ফেসবুকে একটা ক্যাপশন এখন প্রায়ই ঘোরাঘুরি করে— "উমা আজও শ্বশুরবাড়ি থেকে বাপের বাড়ি আসে, আর বাপের বাড়ি থেকে শ্বশুরবাড়ি ফিরে যায়। আগামী বছরে যেন তার নিজস্ব ঘরে গৃহপ্রবেশ ঘটে।" একবার মনে- মনে ভাবলাম, ভাগ্যিস উমার নিজের কোনো বাড়ি নেই! নইলে সারাবছর অপেক্ষা করে থাকা মর্ত্যবাসীর শ্রেষ্ঠ উৎসবটাই হতো না। উমার যদি একান্তই নিজস্ব একখানা বাড়ি হতো, তাহলে তো এই শরতে নিজের বাড়িতে বসেই একাই আপনমনে ছুটি কাটাতো। আর আমরা বছরের এই পাঁচখানা দিন রোজকার মতোই কাটাতাম। সত্যি, সবসময় নিজের, শুধু নিজের সবকিছু থাকাটাও সুখের হয় না!
উমা তার বাপের বাড়ি আসে, যেখানে গোটা সংসার তার অপেক্ষায় থাকে; তার আসার আনন্দে আমাদের চারপাশ সেজে ওঠে। বছর ঘিরে এই অপেক্ষার সঙ্গে জড়িয়ে থাকে শুধু বাঙালির আবেগ আর মন। কাশবন সাজে নদীর ধারে। মা আসছে, শিউলির সুবাস বাতাসে তার আগমনীর বার্তা আনে। তবু যদি মায়ের এইসব নিজের না-হয়, তবে নিজস্বতা কোথায়! কিছু জিনিস অনন্তকাল বেঁচে থাকে স্বমহিমায়, যার পরিবর্তন না-হলেই ভালো।
বিয়ের এতগুলো বছর পরও পুজোর এই ক'টা দিন বাপের বাড়িতেই মনটা পড়ে থাকে। পুজোর দিনগুলি আমি আমার বাড়ির সামনে যে-পুজোটা হয়, সেই পুজোর আমেজটা বড্ড বেশি মিস করি। আমার পুজো এখান থেকেই শুরু। মনে পড়ে, ছোটোবেলায় যখন প্যান্ডেল বাঁধা শুরু হয়—সেইদিন থেকেই আমাদের পুজো শুরু হয়ে যেত। আর দশমীতে যখন সেই মণ্ডপের সাজসজ্জা খোলা শুরু হতো, আমার কী ভীষণ মন খারাপ হতো! আমার মাকে জড়িয়ে বসে থাকতাম।
এখানেও আমার নিজস্ব সংসার, আপনজনদের সঙ্গে গড়ে তোলা আমার নিজেরই সংসার। হ্যাঁ, এটা আামার শ্বশুরবাড়ি। আমারও নিজস্ব কোনো বাড়ি নেই! জানি না, নিজস্ব কোনো বাড়ি হলে আমি সঙ্গে কাকে-কাকে নেবো! কী-কী নেবো! কে-কে আমার সঙ্গে যেতে রাজি হবে! কিংবা, সেখানে হয়তো আমাকে একাই থাকতে হবে! যাইহোক, সে-সব নিয়ে আমার ভাবনা নেই; যেখানে আমার ভালোবাসার মানুষগুলো আছে, সেটাই বর্তমানে আমার নিজস্ব। এখানে আমাকে জড়িয়ে থাকে কিছু নাড়ির বাঁধন। সংসারে 'মায়ের বাঁধন' আর 'মায়ার বাঁধন' দুটোই ভয়ংকর। তাই তো 'মা' তার বাপের বাড়ি আসে। পুজোর দিনগুলোতে আমি মায়ের কাছে থাকতে ভালোবাসি; আর দেখেছি, মা-ও আমায় কাছে রাখতে চায়। এই ক'টা দিন মায়ের একটু অন্যরকম। সারাদিন পুজোর কাজ, সংসারের কাজ। এইসময় মাকে একটু বেশি ভালো লাগে; কেমন একটা দুগ্গা-দুগ্গা ভাব! যেন সব সে এক হাতেই সামলে নেবে! ভাবি, সত্যি মায়ের যদি নিজস্ব বাড়ি হতো? পাগল নাকি! আমরা তবে কোথায় থাকতাম! মায়ের সঙ্গেই আমার পুজো কাটুক। যতদিন আমি আছি, পুজো আছে, মা দুগ্গা আসবে এই মর্ত্যে। আমার মা এভাবেই সব সামলে, আমাকেও সামলে রাখুক।
এখন তো চারিদিকে থিমের পুজো। আমাদের সময়ে পুজোর মজাটাই কিন্তু আলাদারকম ছিল। থিমের পুজোর বালাই ছিল না। ঠাকুর গড়া থেকে মণ্ডপ তৈরি— পুরোটাই চোখের সামনে। পুজো মানে সে কী আনন্দ; ষান্মাসিক পরীক্ষা শেষ হতেই বইখাতা তুলে রেখে পুজো নিয়ে ব্যস্ত হয়ে ওঠা। তখন তো পাড়ার লোকেদের সঙ্গে এত মিল ছিল সকলের, যা বর্তমানে এক পরিবারের মধ্যেও দেখা যায় না! যেন, গোটা পাড়াটাই আমার নিজের লোকজন! সেই উৎসবের দিনগুলোতে সবাই যেন আপনজন।
এই ক'টা দিন বা একটা মাস ধরে নিলেও ভুল হবে না; কোনো অফিস, স্কুল, দোকান—যেখানেই যা-কিছু বলো—"এখন নয়, পুজোর পরে হবে"! সে যে-কোনো কাজ হোক। পুজো শেষ হওয়ার পরে, সেই রেশ কাটতেও আরও কিছুদিন—"এখন তো হবে না, সকলে ছুটিতে আছে"। এই অসুবিধে খানিকটা সকলকে পোহাতে হয়। লক্ষ করে দেখা যায়, এইসময় সকলের শরীর-স্বাস্থ্য বেশ চনমনে থাকে। সারাবছরের মাথাযন্ত্রণা,গা-ব্যথা, হাঁটুর সমস্যা, পেটের সমস্যা—সব কেমন ভ্যানিশ হয়ে যায়!
এখন সময়ের সঙ্গে-সঙ্গে পুজোর দিনগুলোতে সকলের ঘোরাফেরার রকমও খানিক বদলে গেছে। তাই তো সকলে পুজোর ছুটির প্যাকেজ বুক করে, ক'দিন হাওয়া হয়ে যায় দূরদেশে। আমি কখনও এমন প্ল্যান করবো বলে মনে হয় না। আমার ওই ক'টা দিন ঘরে বসে যদি পুজোমণ্ডপের গান শুনে আর ঢাকের তালে মেতে সময় কাটাতে হয়, তবু আমি রাজি। তবে হ্যাঁ, অষ্টমীর সকালে সব পুজোমণ্ডপে এখনও সেই একই গান বাজে। আমারও পুজোর সময় একই মন জড়ানো ভালোলাগাটুকু থাকে। অষ্টমীর সকালে মা দুর্গার মুখের দিকে তাকিয়ে মনে-মনে বলি, এর পরের বছর আবার এসো মা, অঞ্জলি নিতে। সকলকে ভালো রেখো।
বছরের এই পাঁচটা দিনের সঙ্গে কতকিছুই-না জড়িয়ে থাকে! সপ্তমীর প্রথম দেখা থেকে শুরু করে নবমীর রাতে বিদায়ের সুর—প্রেমটা ঠিক কতটুকু জমলো, সেটা নিয়ে ভাবনা নেই; রোমান্সটা মনের কোঠায় থেকেই যায়। নতুন জামা, মণ্ডপের সামনে রঙবাহারি জিনিসগুলো, সারি-সারি সাজানো দোকানপাট, সকলের মুখের হাসি, পায়ে হেঁটে ঠাকুর দেখা, খিচুড়ি থেকে ধুনুচি নাচ, আর এই যে কত রকমারি শাড়িতে মেয়েগুলো মনে করিয়ে দেয় আমার মেয়েবেলা! মা দুগ্গাই জানে তার নিজস্বতা কতটা প্রাণের! এমন উৎসব, যা সবকিছু থেকে তোমাকে ভুলিয়ে রাখবে। অনেক ভালোলাগা বলে শেষ করা যাবেনা। আমার পুজো এখনও আমার মন জুড়ে ভালোলাগা জাগানো। মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে এখনও আমার চোখে জলে ভরে! ঢাকের তালে মেতে ওঠে আমার পুজো। মাগো, তুমি আজীবন তোমার বাপের বাড়িতে এসো। তোমার সিঁদুরমাখা মুখ,ভাসানকালে আমার ভীষণ মনখারাপ, "আসছে বছর আবার এসো" রব, সমস্ত নিয়ে আমার শারদোৎসব।
Comments
Post a Comment