মোহিনীমোহন গঙ্গোপাধ্যায়। জন্ম পুরুলিয়ার শিয়ালডাঙায় হলেও তাঁর কবিতার আবেগ রাজ্য-দেশের গণ্ডি অতিক্রম করে ছুঁয়ে ফেলেছে ইজরায়েলকে। চিন্তনের সমান্তরালে তিনি একই সাথে হেঁটে যান ইজরায়েলি কবি ইয়েহুদা আমিচাইয়ের সঙ্গে। এটাই কবিতার মৌলিক বৈশিষ্ট্য। কবিতাকে সীমান্তের কাঁটাতারে আটকানো যায় না, কবিতা কোনোদিন সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদকে প্রশ্রয় দেয়নি। মোহিনীমোহন গঙ্গোপাধ্যায় 'কেতকী'-তে লিখেছিলেন, "কবিতাই পারে প্রাতিষ্ঠানিক দাঢ্য ও অশুভ শক্তিকে প্রতিহত করতে।" কবিতার আবেগে জাগে বিশ্বনাগরিক, ঝড় ওঠে চিন্তায়। ওয়ার্ডসওয়ার্থ, কিটসের কবিতায় সোমরস যেমন ভুলিয়ে দেয় জীবনের অপ্রাপ্তি; তেমনি ড্রাইডেন, পোপ মনে করিয়ে দেয় আমাদের সমাজ, শাসক ও তার রাজনীতি। আসলে শাসক বদল হলেও শাসকের রূপ বদল হয় না। এ-সহজ সত্য মানুষ ভুলে গেলেও কবিতা ভুলে যায় না, তাই কবিতায় উঠে প্রতিবাদ। ব্রেখটকে বলতে শোনা যায়, "একদিন লোকজনকে শুধুমাত্র নেতাদের কার্যকলাপের জন্য নয়, বরং সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভয়াবহ নিশ্চুপ থাকার কারণে পস্তাতে হবে।" কবিরা প্রতিবাদ করেছে, পরিবর্তনের ডাক এসেছে শব্দে, ঘুমাতে পারেনি চেতনা। মোহিনীমোহন গঙ্গোপাধ্যায়ও তাঁদের ব্যতিক্রম নন। লিও তলস্তয় আক্ষেপ করতেন, "সবাই পৃথিবীকে বদলানোর কথা ভাবে, কিন্ত নিজেকে বদলানোর কথা ভাবে না।"
মোহিনীমোহন গঙ্গোপাধ্যায় শিক্ষকতা দিয়ে জীবন শুরু করেন। ১৯৫৫ সালে 'সাপ্তাহিক সংগঠন' পত্রিকায় প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়। দীর্ঘদিন 'কেতকী'-র সম্পাদনা করেছেন। সামলেছেন 'পাক্ষিক মর্মবীণা', 'সাপ্তাহিক নীহার', 'সাপ্তাহিক মুগবেড়িয়া'-র সম্পাদনা। তাঁর কবিতা প্রকাশিত হয়েছে দেশে-বিদেশে বহু পত্রপত্রিকায়। লিখেছেন 'হিন্দবাণী', 'মৌচাক', 'শুকতারা', 'কিশোর ভারতী', 'কৃত্তিবাস'-এর মতো পত্রিকায়। লন্ডন, সুইডেন থেকেও প্রকাশিত হয়েছে তাঁর কবিতা। তাঁর উল্লেখযোগ্য সৃষ্টিতে রয়েছে 'আঞ্চলিক ভাষার কবিতা', 'অবাক পৃথিবী', 'সেই মানুষ', 'শস্যের মলাট' ইত্যাদি। তাঁর কবিতায় আঞ্চলিকতার মধ্যে ধরা পড়েছে জীবনের চিরন্তন দ্বন্দ্ব। তিনি লিখতে পারেন, "ই মাটি সবারই আকাশ সবার / সবার লাগ্যে সব কিছু সমান না হল্যে / কাল্লায় কাল্লায় শোধ লিব আইঞ্জ্ঞা / ই কনোহ অন্যায় লয়..."। তবু আক্ষেপ জাগে, ভারী পাথরের আড়ালে কবি থেকে গেছেন নুড়ির মতো। ইতিউতি সম্মান পেলেও সেভাবে তাঁকে নিয়ে আলোচনা হয়নি আজও। গুটিকয়েক কবিতাপ্রেমীদের মধ্যেই বেঁচে আছেন এই প্রবাদপ্রতিম কবি।
কবি সিম্বলিজমকে ব্যবহার করেছেন তাঁর কবিতার আখ্যানে। জীবনের মেটাফরকে দিয়েছেন কবিতায় প্রশ্রয়। ভাবনায় লালন করেছেন যন্ত্রণা। 'জাতক' কবিতায় তিনি লিখছেন, "প্রসব যন্ত্রণায় কে তুমি আকাশ ফাটাও?.../ অপেক্ষা করেছে রমণী জননী হবার যন্ত্রণায় সর্বাঙ্গে মোচড় দেয়"। তাঁর কবিতার একই সুর ধ্বনিত হয় ইজরায়েলের কবি আমিচাইয়ের কবিতায়। আমিচাই লিখছেন, "আই ওপেনড অ্যান আয়রন ডোর দ্যাট হ্যাড রিটেন অন ইট ইমার্জেন্সি অ্যান্ড আই এন্টারড উইদিন।" প্রসবযন্ত্রণা ও লৌহকপাটের কনসিটের অনুপম আগুনে গলে যায় কাঁটাতার। বর মার্লে বলেছিলেন, "অন্য কেউ না, আমরাই পারি আমাদের মনকে মুক্ত করতে।" ভালোবাসতেন বাংলা ভাষাকে। তাই সহজে বলতে পারতেন, "বাংলা ভাষার জন্য চিরকাল দিতে পারি প্রাণ।"
তাঁর 'শেষ কথা মানুষের জয়' কবিতায় তিনি যা বলেছেন, তাই যেন বলতে চেয়েছেন কবি আমিচাই। "বাঘের চোয়ালে রাখে হাত / আকাশ জিতে নিতে দেখার সাহস / নীলের ফোয়ারা মেখে স্বপ্ন মাখা দিন /... বিশ্বায়ন পাল্টে দেয় জীবনের রঙ / স্বপ্ন ছিঁড়ে কে ওড়ায় ঘুড়ি? / কাদের লেখায় আমরা কাঁচের পুতুল? / কাদের নেশায় আমরা সখের শিকার? /...সারা দেশ খুন মাখা ভয়ঙ্কর আরেক চম্বল।" আমিচাই বলছেন, "রেস্টলেস আই শ্যাল ওয়ান্ডার অ্যাবাউট / হাঙরি ফর লাইফ আই উইল ডাই।" উন্নয়নে পাল্টে যাচ্ছে পৃথিবীর চেনা মুখ। উন্নয়নের ভাইরাসে আমরা সবাই ক্রমশ অচেনা হতে শুরু করেছি। নিত্যনতুন তথ্য, নতুন প্রযুক্তিতে নিজেকে স্বাভাবিক রাখার সেলফি একটা ট্রেন্ড। ওয়াল্ট হুইটম্যানের রোমান্স ভেঙে, চেনা জায়গায় অল্ডাস হাসলের নবপৃথিবীর সাহসী পদক্ষেপ। কবি মোহিনীমোহন তাই খেয়াল রাখেন বাঘের চোয়াল, কাঁচের পুতুল। কারণ কবি জানেন, পরিবর্তন আসবেই। শেক্সপিয়র তাঁর সনেটে বলেছেন, হয় সময়, নয়তো নিয়তি বয়ে আনবে পরিবর্তন। যদিও কবি মোহিনীমোহন আশাবাদী নন, বরং টমাস হার্ডির নিয়তিবাদে ভরসা রাখেন বেশি। তাই তো 'রাইডার টু দ্য সি' নাটকের মারিয়ার মতো কবি জীবনের অন্তিম গন্তব্যে চম্বলের কথা উল্লেখ করেছেন।
কবি আমিচাই যেখানে শেষ করেন, কবি মোহিনীমোহন সেখান থেকেই শুরু করেছেন। কবি 'ধান' কবিতায় কিটসের শরতের কথা বলতে চাননি, বরং শোকাহত মানুষের এলিজি রচনা করেছেন। "ভালোবাসার ফসল ঘরে তুলব বলেই / কৃষক সহচর আমিও একজন জন্ম প্রেমিক / ক্ষুধার গল্প আছে বলেই অন্নের কথা সবাই বলে।" একই কথা বলা আমিচাই—"স্পিলড ব্লাড ইজ নট দ্য রুটস অফ ট্রিজ বাট ইটস দ্য ক্লোজড থিংস টু রুটস উই হ্যাভ।" ক্ষুধার গল্পে তিনি মনে করিয়ে দেন চল্লিশ দশকের ছবি। 'নবান্ন' নাটকের কুঞ্জ-রাধিকার ভালোবাসার স্রোতে ছিল একজন জন্মপ্রেমিকের রেটোরিক। অন্যদিকে, তাঁর 'নতুন ঘুড়ির খোঁজে' কবিতায় কবি অন্যরকম—"ঘুড়ি কেটে কেটে গেছে হাতে আছে লাটাই /...ঘুড়ি তার কেটে গেছে সব যুদ্ধ এখন থেমেছে / অথচ অনেকে কিছু জয় করতে বাকি / তবে কেন হাতের পতাকা অন্যের হাতে চলে যায় /...সব পাখি ফিরে আসে সব নদী চলে যায় ঘরে।" কবি আমিচাই লেখেন, "আই উইদিন মি / ম্যাই হার্ট উইদিন মাই হার্ট /আ মিউজিয়াম।" লেখক সমারসেট মমের বন্ধু হতে চাননি। জীবনকে বুঝতে চেয়েছেন বাস্তবে। 'টিন্টার্ন আবি' কবিতার দুঃখ তিনিও অনুভব করেন।
ওয়ার্ডসওয়ার্থ বলেছিলেন, "ওয়ার্ল্ড ইজ টু মাচ উইথ আস"। কবি মোহিনীমোহন একইকথা বলেছেন তাঁর 'গোলাপ বাগানের ঝড়' কবিতায়—'বয়স অনেক হলো সত্তর পেরিয়ে গেছি কবে / ভালোবাসাহীন আমি একা পড়ে আছি।" পাশে কবিতার বন্ধু আমিচাই—"এভরিথিং উইল বি অ্যাজ বিফোর"। কবি ইউলিসিস নন। শেলির ওয়েস্টউইন্ডের মতো মিরাকেল তাঁর নেই। অথচ অনাদিসংগ্রামে পালাবার পথও নেই। সময়ের স্রোতে তাই বিশ্বাস হারিয়েছেন। ব্রেখটের প্রতিবেশী হয়ে মোহভঙ্গ হয়েছে। বুঝেছেন, জীবন যেন ক্ষুধিত পাষাণ। নিজের জীবনের গল্প নিজেকে বলা যায় না, হাতে সময় তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যায়। সঞ্চয়ে তাই শুধু প্রতিবিম্ব। 'ছায়াসঙ্গী' কবিতায় কবি বলছেন, "আমি আমার ছায়া একসঙ্গে থাকলেও / দুজনের কোনো বন্ধুত্ব হলো না।" কবি আমিচাই লিখছেন, "উই মেড আওয়ারসেলভস আ উমব অফ ডেঞ্জার...আ হাউস অফ ড্রিডিং ওয়ারস।"
কবি মোহিনীমোহন হেঁটে যান কবি আর্নল্ড-এর ডোভার বিচের নির্জনতায়। একাকী চাঁদের আলোয় শুধু সংশয়। তিনি দেখেন কবি আমিচাই একরাশ বিশ্বাস নিয়ে অপেক্ষা করছেন, "গড ফুল অফ মারসি দ্য প্রেয়ার ফর ডেড।" কবি মোহিনীমোহন হেঁটে গেছেন কবিতার হাজারদুয়ারিতে। জীবনের চড়াই-উতরাই পেরিয়ে অনুভব করেছেন মৌলিক সত্তাকে। তাই বলতে পেরেছেন, "পাথরের কাছে যাই বুক ভরা ভালবাসা খুঁজি / পাথর নির্বাক কিছুই শোনে না / পাথরকে পাথর দিয়ে ঠুকে ঠুকে তাই আগুন জ্বালাই।"
Comments
Post a Comment