প্রাণেশ সরকার

বাবার মৃত্যুর পর-পরই, তাঁর পারলৌকিক ক্রিয়াকলাপ শেষ হলে, আমি প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হই বাদকুল্লা ইউনাইটেড একাডেমি সংলগ্ন সরকার পোষিত প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। আমার দিদি সবিতা সিকদার আমাকে ভর্তি করিয়েছিলেন। প্রসঙ্গত বলি, বাবার মৃত্যুর অব্যবহিত পরেই জামাইবাবু দিদিকে নিয়ে বনগাঁ গোপালনগর থেকে আমাদের বাড়ি চলে আসেন। মাঝেমাঝে বাড়ি গিয়ে তাঁর মা-র ও চাষের জমির দেখাশোনা করে আবারও বাদকুল্লায় চলে আসতেন। বাদকুল্লা বাজারে তিনি ব্যবসা শুরু করেন।  প্রথমে শাকসবজি ও ফলমূলের ব্যবসা, পরে চাল ও আটার ব্যবসা। বাবার মতোই মাটিতে চটের বস্তা পেতে দোকান সাজাতেন তিনি। পড়াশোনার ফাঁকে আমি ব্যবসার কাজে সাহায্য করতাম তাঁকে। দিদিও প্রেসে কম্পোজিটরের কাজ করতেন। কখনও কৃষ্ণনগর, রানাঘাট, শান্তিপুর, কখনো-বা কলকাতায়।  এভাবে যৌথ সংগ্রামের মধ্যে দিয়েই খেয়ে-পরে কোনোরকমে বেঁচে ছিলাম আমরা। ছোটোবোন টুনুও প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। পড়াশোনায় সে মনোযোগী ছিল।

আমিও পড়তে ভালোবাসতাম। পড়ার ফাঁকফোকরে ব্যবসার কাজে সাহায্য করতাম দাদাবাবুকে। দ্বিতীয়-তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ার সময় থেকে আমাদের সংলগ্ন গ্রামসমূহ — ভাদুড়ি, বোয়ালিয়া, চন্দনদহ, মুগরাইল, দেনুই, আড়বলদা গিয়ে ঝুড়ি মাথায় করে চাষির ফসলের খেত থেকে বেগুন, মুলো, সিম, ফুলকপি, বাঁধাকপি, পাতিলেবু, টমেটো ইত্যাদি কিনে বাদকুল্লা বাজারে বিক্রি করতাম; সিদ্ধেশ্বরী কালীমন্দিরের সামনে চট পেতে। ওদিকে চালখোলায় দাদাবাবু চাল, আটা বিক্রি করতেন। মনে আছে, দাদাবাবু রানাঘাটের গড়াইদের আড়ত থেকে চাল আনতেন শনি ও মঙ্গলবার— বাদকুল্লা হাটের দু'দিন, ট্রেনে করে। আমি কখনো-কখনো সেই চালের বস্তা (প্রথমে ২০-৩০ সের, পরে ৫০-৬০ কেজি) স্টেশন থেকে বাজারে মাথায় করে বয়ে আনতাম। বেশিটা আনতেন দাদাবাবু। দিনের দিন সব চাল বিক্রি হয়ে যেত। আমাদের চালের গুণমান ভালো হওয়ায় এত দ্রুত বিক্রি হতো হাটে। এইসব কাজ আর লেখাপড়া পাশাপাশি চলতো। পরীক্ষায় বরাবরই প্রথম হতাম। সমস্ত বই কিনতে পারতাম না। বন্ধুদের কাছ থেকে চেয়েচিন্তে পড়তাম। কিছু অংশ কপি করে নিতাম খাতায়। কিছু বই দেবাশিসবাবু, কামনাবাবু দিতেন— স্পেসিমেন কপি— সে অবশ্য হাইস্কুলে ওঠার পরে। আর মেজোকাকা অর্থাৎ ফেলুবাবু, ধনী ব্যবসায়ী ও আড়তদার, প্রতি ক্লাসে আমাকে কিছু নতুন বই কিনে দিতেন। সে-সব ঋণ ভোলার নয়।

ক্লাস এইট পাস করার পর আমাদের অ্যাপটিটিউড টেস্ট নেওয়া হলো; কে কোন স্ট্রিমে পড়বে, তা ঠিক করার জন্য। তিনটে স্ট্রিম ছিল— সায়েন্স, কমার্স এবং হিউম্যানটিজ। আমি হিউম্যানিটিজ বা মানবিক শাখায় গেলাম। ইলেক্টিভ বিষয় হলো লজিক, ইকোনমিক্স অ্যান্ড সিভিক্স, সংস্কৃত আর ইতিহাস হলো অ্যাডিশনাল ইলেক্টিভ। এছাড়া বাংলা ও ইংরেজি তো ছিল আবশ্যিক। প্রতি বিষয়ে দুটি পেপার, ২০০ নম্বরের। তিনটে শাখা মিলিয়ে আমিই প্রথম হতে থাকলাম স্কুলের পরীক্ষায়, হাফইয়ার্লি ও অ্যানুয়ালে; এছাড়াও নিয়মিত উইকলি টেস্ট তো ছিলই। পড়াশোনার চমৎকার বাতাবরণ ছিল আমাদের স্কুল বাদকুল্লা ইউনাইটেড একাডেমি-তে। শিক্ষকদের নিষ্ঠা ও বিষয়ে ব্যুৎপত্তি অসাধারণ। প্রধানশিক্ষক করুণাময় ভট্টাচার্য দারুণ শিক্ষক ও প্রশাসক ছিলেন। উনি রাষ্ট্রপতি পুরস্কার পেয়েছিলেন। সমগ্র নদীয়া জেলায় আমাদের স্কুলের সুনাম ছিল। ১৯৬৯ সালে হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষা। পরীক্ষা হলো রানাঘাটের ব্রজবালা বালিকা বিদ্যালয়ে। আমার অভিন্নহৃদয় বন্ধু বিপ্লব ভট্টাচার্যের ছোটোমাসির ঘটকপাড়ার বাড়িতে থেকে পরীক্ষা দিলাম। এই ঋণও অপরিশোধ্য। মাসিমা খুব যত্ন করেছিলেন। বাড়ি থেকে টিফিনে লুচি, তরকারি, মিষ্টি ও ডাব পাঠাতেন।  পরীক্ষার ফলপ্রকাশে দেখা গেল, আমি ১০০০-এর মধ্যে ৬৮৪ পেয়ে প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়েছি। লজিকে ২০০-র মধ্যে ১৫৬; চার নম্বরের জন্য লেটার মার্ক্স হয়নি। যাইহোক, ন্যাশনাল স্কলারশিপও পেলাম। বৃত্তির টাকায় কলেজের বইপত্র কেনার সুরাহা হলো। ভর্তি হলাম কৃষ্ণনগর গভর্নমেন্ট কলেজে, ইংরেজি অনার্সে। কলেজজীবন ১৯৬৯-১৯৭২; ১৯৭২-এ অনার্সে সেকেন্ড ক্লাস পেয়ে বিএ পাস করলাম। ফলপ্রকাশের একমাস আগে আমার মা-র মৃত্যু হয়।

মা-র মৃত্যুও আকস্মিক। আগের দিন মহাষ্টমী ও সন্ধিপুজো ছিল। ক্লাবে (নবশ্রী, বাদকুল্লা বাজার) রাত জেগেছি। ভোররাতে সরকারবাড়ির ছোটোছেলে, আমার বন্ধু বুড়ো (অশোক সরকার)-র ঘরে এসে ঘুমিয়েছি। সকাল দশটায় বাড়ি ফিরে ফ্রেশ হয়ে বারান্দায় বসে বাটিতে মুড়ি-মুড়কি ও নাড়ু খাচ্ছি। মা বলছে, "চায়ের জল বসিয়েছি। মুড়ি খেয়ে চা খাবি।" মাংস আনা হয়েছে বাড়িতে। নবমীর দিন। মা মশলা বাটছে। হঠাৎ শুনি মা-র মুখ দিয়ে কেমন একটা শব্দ নির্গত হলো, আর মা বাটনা বাটার শিলের উপর মুখ থুবড়ে পড়ে গেল। আমি দ্রুত উঠে মা-কে তুলে ধরেছি; দিদি, টুনু সবাই ছুটে এসেছে পাশের ঘর থেকে। মা-র জ্ঞান নেই। তাড়াতাড়ি একটা ভ্যানে করে বাদকুল্লা হাসপাতালে নিয়ে গেলাম। ডাক্তার বিবেকানন্দ রায় বললেন, "আমি একটা ইঞ্জেকশন দিচ্ছি, অ্যাম্বুলেন্সে এখনই শক্তিনগর জেলা হাসপাতালে নিয়ে যাও।" ইমারজেন্সিতে ডাক্তার দেখলেন মা-কে, বেডে দিলেন ওঁরা, স্যালাইন ও অক্সিজেন দেওয়া শুরু হলো তৎক্ষণাৎ; নবমী থেকে ত্রয়োদশীর সকাল পর্যন্ত ওভাবেই মা বেডে থাকলো, জ্ঞান ফিরলো না। ত্রয়োদশীর দিন ভোরে দিদি বললো, "আমি মা-র কাছে থাকছি, তুই বাড়ি থেকে স্নানটান করে আয়।" সকাল দশটায় গিয়ে দেখি মা নেই, সাড়ে-ন'টায় মারা গেছেন। শেষ সময়ে দিদিকে কী একটা বলতে চেয়েছিলেন, গলা দিয়ে স্বর নির্গত হয়নি, হঠাৎ মাথা কাত হয়ে গিয়েছে। অ্যাটেন্ডিং ডাক্তার এসে দেখে বললেন, উনি আর নেই। আমার আফশোস থেকে গেল, এই 'নেই' হয়ে যাওয়ার মুহূর্তে আমি মা-র কাছে থাকতে পারিনি। দু-তিনঘন্টা পরে ডেথ সার্টিফিকেট দিলেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ— ম্যাসিভ সেরেব্রাল অ্যাটাক— আমরা একটা ছোটো গাড়ি করে মা-র মরদেহ বাড়িতে নিয়ে এলাম। ছোটোবোন টুনু তো মা-র দেহের উপর শুয়ে আছাড়িপিছাড়ি করতে লাগলো। বিকেল সাড়ে-চারটা নাগাদ আবার একটা ছোটো গাড়িতে মা-কে নিয়ে আমরা শ্মশানযাত্রীরা (নবশ্রী ক্লাবের সদস্যরা, দাদাবাবু ও আমার বন্ধু আড়বান্দির বিপ্লব ভট্টাচার্য) শান্তিপুর রাজঘাটে পৌঁছে মা-র সৎকার করলাম। মনে আছে, মুখাগ্নি করে শ্মশান-সংলগ্ন একটা টিনের চালায় গিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম; এতটাই ধ্বস্ত ছিলাম। সেই নবমীর সকাল থেকে হাসপাতালে কোথা দিয়ে এতগুলো দিন ও রাত কেটে গেল, টেরই পাইনি। টিনের চালায় খড় বিছানো ছিল, বিপ্লব আমার গায়ে পাতলা একটা কম্বল জড়িয়ে দিয়ে আমাকে স্পর্শ করে ছিল। তারপর যারা দাহ করছিল, ওরা এসে আমাকে ঘুম থেকে তুলে বললো, "ওঠো এবার, চিতায় জল ঢালতে হবে।" আমি স্বপ্নাবিষ্টের মতো ওদের নির্দেশ অনুযায়ী যা-যা করণীয় তা করে ওদের সঙ্গেই ফিরে এলাম। শুরু হলো তেরোদিনের শোকপালন, ধরাকাছা পরে হবিষ্যান্ন গ্রহণ করা ও ব্রাহ্মণের কথামতো আনুষঙ্গিক কাজ করা।স্কলারশিপের টাকা কিছু ছিল পোস্ট অফিসে, তা তুলে আনলাম। দাদাবাবুও কিছু টাকা দিলেন। মা-র শ্রাদ্ধশান্তি মিটে গেল। বাবা, ঠাকমা ও মা-র পারলৌকিক কাজের মধ্যে দিয়ে জীবনের একটা বৃত্ত যেন শেষ হলো আমার!

এর কিছুদিন পরে বিএ পরীক্ষার চূড়ান্ত ফল প্রকাশিত হলো। তার একবছরের মধ্যেই ২৩ জুলাই ১৯৭৩ লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার ভিত্তিতে মোট ২২জন প্রার্থীর মধ্যে আমি কৃষ্ণনগর পৌরসভার সেকেন্ড ক্লার্কের পোস্টে বিবেচিত হলাম এবং ওই তারিখেই সেখানে কাজে যোগদান করলাম। চাকরির পাশাপাশি টিউশন পড়ানো চললো যথারীতি। চাকরি পাওয়ার তিন-চার বছরের মধ্যেই টুনুর বিয়ে দিলাম এক সুপাত্রের সঙ্গে। গাংনি নিবাসী যুবক শিক্ষক সুখেন্দ্রকুমার বিশ্বাস হলো আমার আদরের ছোটো ভগ্নীপতি। আমার সামান্য চাকরি। মাসিক ২৭৬ টাকা বেতনে কর্মজীবন শুরু করেছিলাম। ততদিনে বেতন বেড়ে ৩৫০ টাকা হয়েছিল। ধারদেনা করলাম কিছু। দিদি তার সামান্য গহনা থেকে টুনুকে দু-তিনটে গহনা দিল। স্যাকরা নতুন করে গড়ে দিল আবার। মেসোমশায় তো জমির দলিল শেষ পর্যন্ত দিলেন না। আমার অফিসের ল-ক্লার্ক বিশুদা (বিশ্বনাথ গাঙ্গুলি) জমির নকল বের করলেন। একটা নির্দিষ্ট দিনে কৃষ্ণনগর কোর্টে গিয়ে মেসোমশায়ের মেজোভাই সুবল সিকদারকে মা-র যে মাঠান জমি ছিল কমলাপুরে, সওয়া-একবিঘে মতো, সেই জমি ১৪০০ টাকায় রেজিস্ট্রিপূর্বক বিক্রি করে দিলাম মেসোমশায়ের অজান্তে। ওঁর মতো প্রতারক মানুষের সঙ্গে আমাকে 'শঠে শাঠ্যং' নীতিই অবলম্বন করতে হলো বাধ্য হয়ে। বিশ্বনাথ গাঙ্গুলির এই উপকারের কথা জীবনে ভোলার নয়। উনি এসেছিলেন বোনের বিয়েতে, টুনুকে আশীর্বাদ করে গিয়েছেন।

টুনুর বিয়েতে প্রবল বৃষ্টি হয়েছিল। আমরা তখন সুরভিস্থানে টুনুর স্কুলের বান্ধবী কৃষ্ণা চক্রবর্তীদের বাড়ি 'গিরিজা ভবন'-এ ভাড়ায় আছি। এই ভাড়াবাড়িতে চলে আসি চাকরি পাওয়ার মাসখানেকের মধ্যেই। দিদিমার প্রবল আপত্তি ছিল আমাদের চলে আসায়। আমি তাঁকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে তাঁর সম্মতি আদায় করেছিলাম। আসার সময়ে দিদিমার সেই জলে ভরা চোখ এখনও আমার মনে পড়ে। যাইহোক, টুনুর বিয়ে ভালোভাবেই হয়েছিল। প্রবল বৃষ্টির কারণে অনেক আমন্ত্রিতই আসতে পারেনি। কিন্তু মেজোকাকা তাঁর ফিয়াট গাড়ি করে মেজোকাকি, অসীম, শেফালিদি— সকলকে নিয়ে এসেছিলেন। সরকারবাড়ির দু-একজনও এসেছিলেন। বরযাত্রী জনা পনেরো এসেছিল। আমার অফিসের স্যানিটারি ইন্সপেক্টর অজিত খাঁ সকালবেলা লোক দিয়ে খাসি কাটিয়ে ঝুড়িতে করে ২৫ কেজি মাংস পাঠিয়ে দিয়েছিলেন, আর অধর কুরির সরপুরিয়া। ভীম ময়রার দোকান থেকে দাদাবাবু রসগোল্লা ও পান্তোয়া এনেছিলেন, আর অধীর ঘোষের মিষ্টি দই। রানাঘাটের এক উড়ে ঠাকুর রান্না করেছিলেন। ৭০-৮০ জন খেয়েছিলেন। রান্নাবান্না ভালো হয়েছিল। প্রচুর খাবার পড়ে ছিল। পরের দিন সকালে গরিবদুঃখী মানুষকে পাত পেড়ে খাইয়ে দিয়েছিলাম। সন্ধ্যায় বোন-ভগ্নীপতি চলে গেল। তার পরের দিন বউভাতের অনুষ্ঠান গাংনিতে ওদের বাড়িতে খুব জাঁক করে হয়েছিল। ভগ্নীপতির বড়োভাই শঙ্করদা সবকিছুর দেখভাল করেছিলেন। ওদের বিরাট গুষ্টি। তা প্রায় ৪৫০ জন লোক নিমন্ত্রিত ছিল। নববধূর সাজে বোনকে আমার রাজরানি মনে হচ্ছিল। মা-র কথা মনে পড়ছিল খুব। আমাদের বাড়ি থেকে আত্মীয়স্বজন মিলে জনা কুড়ি লোক গিয়েছিলাম। কৃষ্ণা, কৃষ্ণার বোন রত্নাও গিয়েছিল মেয়েপক্ষের হয়ে। গগন বিশ্বাসের বাড়ির লোকজনও এসেছিলেন; ওঁরা আমার ভগ্নীপতির আত্মীয়। সুখেনের বড়োমামা ডাক্তার ব্যোমকেশ বিশ্বাস জমিদারবাড়ির জামাই ছিলেন। এই ডাক্তারদাদু আমাকে বিশেষ স্নেহ করতেন। তিনি কলকাতা কর্পোরেশনের মেডিক্যাল অফিসার ছিলেন। আমার ছাত্রাবস্থায় আমার পড়াশোনার খোঁজখবর নিতেন।
সরকারবাড়িতে থাকাকালীন সময়েই দিদির প্রথম পুত্রসন্তান জয়ন্ত (নেটু)-র জন্ম হয় বাদকুল্লা হাসপাতালে। আমি তখন ক্লাস নাইনে পড়ি। মনে আছে, আমি আর মা হ্যারিকেন হাতে শীতের রাতে হসপিটাল কমপাউন্ডে অপেক্ষা করছিলাম। নার্স (ঊষা ম্যাডাম, আমার সহপাঠী তপনের মা) এসে মা-কে বললেন, "তোমার মেয়ের কী ফুটফুটে ছেলে হয়েছে দিদি, যাও দেখে এসো।" মা ভিতরে গেলেন, আমার প্রবেশ নিষিদ্ধ। একবুক অভিমানে ঠান্ডায় দাঁড়িয়ে থাকলাম। মা এসে বললেন, "চল, বাড়ি যাই। কাল সকালে অর্জুন ও তার মা এসে খোকাকে দেখবে'খন।" মনে আছে, আমার বড়ো ভাগ্নে নেটুর (বাঁ-হাতে সব করতো বলে পাড়ার লোক ওকে ন্যাটা বলতো, সেটাই শেষ পর্যন্ত নেটুতে পরিণত হলো) অন্নপ্রাশনের অনুষ্ঠান ভালোভাবেই হয়েছিল।

এই প্রসঙ্গে আমার দাদাবাবুর মা (আমার মায়োইমা)-র কথা বলি একটু। আগেই উল্লেখ করেছি, দাদাবাবু মায়োইমাকে আমাদের বাড়ি নিয়ে এলেন আমার মা-র পীড়াপীড়িতে। একা কেন তিনি গোপালনগরে পড়ে থাকবেন? বুড়ি মানুষ, অসুখবিসুখে কে দেখবে তাঁকে— এই ছিল আমার মা-র অকাট্য যুক্তি। আমার মা-কে দাদাবাবু ভীষণ শ্রদ্ধা করতেন, ভালোবাসতেন, মা ছাড়া কথাই বলতেন না। তিনি শেষ পর্যন্ত মায়োইমাকে নিয়ে এলেন, আমাদের পরিবারের সদস্যসংখ্যা একজন বেড়ে গেল। গোপালনগরে দাদাবাবুর জ্ঞাতিভাইরাই তাঁর জমিতে চাষবাস করতেন ও নিয়মিত ফসলের ভাগ দিতেন। দাদাবাবু পোস্টকার্ড পেলেই গোপালনগরে গিয়ে ফসল বিক্রি করে টাকা নিয়ে আসতেন। আর যতবারই বাড়ি যেতেন, ততবারই দশ-বারোটা ঝুনো নারকেল নিয়ে আসতেন। ওবাড়িতে একটাই নারকেল গাছ ছিল। প্রচুর ফল হতো। মা সেই নারকেল দিয়ে নাড়ু বানাতেন। গরম মুড়ি দিয়ে নারকেল-কোরাও খেতাম আমরা প্রাণভরে।

মায়োইমা তিন-চারবছর বেঁচেছিলেন বাদকুল্লায়। তারপর এক প্রবল বর্ষণের (শ্রাবণ মাস ছিল) রাতে তাঁর মৃত্যু হয়। পরের দিন সকাল দশটা নাগাদ মুষলধারায় বৃষ্টিপাতের মধ্যেই ইউনাইটেড ক্লাবের সদস্যরা দাদাবাবুকে সঙ্গে করে পাটকাঠি, কেরোসিন তেল,সাইকেলের টায়ার, কাঁচা আমকাঠ নিয়ে শবদেহ কাঁধে তুলে বাদকুল্লা শ্মশানে মায়োইমার অন্তিম সংস্কার করেছিলেন। শ্মশানে আমিও গিয়েছিলাম। চিতা জ্বালানোয় খুবই সমস্যা হয়েছিল। কেরোসিন, টায়ার ইত্যাদি দিয়ে শেষ পর্যন্ত চিতায় সাজানো কাঠ ধরানো গিয়েছিল। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, বৃষ্টিও থেমেছিল।  দাদাবাবু, দিদি নিষ্ঠার সঙ্গে হবিষ্য পালন ইত্যাদি করে, ১২দিনের মাথায় কামান ও তার পরের দিন শ্রাদ্ধশান্তি এবং তারও পরের দিন আঁশমুক্তি ইত্যাদি পারলৌকিক ক্রিয়াদি করলেন। আঁশমুক্তির দিন কিছু পাড়াপ্রতিবেশী এসেছিলেন। গোপালনগরের আত্মীয়স্বজনও এসেছিলেন প্রায় সবাই। দাদাবাবু রানাঘাট থেকে মাছ ও দই-মিষ্টি নিয়ে এসেছিলেন সকালের ট্রেনে। ভালোভাবেই কাজ মিটেছিল আমাদের।

এবার দিদির কথা বলবো। আগেই বলেছি, দিদি লেটার টাইপ প্রেসে কম্পোজিটরের কাজ করতো। এই কাজ শেখার ও কাজ শুরু করার আগে দিদি অন্যান্য কাজও করেছিল। তাঁত চালানো, বোতামকলে ঝিনুকের বোতাম তৈরি করা ও বাদকুল্লা সিনেমা হলে গেটকিপারের কাজও করেছিল দিদি। আমাদের স্কুলের শিক্ষক ডাক্তার ঝড়ুলাল বিশ্বাস তখন গ্রামপ্রধান। তাঁর উদ্যোগে যে কো-অপারেটিভ সোসাইটি গড়ে উঠেছিল বাদকুল্লায়— তারই অধীনে তাঁতকল ও বোতাম তৈরির কারখানা পরিচালিত হতো। বোতামকল কিছুদিনের মধ্যেই উঠে যায়, কারণ, বোতামের তেমন চাহিদা ছিল না বাজারে। কিন্তু ১০-১২টি তাঁত চালাতেন মহিলা ও পুরুষেরা। দিদিও তাঁত চালাতো। ধুতি, শাড়ি, গামছা, তোয়ালে ইত্যাদি উৎপন্ন হতো সেই তাঁতে। তাঁত চালানো খুবই কঠিন কাজ। আমি বাদকুল্লা কদমতলায় তাঁতকলে গিয়ে দিদি ও অন্যান্যদের তাঁত চালাতে দেখেছি। তাঁতের মাকু একবার ডানে একবার বাঁয়ে যাচ্ছে, আর বস্ত্রখণ্ড ক্রমশ ধীরে-ধীরে তৈরি হচ্ছে। বিশ্বকর্মা পুজো খুবই ধুমধাম করে হতো তাঁতকলে। দিদি আমাকে আর টুনুকে নিয়ে যেত পুজোর দিন। পুজো হলে প্রসাদ তো পেতামই, তারপর মাংস-ভাতও খেতাম আমরা। পুজো ও খাওয়ানোর খরচের সিংহভাগ দিতেন সমবায় কর্তৃপক্ষ। কর্মীরাও চাঁদা দিতেন। খুবই আনন্দ হতো বিশ্বকর্মা পুজোর দিন। এছাড়াও ধুমধাম করে পুজো হতো বিদ্যুৎ সরবরাহ কেন্দ্রে এবং কালী সরকারের চালকলে। পুজোর পরের দিন বিদ্যুৎ সরবরাহ কেন্দ্রে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হতো। কলকাতার সঙ্গীতশিল্পীরা আসতেন। একবার ভি বালসারা পিয়ানো অ্যার্কোডিয়ান বাজিয়েছিলেন। আর, আমাদের সরকারবাড়ির ফকুদা (আশিস রায়) গান গেয়েছিলেন। তিনি ছিলেন কিশোরকণ্ঠী। পশ্চিমবঙ্গের নানা জায়গায় নানা অনুষ্ঠানে পারিশ্রমিকের বিনিময়ে গান গেয়ে বেড়াতেন। আমার বন্ধু মহাদেব দাস তাঁর সঙ্গে ডুগিতবলায় সঙ্গত করতো।

যাইহোক, দিদির কাজের কথা বলছিলাম। তাঁতকল তো উঠে গেল। এবার বাদকুল্লা রেল স্টেশনের পশ্চিমে, মাস্টারমশাই ঝড়ুলাল বিশ্বাসের সিনেমা হলে গেটকিপারের কাজ শুরু করলো দিদি। নাইট শোয়ের পর দাদাবাবু হ্যারিকেন হাতে নিয়ে দিদিকে বাড়ি আসতেন। এই কাজে কত আর পারিশ্রমিক! এই সময় রবিদা (প্রীতিভূষণ আচার্য)-র পরামর্শে আমি দিদিকে ছাপাখানায় কম্পোজিটরের কাজ শিখতে বললাম। দিদি রাজি হলো। আমি আমার স্কুলের হেডমাস্টার মশায় করুণাময় ভট্টাচার্যকে বললাম দিদির নামে একটা সুপারিশপত্র লিখে দিতে। স্যার সঙ্গে-সঙ্গে তাঁর বন্ধু লেখক ও সাংবাদিক নির্মল দত্তকে চিঠিতে অনুরোধ করলেন, তাঁর প্রিন্টিং প্রেসে যেন দিদিকে কাজ শেখার ব্যবস্থা করে দেন। নির্মলবাবু কৃষ্ণনগরে তাঁর প্রেসে সেই ব্যবস্থা করে দিলেন। মাস দুয়েক কাজ শিখে, দিদি ওখানেই কম্পোজিটরের কাজ করতে লাগলো। বাণী প্রেসে দিদি বছর দুয়েক কাজ করেছিল। তারপর রানাঘাটের একটা প্রেসে চলে আসে। ওখান থেকে শান্তিপুর। তারপর কলকাতা। মানে, যখন যেখানে কাজ থাকে আর কী! বিশেষ করে, ভোটার লিস্ট যখন তৈরি হয়, তখন প্রেসে কাজের চাপ থাকে। ওভারটাইমও করতে হয় দিদিকে। এভাবে কাজ করতে-করতে দিদির খুব শরীর খারাপ হলো, মুখ দিয়ে দু'দিন রক্ত পড়লো। মা তো খুব ঘাবড়ে গিয়েছিল। দিদিকে নিয়ে আমি সোজা কৃষ্ণনগরে ডাক্তার মুক্তি রায়ের চেম্বারে গেলাম। ডাক্তারবাবু ওকে যত্ন করে দেখলেন, এক্স-রে করলেন এবং ডায়াগনোসিস হলো। উনি বললেন, যক্ষার ফার্স্ট স্টেজ। ওষুধ, ইঞ্জেকশন ও ডায়েট চার্ট— সবকিছুর নিদান দিলেন প্রেসক্রিপশনে। এত মহৎপ্রাণ, কোনো ফিজ নিলেন না; এক্স-রের টাকাও নিলেন না। বললেন, "তোমাকে তো চিনি আমি, মিউনিসিপ্যালিটিতে কাজ করো। করদাতাদের কথা মন দিয়ে শুনে তাঁদের কাজ করে দাও। ভালো আচরণ করো তাঁদের সাথে। এ-শহরের লোক তোমায় ভালোবাসে। আমি কেন সামান্য ক'টা টাকা তোমার কাছ থেকে নেবো! দিদিকে নিয়ে বাড়ি যাও, ওষুধপত্র-খাদ্যখাবার খাইয়ে ভালো করে তোলো, একমাস পরে দিদিকে নিয়ে আবার এসো।" আমি সব ওষুধপত্র কিনে আনলাম, মা খুব যত্ন করলেন দিদির। খুব তাড়াতাড়ি আরোগ্যের পথে চলে এল দিদি। ঠিক একমাস পরে ডাক্তার রায়ের কাছে আবার গেলাম। আবার এক্স-রে করলেন এবং দেখে বললেন, "চমৎকার! অনেকটাই রিকভারি হয়েছে।" প্রেসক্রিপশনে ওষুধ কিছুটা কমিয়ে দিলেন। সঠিক চিকিৎসা ও যত্নে দিদি আরোগ্যলাভ করলো দ্রুত। এবার কিন্তু আমি আর ওকে কাজ করতে দিলাম না। বরং টিউশনি পড়ানো বাড়িয়ে দিলাম। সবাইকে বাঁচাতে হবে তো! সকালে বাড়িতে পড়াতাম, সারাদিন পৌরসভায় হাড়ভাঙা খাটুনি। বাড়ি ফিরে, কখনো-বা স্টেশন থেকে সোজা ছাত্রছাত্রীদের বাড়ি গিয়ে পড়িয়ে, রাতে ক্লান্তিতে মাতালের মতো টলতে-টলতে বাড়ি ফিরতাম। মনে হতো, মাথার উপর ভারী পাথরখণ্ড একটা। ভারে কুঁজো হয়ে যাচ্ছি, সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছি না। এসবের মাঝে একটু অবসর পেলেই কবিতা লিখতাম। কবিতা কখনও ছেড়ে যায়নি আমাকে।
(ক্রমশ) 

Comments