মধুপর্ণা রায়

"ওই জানালার কাছে বসে আছে / করতলে রাখি মাথা.../ চোখের ওপরে মেঘ ভেসে যায় / উড়ে উড়ে যায় পাখি.../ মধুর স্বপনে প্রাণের মাঝারে / বাজিছে মধুর বাঁশিটি"...! স্পর্শহীন। অথচ বিপুল স্পর্শময় ছবি। আমি ষোলোতে দেখেছি। আমি এখনও দেখতে পাই।

এসব আমার প্রাপ্তি নয়। প্রাপ্য নয়। শুধুমাত্র পাওয়া। পেয়ে যাওয়া। একে রাখবো কোথায়...আধার নেই...পৃথিবী নির্মম...বাস্তব কঠিন...এমন কোনো ভাবনা আমার পেয়ে যাবার তালিকায় থাকেনি। দরজায় দাঁড়িয়েছে। আমি মুখোমুখি। ঘটনার বিস্রস্ততা এসে দাঁড়ালে সেখানে লেনদেন। তারই সঙ্গে চলাচল। সে তখন কর্ম। কর্মের চেয়ে মহৎ ধর্মই-বা কী আছে? আবার সে এক বাধ্যবাধকতাও বটে। জানালার ছবি কেঁপেছে। করতলে সমর্পণ ছিল যার, তার পায়ের পাতায় তখন কাঁটার পথ। সে হেঁটেছে। সে-ই তখন তার শ্রেয় কাজ। জানালা গলে উড়ে এসেছে নীলরঙ চিঠি। লেখা থাকে—"আমার সকল কাঁটা ধন্য করে ফুটবে ফুল ফুটবে"!  শব্দরা কেমন ফুল হয়ে ফুটে রইলো। কাঁটায় পা রেখেছি। মন রেখেছি শব্দসম্ভারে। আমার কিছুই রক্তাক্ত হয়নি। আমি ভাবের নই। কাজের। এমন উচ্চারণের মালিকদের আমার লম্বা স্যালুট। আমার দরজায় এলে নিশ্চয় আতিথেয়তা পাবেন। বাইরের পৃথিবীর অনেকটাই আমার দৃশ্যপটে ঝাপসা। ধূসর। চাপ-চাপ। ছিন্নভিন্ন। তীব্রতাহীন। ভোঁতা আলো। বিচ্ছেদসুর। কিছু মেঘেরা ভেসে চলে যায় না। জমাট বেঁধে প্রতিপক্ষ খোঁজে। ঈর্ষা, লোভ, সিংহাসন—তিনটি মাদক। রকমের হেরফের মাত্র। উৎস এক। লক্ষ্য অভিন্ন। মাঝের যাত্রাটুকুর নাম হতেই পারে— কর্ম। যুদ্ধ চলে ছায়ার সঙ্গে। অথবা যুদ্ধ চলে সত্যের বিরুদ্ধতায়। করতলে মাথা রেখে চোখের মেঘে ভাসে যে...সে  ভাসে। এই অনিবার্য ভেসে চলা ভাবজগতের। দম্ভ-তরবারি কর্মজগতের। কর্মের এমন একটি দিকনির্দেশও আছে বইকী। এতসব মিলেমিশে গোলক পৃথিবী। তবু নিখুঁত গোলক সে নয়। অনিয়মিত তরঙ্গায়িত গোলক। আকৃতির পৃষ্টের সঙ্গে কোনো পদার্থের আকৃতির সাদৃশ্য নেই! পৃথিবীর আকৃতি পৃথিবীরই মতো হয়।

যার চোখের অনির্দিষ্ট ওপরে মেঘ ভেসে যায়...চোখের তারায় পাখি ডানা মেলে...বসে থেকে-থেকে সে বুঝি পেয়ে যায় সত্যের নির্দেশ। যে-গ্রহটিকে সমতল বলে ভ্রম হয়, সে আসলে সমতল নয়। বসে যে আছে বলে ভ্রম হয়, সেও আসলে নিছক বসে নেই। সে হাঁটছে। গভীরে একটা মিশ্রতাহীন অন্বেষণের প্রয়োজন শুধু মানুষেরই থাকে। পথের দু'পাশে শ্রেণিবিভাজন, পথের দু'পাশে বিলাসী শৌখিনতা, পথের দু'পাশে নিরন্ন হাহাকার, আরও কী-কী যেন...দুই মেরুর এই গ্রহটিতে ছিন্নচাপ মেঘ জড়িয়ে! তবু  হাঁটা তো বন্ধ হয়নি। তবে কিছু এল না কেন!

পরাণসখা এল না।  প্রিয়বন্ধু এল না। বিভাময় কোনো প্রেম নয়। অবিমিশ্র সুখ অথবা চমৎকার কোনো দুঃখ—কিছু নয়—কেউ নয়! কেবল দুর্দম কোলাহলে আছড়ে ভাঙলো একটা আস্ত রাত! গণন-অযোগ্য তাপ্পিতে আমাদের বুক জুড়ে ফাটল! কেউ তবু বসে থাকে। কেউ তবু হাঁটতে থাকে। স্থান দখলের, নিজেকে প্রমাণ করার, সফলতা কাড়াকাড়ির ওইপারে। তার উজ্জ্বল বিষাদময়তা একটি জলবিন্দু হয়ে পদ্মপাতায় পড়ে আছে। সে অবশ্য ঠিক জানে। জানে বলেই সে-জল সে ধরে রাখতে চায়নি।

Comments