তপন মাইতি

শরতের একফালি মেঘ হঠাৎই সব নীল মুছে দিল। গ্রাম থেকে শহরে প্রথম ছেলেটার। প্রথম ট্রেন-ট্রাম-মেট্রো চড়া। কলকাতায় সল্টলেকে কাকুর ফাইভ স্টার হোটেলে থাকা। এত ভিড়ভাট্টা, লোকজন। মিনিস্কার্ট ছোটো পোশাক কেমন যেন তার কাছে বেখাপ্পা। মুহূর্তের মধ্যেই কেমন যেন ম্লান হয়ে গেল। মনে পড়ে গেল সেই উপন্যাসী ঢঙ। এই তো সেই আদিবাসী কলেজের মেয়েটা। ঠিক কী যেন নাম তার...হ্যাঁ, মনে পড়েছে, আকাঙ্ক্ষা। বলতে-বলতে ষষ্ঠী জুড়ে নূপুর বাজিয়ে বৃষ্টি নামলো। গভীর কণ্ঠে 'রক্তকরবী' নাটকের মতো। কলেজে সেদিন যেতে-যেতে ছাতার ভেতর বলেছিল, "বৃষ্টির পর ঠান্ডা হাওয়াটা কেমন যেন শীত-শীত করছে। তোর দামি জামাটা দে না!" তাকে দিতে উদ্যত হওয়ায়, ফেরত দিল। বললো, "লাগবে না। দেখছিলাম, তুই দিস কিনা।" বাতাসে তখন শরতের উপন্যাস-উপন্যাস ভাব।কোত্থেকে হুড়মুড়িয়ে বুড়ো দাদুর হাওয়া কানে-কানে ফিসফিস করে বললো, "দ্যাখ দাদু, শহুরে হাওয়া একদম গায়ে লাগাবি না। শহুরে হাওয়া আর সরু চালের ভাত পেটে পড়লে অনেক পরিবর্তন হয়ে যাবি। বুঝতে পারবি না দাদু।" দেখতে-দেখতে বৃষ্টি সব কিছু ধুয়ে সাফ করে দিয়ে, কোন পাড়ায় উধাও হলো কে জানে! যেন এতক্ষণ কিচ্ছুটি ঘটেনি। কিচ্ছুটি জানে না। তারপর মেঘটা ক্রিম মেখে ছিপছিপে ফরসা হলো। মেক-আপের বহরে বয়স ধরা গেল না। তারপর মহাসপ্তমীতে ঠাকুর দেখতে বেরোলো। দীর্ঘ লাইন। তীব্র রোদ। ঘুরতে-ঘুরতে মহাঅষ্টমীর ভোর হয়ে এল। কিন্তু মনের মধ্যে বিপরীত প্রতিক্রিয়া। আমাদের আকাঙ্ক্ষার আঁচলে শিউলিফুল আছে। ভোরে শিশির-দূর্বার উপর হাঁটা আছে। উচ্ছ্বল প্রাণবন্ত আছে। আমাদের গ্রামে শরৎ আছে। কাব্য-উপন্যাসে আছে। কথার কথায় কথা রাখা আছে। হারিয়ে যাওয়া আছে। পালিয়ে যাওয়া আছে। বুড়িয়ে মুড়িয়ে কুড়িয়ে ফুসলে নিয়ে যাওয়া আছে। প্রেমে পড়ে হাত কেটে নাম লেখা আছে। মন ভাঙলে, পরীক্ষায় খারাপ রেজাল্ট আছে। লোডশেডিং আছে। আমাদের যেমন একটা শরৎ আছে, কলকাতা শহরের তেমন একটা শরৎ আছে। শরতের একফালি মেঘ হঠাৎই সব নীল নিয়ে নিলেও, কলকাতায় বসে নীল ডায়েরির পাতায় লেখা আছে। প্রথম পাতার প্রথম ছবি শরতের ছাতিমফুল আর আকাঙ্ক্ষার জীবনের প্রথম শরৎকাল।আর কলকাতা শহরে প্রথম শারদীয়া উৎসবের উপলব্ধিটাই আলাদা। অনুভবে যতটা বুঝলাম, কলকাতার ভেতরে আছে অনেক কলকাতা। যত দেখছি, অবাক হয়ে যাচ্ছি; এখানে কত মুক্ত স্বাধীনতা আছে। তোমার ইচ্ছেমতো অনেক কিছু করবার এবং করাবার আছে। জীবনের প্রথম শহুরে পুজো, তা আবার কলকাতার মতো শহরে; ভাবা যায়! সে আমার প্রথম প্রেমের মতো কলকাতার পুজোর স্মৃতি। 

Comments