তখন প্রায় অনেক গ্রামেই যাত্রাদল ছিল। পুজোর আগে মাসখানেক ধরে রিহার্সাল চলতো। গ্রামেরই কেউ-কেউ বাঁশি বাজাতে পারতো। কেউ-বা হারমোনিয়াম। মুচিপাড়ায় দু'একজন সানাই ও ঢোলবাজিয়ে ছিল। সাধারণত বিয়ের অনুষ্ঠানে তাদের ডাক পড়তো। এদেরও যাত্রায় নেওয়া হতো। গ্রামেরই কোনো আগ্রহী শিক্ষিত, হয়তো পেশায় প্রাইমারি স্কুল-মাস্টার, যাত্রাদলের পরিচালক হতো। আমাদের বাড়ির বৈঠকখানায় একটা ঢাউস কাঠের বাক্সে যাত্রার পোশাকআশাক, দাড়ি-গোঁফ, মেয়েদের বড়ো-বড়ো চুল, টিনের তলোয়ার, ঢাল ইত্যাদি থাকতো। আমরা ছোটরা ওই বাক্স বিষয়ে বিশেষ কৌতূহলী ছিলাম। ছেলেরাই ফিমেল অভিনয় করতো। তবে যার নাম হয়তো মধু বা মাধব, ফিমেল অভিনয় করার পর তার হয়তো দ্রৌপদী বা সীতা ডাকনাম হয়ে যেত। এই কারণে ফিমেল অভিনেতা কেউ হতে চাইতো না।
যাইহোক, এখন আর গ্রামে যাত্রাদল গড়ে ওঠে না। ছয়ের দশকেও বহু গ্রামেই নিজস্ব যাত্রাদলের অস্তিত্ব চোখে পড়েছে। বাহাত্তর সালে বন্ধু গল্পকার শান্তিনাথ, অধ্যাপক শতঞ্জীব রাহা ও আমি আমাদের গ্রাম তিলকপুরে দুর্গাপুজোর সময় একদিন গিয়ে পড়েছিলাম। আমাদের গ্রামের অনেকেই আর্মিতে কাজ করে। পুজোর সময় তাদের উদ্যোগে একটা যাত্রানুষ্ঠান আয়োজিত হয়েছিল। আমরা তিনজন সেই যাত্রা দেখেছি। অভিনয়ে এক রাজার লাম্পট্যের দৃশ্য। রাজা কাঁচের গ্লাসে মদ্যপান করছে এবং নারীবেশী দু'জন ছেলে বাইজির নৃত্য করছে। শান্তি আমার কানে-কানে বললো, "দ্যাখ, রাজা সত্যিকারের মদ খাচ্ছে! আমাদের একটু ম্যানেজ করতে হবে।" ম্যানেজ হয়েছিল। আগে গ্রামের কোনো ধনীলোক শহরে এসে গোপনে হয়তো মদ্যপান করতো। তবে আমাদের গ্রামের আর্মির চাকরি করা যুবকরা খোলাখুলি মদ খাওয়ার সূচনা করেছে। এখন গ্রামের কাছেই সরকারি মদের দোকান!
ছোটোবেলার দুটো স্মৃতি দিয়ে শেষ করছি। একবার ফিমেল অভিনেতার শাড়ি আমার মায়ের কাছ থেকে নিয়ে যায়। যখন ফিরিয়ে দেয়, দেখা গেল শাড়িটিতে অসংখ্য বিড়ির পোড়া দাগ! মা বকাবকি করে আর শাড়িটা ফেরত নেয়নি।
আমি তখন হয়তো থ্রি-তে পড়ি। ঠান্ডা লাগবে, এই আশঙ্কায় মা রাত্রে যাত্রা দেখতে যেতে দিত না। বহুকষ্টে অনুমতি পেয়ে যাত্রা দেখতে যাই। রাম-রাবণের যুদ্ধ ছিল। সম্ভবত 'রামের বনবাস'। হ্যাজাকের আলোয় জমে উঠেছে যাত্রাপালা। রাম "ভাই লক্ষ্মণ...ভাই লক্ষ্মণ..." বলে চিৎকার করছে। কিন্তু লক্ষ্মণ আর আসে না! অনেকটা সময় পরে আলুথালু লক্ষ্মণের প্রবেশ। রাম প্রচণ্ড ক্রুদ্ধ হয়ে লক্ষ্মণকে প্রবলভাবে চপেটাঘাত করতে শুরু করে। ছোটোবেলায় বিষয়টা বুঝতে পারিনি। ফেরার পথে এক তুতোদাদার কাছে জানি যে, লক্ষ্মণের বড়ো-বাইরের ডাক এসেছিল। থাকতে না-পেরে, কাছেই এক মাঠে যায়। বর্ষার জল মাঠের খানাখন্দে ছিল। কিন্তু পোশাক কাদামাখা ও আলুথালু হয়ে গিয়েছিল!
সাতের দশকেও দেখেছি, কৃষ্ণনগর হাটের পাশে একটা দোকানে সাইনবোর্ড ছিল—"এখানে যাত্রার পোশাক ও ফিমেল অভিনেত্রী পাওয়া যায়"। সাতের দশকেই শুরু হলো কলকাতার বড়োবাজারের, চিৎপুরের যাত্রা কোম্পানির রমরমা। শান্তিগোপাল। খবরের কাগজে পাতাভরা বিজ্ঞাপন। গ্রামে বড়োপুজোয় যাত্রা দেখা আর চোখে পড়ে না।
Comments
Post a Comment