অদিতি ঘটক

আমাদের দুটো বাড়ি। একটা বাবা-মায়ের চাকরিসূত্রে কলকাতা শহরতলি ঘেঁষা, আর একটা দেশের বাড়ি। ছোটোবেলায় এই দেশের বাড়ি যাওয়া আমাদের একটা অবশ্যকর্তব্যের মধ্যে পড়তো। প্রতিবছর নিয়ম করে গ্রীষ্ম আর পুজোর ছুটিতে দেশের বাড়ি যাওয়া বাধ্যতামূলক। আমাদের খুব আনন্দ হতো। সেই কু-ঝিকঝিক ট্রেনে করে আমরা সবুজ-হলুদ ধানক্ষেত, টইটুম্বুর হাওয়ার বিলিকাটা পুকুর বা পদ্ম-শাপলাভরা সরোবর, পাট চোবানো ছোটো খাল, কাশবনের চরজোড়া নদী, শান্ত-স্নিগ্ধ গ্রাম দেখতে-দেখতে যেতাম। মেঠো গ্রাম্য জীবনের টুকরো-টুকরো কোলাজ, লাইনধার ছোঁয়া গঞ্জ, রক্ষীবিহীন মেঠো রাস্তার লেভেলক্রসিং ছবির মতো উঠে আসতো। আসলে, আমাদের দেশের বাড়ি ছিল অনেক দূর। ব্যান্ডেল থেকে কাঠের সেই পুরোনো গাড়িতে চেপে যেতে হতো চার ঘণ্টা। একটাই ব্রডগেজ লাইন। ডাউন ট্রেন এলে, ট্রেন দাঁড়িয়ে যেত দু-তিনটে স্টেশন আগে। সেই ট্রেন এই স্টেশনে পাস হবে, তবে আমাদেরটা নড়বে। কোনো-কোনো স্টেশনে জল নেওয়ার জন্য দাঁড়াতো। আরও পাঁচটা লোকের মতো বাবাও তখন নেমে টিউবওয়েল থেকে জল ভরে আনতো। আমরা উৎকন্ঠা নিয়ে প্রহর গুনতাম, এই বুঝি ট্রেন ছেড়ে দিল! বাবা বোধহয় উঠতে পারলো না! বাবাকে কামরায় উঠতে দেখলে, ধড়ে প্রাণ আসতো। ট্রেন স্টেশনে ঢোকবার সময় বা ট্রেন থেকে স্টেশনে নেমে, ইঞ্জিন দেখা একটা রোমহর্ষক ব্যাপার ছিল। কয়লার ইঞ্জিনে কয়লা ছুঁড়ে দেওয়া লোকগুলোকে সুপার হিরো ছাড়া কিছু মনে হতো না। জ্বলন্ত আগুনে কয়লা ছুঁড়তো, জল নিত। ক্রসিং, পাস—এই করে সময়  আরও বাড়তো। বাড়ি থেকে বেরোতাম রাতের অন্ধকার থাকতে আর পৌঁছতাম প্রায় দুপুর গড়িয়ে। পুজোর সময় ব্যাগভর্তি নতুন জামাকাপড় নিয়ে আমরা মহানন্দে দেশের বাড়ি যেতাম। সেই সময় খুব বেশি হলে দুটো নতুন জামা। আর বরাত যদি খুলে যেত, তাহলে তিনটে অবধি গিয়ে গাড়ি আটকে যেত। তাই-ই আমাদের কাছে প্রচুর ছিল। দাদু, ঠাকুমা, দুই কাকা, পিসি, গরু-বাছুর, ঠাকুমার হাতে তৈরি ফুলবাগান, সবজিবাগান, তালগাছ, খেজুর গাছ, কুলগাছ, আমড়া গাছ, নাম-না-জানা আরও কিছু গাছ, ভারেন্ডা, শুশুনি, নোটেশাক, খিড়কিপুকুর—সব নিয়ে আমাদের দেশের বাড়ি সরগরম। আমরা যাওয়াতে তা জমজমাট হয়ে যেত।

কাটোয়া লাইনের ট্রেনে যারা গেছে তাদের অভিজ্ঞতা আছে, হিরে থেকে জিরে সবই ট্রেনে ওঠা থেকে হকারদের হাঁকাহাকি নামা পর্যন্ত বজায় থাকতো। দাঁত মাজার মাজন থেকে তা হজমিগুলি হয়ে শেষ হতো। মাঝে থাকতো ছোলাসেদ্ধ, ডিমসেদ্ধ, বিভিন্নধরনের লজেন্স, দিলখুশ, শোনপাপড়ি, ডাব, গুড়কাঠি, শসা ও বিভিন্ন ফল। প্যাকেট করে বেল বা দইয়ের ঘোল। আর 'জলখাবার' বলে একটি বস্তু বিক্রি হতো তখন। বড়ো-বড়ো ডেকচি মাথায় লোকগুলো আসতো গরম-নরম ডালপুরি, সঙ্গে তরকারি ও মিষ্টি; মানে রসগোল্লা। ওদের কাঁধে ঝোলানো থাকতো একটা গোল সরু ছোটো বাঁকানো নল ফিট করা টিনের গোল বড়ো কৌটো। তাতে থাকতো জল। "খাবার, খাবার..." করে লোকগুলো হাঁকতো। ওই খাবার আমাদের যেন ট্রেনে উঠলে খেতেই হবে! একটা অলিখিত নিয়ম বোধহয় আমরা তৈরি করে নিয়েছিলাম। আমরা ছোটো ছিলাম, তাই স্টেশনে নেমে বা বড়ো কোনো জায়গা থেকে জল খেতে পারতাম না। ওই লোকগুলো সেই কৌটো থেকে জল আমাদের মুখে ঢেলে দিত। ঠিক তারপরেই উঠতো পেতলের থালায় সাদা কাপড় ঢাকা দেওয়া মনোহরা। তাছাড়া গামছা, নানা কভার, সেফটিপিনের হরেক মাল, বাচ্চাদের বই, ব্যাথার মলম, তেল...যেন ট্রেনটা হকারদের জন্যেই! একজনের ঘাড়ের উপর আর একজন হেঁকে যাচ্ছে। সিটের মাঝের প্যাসেজ সর্বক্ষণ ওদের দখলে। এইভাবে কান ঝালাপালা করে চতুর্থী বা পঞ্চমীর দিন রিকশায় প্রায় চল্লিশ মিনিট চেপে দেশের বাড়ি পৌঁছনো। হাত-মুখ ধুয়েই দেখে আসা, ঠাকুর গয়না পরেছে কিনা। তাঁর হাতে অস্ত্র উঠেছে কিনা। আমাদের বাড়ির গলি পেরিয়ে বাঁদিকে একটু বাঁক নিলেই বুড়িমাতলা। সেখানে মাটির চালাঘরে মা দুর্গার মৃন্ময়ীমূর্তি। তিনিই আমাদের বুড়িমা। জায়গাটা বুড়িমাতলা। আমাদের পাড়াতে ঢুকতেই একটি বিরাট বড়ো দালানবাড়ি। সেখানে ঠাকুরের নিত্যপুজো হতো। আরতির সময় প্রতিদিন ঢং-ঢং করে কাঁসা বাজতো। দুর্গাপুজোর সময় সেখানেও মন্দিরের ভেতর মৃন্ময়ী দুর্গামায়ের পুজো হতো। তবে আমাদের ভালো লাগতো এই সাদামাটা বুড়িমাকে। তাঁর নতুন বেনারসি, নাকের নোলক, টায়রা-টিকলি খুব প্রাণবন্ত লাগতো। মন্দিরের খিলানের আড়াল থাকতো না। মা ওই দালানবাড়ির থেকে একটু বেশি উচ্চতার হতেন। নতুন জামা পরে কতবার যে যেতাম-আসতাম, তার ঠিক নেই। বড্ড দুঃখ লাগতো অসুর বেচারার জন্য। মনে হতো, পুরো পুজোটা ওকে শুয়ে রক্ত ঝরিয়ে কাটাতে হবে। সবাই কী সুন্দর সেজেগুজে মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে। বেচারার কোনো নতুন জামা নেই। অষ্টমীর সকালবেলা উপোস করে অধীর হয়ে অপেক্ষা করতাম, কখন পুষ্পাঞ্জলির ডাক পড়বে। পুষ্পাঞ্জলি দিলে, প্রসাদ খেয়ে তবেই লুচি খেতে পারবো। নবমীর রাতে মায়ের মুখে পড়তো বিষণ্ণতার ছায়া। আমরা বিকেলে সেজেগুজে গ্রামের আশেপাশের পাড়ার অথবা বাড়ির ঠাকুর দেখতে বার হতাম। ঘুরেফিরে বুড়িমাকে দর্শন করে, ভারাক্রান্ত মনে বাড়ি আসতাম। দশমীর রাতে আঁধারজমা পাড়াগাঁয়ে আলোর রোশনাই এসে পড়তো। হ্যাজাক, টিউবলাইট দিয়ে সাজানো প্রসেশন বের হতো। গোটা গ্রাম ঘুরে তারপর বিসর্জন। বড়ো-বড়ো শুঁড় তোলা ঢাকের আওয়াজে সরগরম হয়ে উঠতো চতুর্দিক। ঢাকিরা গোল হয়ে নাচতে-নাচতে ঢাক বাজাতো। কেউ ধুনুচি নাচ নাচতো। কতরকম সঙ সাজা লোক সঙ্গে যেত। কেউ রণপা পরে হাঁটতো। সাইকেলভ্যানে প্রতিমা চাপানো থাকতো। ছোটো জেনারেটর দিয়ে টিউবলাইট জ্বালানো হতো, অপেক্ষাকৃত পয়সাওয়ালা বারোয়ারি বা বাড়ির পুজোর প্রসেশনে। একাদশীতে আবার নিস্তরঙ্গ নিত্যনৈমিকতায় ডুবে যেত পাড়াগাঁ। আমরা দ্বাদশী কি ত্রয়োদশীর দিন রওনা দিতাম মামাবাড়ি। ন্যারোগেজ ট্রেনে চেপে একঘন্টা কাটিয়ে, রিকশা করে মিনিট পনেরো গিয়ে পৌঁছতাম মামাবাড়ি। মামাবাড়ির পুজোর জামাকাপড় দেওয়া হতো তখনই। সবাই মিলে হইহুল্লোড় আনন্দ করে লক্ষ্মীপুজোর ভোগ খেয়ে একদিন থেকে, আবার ফিরে আসতাম আমাদের দেশের বাড়ি। সেখানে আবার ক'দিন কাটিয়ে, তারপর আবার সেই কু-ঝিকঝিক গাড়ি ধরে আমাদের দ্বিতীয় বাড়ি। এই রুটিন আমাদের চলেছিল কয়লা থেকে ডিজেল ইঞ্জিন হয়ে ইলেকট্রিক ট্রেন হওয়া পর্যন্ত। শেষের দিকে আমরা বড়ো হয়ে উঁচু-উঁচু ক্লাসে ও সরকারি নিয়মে ছুটি কমে যাওয়াতে, আমাদের যাওয়া অনিয়মিত হয়ে পড়ে। পুজো এলেই এখনও আমাদের গ্রামের পুজো স্মৃতির পটে ভেসে ওঠে।

Comments