প্রাণেশ সরকার

কৃষ্ণনগর পৌরসভায় যখন কাজ শুরু করি, তখন চেয়ারম্যান ছিলেন ভোলানাথ দত্ত মহাশয়। প্রকৃত ভদ্রলোক এবং সুদক্ষ প্রশাসক। কর্মচারীদের সঙ্গে তাঁর চমৎকার সম্পর্ক ছিল; আর আমাদের কর্মীরাও ছিলেন সুদক্ষ। কিন্তু পৌরসভার আর্থিক অবস্থা খুবই খারাপ ছিল। আমাদের বেতন প্রতিমাসে হতো না। ট্যাক্স আদায় সীমিত। সরকার তিনমাস অন্তর ডিএ-র টাকা দিত। পার্ট পেমেন্ট হতো আমাদের। ১৯৭৬ সালে ইমারজেন্সির সময়ে সরকার মিউনিসিপ্যাল বোর্ড অফ কমিশনার্স-কে সুপারসিড করে অমিত কুশারী (আইএএস, এডিএম-জেনারেল, নদীয়া)-কে কৃষ্ণনগর পৌরসভার অ্যাডমিনিস্ট্রেটর নিযুক্ত করলো। সঙ্গে একজন এক্সিকিউটিভ অফিসার, সাধারণত তিনি হতেন কোনো অবসরপ্রাপ্ত ডব্লিউবিসিএস অফিসার। যেদিন এই ব্যাপারটা হলো, সেদিন ট্রেন দেরি করে চলায় অফিস পৌঁছতে আমার ১৫ মিনিট দেরি হয়। অফিস-চত্বরে পা দিয়েই বুঝতে পারি, চারদিকে থমথমে পরিবেশ। বড়োবাবু অমলেন্দু বাগচী বললেন, অ্যাটেনডেন্স রেজিস্টার আছে অ্যাডমিনিস্ট্রেটরের ঘরে। ওখানে গিয়ে দেখি, চেয়ারম্যান তাঁর চেয়ারেই বসে আছেন। পাশের চেয়ারে খুবই সুদর্শন, উজ্জ্বল, সপ্রতিভ এক যুবক বুশশার্ট ও ট্রাউজার্স পরে বসে।চেয়ারম্যান আমার দিকে হাজিরা-খাতা এগিয়ে দিয়ে বললেন, "কী ব্যাপার, তোমার দেরি কেন? তুমি তো সময়মতোই অফিসে আসো!" সবিনয়ে উত্তর দিই, "স্যার, ট্রেন লেট।" তিনি বললেন, "ঠিক আছে, এখনকার সময় দিয়েই সই করো।" অ্যাডমিনিস্ট্রেটরের দিকে ফিরে বললেন, "মিস্টার কুশারী, এই হলো আমাদের সেকেন্ড ক্লার্ক। ও কাজ জানে, সিনসিয়ার; ওকে দিয়ে আপনি কাজ পাবেন।" আমি দু'জনকে হাতজোড় করে প্রণাম করে বিদায় নিলাম। বড়োবাবু বললেন, "অ্যাডমিনিস্ট্রেটর দুটো ড্রাফট করতে দিয়েছেন। একটা আমি করছি, অন্যটা তুমি করো।তারপর দুটো ড্রাফট নিয়ে ওঘরে যাও।" আমি ড্রাফট খুব দ্রুত লিখে, দুটো ফাইল নিয়েই অ্যাডমিনিস্ট্রেটরের ঘরে যাই। ভূতপূর্ব চেয়ারম্যান ইতিমধ্যে চলে গেছেন। মিস্টার কুশারী চিঠি দুটো খুঁটিয়ে পড়ে বললেন, "বাঃ, ভালো হয়েছে। যাও, টাইপ করে নিয়ে এসো। টাইপ হয়ে গেলে, বড়োবাবুকে নিয়ে আসতে বলো।" বড়োবাবু অমলেন্দু বাগচী তদানীন্তন স্কটিশ চার্চ কলেজের বিএ, সুন্দর ড্রাফট করতেন। আমাকে কাজ উনিই শিখিয়েছিলেন। কিন্তু তখন তাঁর বয়স ৫৫-৫৬; কানে বরাবরই বেশ কম শুনতেন। যাইহোক, ফাইল নিয়ে উনি তো ওঘরে গেলেন। মিস্টার কুশারী বললেন, "আরে আপনি তো কানে কিছুই শুনতে পান না দেখছি! কাজ করবেন কীভাবে?" তিন-চারদিন পরে অ্যাডমিনিস্ট্রেটর ওই কানে না-শোনার যুক্তিতে ওঁর সার্ভিস টার্মিনেট করলেন, অর্ডার বেরিয়ে গেল। এরপর আমার পক্ষে যা মর্মান্তিক হলো, তা হলো এই যে, ওঁর পরিবর্তে আমাকে অফিসিয়েটিং হেড ক্লার্ক করা হলো। আমি তো স্তম্ভিত; মরমে মরে যাচ্ছি একেবারে! পিতৃতুল্য এই মানুষটি এই বয়সে চাকরি খুইয়ে সংসার চালাবেন কী করে! যাইহোক, অফিসের সিনিয়রমোস্ট কিছু স্টাফ গিয়ে অনুরোধ করলেন, ওঁর স্ত্রীকে অন্তত একটা কাজ দেওয়া হোক। দুই ছেলে ওঁদের, স্কুল-কলেজে পড়ে; চলবে কী করে সংসার! মিস্টার কুশারী শ্রীমতি বাগচীকে শহিদ অনন্তহরি প্রাথমিক পৌর বিদ্যালয়ে শিক্ষিকার কাজ দিলেন। 

সুতরাং আমাদের অফিসে ইমারজেন্সির প্রথম ক্যাজুয়ালটি হলেন অমলেন্দু বাগচী। এবার আমাকে অফিসিয়েটিং হেড ক্লার্ক করায় অফিসে গুঞ্জন উঠলো—"এ কী! একটা বাচ্চা ছেলে প্রাণেশ, মাত্র চারবছর চাকরি করছে; আমরা সিনিয়র এমপ্লয়িরা থাকতে ও কেন? এ তো অন্যায়!" কথাটা অ্যাডমিনিস্ট্রেটরের কানে গেল। উনি তখনই একটা নোটিশ জারি করলেন, অফিসিয়েটিং হেড ক্লার্কের পদে কাজ করার জন্য অফিসের স্টাফ (ন্যূনতম যোগ্যতা ম্যাট্রিকুলেশন বা সমতুল পাস) যাঁরা ইচ্ছুক, অমুক দিন একটা লিখিত পরীক্ষায় বসবেন। কর্তৃপক্ষ তারপর বিবেচনা করবেন ওই পরীক্ষার ভিত্তিতে। পরীক্ষা হলো। পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণ করলেন এক্সিকিউটিভ অফিসার। খাতা দেখা হলো। অ্যাডমিনিস্ট্রেটর সংশ্লিষ্ট পরিক্ষার্থীদের (তাদের মধ্যে আমিও ছিলাম) ডেকে খাতা দেখালেন। পরিশেষে বললেন, "প্রাণেশ সরকার-ই যোগ্যতম, ওকেই আমরা ওর পদে বহাল রাখলাম।" আমি তো আমার মতো কাজ করতে লাগলাম। কিন্তু অফিসে আমার কিছু শত্রু তৈরি হলো। যতদিন চাকরি করেছি ওখানে, ততদিন ওরা শত্রুতা করেছে আমার সঙ্গে। অবশ্য কোনো ক্ষতি করতে পারেনি। ১৯৭৭-এর জানুয়ারি থেকে আর অফিসিয়েটিং নয়, পাকাপাকিভাবেই হেড ক্লার্ক করা হলো আমাকে। দায়িত্ব বেড়ে গেল। সারাদিন প্রচুর করেসপন্ডেন্স করতে হয়। তাছাড়া কোটেশন ও টেন্ডার প্রসেস করার কাজ, বোর্ড অফ কমিশনার্সের মান্থলি মিটিংয়ের এজেন্ডা-সহ নোটিশ তৈরি করা, মিটিংয়ের দিন সমস্ত কাগজপত্র ও ফাইল নিয়ে মিটিংয়ের প্রিসাইডিং অফিসার (সাধারণত চেয়ারম্যান; তাঁর অনুপস্থিতিতে ভাইস-চেয়ারম্যান)-কে ব্রিফ করা এবং মিটিংয়ের এজেন্ডা অনুযায়ী রেজোলিউশন নোট করা, আর পরেরদিনই মিটিংয়ের সম্পূর্ণ মিনিটস লিখে ফেলা এবং তদনুযায়ী ফলো-আপ— সবই করতে হতো আমাকে। মিটিংয়ের দিন সকাল আটটায় অফিসে পৌঁছে একা কাজ করতাম। দারোয়ান রঘুবীর প্রধান ঘর খুলে দিত, চা-টা এনে দিত। রাত আটটা-ন'টায় বাড়ি ফিরতাম। পরেরদিনও তাই। এসব অবশ্য পৌরপ্রশাসক বা অ্যাডমিনিস্ট্রেটরের সময়কাল শেষ হয়ে পুনর্বার নির্বাচিত কমিশনারদের বোর্ড গঠন হওয়ার সময়ের কথা।

আমি চারজন অ্যাডমিনিস্ট্রেটরের সঙ্গে কাজ করেছি। অমিত কুশারী, প্রদীপ ভট্টাচার্য (আইএএস, এডিএম-ল্যান্ড রিফর্মস), বিজয় চ্যাটার্জি (আইএএস, এডিএম-জেনারেল) এবং প্রণব ভট্টাচার্য (ডব্লিউবিসিএস-এক্সিকিউটিভ)। এঁদের আমলে একজন করে এক্সিকিউটিভ অফিসার এবং ফিনান্স অফিসারও থাকতেন। প্রথম-প্রথম সমস্ত অ্যাডমিনিস্ট্রেটর-ই নিজেরাই রেজোলিউশন লিখতেন এবং এক্সিকিউটিভ অফিসার খাতায় নম্বর ও তারিখ দিয়ে সেটা কপি করতেন। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই ওই দুটো কাজ আমাকেই করতে দিতেন অ্যাডমিনিস্ট্রেটররা। আমাকেই রেজোলিউশনের ড্রাফট করতে বলতেন। আমি ফাইলে তা পুট-আপ করলে, প্রয়োজনমতো কিছু সংশোধন করতেন কখনও। তবে সেটা ক্বচিৎ-ই হতো। তারপর প্রসিডিং বুকে লিখতাম। এছাড়াও সারাদিন প্রচুর চিঠিপত্র (সরকারের বিভিন্ন বিভাগে এবং কখনও করদাতাদের সঙ্গেও) লিখতে হতো। একটা কথা বলতে পারি, কৃষ্ণনগর পৌরসভার দৈনন্দিন চিঠিপত্র লেখার যে পরিমাণ, তা যে-কোনো সরকারি বিভাগের থেকে অনেক-অনেক বেশি। এটা আমি বলছি পৌরসভায় আমার কর্মরত সময়ের কথা, অর্থাৎ ১৮ জুলাই ১৯৭৩ থেকে ২৮ সেপ্টেম্বর ১৯৮৪ পর্যন্ত। জেনারেল সেকশনে আমার টিম-মেম্বাররা খুব দক্ষ ছিল। সেকেন্ড ক্লার্ক পথক্লান্ত বাগচী, টাইপিস্ট প্রকাশ কর্মকার, ডেসপ্যাচ ক্লার্ক শেফালি চ্যাটার্জি, থার্ড ক্লার্ক (রিসিভিং) বিশ্বনাথ সান্যাল ও পরে রত্না দাস, পিওন মণি দাস ও কৃষ্ণ দাস (এঁরা সাইক্লোস্টাইল মেশিনও চালাতেন প্রয়োজনমতো)। তাছাড়া অ্যাকাউন্টস, ট্যাক্স, লাইসেন্স, কনজারভেন্সি, পিডব্লিউডি, মেকানিক্যাল, ওয়াটার ওয়ার্কস, মোটর ভেহিকলস— সব বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগের জরুরি কাজ করতে হতো। কারণ, হেড ক্লার্ককেই সমস্ত ভাইটাল বিষয়ে প্রধান প্রশাসক (চেয়ারম্যান বা অ্যাডমিনিস্ট্রেটর)-কে ব্রিফ করতে হতো। কাজের চাপ ছিল খুব। শিক্ষাবিভাগের (পৌরসভার ছয়টি প্রাথমিক বিদ্যালয় ছিল) কাজও আমাকেই দেখতে হতো। 

প্রসঙ্গত বলি, ১৯৮১ সালের সেন্সাস যখন হয়, আমি তখন কৃষ্ণনগর শহরের সেন্সাস সুপারিন্টেন্ডেন্ট ছিলাম, হেড ক্লার্ক হিসেবে আমার দৈনন্দিন কাজের পাশাপাশি। জেলাশাসকের অফিস থেকে একটা জিপ দেওয়া হয়েছিল; সারা শহর জুড়ে ক্ষেত্রসমীক্ষা ও অন্যান্য কাজ করতে হতো। ট্যাক্স বিভাগের শশাঙ্ক চক্রবর্তী ছিলেন আমার সহকারী। এই জনগণনার কাজ খুব ভালো হয়েছিল। আমিই অসংখ্য এন্যুম্যারেটর ও সুপারভাইজার নিয়োগ করেছিলাম। কৃষ্ণনগর কলেজিয়েট স্কুলে ওদের প্রশিক্ষণও দিয়েছিলাম আমি ও শশাঙ্কবাবু। সিনিয়র ডেপুটি কালেক্টর পল্লব গোস্বামী নদীয়ার চিফ সেন্সাস অফিসার হিসেবে আমাকে খুব সাহায্য করেছিলেন। একটা কথা এখানে উল্লেখনীয়, তা হলো, পরবর্তীকালে আমাদের সমস্ত এন্যুম্যারেটর ও সুপারভাইজার সরকারি চাকরি পেয়েছিলেন। শহরের বেশ কিছু তরুণ-তরুণী, যাঁরা সেন্সাসের কাজ করেছিলেন, তাঁরা অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার হারিয়ে ফেলায় আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন। আমি সবাইকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটারের অ্যাটেস্টেড কপি দিয়েছিলাম। 

১৯৮১ সালে কৃষ্ণনগর পৌর কর্তৃপক্ষ আমাকে দ্য ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার অ্যান্ড আর্বান অ্যাডমিনিস্ট্রেশন-এ পড়াশোনার জন্য ইন-সার্ভিস ট্রেনি হিসেবে ডেপুট করেছিল। আমি প্রতি সোম থেকে শনিবার বাড়ি থেকে কলকাতার কলেজ স্ট্রিট ক্যাম্পাসে যেতাম, ক্লাস করতাম। খুব এক্সটেন্সিভ স্টাডি করেছি ওই প্রতিষ্ঠানের লাইব্রেরিতে। ট্রেনিং-এর সময়ে আমাদের প্রচুর ফিল্ড স্টাডি করতে হয়েছিল। এই উপলক্ষে ফলতা ওয়াটার ওয়ার্কস (পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম জলপ্রকল্প; প্রথমটি আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়ায়), ধাপায় কমপোস্ট ম্যানুওর তৈরির প্রকল্প (এটা কৃষ্ণনগর পৌরসভাতেও গোদাডাঙার মাঠে ছিল) এবং সলিড অ্যান্ড লিকুইড ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট, কলকাতা মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশনে কীভাবে ট্যাক্স ফিক্সেশন ও প্রপার্টি ভ্যালু অ্যাসেসমেন্ট করতে হয় ইত্যাদি কাজ পর্যায়ক্রমে স্টাডি করতে ও রিপোর্ট তৈরি করতে হয়েছিল। চূড়ান্ত পরীক্ষায় (থিওরিটিক্যাল ও প্র‍্যাকটিক্যাল) আমি ফার্স্ট ক্লাস সেকেন্ড হয়েছিলাম। এই ফলে আমাদের চেয়ারম্যান সুহৃদ চ্যাটার্জি (ব্রিটিশ আমলের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট এবং অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের কাকা) খুশি হয়েছিলেন খুব। আমাকে বোর্ড অফ কমিশনার্সের মিটিং-এ অভিনন্দন জানানো হয় এবং আমাকে দুটো স্পেশাল ইনক্রিমেন্টও দেওয়া হয়। আমি পৌরসভার কাজে থাকলে সম্ভবত এক্সিকিউটিভ অফিসার হতে পারতাম, ওই ডিপ্লোমার জন্য। কিন্তু ১৯৮৪-র ২৮ সেপ্টেম্বর আমি পৌরসভা থেকে লিয়েন নিয়ে, কালীনগর উচ্চ বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে ২৯ সেপ্টেম্বর যোগদান করি। ডিস্ট্রিক্ট ইন্সপেক্টর অফ স্কুলস-এর অ্যাপ্রুভ্যাল পাওয়ার পর পৌরসভা থেকে ইস্তফা দিই। আমার জীবনে এই কর্মস্থল পরিবর্তন একটা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। কারণ, শিক্ষকতার কাজ বরাবরই ভালোবাসতাম আমি, আর এবার স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করায় লেখালেখিতে আরও বেশি করে মন ও সময় দিতে পারলাম। একথার অর্থ এই নয় যে, আমি পৌরকর্মী হিসেবে কাজে ফাঁকি দিয়েছি কখনও। বরং খুবই নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করেছি। আমার কাজের প্রমাণ ছড়িয়ে আছে আমার সময়ের অসংখ্য ফাইলে এবং রেজোলিউশন বইয়ে।

১৯৭৮-৭৯তে অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জেমস জে ওয়াইজ নামে স্নাতকোত্তর স্তরের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের এক উজ্জ্বল তরুণ এসেছিলেন আমার কাছে পৌরসভায়। ভারত সরকারের শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিভাগের সচিব তাঁকে পাঠিয়েছিলেন রাইটার্সে, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের শিক্ষা সচিবের কাছে। তিনি আবার তাঁকে পাঠালেন নদীয়ার জেলাশাসক রাণু ঘোষের কাছে। রাণু ঘোষ জেমসের আবেদনপত্রের উপরে লিখলেন—"অ্যাডিশনাল ডিএম, নদীয়া (জেনারেল) কাম অ্যাডমিনিস্ট্রেটর, কৃষ্ণনগর মিউনিসিপ্যালিটি মে প্লিজ হেল্প দ্য অস্ট্রেলিয়ান স্টুডেন্ট।" অমিত কুশারী সরাসরি সেই চিঠিতে নোট দিলেন—"প্রাণেশ, প্লিজ হেল্প জেমস।" একদিন দুপুর একটা নাগাদ জেমস এল আমার কাছে। পরিচয়পর্ব শেষে সে জানালো যে, সে কাজ করছে উনবিংশ শতকের শেষভাগে অবিভক্ত বাংলার আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিস্থিতি নিয়ে। আরও বললো যে, সে শুনেছে কৃষ্ণনগর পৌরসভায় এ-বিষয়ে অনেক তথ্য আছে। আমি তাকে বললাম, "হ্যাঁ অবশ্যই আছে। তুমি আমাদের পুরোনো রেজোলিউশন বুক দ্যাখো।" এই বলে আমার অভিজ্ঞ পিওন মণিদাকে বললাম, "মণিদা, সাহেবকে ১ থেকে ১০ নম্বর বইগুলো বের করে দাও।" মণিদা হলঘরে ওকে বইগুলো দিল। জেমস আমাদের সুবিশাল হলঘরের একপাশে বসে বইগুলো পড়তে শুরু করলো। মণিদা ওকে চা দিয়ে এল। শেফালদি ও রত্নাদি তো সাহেবকে দেখে খুব মজা পেয়েছে! আমাকে বলছে, "যান, আপনি এবার জেমসের সঙ্গে অস্ট্রেলিয়া চলে যান। ওখানে নিশ্চয়ই ওর সুন্দরী বোন আছে। তাকে বিয়েটিয়ে করে ওদেশেই কাজকম্মো জুটিয়ে থেকে যান। এত সুন্দর ইংরেজি জানেন আপনি; সাহেবের সাথে যখন কথা বলেন, আপনার উচ্চারণ শুনে তো মনেই হয় না আপনি ভেতো বাঙালি!" আমি বলি, "ওসব ছাড়ুন। বাদকুল্লা ছেড়ে কোথাও যাচ্ছি না আমি। আপনারা বরং কাজের ফাঁকে-ফাঁকে ওর সুবিধা-অসুবিধার প্রতি খেয়াল রাখুন।" শেফালিদি বলেন, "সেকথা বলতে হবে না আপনাকে। আমি মণিদাকে কফি, কনডেন্সড মিল্ক আর ভালো বিস্কুট আনতে বলেছি। এবার কফি হবে। সাহেবকে দেবো, আমরাও খাবো।" আমাদের ঘরেই চা-কফি করার ব্যবস্থা ছিল। ভালো কাপ-প্লেটও ছিল। প্রথমদিন জেমস বেলা ১-১৫ থেকে ৫-৩০ পর্যন্ত একটানা পড়াশোনা করলো। রেজোলিউশন বুকের বিভিন্ন পৃষ্ঠায় কাগজের ফ্ল্যাপ গুঁজে রাখলো। কিছু পাতার ছবিও তুলে নিল ওর খুবই দামি ছোটো ক্যামেরায়। ৫-৩০এ অফিস বন্ধ হলো। আমি বললাম, "চলো, বেরোনো যাক এবার। অনেক কাজ করেছো।" জেমস মিষ্টি করে হেসে আমার দু'হাত চেপে ধরে বললো, "তোমাকে অজস্র ধন্যবাদ। খুব কাজে আসবে আমার এইসব নথি।" ও স্টেশনের কাছে সিটি হোটেলে উঠেছে। আমিও স্টেশনে যাবো ৬-৩০এর লোকাল ধরতে। বললাম, "চলো হেঁটেই যাই। যেতে-যেতে কথা হবে।" আমার প্রশ্নের উত্তরে জেমস বললো, ডক্টর শিবনারায়ণ রায় (কলকাতায় ফিরে যিনি 'জিজ্ঞাসা' সাহিত্যপত্রটি সম্পাদনা ও প্রকাশ করতেন; আমি কবিতা লিখেছি ওঁর কাগজে) আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পলিটিক্যাল সায়েন্সে অধ্যাপনা করছেন। উনিই আমাকে ভারতে পাঠালেন। উনিই আমার রিসার্চ গাইড। আসলে, পোস্টগ্র‍্যাজুয়েশনের সেভেন্থ ও এইটথ পেপারের জন্য আমাদের গবেষণালব্ধ মৌলিক কাজ জমা দিতে হয়।" আমি তো শুনে মোহিত হয়ে গেলাম। কী সুন্দর চিন্তাভাবনা ওদের বিশ্ববিদ্যালয়ের! আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে তো এই ব্যবস্থা নেই! কথা বলতে-বলতে আমরা চলে এলাম স্টেশনের কাছে। জেমস বিদায় নিয়ে হোটেলে চলে গেল, আর আমি স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে। আমার ট্রেন আমার জন্য অপেক্ষা করছে। 

জেমস প্রায় দশদিন আমাদের অফিসে পাগলের মতো পড়াশোনা ও কপি করলো। আমরা সবাই ওকে যথাসাধ্য সাহায্য করেছি। বিশ্বনাথ গাঙ্গুলিও সাহায্য করেছেন ওকে। মাঝেমধ্যে মিস্টার কুশারীও খোঁজখবর নিতেন। আমি টিফিনের সময় ওকে বাইরে নিয়ে গিয়ে চা-টোস্ট খাওয়াতাম। একদিন অধরের সরভাজা-সরপুরিয়াও খাইয়েছি। ঘূর্ণির মাটির পুতুলও দেখালাম। ও তো মুগ্ধ! আমার দেশের অতিথি-ছাত্র; যতটা অতিথি-সৎকার করা যায় আমার সাধ্যমতো তা করেছি। এখান থেকে কলকাতায় যাবে ও। ওখানে পার্ক স্ট্রিটে এক গোয়ানিজ পরিবারের পেয়িং গেস্ট হিসাবে থাকবে। কৃষ্ণনগর থেকে চলে যাওয়ার আগের দিন সন্ধ্যায় ওর হোটেলে আমাকে ডিনারের আমন্ত্রণ জানালো জেমস। আমার পছন্দ অনুযায়ী হাতেগড়া রুটি, চিকেন কষা ও আইসক্রিম অর্ডার করলো। আর্লি ডিনার সেরে, ওকে শুভরাত্রি জানিয়ে বাড়ি ফিরলাম আমি। 

জেমস কলকাতায় গিয়ে ন্যাশনাল লাইব্রেরি, রামমোহন লাইব্রেরি ফাউন্ডেশন, বঙ্গীয় সাহিত্য সমাজ ইত্যাদি জায়গায় কাজ করতে লাগলো। তখন তো মোবাইলের যুগ নয়। চিঠিতে ও আমাকে ওর কাজের আপডেট দিত। এবার যা হলো, তাতে আমি চমকে গেলাম! আগেই বলেছি, কলকাতায় ও গোয়ানিজ রোমান ক্যাথলিক ক্রিশ্চান এক পরিবারে পেয়িং গেস্ট ছিল। ওই পরিবারের ছোটো মেয়ে লীলা গোমস-কে ও বিয়ে করছে। লীলা ইংরেজিতে এমএ। জেমস বিয়ের কার্ড পাঠিয়েছে আমাকে। সঙ্গে সুদীর্ঘ এক চিঠিতে সবিস্তারে ওর প্রণয়কাহিনি বর্ণনা করেছে। এর মধ্যে মেলবোর্নেও গিয়েছিল। ওর মা-বাবা-দিদি-জামাইবাবু বিয়েতে আসছেন। সেন্ট পলস ক্যাথিড্রালে রিসেপশন। বিশ্বনাথ গাঙ্গুলিকেও নিমন্ত্রণ জানিয়েছে। আমাকে অবশ্যই ওদের বিয়ের রিসেপশনে উপস্থিত থাকতে হবে বলে সনির্বন্ধ অনুরোধ জানিয়েছে। গিয়েছিলাম আমি। বিশুদাও গিয়েছিলেন। ফিরেও এসেছিলাম গভীর রাতের লালগোলা প্যাসেঞ্জার ধরে। আমাদের দু'জনের বাড়ির জন্য বিশাল কেক পাঠিয়েছিল। জেমস আমাদের সঙ্গে ওর এবং লীলাদের পরিবারের সকলের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল বেশ আন্তরিকভাবে। ওদের শুভ আগামীদিন প্রার্থনা করে, ফিরে এসেছিলাম। দেশে ফিরে ও লিখেছিল, পাস করে ও মেলবোর্নেই পড়াচ্ছে। লীলাও একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াচ্ছে। বেশ কিছুকাল চিঠিপত্রে সংযোগ ছিল আমাদের। ও ফিরে গিয়ে ডক্টর শিবনারায়ণ রায়কে আমার কথা, আমার কবিতার কথা বলেছিল। আমার অনেক কবিতা ওকে শুনিয়েছিলাম। মুখে-মুখে ইংরেজি অনুবাদও করে দিতাম, ওর বুঝতে সুবিধা হবে বলে। পরে তো 'জিজ্ঞাসা'-য় আমি বেশ কিছু কবিতা লিখি এবং ডক্টর রায়ের সঙ্গে সংযোগ রচিত হয়। ওঁর অনেক বই আমি পড়েছি। একজন মনীষী উনি। এমএন রায়ের বংশধর এবং একজন প্রথিতযশা র‍্যাডিক্যাল হিউম্যানিস্ট। আমার সৌভাগ্য, ওঁর মতো একজন মানুষের সঙ্গে আমার সংযোগ হয়েছিল। 

কলেজ ক্যাম্পাস ছিল আনন্দে ভরপুর। স্কুলজীবনেই কবিতা লেখা শুরু করেছিলাম। স্কুলের বার্ষিক পত্রিকা 'অগ্রগতি'-তে কবিতা, প্রবন্ধ প্রকাশিত হতো। সহকারী প্রধানশিক্ষক রেবতীকান্ত রায় 'অগ্রগতি'-র সম্পাদক ছিলেন। তিনি আমাকে কবিতা লেখায় উৎসাহ দিতেন। নিজেও কবি ছিলেন। আমাদের পাড়াতেই শীতলাতলার কাছে ছোটো একটা ঘর ভাড়া নিয়ে বসবাস করতেন এই অকৃতদার উজ্জ্বল বরেণ্য মানুষটি। তাঁর ঘরে স্টোভে চা করে খাওয়াতেন স্যার। ক্লাস টেন-ইলেভেন এবং কলেজের দিনগুলিতে সপ্তাহে একদিন স্যারের বাসাবাড়িতে নিয়মিত যেতাম। চা খেতে-খেতে আমার পরমপূজ্যপাদ শিক্ষকের মুখে তাঁর নিজের লেখার পাশাপাশি বুদ্ধদেব বসু, সুধীন্দ্রনাথ দত্তের কবিতা শুনতাম; রবীন্দ্রনাথ তো ছিলেন-ই। তিনি আমাকে টিএস এলিয়ট, ডব্লিউবি ইয়েটস, এজরা পাউন্ড, অডেন, হুইটম্যান, খলিল জিব্রানের কবিতাও শোনাতেন। শেক্সপিয়রের নাটক ও সনেট নিয়ে চমৎকার আলোচনা করতেন, আর আমাদের মাধ্যম ছিল অবশ্যই ইংরেজি। আমি ওঁর কাছে খুব ঋণী। সাহিত্যে আর যিনি আমাকে দীক্ষিত করেছিলেন, বিশেষত বাংলা সাহিত্যে, তিনি আমাদের স্কুলের দর্শনের শিক্ষক কামনা সাহা। আমার প্রথম কবিতার বই অন্ধ করোটির রেখা  আমি রেবতীকান্ত রায়কেই উৎসর্গ করেছিলাম। এর অনেক পরে বাংলাদেশের অধ্যাপক ডক্টর রহমান হাবিবের বাংলা গ্রন্থ রাজা রামমোহন রায় : দর্শন ও ধর্মচিন্তা-র যে ইংরেজি অনুবাদ করি Rammohan Roy শিরোনামে, সেই বইটি আমি আমার পরমশ্রদ্ধেয় তিনজন স্কুলশিক্ষক কামনা সাহা, সুনীল চক্রবর্তী এবং দেবাশিস মণ্ডলকে উৎসর্গ করেছি। কলকাতার সোপান পাবলিশার্স ২০১২ সালে বইটি প্রকাশ করেছিলেন। 
(ক্রমশ)

Comments