ইদানীং জন্তু-জানোয়ারও কেমন যেন মানুষের মতো অতিরিক্ত স্বাধীনচেতা হয়ে উঠেছে। সবাই স্বাধীনতা চায়, তবে অন্যের অধিকার হরণ করে। ভারী হাতগুলো অবশ হবার যোগাড়, এত ভার সইবার কথাও নয়; তাই অপারগ হয়ে গেটের দিকে পা বাড়াতে দেখি, কুকুর নয় ঢাউস সাইজের এক পার্সেল! পুরোদস্তুর ডাকবাক্স যেন দরজা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। পা দিয়ে নাড়াতে ওজন টের পেলাম—সাচ্চা জিনিসে ঠাসা। কী আছে তাতে, কে জানে! এমন ওজনদার বোঁচকা টেনে ঘরে তোলা আমার একার কাজ নয়। কোনোমতে ওটাকে পাশ কাটিয়ে ঘরে ঢুকে পড়লাম।
নভেম্বর মাস চলছে। এদেশে 'থ্যাঙ্কস গিভিং’ নামের লোক-উৎসব আসন্ন। পুঁজিবাদের এই দেশে মানে মার্কিনমুলুকে এখন জিনিসপাতি কেনাবেচার ধুম পড়ে গেছে। কতরকমের ছাড়-ছাঁটের হাতছানি চলছে তার কোনো ইয়ত্তা নাই। এই কাটছাঁটের হুজুগে মানুষ নিজের জন্যে সারাবছরের কেনাকাটা তো বটেই, বন্ধু-স্বজনদেরও উপহার-উপঢৌকন পাঠাতে এতটুকু কার্পণ্য করে না।
এদেশে ডাক-ব্যবস্থায় পণ্য পরিবহন বেশ সহজ এবং সুলভ হওয়ায় বেশিরভাগ লোক আটপৌরে জিনিসপাতি কেনাকাটায়ও ডাকের সুবিধা নেয়। আর উৎসব হলে তো কথাই নেই। সকাল হতে ডাকের লোক মানুষের দোরে-দোরে সে-সব বিলাতে শুরু করে দেয়।
তবে আমি ওসব অনলাইন কেনাকাটার রাস্তায় ভুল করেও যাই না, বড়ো ঝক্কিঝামেলা মনে হয়। এ-মুহূর্তে মনে প্রশ্নের ঢেউ বইছে। এই পার্সেল তবে আসল কেমন করে! ভাবলাম, কেউ হয়তো আমাকে গিফট-পার্সেল পাঠিয়েছে! কিন্তু আমাকে কে উপহার পাঠাবে! ধরাধামে কেউ আমাকে পার্সেল পাঠাতে পারে, এমনতর লোক পাওয়া দুষ্কর বটে!
গিফট-পার্সেলটা দেখামাত্র বুকটা ধক করে উঠলো! অনেকটা পথঘাটে শ্মশানের পোড়াকয়লা-ভাঙা মাটির কলসি সহসা চোখে পড়লে যেমন করে বুকে বেদনার মেঘ জমে!
পার্সেল যে আমার নামে কখনও আসেনি, তা বললে নির্ঘাত নিজের সঙ্গে বেইমানি করা হবে। একটা পার্সেল আমার উঠতি-বয়সে নেহাত এসেছিল বটে—অনেকটা সাপ-লুডু খেলার মতো করে আমার জীবনটাকে উলটপালট করে দিতে! যেন একঝটকায় উঠে গেলাম পথের মাথায়, পরক্ষণে কিছু বুঝতে-না-বুঝতে ধপাস করে পড়ে গেলাম লেজে—শূন্যে অর্থাৎ মাটিতে! তবে এর উল্টোটাও হতে পারে! এই শীতের সন্ধ্যায় সারাদিনের ক্লান্তি শেষে বাসায় ফিরে কই একটু দম নিবো, তা না—এই পার্সেল আমাকে সেই কবেকার স্মৃতিতে ফিরিয়ে নিয়ে শীতকুয়াশার মতো বেদনার চাদরে ডুবিয়ে ছাড়লো!
কলেজ থেকে ফিরতে জানা গেল, আমার নামে একটি পার্সেল এসেছে। পার্সেল কী জিনিস—বাঘ না ভাল্লুক, তখনও খোলাসা করে কিছুই জানি না। তবে কিছু একটা অবৈধ জিনিস তো বটেই, তা না-হলে বাড়ির লোকের এত ফিসফিসানি কানাকানি কেন! পুরো বিষয় জানতে নিজের রুম থেকে অন্দরবাড়ি ঢুকি। বাড়ির সকলে এমনকি আমার মা-জননীও আমার সংস্পর্শ এড়িয়ে চলছেন, যেন আমি অচ্ছ্যুৎ! অবশ্য বাড়িতে ভয়াবহ কিছু ঘটার সময়ে তাঁর এমন অবস্থা নতুন নয়—এবাড়িতে তাঁর আলাদা কোনো কদর নেই, আর পাঁচটা আসবাবের মতোই এ-সংসারে তাঁর সংযুক্তি! তিনি তাঁর শাড়ির আঁচলে চোখের জল সামাল দিচ্ছেন। বাড়ির পরিবেশ অনেকটা কালবৈশাখী ঝড়ের আগের প্রকৃতির মতো নীরব,থমথমে! বুঝতে পারলাম নিজের অজান্তে মহাপাপ করে বসে আছি!
বড়োচাচা, যাকে দেখলে আমার বাবার কাপড়চোপড় ভিজে ওঠে, যার পরপর দু’পত্নী তাঁর ইদ্দত-ইজ্জতের তাণ্ডব থেকে রেহাই পেতে রাতের অন্ধকারে নিরুদ্দেশ হয়েছেন—তিনি বাংলাঘরের খোদাইনকশা করা চেয়ারে অগ্নিদগ্ধ কাঠের টুকরো মেজাজ ধারণ করে বসে আছেন। তিনি চণ্ডালরোগী, চোখজোড়া কড়কড়ে লাল হয়ে আছে—সামনে পড়লে রক্ষা নেই! বাড়ির সবাই ভয়ে কাঁপছে। আজকে আমার একটা দফারফা করা হবে। আমাদের বাবা নিষ্কর্মা, সকাল-সন্ধ্যা তাস পেটান, মনের আনন্দে ঘুরে বেড়ান, জগৎ-সংসার নিয়ে তাঁর কোনো মাথাব্যথা নেই। আমরা বড়োচাচার দয়াদাক্ষিণ্যে বেঁচে আছি। বলাবাহুল্য, আমাদের সঙ্গে চাচার সম্পর্ক মালিক-ভৃত্যের ন্যায়।
সকলে ভয়ে মজে থাকলেও আমার কেন যেন কোনো ব্যাপারে বাড়তি ভয়ডর কাজ করে না। আমার লাজ-লেহাজ স্বভাব-আচার ভালো না, বড়োচাচার এহেন অভিযোগের শতভাগ সত্য কিনা জানি না; তবে আমার আলগা ডরভয় আসলেই একটু কম। আমি কলেজ থেকে ফিরতে চাচা আমাকে তলব করেন। আমি নির্ভয়ে স্বাভাবিক চাঞ্চল্যে তাঁর সামনে যেয়ে দাঁড়াই।
বড়োচাচার পায়ের কাছে চতুর্ভুজাকৃতি একটা বাক্স, বাঁশকাগজের মোড়কে প্যাঁচানো, তার ওপর মোটা কালো কালির হরফে ইংরেজিতে আমার নাম-ঠিকানা লেখা। এই প্রথম সেই রহস্যময় পার্সেল স্বচক্ষে দেখতে পাই। আমি অবাক হয়ে বাক্সের দিকে তাকিয়ে থাকি। সে-সময় চাচা চরম ক্রোধে কাঁপছেন, কাঁপাহাতে ধরা বয়স্ক-লাঠিটি নাক বরাবর তুলে দু’চোখের মণি তাতে নিবদ্ধ করে চণ্ডালরোগটাকে বোধহয় জেতেজুতে সামলে নেবার চেষ্টা করছেন; কিন্তু তাঁর তোতলানো কথাবাতায় বুঝা যাচ্ছে তা সম্ভব হচ্ছে না।
কিন্তু সে-সবে আমার ছিটেফোঁটা খেয়াল নেই। আমার সমস্ত আগ্রহ সেই চারকোণা বাক্সের ভেতর। আমি হাত বাড়িয়ে পার্সেলটি ধরতে গেলে বড়োচাচা নেকড়ের মতো হুঙ্কার দিয়ে উঠেন। এবার আমার অন্তরাত্মা বাতাসে দোলা বাঁশপাতার মতো থরথরিয়ে কেঁপে উঠে। তাঁর ভাবভঙ্গিতে মনে হচ্ছে, পার্সেলের ভেতর বোধহয় মার্কিনি অ্যাটম-বোমা আছে। ফেটে যাওয়া সময়ের অপেক্ষামাত্র। বড়োচাচার ফেটে উঠার কারণ অবশ্য অমূলক নয়। সে-ঘটনা খোলাসা করে বলি, যদিও সেটাই একমাত্র কারণ কিনা আমার কাছে তখনও স্পষ্ট নয়! তারপরও সে-ঘটনা তখন আমার মনে সে-সময়ে চাড়া দিয়ে উঠলো।
আমার দাদা তখনকার সময়ে অর্থাৎ ব্রিটিশ আমলে মোটামুটি অবস্থাপন্ন ছিলেন। অর্থের সাথে যশের যোগসাজশ সবার ভাগ্যে মিলে না। যদিও একটা পাওয়া হলে, পরেরটার তরে মুখিয়ে থাকে মানুষের মন। দাদা মুখ্যত বিষয়সম্পদ পৈত্রিকসূত্রে পেলেও যশ বিষয়টা তাঁর জীবনে অধরা থেকে যায়। কিন্তু এমন অবস্থা মেনে নেওয়া তাঁর জন্যে বেশ কষ্টকর ছিল। এবং এর একটা উচিত কারণও ছিল। দাদার বাল্যবন্ধু যোগেন্দ্রনাথ বসু-র সে-সময়ে এলাকায় বেশ নামডাক ছিল। দু’জনে একত্রে পাঠশালায় পড়ছেন, একই মাটি-আলো-জলে বেড়ে উঠেছেন এবং সম্পর্কও নেহায়েত মন্দ ছিল না। কিন্তু একটা সময় পর দেখা গেল, বন্ধু তাকে অযথা অবহেলা করতে শুরু করলো। দাদা ধনে-মানে বলতে গেলে বন্ধুর চেয়ে ভালো অবস্থানে থাকলেও, হিন্দু অধ্যুষিত এলাকা বলে তাঁকে কোণঠাসা করে রাখা হলো। এবং বন্ধুর তাচ্ছিল্যের মাত্রা দিনকে দিন বাড়তে থাকল। একটা সময় পর দেখা গেল, দাদাকে অযথা রাস্তাঘাটে লোকের সামনে ছোটো করা হচ্ছে। দাদা বাল্য-সম্পর্কের জোরে বিষয়টার একটা সুরাহা করতে চাইলেও তাঁর বন্ধুর অনীহায় শেষপর্যন্ত ব্যর্থ হন। বন্ধুর এরূপ আচরণে তিনিও একটা সময় পরে বীতশ্রদ্ধ হয়ে উঠেন এবং সামান্য একটা ইস্যুতে দু’জনে মামলা-মোকদ্দমায় জড়িয়ে পড়েন।
মামলায় দু’পক্ষ সমানে-সমানে লড়ছিল। কথায় আছে— পুলিশে ধরলে এক ঘা, উকিলে ধরলে দশ ঘা। মামলায় যা হয়—উভয়ে মামলার পেছনে সম্পদ ঢেলে প্রায় নিঃস্ব হওয়ার অবস্থায় পৌঁছে এবং অযথা মামলায় জড়িয়ে নিজেদের ভুল হাড়গোস্তে সমানে টের পায়, কিন্তু ততদিনে যা হবার কথা ছিল হয়ে সম্বল প্রায় শেষ! তখনকার বিচারব্যবস্থা বড়ো ন্যায্য ছিল, এখনকার মতো পেশিবহুল ছিল না বটে! প্রায় চার বছর পর মামলার ফাইনাল রায়ের আগে পরিষ্কার বোঝা গেল, রায় দাদার পক্ষে যাবে।
এমন একটা সময়ে রাতের অন্ধকারে কে বা কারা একটি চৌকোনা বাক্স আকৃতির পার্সেল দাদার ঘরের দরজার চৌকাঠের পরে রেখে যায়। আমার দু’বছর বয়সী একমাত্র ফুফুর ভোরসকালে ঘুম ভেঙে যেত। তখন কাকভোরে বাড়ির সাহায্যকারী মেয়ের কোলে চড়ে সারা বাড়ি ঘুরে বেড়াতো। ফুফুকে কোলে নিয়ে মেয়েটি দাদার ঘরের বাইরবাড়ির উঠোনে গেলে পার্সেলটি তার চোখে পড়ে। সে কিছু না-বুঝে পার্সেলটি খুলে ফেলতে তরতরিয়ে বেরিয়ে আসে একটি জ্যান্ত দাঁড়াস সাপ। সাপ দেখে মেয়েটি ভয়ে চিৎকার করে দূরে সরে পড়ে এবং ফুফু ছিটকে পড়ে তার কোল থেকে। এই ফুসরতে ফুফুকে সাপ কামড়ে দিয়ে হাওয়া হয়ে যায়। বিষাক্ত সাপের ছোবলে ফুফুর মৃত্যু হয়। ফুফু, দাদার পরপর চার ছেলে সন্তানের পরে একমাত্র মেয়ে সন্তান; তার মৃত্যুর পর দাদার মাথাখারাপ হয়ে যায়। তিনি বেশ ক’বছর নিরুদ্দেশ ছিলেন। ধারণা করা হয়, বিরুদ্ধপার্টি মামলায় হেরে যাবে নিশ্চিত হয়ে এমন জঘন্য কাজটি করেছিল!
বড়োচাচার চোখদুটো ধনুকের তীরের মতো আমার দিকে স্থির হয়ে আছে, ও-দৃষ্টি এ-মুহূর্তে আমাকে পুরোপুরি কাহিল করে ফেলে। আমি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকি। যদিও প্রকৃত ঘটনা এখনও আমার কাছে পরিষ্কার নয়। চাচার এই ক্রোধান্বিত মূর্তি কি দাদার সেই প্রাগৈতিহাসিক ঘটনা স্মরণে নাকি নির্দোষ চারকোণা আমার নাম খচিত এই ডাকবাক্সের কারণে, তখনও আমি বুঝতে পারি না।
পার্সেলে আমার নাম-ঠিকানা থাকলেও প্রেরক সম্পূর্ণ অচেনা। প্রেরকের স্থানে একজন আমেরিকান যুবকের নাম-ঠিকানা। চাচা পার্সেলের দিকে তাকিয়ে জানতে চান, লোকটা কে! সাহেবের নামটি বেশ কঠিন, উচ্চারণ করতে যেন দাঁত খুইয়ে পড়ছিল আমার, চেনার তো প্রশ্নই আসে না! যদিও শহরের নামটি চোখে পড়তে আমি প্রকৃত ঘটনা ধরে ফেলতে পারি।
এবার আমি বিস্মিত হবার অভিনয় করি, যতটা সম্ভব কপালে চিড়ল ভাঁজ ফেলে বড়োচাচার চোখের দিকে সরাসরি তাকাই এবং ঘাড় নাড়িয়ে না-চেনার ভঙ্গি করি। তার চোখের মণি দু’টো রাগে-ক্ষোভে মার্বেলের মতো এদিক-সেদিক ঘুরছিল এবং একটা সময় পর স্থির হলো। অর্থাৎ আমার বাকহীন, নিপুণ অভিনয় যথার্থ হয়েছে। তিনি আমাকে শতভাগ বিশ্বাস করেছেন।
আমাদের বাড়ির সীমানা ছাড়িয়ে পশ্চিমদিকে একটি মজা-ডেঙ্গা ছিল। তারও পশ্চিমে ছিল তাঁতিপাড়া। সেই পাড়ার সকল কাচা-পায়খানার মলমূত্র মজা-ডেঙ্গায় এসে আশ্রয় পেত। বড়োচাচার ক্রোধের হাতে অসুরের শক্তি জমা হলো—তিনি সেই পার্সেল ডেঙ্গার মধ্যিখানে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন। আমার চোখের সামনে তখন সাহেবি নামের অগোচরে লুকিয়ে থাকা জাভেদের বেদনা-বিধুর মুখটা ভেসে উঠলো।
জাভেদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক বাল্যকালের অর্থাৎ যে-বয়সে পাপ-পুণ্য বাটখারায় হিসেব করা হতো না, তখনকার। আমার বয়স পাঁচ, জাভেদের আট-নয় হবে হয়তো। একই গ্রামে বসবাস। কাকভোরে খালিপায়ে মক্তবে আরবি শিখি, বেলা উঠতে স্কুলে যাওয়ার নাম করে বনে-বাদাড়ে ঘুরে বেড়াই। আমাদের বাড়ি থেকে ওদের বাড়ি হাঁটাপথ। বই কোলে নিয়ে একদৌড়ে ওর বাড়ি চলে যেতাম। তারপর দু’জনে মিলে বাকি বন্ধুদের নিয়ে স্কুল পালিয়ে মাঠেঘাটে ছুটে বেড়াতাম।
একসময় সে স্কুল পাশ শেষে গ্রাম ছাড়ে। এরপর বহুকাল যোগাযোগ ছিল না। তারপর যখন আবার যোগাযোগ হলো, সে-সময়ে আমি সমাজ থেকে পাপপুণ্যের হিসেবনিকেশ পইপই করে শিখে ফেলেছি। এখন চাইলেই দু’জনে বাড়ি ছেড়ে আমাদের সেই স্মৃতিমেদুর পথেঘাটে হেঁটে বেড়াতে পারি না। জাভেদ আমার বাড়ি ছুতাছাতায় আসলেও, আমার তার কাছে ছুটে যাওয়া হয় না। একসময় সে বিদেশ চলে যায়, কিন্তু সবার অলক্ষ্যে আমাদের যোগাযোগটা ঢিলেঢালা করে হলেও রয়ে যায়।
বছর দুই পরে আমিও কলেজে ভর্তি হলাম এবং যোগাযোগ চিঠিপত্রের মাধ্যম হলেও সম্পর্ক আগের চেয়ে বেশ মজবুত হলো। একটা সময় পর দু’জন দু’জনের মনে বোধহয় পোক্তভাবে বসতি করে নিলাম । তা না-হলে এতদিন গোপনে আমার বন্ধুর বাড়ির ঠিকানায় তার চিঠি আসলেও এখন আমার ঠিকানায় সরাসরি তার পাঠানো পার্সেল ভিড়লো কী করে! পার্সেল মজা-ডেঙ্গায় ডুবতে যেন তাকে আরও বেশি মায়ায় বেঁধে ফেললাম। এবং বলতে গেলে পার্সেলের এমনতর অঘটনের দৌলতে একত্রে এবং দ্রুত ঘর বাঁধার সিদ্ধান্ত নিলাম। জাভেদ দেশে ফিরে সামাজিকভাবে বিয়ের প্রস্তাব পাঠালে, বড়োচাচা তা প্রত্যাখান করেন। যা আমরা আগেই আঁচ করেছিলাম, কারণ চাচার বংশমর্যাদা ছিল সমস্ত বোধবিচার ছাড়িয়ে!
একদিন কলেজ যেতে বাড়ির বের হয়ে আর ফিরলাম না। জাভেদের মামাবাড়ি আমাদের গ্রাম ছাড়িয়ে থানাশহরে, সেখানে আমাদের বিয়ের সমস্ত ব্যবস্থা করা ছিল। বেনারসি পেঁচিয়ে সামান্য বুলি মুখে আওড়িয়ে দু’জন একত্রে বাস করতে সামাজিক স্বীকৃতি নিয়ে নিলাম।
বছর খানেকের মধ্যে কাগজপত্র গুছিয়ে গাট্টিবোঁচকা বেঁধে চলে গেলাম জাভেদের কাছে। আমেরিকায় শুরুতে গুছিয়ে নিতে একটু সময়ক্ষেপণ হলেও বছরখানেকের ভেতর আমরা বেশ চাঙ্গা হয়ে উঠলাম। জাভেদ পড়াশুনা প্রায় শেষ করে এনেছে এবং ভালো একটা চাকুরিও জুটিয়ে ফেলে। আমি কলেজে ভর্তি হলাম। দু’কামরার এক বাসা নিলাম, যার ব্যালকনিতে বসে আমরা সকাল-সন্ধ্যা পাহাড়ের গায়ে ঠেসে থাকা আকাশ দেখি।
আকাশ ক্ষণেক্ষণে রূপ বদলায়, ময়ূরের পেখম খোলার মতো করে উন্মুক্ত হয় পাহাড়ের চূড়া ছুঁয়ে। আমরা নিজেদের আকাশ ভাবি, কখনও পাহাড়। পাহাড়ের গায়ে কত কী নামে-বেনামে ফুল ফোটে। আমরা হাতে হাত ধরে নির্ভরতায় হেঁটে চলে যাই দূর-অসীমে। আমাদের দু’জনের সংসার-নৌকা ভাসতে লাগল সুখের সমুদ্রে।
আস্তেধীরে একসময় আমাদের তরতাজা সুখগুলো মিইয়ে যেতে লাগলে। শরতের ছেঁড়া-ছেঁড়া মেঘের আদলে আমাদের মনের আকাশে এলোমেলো, দিকশূন্য হয়ে উড়তে লাগলো। আমাদের পরিবার এবং আশেপাশের প্রিয়জনেরা জোর করে হলেও মনে করিয়ে দিল—অগোছালো মেঘে বৃষ্টি নামে না, সুখের সমুদ্র পাড়ি দিতে শক্ত সাঁকোর বিকল্প নেই!
আমি গোপন দীর্ঘশ্বাসে অবিন্যস্ত মনের নিশানা খুঁজি আর জাভেদ ভরাপূর্ণিমায় পাহাড়ে সেইপ্রান্তে চোখ রেখে আড়ালে অশ্রু মুছে। আমাদের দু’কামরার বাসাটা তখনও একই ছিল—বসার ঘরের কাছঘেঁষা ব্যালকনি, আকাশ, পাহাড় সব সেই আগের মতোই—আকাশটা তখনও পাহাড়ের গায়ে হেলান দিয়ে ঘুমাতো, শুধু আমাদের মনের দূরত্ব ধীরলয়ে বাড়ছিল!
সবুজ পাহাড়টা একসময় বিবর্ণ হয়। বজ্রপাতে মাথা ভেঙে পড়া প্রকাণ্ড কোনো বৃক্ষের মতো ন্যাড়া, ন্যুব্জ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। আমরা ভরাপূর্ণিমার আঁধারে পাশাপাশি বসে গোপনে হাতের কড়ে গুণে-গুণে হিসেব মিলাই— বিয়ের আট বছর পেরিয়ে গেছে! আমাদের মাঝে আজও সন্তান নামের কোনো সেতু গড়ে উঠেনি। আমি এবং জাভেদ একটার পর একটা পরীক্ষানিরীক্ষার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি তাও কয়েকবছর ধরে। একসময় আমার ফ্যালোপিয়ান টিউব সমস্যা জানা যায়। ডাক্তার আমাদের ষোলোআনা নিরাশ করেন না, সার্জারির ভেতর দিয়ে গেলে সহজেই নাকি এই সমস্যার বিস্তর ফল পাওয়া যায়। কিন্তু জাভেদ চিকিৎসা বিষয়ে হতোদ্যম হয়ে পড়ে। যদিও আমার ফ্যালোপিয়ান টিউব সমস্যা ধরা পড়ার পূর্বপর্যন্ত তার এরূপ অনীহা তো দূরে থাক, অতি-উৎসাহী ছিল!
সে-সব আমার সমস্যা ধরা পড়ার আগের কাহিনি। ছোটোবেলায় জাভেদ ফুটবল খেলতে যেয়ে জায়গামতো শক্ত আঘাত পায়, ডাক্তার তখন তার ভবিষ্যৎ পিতা হওয়া বিষয়ে সংশয় জানান। বিয়ের আট বছর পেরিয়ে যেতে সে সেই শঙ্কায় এতদিন ডুবেছিল। বিয়ের দু’চার বছর পেরিয়ে যেতে সন্তানের বিষয় উঠলে তার মধ্যে অধীর অস্থিরতা টের পেতাম। আমাকে তাবৎ দুনিয়ার নিঃসন্তান দম্পতিদের প্রেমকাহিনি শুনাতো। তার এরূপ আচরণে আমি গর্ববোধ করতাম, কারণ আমি তার ঘটনাটা তখন জানতাম না।
সেদিনটির কথা স্পষ্ট মনে পড়ে। দু’দিন ধরে অবিরাম তুষার ঝরছিল, আকাশে বোধহয় চতুর্দশী চাঁদও ছিল। দিনের মতো ফকফকা পরিষ্কার লাগছিল সেদিনের রাত। আমরা অভ্যাসবশত কফির মগ নিয়ে ব্যালকনিতে পাশাপাশি বসে আছি। ডাক্তারের কাছে সবে দু’জনে টেস্ট দিয়ে এসেছি, দু’চারদিন বাদে নিশ্চিত রেজাল্ট জানা যাবে। তাকে অতিরিক্ত বিষণ্ণ এবং উৎকণ্ঠিত মনে হলো, যদিও মনটা আমারও ভীষণ খারাপ ছিল। আমি ওর মনটা শান্ত করতে একটু বেশি ঘনিষ্ঠ হয়ে ওর পাশে বসি। সে খুব অপরাধবোধ নিয়ে ফুটবল খেলার কাহিনিটি বলে। সেই আমি জানলাম!
তার চোখের পানি চাঁদের আলোয় ঝিকমিক করছে! আমার হাতদুটো ওর দু’হাতে শক্ত করে ধরা, চোখে অবুঝ শিশুর মতো আশ্রয়ের প্রার্থনা! ওর অসহায়ত্ব আমাকে খুব পোড়াচ্ছিল! আমি ওর অমন বেদনার্ত চাহনিতে এমনভাবে সংহত হলাম যে আমার সারাজীবনের মা হওয়ার বাসনা মুহূর্তে হাওয়া হয়ে গেল। আমি সন্তানহীন হয়ে আজীবন ওর পাশে থাকার প্রতিজ্ঞা করি। সেদিন আমাকে জড়িয়ে ধরে বাচ্চাদের মতো খুশিতে কাঁদছিল। আমি নিজেও চোখের পানিতে ভাসছিলাম, সারাজীবন একত্রে থাকবো—এমন স্বপ্নে বিভোর হয়ে।
তিনদিন পর রেজাল্ট পেলাম—আমার ফ্যালোপিয়ান টিউব সমস্যা। জাভেদের কোনো সমস্যা নেই। সে সম্পূর্ণ নির্দোষ। জাভেদ এমনতর একটি অশুভ সংবাদে উজানের ঢলে গর্ভবতী-নদীর মতো খুশিতে ছলছলিয়ে উঠলো! তার খুশির বাঁধভাঙা জোয়ারে আমি দমবন্ধ হয়ে যেন মরে যাচ্ছিলাম। দু’হাতে কান চেপে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়লাম। নিজেকে কিছুতেই সামলে নিতে পারছিলাম না! আমার প্রচণ্ড কষ্টটা আমার রোগে নয়, উল্লসিত জাভেদকে দেখে। চুপচাপ স্বভাবের গোবেচারা জাভেদ অনবরত কথা বলেই যাচ্ছিল। নিজে নির্দোষ, সেই সংবাদ মুহূর্তে সে ফোনের মাধ্যমে পরিচিতজনদের জানিয়ে দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। ওর চোখের সামনে আমি নিজেকে ফিরে পেতে কী ভয়ঙ্কর কষ্টের ভেতর দিয়ে যাচ্ছিলাম, তা ওর অগোচরে রয়ে গেল!
এরপর থেকে আমি নতুন এক জাভেদকে পেলাম, সম্পূর্ণ ভিন্ন স্বভাব-মেজাজের। আমার এতদিনের যাপিত স্বভাবগুলো তার কাছে অসহনীয় হয়ে উঠলো! আমার চুল বাঁধা একসময় সে খুব আদরচোখে দেখতো। মেঝেতে ঝরে-পড়া চুল একটা-একটা করে তুলে নিয়ে যত্ন করে ছোটোবেলার স্ট্যাম্প, ভিউকার্ড জমানোর মতো করে সংগ্রহ করতো। অথচ সেদিন সেই ঝরে পড়া একটি চুল মেঝেতে পড়া দেখে গোখরো সাপের মতো ফণা তুলে আমার দিকে তেড়ে আসলো। এবং এই সামান্য ছুতোয় আমাকে দুনিয়ার অভিযোগে বিপর্যস্ত করে ক্ষান্ত হলো না; চিৎকারে চারপাশ জাগিয়ে তুললো! আমি যত না কষ্ট পেলাম, বিস্মিত হলাম ঢের বেশি।
এই ঘটনার পর থেকে আমাদের বন্ধুত্বটা নিঃশেষ হতে শুরু করলো—মুখ্যত আমাদের স্বাভাবিক জীবনের রুটিন আলগোছে বদলে যেতে লাগলো। আমরা পাশাপাশি রইলাম বটে, সারাদিনে দু’একটা কথা হতো কিনা! মুহূর্তগুলো এমন হলো যেমন, সেই আগের মতো তুষার ঝরছে; অভ্যাসমতো আমি হয়তো দু’মগ কফি নিয়ে বাইর-বারান্দায় গেছি, জাভেদ দূর পাহাড়ের দিকে উদাস চোখে তাকিয়ে হাত বাড়িয়ে কফির মগ তুলে নিল কিন্তু চুমুক দিতে ভুলে গেল। আমিও হয়তো ধুঁয়া-উঠা কফিকাপ শীতল হয়ে যাওয়া পর্যন্ত তার পাশে চুপচাপ বসে থাকতাম—বাক্যহীন, জড়-র মতো! স্বপ্নহীন জীবন্মৃত। সেই অসাড় জীবন বয়ে নিয়ে গেলাম আরও মাসছয়েক!
ডাক্তারের অফিস থেকে চিকিৎসা শুরুর তাগিদ আসছিল। এদেশে রোগীর চেয়ে ডাক্তার কিংবা তার অফিসের লোকজনের চিকিৎসার আগ্রহ থাকে বেশি। কারণ, ইনস্যুরেন্স কোম্পানির টাকা হাতিয়ে নেওয়ার মোক্ষম সুযোগ। আমি চিকিৎসা চালিয়ে নিতে ইনস্যুরেন্স কোম্পানির সাথে কথা বললাম। প্রচুর টাকা খরচা, যেমনটা আমেরিকাতে হয় আর কী! জাভেদকে বিষয়টা জানাতে সে বারুদের মতো ফুস করে জ্বলে উঠলো এবং আমাকে পরিষ্কার জানালো, ওসব ফালতু কাজে সে খরচ করবে না। নিজেকে সেদিন আমার পায়ে-দলা দূর্বাঘাসের মতো অপাংক্তেয় মনে হলো। নিজেকে এতটা হীন কখনও এর আগে মনে হয়নি। আমি তার মনের কথা ধরতে পারলাম, যদিও নীরবে সব সয়ে তাকে শোধরানোর শেষ সময়টুকু দিলাম।
জাভেদ নিজেকে মুক্ত করতে এক পা যেন বেশিই মুখিয়ে রইলো। দেশে স্বজনদের সাথে তার দ্বিতীয় বিয়ের বিষয়ে আলাপ করতে এতদিন রাখঢাক ব্যাপারটা মেনে চললেও, ইদানীং আমাকে শুনাতে উচ্চস্বরে কথা বলতে থাকে। যদিও তার দ্বিতীয় বিয়ে নিয়ে আমার সাথে কোনো কথা বলার প্রয়োজনবোধ করেনি। আমি অবস্থান্তরে মন থেকে তাকে মুছে ফেলতে মনস্থির করি।
বিষয়টা ভীষণ কঠিন মনে হচ্ছিল অন্তত আমার কাছে, কারণ আমি এখনও ওকে ভালোবাসি। জাভেদকে ছাড়া নিজেকে বাঁচিয়ে রাখা অচিন্তনীয় মনে হলো। অর্থনৈতিকভাবে আমি ওর চেয়ে এগিয়ে এবং পশ্চিমা-সমাজব্যবস্থায় একা বাস করা বিষয়ে কোনো প্রতিবন্ধকতা তো নেই-ই, বরং সমাজ এক্ষেত্রে আরও বেশি সুবিধা দিতে প্রস্তুত থাকে। তারপরও জাভেদ যতটা আমাকে ছেড়ে যেতে তাড়াহুড়া করে, আমি তার উল্টোটা করি। নিজের সাথে অবিরত যুদ্ধ করে একটা ফয়সালায় আসতে ব্যর্থ হই। নিদ্রাহীন রাত কাটে, দিনেরবেলা উদভ্রান্তের মতো ঘুরে বেড়াই। বেহায়ার মতো ভবিষ্যৎ ভাবি—সব ঠিক হয়ে যাবে, কিন্তু বাস্তবতা কি স্বপ্নের পথ ধরে হাঁটে!
জাভেদের দ্বিতীয় বিয়ে পাকাপোক্ত হয় ওর দূরসম্পর্কের খালাতো বোনের সাথে। অসামান্য প্রতিভাধর মেয়ে বটে! আমাকে জাভেদের মন থেকে ঝরাপাতার মতো খসিয়ে ফেলতে ওর ভূমিকা অনেকটা ভূত তাড়ানোর সরষের মতো। আমাদের সংসারের সামান্য চিড় টের পেতে দুনিয়ার অপরপ্রান্ত থেকে অপার নিপুণতায় জাভেদের মনপ্রাণ জয় করে আমার সাজানো সংসারটার মালিক বনে গেল! তাদের প্রথম-প্রেমের মতো রসালাপ পাশের কামরা থেকে হরহামেশা শুনতে বাধ্য হতাম, কারণ জাভেদ ইচ্ছে করে দরজা খোলা রাখতো। তখন পর্যন্ত অফিসিয়ালি তালাক ব্যাপারটা আমাদের মধ্যে ঘটেনি। সে তালাকের জন্যে মুখিয়ে থাকলেও মোটা অংকের মোহরানা কিংবা এদেশে দ্বিতীয় বিয়ের জটিলতার দরুন নিজে থেকে তা করছিল না। তবে সে কৌশলে আমাকে মানসিক অশান্তির চরমে নিয়ে বাধ্য করে তালাকের বৈধ কাগজপত্র পাঠাতে। আমিও আর নিতে পারছিলাম না এবং তাকে বিনাপয়সায় মুক্ত করে দিই। স্বাভাবিক অর্থে সে ধরে নেয়, জিতে গেছে। আদতে সে হেরে যায়, যা বোঝার ক্ষমতা সে ততদিনে হারিয়েছিল!
জাভেদ বিয়ে করতে দেশে চলে গেল। আমি আমাদের সংসার ছেড়ে দূরের স্টেট ক্যালিফোর্নিয়ায় একা সংসার করতে চলে এলাম। চাকুরি ট্রান্সফার নিয়ে আসায় তেমন কোনো সমস্যায় পড়তে হলো না ঠিকই, কিন্তু নিঃসঙ্গতা বিশেষ করে জাভদেকে ছেড়ে থাকার কষ্ট আমাকে বিপর্যস্ত করে তুললো। প্রথম অবস্থায় মরে যেতে ইচ্ছে করতো! এরপর ধীরে-ধীরে সয়ে গেল। সময়, জীবনের দুঃসহ স্মৃতিগুলোকে কৌশলে এবং আলগোছে মনের গভীরে তোলা-কাপড়ের মতো গুছিয়ে রাখে। সময়ে-সময়ে তা মুচড়ে উঠে অতীত-বেদনার জানান দেয় বটে! তারপরও জীবন তো বয়েই যায়!
এই শীতের রাতে কে যেন ডোরবেল বাজালো! এতক্ষণ ডুবে থাকা অতীত স্মৃতিস্তূপ থেকে সরে এসে ক্যামেরায় চোখ ফেরালাম। দরজার ওপাশে দাঁড়ানো ভদ্রলোক আমার পাশের লেনের বাসিন্দা। আমাদের বাসার নাম্বার একই কিন্তু আমার স্ট্রিট, তার লেন—এখানেই মূল সমস্যা। মাঝেমধ্যে পোস্টম্যান লেন এবং স্ট্রিট দেখতে ভুল করে। আর আমার লেটারবক্সে তার লেটার জমা পড়ে, যেমন আমারটা তার বাক্সে! আজও পোস্টম্যান ভুল করে তার পার্সেল আমার বাসায় রেখে গেছে!
Comments
Post a Comment