুধুমাত্র আছে। অর্ধেক জলের মধ্যে, বাকি অংশ সিভিল কোর্টের পেছনে দাঁড়া করানো। ধুবড়ি ঐতিহাসিক শহর। এখনও বহু মানুষ আসেন বাইরের থেকে, ধুবড়ির ঐতিহাসিক অঞ্চল দেখতে। নদের পাড়েই অবস্থিত পাঁচ পিরের দরগা। এরও অনেক ঐতিহাসিক তথ্য আছে। আসামের ইতিহাস বইতে ধুবড়ির নাম এসবের জন্য বিখ্যাত। 

শহরের সব মানুষ নদের পাড়ে পাথরবাঁধানো ঘাটে বসে দেখতেন বির্সজন। সম্পূর্ণ নদের মধ্যে বড়ো-বড়ো নৌকায় দেবীমূর্তি নিয়ে চলতো নানানরকম খেলা, নাচ, গান ইত্যাদি। সন্ধ্যার মধ্যেই বির্সজন হতো। প্রথম বির্সজন দেখেই নদ থেকে বোতল ভর্তি করে জল নিয়ে বাড়ির পথ ধরতেন অধিকাংশ মানুষ; হাতে গরম-গরম জিলাপি ও অন্যান্য মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে। ঘরে এসে নদের সেই পবিত্র জল সকলের মাথাতে, ঘরের সব কিছুতেই ছিটিয়ে দেওয়া হতো। তারপর বড়োদের প্রণামের পালা। শুধু নিজের ঘরে না, বাড়ির সবার ঘরেই আমরা সবাই যেতাম প্রণাম করতে। বেশি উৎসাহ ছিল ভোজনের দিকে! কত মিষ্টি খেতাম! আজকাল মোটা হওয়ার ভয়ে মিষ্টির থেকে শতহাত দূরে থাকার চেষ্টা করি।

নদের পাড় থেকে এসে সবাইকে প্রণাম করে, যেতাম মণ্ডপে। খালি মণ্ডপ যেন খাঁ-খাঁ করতো মূর্তির বিরহে। ওখানে বেলপাতাতে মা দুর্গার নাম লিখতাম আমরা সবাই তিনবার করে। তারপর পুরোহিতমশাই মাথায় ঘটের জল ছিটিয়ে দিয়ে আর্শীবাদ করতেন আমাদের। হাতে দিতেন ক্ষীরের অমৃতি। বেশ বড়ো আকারের। রাতে যখন শুতে যেতাম, সবকিছু শেষ হওয়ার পর নিজের অজান্তেই চোখ থেকে কী এক বেদনায় জল পড়ে যেত। চুপচাপ, নিঃশব্দে কাঁদতাম। আমি জানতাম, দাদা-দিদি-বোন-ভাই সবারই একই অবস্থা। কেউ কাউকে বুঝতে দিতাম না। কী এক কষ্ট যেন দলা পাকিয়ে থাকতো বুকের ভেতর। ঠাকুমার বুকে মুখ লুকিয়ে কাঁদতাম নিঃশব্দে। স্বজন হারানোর কান্না যেমন, তেমনই। শেষ হয়ে যেত প্রত্যেকবারের পুজো এভাবেই। 

বেশ কয়েক বছর হলো ধুবড়ি যাওয়া হয় না পুজোর সময়। ঠাকুমা, বাবা তো কবেই চলে গেছেন আমাদের ছেড়ে। দাদা, ছোটোভাইও অকালে চলে গেছে। দিদির মেয়ে ডিম্পি অপেক্ষা করে থাকতো আমার জন্য। ওকেও গায়ে আগুন দিয়ে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে এই পৃথিবী থেকে। বাবা বসে থাকতেন রাস্তায় চোখ বিছিয়ে, কখন তাঁর জয়সুন্দরী পরিবার নিয়ে যাবে বাপের বাড়িতে। বাবার সঙ্গে শেষ দেখাও সেই পুজোর সময়েই। এখন আর অপেক্ষা নেই। আবাহন নেই। আছে শুধু বিসর্জনের ঢাকের শব্দ। আর আছে স্মৃতির কোলাহল-ভরা বাক্স। ওটুকুই এখন সম্বল। বাকি সব তো মৃত্যুর নামতা মাত্র!



Comments

Post a Comment