দুর্গাপুজো নিয়ে বাঙালির আবেগ সীমাহীন। তাই প্রত্যেক বছর পুজো চলে গেলেই, পরের বছরের পুজোর প্রতীক্ষা শুরু হয়ে যায় যেন সব বাঙালির মনে। এমনকি আমার মতো যারা পুজো-প্যান্ডেলের ভিড় এড়িয়ে চলে, ফাঁকা সময় খোঁজে যে-কোনো প্রতিমা দর্শনের এবং সেই সুযোগ না-পেলে ওইদিকে যাওয়ার পরিকল্পনাই বাতিল করে শুধুই ভিড় ও ভিড়-সংক্রান্ত বিবিধ হয়রানির ভয়ে, তাদের মনের গভীর-গোপন কোণেও এই অপেক্ষা থাকে। এই অপেক্ষার কারণেই পুজো চলে গেলেও, পুজো নিয়ে কথাবার্তা অথবা ভাবনা এবং লেখালেখিও বাঙালির আর ফুরোয় না। কিন্তু বিশেষত এই লেখালেখির ব্যাপারটা প্রায় পুরোটাই মহানগরীর দুর্গাপুজো-কেন্দ্রিক। খুব বেশি হলে, কলকাতার শহরতলির কয়েকটি পুজো সেই আলোচনায় স্থান পায়। অথচ বাঙালির প্রধান উৎসব মানে তো শুধু কলকাতার উৎসব নয়! পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায়, ভারতের অন্যান্য রাজ্যের বাঙালিপ্রধান অঞ্চলেও অজস্র প্রাচীন অথবা বিশিষ্ট এবং উল্লেখযোগ্য পুজোর আয়োজন হয়ে থাকে। এমনকি বিদেশেও, যেখানেই প্রায় যেখানেই একদল বাঙালি জুটে যায় একসঙ্গে— সেখানেই দুর্গাপুজোর আয়োজন যেন এক অবধারিত পরিণতি। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের দৈনিক সংবাদপত্রের দৌলতে বিদেশের পুজো যদিও-বা ভিতরের পাতায় একটু-আধটু জায়গা পায়, অন্য রাজ্যের পুজো ততটাও পায় না। জেলার নিজস্ব পাতায় ছাড়া, জেলা-মফস্বলের পুজো তো আরোই না! সেই অভাববোধ থেকেই বোধহয় লেখা হয়ে গেল এই প্রতিমা উপাখ্যান, যার কেন্দ্রে শহর বহরমপুরের দুর্গাপুজো। এখানে বলে রাখা ভালো, এই লেখা ও তার সঙ্গে জুড়ে থাকা যাবতীয় ছবি কোনোভাবেই বহরমপুর শহরের সম্পূর্ণ পুজো-পরিক্রমা নয়। এই শহরের অনেক উল্লেখযোগ্য পুজোর উল্লেখই এখানে নেই। আবার সেইভাবে বিখ্যাত নয়, অথচ দৃষ্টিনন্দন, এমন পুজোর সন্ধানও এখানে পাওয়া যেতে পারে। আসলে, পথ চলতে-চলতে ক্যামেরায় যতটুকু ধরে রাখা গিয়েছে এবারের আয়োজন এবং অবশ্যই মনের মণিকোঠায়, তাদের নিয়েই এইটুকু লিখে রাখা। আরও বলে রাখা জরুরি যে, এখানে ধরে রাখা সব পুজোরই অবস্থান বহরমপুর শহর অর্থাৎ পৌর এলাকার মধ্যে। ফলত, সাম্প্রতিক সময়ে শহরের আশপাশে জনপ্রিয় হয়ে ওঠা অনেক বড়ো দুর্গাপুজোর সন্ধানও এই লেখায় নেই। শহরের উত্তরে আয়েসবাগ, ভাগীরথীর অপর পারে রাধারঘাট বা গোয়ালজান, শহরের দক্ষিণে অযোধ্যানগর ও হরিদাসমাটি এবং বানজেটিয়া অঞ্চলের বিখ্যাত পুজোদের এখানে পাওয়া যাবে না; কারণ তাদের অবস্থান বহরমপুর পৌরসভার বাইরে। অতএব প্রিয় পাঠক, সবদিক থেকেই অসম্পূর্ণ এই একঝলক উপাখ্যানে আপনাদের স্বাগত।
বহরমপুর শহরের প্রায় মাঝামাঝি অবস্থিত রানিবাগান দুর্গামন্দিরের পুজো বরাবরই খুব বিখ্যাত। এবারের প্রতিমাশিল্পী উজ্জ্বল নাথ। স্থায়ী ও প্রশস্ত মন্দির থাকলেও, তাকে ঘিরে তৈরি প্রতিবারই তৈরি হয় দর্শনীয় প্যান্ডেল, আর থাকে ঝলমলে আলোকসজ্জা—যার কিছুটা দেখা যাচ্ছে উপরের ছবিদুটিতে।
শহরের প্রায় মাঝখানে অবস্থিত, অথচ জনবিরল মণ্ডপ পাওয়া যায়— এমন পুজোর সন্ধান পাওয়া যাবে বহরমপুর গার্লস কলেজের ঠিক উল্টোদিকে রোডস কোয়ার্টারের পুজোতে গেলে। এবার তাদের দৃষ্টিনন্দন প্রতিমার শিল্পী পলাশ ঘোষ। উপরের ছবিতে ধরা রইলো সেই নিদর্শন।
শহরের মধ্যভাগে কাদাই অঞ্চল ও তার আশপাশে বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য পুজোর আয়োজন হয়। তার মধ্যে অন্যতম উল্লেখযোগ্য কল্যাণ সংঘের পুজো। এবারে তার ব্যতিক্রমী সাজের প্রতিমা—যিনি কিনা অসুরের সঙ্গে যুদ্ধরতা নন, সম্ভবত তাকে পরাজিত করে বরাভয় দিচ্ছেন মর্ত্যবাসীদের। অসুরও হতমান এবং ক্ষমাপ্রার্থী। এই প্রতিমার স্রষ্টা চন্দন দাস। উপরের দুটি ছবি কল্যাণ সংঘের মণ্ডপ থেকে তোলা।
কাদাই অঞ্চলের আরেকটি উল্লেখযোগ্য পুজোর নাম লোয়ার কাদাই সর্বজনীন। খুব অপ্রশস্ত এলাকার মধ্যে পুজো করতে হলেও, প্রতিবছরই তারা বিভিন্নরকম উদ্ভাবনী শক্তির পরিচয় রাখে। এবার তাদের ভাবনার নাম ছিল 'দুর্গানগরী', যা আসলে মূল প্রতিমা-সহ মোট ২৩টি বিভিন্নধরনের দুর্গাপ্রতিমার প্রদর্শন। প্রতিটি প্রতিমাই তৈরি করেছেন অসীম পাল। তিনিই সম্ভবত বহরমপুরে এই প্রজন্মের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য মৃৎশিল্পী। তাঁর আরেকটি পরিচয়— তিনি প্রবাদপ্রতিম শিল্পী যামিনী পালের পৌত্র; যে যামিনী পাল কলকাতা থেকে শুরু করে দেশের বিভিন্ন রাজ্যে এবং বিদেশেও অজস্র স্মরণীয় শিল্পকর্মের নিদর্শন রেখে এসেছেন আজীবন এবং ভূষিত হয়েছেন শিল্পশ্রী উপাধিতে। প্রয়াত পিতামহের পদাঙ্ক অনুসরণেই অসীম প্রতিমা তৈরি করেন। তাঁর প্রয়াত পিতা চন্দন পালও প্রখ্যাত শিল্পী ছিলেন। সেই পরম্পরা অনুসরণ করেই অসীম কাজ করছেন। উপরের দুটি ছবিতে লোয়ার কাদাই-এর মূল প্রতিমাটি দেখলে, পাঠক সেই আন্দাজ পাবেন। অসামান্যা এই প্রতিমাও যুদ্ধরতা হয়ে নেই, এবং এখানেও পরাজিত মহিষাসুর অস্ত্রত্যাগী ও ক্ষমাপ্রার্থী।
বহরমপুরের উত্তরদিকে যেতে থাকলে, খাগড়া অঞ্চলে যে-সব বিখ্যাত দুর্গাপুজো পাওয়া যাবে তাদের মধ্যে সম্ভবত সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য স্বর্গধাম সেবক সংঘের বহুদিনের পুজো। উপরের ছবিতে এই পুজোর যুদ্ধারতা প্রতিমা, অসীম পালের অসামান্য শিল্পসৃষ্টির আরেকটি নিদর্শন।
আরও এক আত্মসমর্পণকারী ও ক্ষমাপ্রার্থী অসুরের সন্ধান পাওয়া গেল স্বর্গধামের খুব কাছেই, বুড়োশিবতলা সর্বজনীনের পুজোয়। ঘরোয়া সাজের এই প্রতিমার শিল্পী সমর পাল। উপরের ছবিতে রইলো বুড়োশিবতলার সেই পুজোর ঝলক।
খাগড়া অঞ্চলের খুব প্রসিদ্ধ জগদম্বা মন্দিরের সুপ্রাচীন দুর্গাপুজো। দর্শনার্থীদের ভিড়ে ও সপ্তমী-সকালের পুজোর ব্যস্ততার মাঝে সেই প্রতিমার ছবিটি তুলতে হলো মন্দিরের বাইরে থেকেই। কিন্তু উপরের ছবিটি দেখুন, ওই ভিড়ের মধ্যেও তো দেবীর মুখের আলো আমাদের চোখ পড়তে ভুল করেনি!
বহরমপুর শহরের দক্ষিণদিকের পুজোগুলোর মধ্যে অন্যতম উল্লেখযোগ্য অভ্যুদয় সংঘের প্রতিমা। এলাকার নাম স্বর্ণময়ী। বহরমপুর কোর্ট রেল স্টেশনের খুব কাছে, মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজের ঠিক উল্টোদিকে এই পুজোর প্রতিমাশিল্পী শ্রীদাম হালদার। তিনি এই পুজোর কার্তিককে উপস্থাপন করেছেন একদম অন্যতর রূপে। উপরের ছবিতে দেব-সেনাপতির সেই 'ক্লিনশেভড লুক' ধরে রাখা গিয়েছে, মহাষ্টমীর অঞ্জলি-পর্বের ভক্ত-সমাগমের মধ্যেও।
নবমীর দিন আবার শহরের দক্ষিণে। গোরাবাজার অঞ্চলের লালসড়ক সর্বজনীনের পুজোপ্রাঙ্গণে, ধরে রাখা গেল মৃৎশিল্পী পলাশ ঘোষের আরও একটি উল্লেখযোগ্য কাজ।
তারপরের গন্তব্য শহরের দক্ষিণতম প্রান্তে, ভাগীরথী নদীর ধারে উমাসুন্দরী পার্কের পুজো। ১৯৪৬ সালে প্রতিষ্ঠিত এই দুর্গামন্দিরটি সারাবছরই শহরের অন্যতম দৃষ্টিনন্দন স্থান, উপরের ছবিতে ধরে রাখা তার দুর্গাপ্রতিমার মতোই।
উমাসুন্দরী পার্কের খুব কাছেই বটতলা দুর্গাপূজা কমিটির পুজো বরাবরই খুব অনাড়ম্বর। এমনকি তার মণ্ডপটিও তেমন আকর্ষণীয় নয়। কিন্তু প্রতিমার সৌন্দর্য আড়ম্বরের সেই অনুপস্থিতিকে একদম ঢেকে দিতে পারে। উপরের দুটি ছবিতে ধরে রাখা গিয়েছে শিল্পী সুব্রত নাথের সেই শিল্পকর্ম।
উৎসবের দিন শেষ হয়ে আসে, কিন্তু প্রতিমা উপাখ্যান তো ফুরোবার নয়! বিজয়াদশমীর সকালে তাই ক্যামেরার চোখ আর মানুষের মন নিয়ে বেরিয়ে পড়া যায় আবার শহরের উত্তরপানে। সেইভাবেই মধুবর্ষণ এলাকায় ধরে রাখা যায় শিল্পী সুহাস নাথের তৈরি সাবেক শ্বেতশুভ্র সাজের প্রতিমাটির প্রতিচ্ছবি; লেখার এই অংশের ঠিক উপরে।
তবুও তো কোথাও একটা ইতি টানতেই হয়। অসম্পূর্ণ এই পুজো-পরিক্রমা তাই আপাতত এখানেই শেষ করা যাক, শহরের উত্তরতম প্রান্তে সইদাবাদ কুহেলী সংঘের পুজোর ছবি দিয়ে। ৪৯ বছরের এই পুজোর এবারের থিম ছিল 'কৃষকবন্ধু'। উপরের ছবিতে যে-অভিনব প্রতিমাটি দেখা যাচ্ছে, সেটি এবং তার সম্পূর্ণ মণ্ডপটি পুরোপুরি দেশজ ও গ্রামীণ উপাদানের ব্যবহারে, নান্দনিক আলোছায়ার আবহে নির্মাণ করেছিলেন তন্ময় দাস।
★
চিত্রগ্রাহক : রাহুল ঘোষ
ডিভাইস : আইফোন ১২ মিনি
Comments
Post a Comment