ফারহানা আহমেদ

অহনার বয়স ত্রিশের কোঠায়। চার ভাইবোনের একে-একে সবার বিয়ে হয়ে গেছে। সে তার মায়ের সেজোকন্যা। ছোটোটার বিয়ে তার জন্য আটকে ছিল। কতদিন আর আটকানো যায়! একদিন তারও বিয়ে হয়ে গেল। 

অহনা তার মায়ের রঙ পেয়েছে। কালো বললে ভুল হবে। বেশ কালো। উচ্চতা কম। তার ওপর লেখাপড়াও তেমন হয়নি। স্কুলে তার মন বসতো না। কলেজটাও কেমন পেরিয়ে গেছে। ভালো কোনো বিষয় না-পাওয়ায় সে একটা সাধারণ কলেজে বিএ-তে  ভর্তি হয়েছিল। এখন সেখানেও সে অনিয়মিত ছাত্রী।

অহনার বাবা অনেক চেষ্টাচরিত্র করে একটা-দুইটা প্রস্তাব আনে। কিন্তু শেষ অব্দি টেকে না। তিনি মোটামুটি মেনে নিয়েছেন যে, এই মেয়েকে বিয়ে দিয়ে মরতে পারবেন না। ঘটককে বলেকয়ে শেষবার একটি পাত্র যোগাড় করেছেন। আজ বিকেলে তারা দেখতে আসবে। 

সাজসাজ রব করার মতো ইচ্ছে নেই অহনার মায়ের। বাড়তি খরচ করে কী লাভ। তিনি তো জানেনই। খাবারদাবার খেয়ে ৫০ টাকা অহনার হাতে গুঁজে দিয়ে বাড়িতে গিয়ে পাত্রপক্ষ জানিয়ে দেবে, মেয়ে তাদের  পছন্দ হয়নি। তাই সাধারণ কিছু মিষ্টি আর সিঙাড়ার ব্যবস্থা করলেন। অহনাকেও সাজতে তেমন তাগাদা দিলেন না। 

পাত্র তার মা-কে নিয়ে দেখতে এসেছে অহনাকে। কোনোরকম অভিযোগ ছাড়া বিয়ে ঠিক হয়ে গেল। পাত্র কোনো যা-তা গোছের নয়। ভালো মাইনের চাকরি, বাড়ি, গাড়ি সব আছে। বরং অহনার বোনদের তুলনায় বেশিই আছে। অহনার মায়ের মুখের ভেতর থেকে মাছি কেবল যাওয়া-আসা করতে লাগলো। এমনও হয়!


অহনা আজ হালকা গোলাপি একটা সুতির শাড়ি পরেছে। অনীকের সাথে তার বিবাহপূর্ব দেখা করার দিন আজ। অহনা কখনও ডেটিং-এ যায়নি। তার ছোটোবোন তাকে সাজিয়ে দিল। অহনার মনে হচ্ছে তার অনুভূতি বলে কিছু নেই। যন্ত্রের মতো রওয়ানা হলো সে। 

অনীক তাকে তার বাড়িতেই নিয়ে এসেছে। এত বড়ো বাড়ি! সে জড়সড় হয়ে সোফায় বসে রইলো। কিছুক্ষণ পর অনীকের মা অহনাকে রান্নাঘরে ডেকে নিয়ে গেল। অহনা কিছুই বুঝতে পারছে না। সে এবাড়িতে বেড়াতে এসেছে। কিন্তু এদের হাবভাব দেখলে মনে হচ্ছে, সে কোনো চাকরিতে জয়েন করতে এসেছে। অনীকের মা ঘুরিয়ে-ঘুরিয়ে বাড়ি দেখালো, বাগান দেখালো, চিলেকোঠা দেখালো, এমনকি বাথরুমও দেখালো। এত বড়ো বাড়িতে কোনো কাজের লোক সে দেখেনি। 

অনীক তাকে বাড়িতে রেখে বেরিয়ে গেছে। ফেরার নামগন্ধ নেই। কিছুক্ষণ পর এক অর্ধমাতাল লোক এল। তিনি অনীকের বাবা। অনীকের মা এবার তাকে নিয়ে চললো দোতলার এক বদ্ধ ঘরে। সেখানে শিকল দিয়ে বাঁধা একটি মেয়ে বসে আছে। সে অনীকের বোন। 

এসব বাস্তবতার ভেতরেই বিয়ে হয়ে গেল অহনার। অহনা টুঁ শব্দটি না করে শ্বশুরবাড়ি চলে গেল। 

ঘটনার শুরু এখানেই।


এ-বাড়িটায় কিছু একটা আছে। রাত বাড়লে টের পাওয়া যায়। কেমন যেন খাঁ-খাঁ শব্দ করে। দূরে কোথাও পাখি ডানা ঝাপটায়। যেন কেউ পাখিটার গলা চেপে ধরেছে। কল থেকে অকারণে পানি পড়ার মতো আওয়াজ হয়। অথচ বাড়ির কোনো কল খোলা নেই। বাচ্চার কান্নার আওয়াজ শোনা যায়। এবাড়িতে তো নয়ই, পাশের বাড়িতেও কোনো বাচ্চা নেই। মাঝেমাঝে জোরে হাসি শোনা যায়। যদিও এই হাসির কারণ তার ননদ লিলি। 

ঘুমের ঘোরে অনীক একটানা কথা বলে। প্রথম-প্রথম অহনা ভয় পেতো। একদিন সুযোগ বুঝে সে তার শাশুড়িকে জিজ্ঞেস করলো ব্যাপারটা। তিনি খানিকক্ষণ উদাস থেকে বললেন, ওর সাথে একটা পরি থাকে। অহনা হতভম্বের মতো কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলেছিল, আপনারা এযুগের মানুষ হয়েও এসব বিশ্বাস করেন মা? 

ভদ্রমহিলা মুচকি হেসে বলেছিল, ক'দিন থাকো। তুমিও বিশ্বাস করবে। 

অহনা অনীককেও একদিন জিজ্ঞেস করেছিল। অনীক বললো, মা বলেছে আমার সাথে যে পরিটা থাকে তার সাথে যেন আমি সুন্দর করে কথা বলি। নয়তো আমার ক্ষতি হবে। 

অহনা কিছুক্ষণের জন্য নির্বাক হয়ে বসেছিল। সে লেখাপড়ায় এতো ভালো না। তাই বলে এই হিসাব মিলাতে না-পারার মতো অতটাও খারাপ না।

সবচেয়ে অদ্ভুত আচরণ করে তার শ্বশুরমশায়। তার দিকে কেমন করে যেন তাকায়। মেয়েরা ছেলেদের চোখের ভাষা সবচেয়ে ভালো বুঝতে পারে। অহনাও বোঝে। তার খুব অস্বস্তিবোধ হয়।


তাদের বিয়ের প্রায় দুইমাস হতে চললো। কিন্তু অনীক কখনও তাকে কাছে ডেকে নেয় না। সে কাছে গেলেও দূরে সরে যায়। বলে, তুমি কাছে এসো না। পরি রাগ হবে। রাগ হলে তোমার ক্ষতি করবে। 

অহনার হতাশা রাগ হয়ে জমতে-জমতে অভিমানের মতো গাঢ় হয়ে যায়। একা-একা চোখের পানি ফেলা ছাড়া আর কিছুই এ-মুহূর্তে করার নেই তার। বিয়ের পর তার বাবা-মা এবাড়িতে আসেনি কখনও। এমনকি তাকে নিয়ে যাওয়ার কোনো প্রস্তাব দেয়নি। বোনেরা তো আসেই না কখনও। সে একাই ছিল। বিয়ের পর যেন একাকিত্ব ছাড়া আর কিছুই রইলো না। 


বারান্দায় অন্ধকারে দাঁড়িয়ে ছিল অহনা। হয়তো সে অনন্তকাল দাঁড়িয়ে থাকতো। যদি না তার শাশুড়ির গলা শুনতে পেতো। কারও সাথে তর্ক করছে সে। চুপিচুপি দরজার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। তার শ্বশুরমশায়কে দেখা যাচ্ছে। দু'জনে তুমুল তর্ক হচ্ছে। কথাগুলো স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে না। হঠাৎ একটা ঠান্ডা হাত তার পিঠ ছুঁয়ে দিল। সে ঘুরে দাঁড়াতেই অনীককে দেখলো। খানিকটা ভয় পেয়ে পিছিয়ে এল সে। অনীককে কেমন অচেনা লাগছে। খসখস করে অনীক বললো, ঘরে এসো। কান পেতো না। ভয় পাবে। 

কী যেন ছিলো অনিকের গলায়। সে যন্ত্রের মতো অনিকের পিছু পিছু ঘরে এল। 

বাড়ির বাইরে সে যায় না। কড়া নিষেধ আছে। তাছাড়া দিনেরবেলাতেও গেটে তালা থাকে। তার ননদ লিলির জন্য দেওয়া হয়। হাতকড়া খুলে দিলেই সে দৌড় দেয়। পুরো বাড়িতে একটা লঙ্কাকাণ্ড বাঁধায়। তাকে ধরা তখন অসম্ভব হয়ে ওঠে। এ-কারণে গেটে বড়ো তালা থাকে। 

প্রথম-প্রথম লিলিকে সে খাওয়াতে যেত। মেয়েটি একদম স্বাভাবিক একজন মানুষ। সে কেঁদে-কেঁদে তাকে শিকলটা খুলে দিতে বলতো। চাবি ড্রয়ারেই থাকে। অহনা একদিন খুলে দিয়েছিল। এক সেকেন্ডে দৌড়ে নিচে নেমে লিলি উধাও। ভাগ্যিস অনীক বাড়িতে ছিল। সে দৌড়ে ধরে নিয়ে এল। লিলি অসহায়ের মতো তার দিকে তাকালো। ততক্ষণে তাকে অনেক বকা খেতে হয়েছে। এরপর থেকে তার উপরে যাওয়া নিষেধ।


আজ কী মনে করে সে উপরে এল। দেখলো, ধূসর বিবর্ণ এক প্রতিমা জানালা দিয়ে বাইরে চেয়ে আছে। তার দু'চোখ বেয়ে পানি পড়ছে। কিছুক্ষণ আগে তার শাশুড়ি বাজারে গেছে। শ্বশুর ঘুমাচ্ছে। অনীক এ-সময়ে বাসায় থাকে না। চাকরি করে বলে মনে হয় না। কিন্তু একটা নির্দিষ্ট সময়ে সে বাসায় থাকে না। এই সুযোগে সে লিলির কাছে এল। 


লিলি তাকে দেখে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক গলায় বললো, এখান থেকে চলে যাও। আমি কারও মেয়ে, বোন কিছু নই। আমাকে এরা আটকে রেখেছে। খুব শীঘ্রি মেরে ফেলবে। তোমাকেও মেরে ফেলবে। 

অহনা অবাক হয়ে বললো, তুমি কে? 

লিলি বললো, পরি। বলেই হাসতে লাগলো। 

অহনা বুঝতে পারছে না। এটা কি কোনো স্বাভাবিক মানুষের কথা, নাকি পাগলের প্রলাপ।

লিলি চোখ ঘুরিয়ে নিল বাইরে। বললো, এই মহিলা তার ছেলের এবং স্বামীর জন্য মেয়ে শিকার করে। যে-সব মেয়েদের পরিবারে তেমন কেউ থাকে না, তাদের ধরে নিয়ে আসে বা বিয়ে করে আনে। তারপর তাদের ঘরে আটকে রাখে। ওই যে বুড়ো লোকটা দেখছো, ও একটা জানোয়ার। ও প্রতিরাতে আমাকে অত্যাচার করে। অত্যাচার শেষ হলে মেরে ফেলবে। কেউ জানবে না। আমার আরও দুটো বোন ছিল। তাদেরও মেরেছে। বুড়ো লোকটা শুধু ফুর্তি করে। কিন্তু ছেলেটা খুন করে। ও খুনি। 

একটু থেমে বললো , তোমাকে নাও মারতে পারে। তুমি তো অবাধ্য নও। 

কিছুক্ষণের জন্য অহনার মনে হলো কথাগুলো সত্য।  পরক্ষণেই মনে হলো, তার শাশুড়ি বলেছে, লিলির সিজোফ্রেনিয়া আছে। হিস্টেরিয়ার লক্ষণ আছে। মাঝেমাঝে সে নিজেকেও চেনে না। 

বাইরে গেট খোলার আওয়াজ শুনে সে দ্রুত নিচে নেমে এল। ভেবে রাখলো, রাতের বেলা সে নজর রাখবে। 


এখানে সবার খাওয়াদাওয়া সন্ধ্যা হতেই শেষ হয়। একটু নিরিবিলি জায়গাটা। অহনার আজকাল সন্ধ্যা হতেই চোখ বুজে আসে। কিছুতেই চোখ খোলা রাখতে পারে না। আজকে সে প্রাণপণ চেষ্টা করছে চোখ খোলা রাখার। কিন্তু পারছে না। কান সজাগ রাখার। অথচ তার ইন্দ্রিয় কোনো সাড়াশব্দ দিচ্ছে না।

ভোরে ঘুম ভাঙতেই শোনে, লিলি গতরাতে মারা গেছে। অবিশ্বাস্য। যার সাথে গতকাল সকালে তার কথা হয়েছে, সে কীভাবে একরাতে মরে যেতে পারে! অহনা চুপ হয়ে গেল। পালাতে হবে তাকে। লিলি ঠিককথাই বলেছে। কিন্তু পালাবে কীভাবে? এসব ভাবতে-ভাবতেই তার চোখে ঘুম নেমে এল। 


পরদিন সকালে নিজেকে শিকলবন্দি আবিষ্কার করলো সে। সে কিছু বলতে যাচ্ছিলো। কিন্তু অনীক বললো, বেশি জেনে ফেলেছো। এখন এখানে পচে মরো। 

তার যে কী হয়েছে  সে নেশাগ্রস্তের মতো অনীকের দিকে তাকালো। আধা কথা বোঝে তো আধা কথা বোঝে না। শুধু মাথায় ঘুরছে, পালাতে হবে। পালাতে হবে। 


তার কিছুদিন পর একটা মেয়েকে এনে তার শাশুড়ি দূর থেকে পরিচয় করিয়ে দিল, ও আমার মেয়ে লিলি। ও অসুস্থ। 

অহনা কিছু বলতে যাচ্ছিলো। কিন্তু তার ঠোঁট কেমন জড়িয়ে-জড়িয়ে যাচ্ছে।

Comments