নিতাই ভট্টাচার্য

ইচ্ছে অপূর্ণ রয়ে যায়

বাড়ি ফিরতেই লতিকার কথার ঝড় আছড়ে পড়ে সুবলের উপর। 
"কোথায় ছিলে তুমি? ইসকুল ছুটি হয়েছে কোনকালে। বাড়ির কোনো কাজে পাওয়া যায় না, সারাদিন শুধু..."
ভ্যানটা উঠানের একপাশে রেখে দুয়ারের সামনে এসে দাঁড়ায় সুবল। হাঁপিয়ে গেছে, জোরে ভ্যান টেনে বাড়ি ফিরেছে। 
কাল চড়ক সংক্রান্তি। ধর্মরাজের পুজো। আজ থেকেই গ্রামে বিরাট ধুম। ভোরবেলা থেকে পাঁচটা গ্রামের মানুষ পুজো নিয়ে হাজির হবে ধর্মরাজের মন্দিরে। সেই উপলক্ষে আজ ছেলেমেয়েদের নাম ডেকেই স্কুল ছুটি হয়েছে, বন্ধ থাকবে তিনদিন। স্কুলবাড়িতে তালা চাবি মেরে বাড়ি ফিরছিল সুবল। পথে রতন বিশ্বাস ফোন করে। জলের অর্ডার আছে। এখুনি পৌঁছে দিতে হবে কুড়ি জার পানীয় জল। ভ্যান নিয়ে রতনের জলের প্লান্টের দিকে যাচ্ছিলো সুবল। তখন ফোন করে লতিকা বলে "মেয়ের জ্বর। তাড়াতাড়ি বাড়ি এসো।"
কী বিপদ! মাঝরাস্তা থেকে তাড়াহুড়ো করে বাড়ি আসে সুবল।
লতিকার কোলে শুয়ে রয়েছে মেয়ে। ঘরে আসে রতন। বাবাকে দেখে উঠে আসতে চায় মেয়েটা।
"জ্বর গায়ে তুই খেলে বেড়াবি?" বলে মেয়েকে জোর করে কাছে টেনে নেয় লতিকা। মেয়ের কপালে, গালে হাত ছোঁয়ায় সুবল। বলে, "কোথায় জ্বর? গা একদম ঠান্ডা। যত অলক্ষণে কথা তোর!" 
"ইস, কী বুদ্ধি রে! রোদে পোড়া হাতে মেয়ের জ্বর দেখতে এসেছে। গরম হাতে গায়ের তাত বোঝা যায়? যাও, কিছু করতে হবে না তোমায়। সুধীর মাস্টারের সঙ্গে সমুদ্দুর থেকে সূর্য ওঠা দেখতে যাও। সেই ভালো। ছেলেমেয়ে নিয়ে আমি মরে পড়ে থাকি।" লতিকার দু'চোখে জল।
এতক্ষণ চুপ ছিল সুবলের মা। কোমরের ব্যথা, আজ সকাল থেকে উঠতে পারেনি বিছানা থেকে। পাশের ঘর থেকে গলা তুলে বলে, "তুই বাপ নয় সুবল, পাষণ্ড একটা। মেয়ের গা পুড়ছে, আর তুই চললি সুধীর মাস্টারের সঙ্গে নাচতে। পইপই করে বললাম সংক্রান্তির সময় বাড়ির বাইরে থাকতে নেই। ধর্মরাজের রোষ পড়ে সংসারে। ঠাকুর কী বিপদ হলো দ্যাখো দিকি।"
শাশুড়ির কথার পোঁ ধরে লতিকা, "থাক মা, ছেড়ে দিন। ওসব কথা ওকে বলে লাভ নেই। ভাববে, বেড়াতে যাওয়ায় বাধা দিচ্ছি। শুনলেন তো বলছে, মেয়ের গায়ে জ্বর নেই!"
লতিকার কথায় কথা দেয় না সুবল। আবার ফোঁস করে উঠবে, শেষে যাওয়া হবে না সুবলের। এই কয়দিন অনেক কাঠখড় পুড়িয়েছে সুবল। তবেই রাজি হয়েছে লতিকা। নয়তো সুধীর মাস্টারের সঙ্গে চাঁদিপুর যাওয়ায় কিছুতেই সায় দিত না। 
ঘামে ভেজা জামাটা খুলে বাঁশের খুঁটিতে ঝুলিয়ে দিয়ে গামছায় গায়ের ঘাম মোছে সুবল। 
রান্নাচালা থেকে লতিকা বলে, "বলছি, আমার কথা কানে গেল? নাকি সুধীর মাস্টারের কথাই ভেবে চলেছো?"
" শুনছি, বল।"
"যাক তবু শুনে শান্তি যে আমার কথা কানে নিচ্ছো। আমার সাত পুরুষের ভাগ্যি।" বলে  কাঠের উনুনে ফুঁ দেয় লতিকা।
"কাজ আছে। আবার অর্ডারের জল দিতে বামনগাছি যেতে হবে। যা বলার তাড়াতাড়ি বল।" বলে সুবল।
"হারু ডাক্তারের কাছ থেকে ওষুধ নিয়ে এসো। রাতবিরেতে আমি একলা কোথায় ছুটবো! ওদিকে মাও বিছানা নিয়েছে। সব দায় এখন আমার উপর। আবার সন্ধ্যা হলেই তো তুমি..."
আজ রাতে সুধীর মাস্টারের সঙ্গে চাঁদিপুর যাবে সুবল। সুধীর মাস্টারের জামাই চাঁদিপুরে ট্রান্সফার হয়েছে সপ্তাহ দুয়েক আগে। হোটেলে ছিল এতদিন। দিন দুয়েক হলো কোয়ার্টার পেয়েছে। তবে বসবাসের ঠিক উপযুক্ত নয়। মানুষ না-থাকলে বাড়িঘর যেমন হয় আর কী। সেদিন কথায়-কথায় জামাইয়ের কোয়ার্টারের অবস্থার কথা সুবলকে বলে সুধীর।
"এ আর কী এমন কাজ! দুটো দিন হাতে সময় পেলেই বাড়ির রূপ ফিরিয়ে দেবো।" বলেছিল সুবল। চিন্তামুক্ত হয় সুধীর। সুবল কাজের ছেলে। সুধীর বলে, "চিন্তা করিস না সুবল, বিনে পয়সায় খাটাবো না তোকে। দু'দিন কাজ করবি, দু'হাজার টাকা দেবো। গাড়ি করে নিয়ে যাবো।"  
তাছাড়া চাঁদিপুরে সমুদ্র আছে। ভোরবেলায় সমুদ্রের বুকে লাল সূর্য ভেসে ওঠে। লাখ টাকা খরচ করলেও অমন দৃশ্য নাকি দেখা যায় না। সুধীর মাস্টারের কথা শুনে সুবলের গায়ে সমুদ্রের বাতাস লেগেছিল সেদিন।ছেলেবেলা থেকে সমুদ্র দেখার ইচ্ছে সুবলের। সুবল তখন ছোটো। সজনেখালি যেত মায়ের সঙ্গে, মামাবাড়ি। সেখানে মামার কাছে সমুদ্রের গল্প শুনতো। কেমন করে বড়ো-বড়ো ঢেউ সামলে ডিঙি নিয়ে মাছ ধরে সুবলের মামা। বহুবার বায়না করেছে মামার কাছে, সমুদ্র দেখবে। রাজি হয়নি সুবলের মা—"বড়ো হয়ে যাবি সমুদ্দুরে।"
তারপর থেকে আর বড়ো হওয়া হয়ে ওঠেনি সুবলের। সমুদ্দুর দেখার ইচ্ছে অপূর্ণ রয়ে গেছে। সুধীর মাস্টারের কথা শুনে সেই অপূর্ণ সাধ গা-ঝাড়া দিয়ে ওঠে আবার। মনে-মনে ঠিক করে সুবল, এ-সুযোগ ছাড়া যাবে না মোটেই। "বিনে পয়সায় কাজ করবো মাস্টারমশাই। একবার সমুদ্দুর দেখবো আমি।" বলে সুবল। 
সেদিন রাতের বেলায় চাঁদিপুরের কথা বাড়িতে বলে সুবল। সামনে বসে সব কথা শুনছিল সুবলের সাত বছরের ছেলেটা। জিজ্ঞাসা করে, "বাবা চাঁদিপুর কোথায়?"
ছেলের প্রশ্নে হোঁচট খায় সুবল। চাঁদিপুর কোথায় শোনা হয়নি। তবে সমুদ্দুর যখন, সজনেখালির কাছাকাছিই হবে। "ওই তো ক্যানিং পার হলেই সজনেখালি। তারপরেই চাঁদিপুর।" কয়েক মুহূর্ত ভেবে নিয়ে বলে সুবল। 
"আমি সঙ্গে যাবো।" বায়না রাখে ছেলে।
" তুই গেলে তোকে সামলাবে কে? আমায় কাজ করতে হবে যে।" বলে সুবল। 
হতাশ হয় সুবলের ছেলে। চেয়ে থাকে বাবার দিকে। ছেলের দিকে তাকিয়ে বুকটা বেজে ওঠে সুবলের, ছেলেবেলার সুবলকে মনে পড়ে। ছেলের মাথায় হাত রেখে আদর করে খানিক।
"না-না বাপু, অতদূরে গিয়ে কাজ নেই। চাঁদিপুর অনেক দূর। তাছাড়া সংক্রান্তির সময় বাড়ির মানুষ বাইরে থাকবে, সে বড়ো অমঙ্গলের কথা।" বলতে বলতে গলা ধরে এসেছিল লতিকার। 
পিছিয়ে থাকেনি সুবলের মা। "সংক্রান্তি বলে কথা! বাবা ধর্মরাজের পুজো। তোকে পয়সা আনতে অতদূর যেতে হবে না সুবল। সজনেখালি কি এখানে!"
পরদিন সুধীর মাস্টারকে বলে সুবল, " মা-বউ একজোট হয়ে বলছে সংক্রান্তি, সংসারের অমঙ্গল..."
সুবলের কথা শুনে হাসে সুধীর মাস্টার। বলে, "সংসার এক রঙ্গমঞ্চ সুবল। যা দেখিস সব মিথ্যে। যা বুঝিস তাও সত্যি নয়। এখানে কেউ কারও পক্ষে নেই, আবার বিপক্ষেও নেই। এখানে সবাই এক-একটা পক্ষ। নিজেরটুকু বুঝে নেয় সবাই। সংসারে নিজের জন্য বাঁচতে চাওয়া বড়ো কঠিন। অদৃশ্য গণ্ডি টানা আছে চারপাশে। টপকে বাইরে আসা সহজ নয় বড়ো। এ-সত্যি আমি আগেই বুঝেছি।" 
বড়ো অদ্ভুত লাগে সুধীরের কথা। কিছুটা বোঝে সুবল। কিছুটা তার বোধের ওপারে থাকে।
পয়সা উপার্জনের চিন্তায় দিনের প্রতিটি মুহূর্ত কাটে সুবলের। উদয়স্ত হাড়ভাঙা খাটুনি। ভোরবেলায় রতন বিশ্বাসের প্ল্যান্ট থেকে পানীয় জল ভর্তি জার নিয়ে এদিক-সেদিক দিতে যায়। সময়ের ভুলচুক হলে কড়া কথা শোনায় রতন। এরই মধ্যে সময় বের করে পাশের গ্রামের প্রাইমারি স্কুলের গেট খুলে ঘরদোর ঝাঁট দেয়। স্কুল ছুটি হলে পরে, ঘরে-ঘরে তালা মেরে দিতে হয় সুবলকে। এ কাজে মাস শেষে ছয়শো টাকা দেয় সুধীর। মাঝেমধ্যে সুধীর মাস্টারের কাছে নানা গল্প শোনে সুবল। 

সুধীর মাস্টারের পায়ের তলায় সর্ষে। স্কুলে ছুটি পেলেই পাহাড় নদী সমুদ্র দেখে বেড়ায়। ফিরে এসে গল্প বলে সুবলকে। সেইসব কথা শুনে বহুদিন রাতে আঁধার ঘরে পাহাড়, নদী, ঝর্না দেখেছে সুবল। গভীর রাতে মনের মাঝে ঘুমিয়ে থাকা ইচ্ছেটা সমুদ্রের মতো গর্জন করে নাড়া দিয়েছে সুবলকে। ঘুম ভেঙেছে সুবলের। লতিকা বলে, "মরণ! সারাদিন জল বেচে রাতের বেলায় যত ভীমরতি হয়।" উত্তর দেয় না সুবল। চেয়ে থাকে চার দেওয়ালের মধ্যে ধরে রাখা অন্ধকারে। স্বপ্নে ভেসে আসা পার্থিব বিস্ময়গুলিকে খোঁজার চেষ্টা করে সুবল। সুধীর মাস্টারের কাছ থেকে চাঁদিপুর যাবার প্রস্তাব পাবার পর থেকে ভিতরে-ভিতরে সমুদ্র দেখার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে সুবল। রোজ রাতে নানা কথা বলে লতিকার সায় পেয়েছে সুবল। "এমনি-এমনি যাচ্ছি না, দুই হাজার টাকা হাতে পাবে।" উপার্জনের মোটা অর্থ-অঙ্ক সামনে এনে সংক্রান্তির নিয়মের লক্ষ্মণরেখা কেটে বাইরে আসতে চেয়েছে সুবল। শেষমেষ পেরেছে। 
"নেহাত দু'পয়সা আসবে, নয়তো..."  বলেছে লতিকা।আজ সকাল থেকে মনে-মনে বেশ উত্তেজিত সুবল।  ঠিক রাত নয়টায় গাড়ি ছাড়বে সুধীর মাস্টারের বাড়ির সামনে থেকে। 
"হারু ডাক্তারের কাছে যাবার সময় হবে তোমার?" বলে লতিকা।
জামা গায়ে চড়ায় সুবল। হারু ডাক্তারের বাড়ি যাবে। "কী বলবো ডাক্তারকে?" জিজ্ঞাসা করে সুবল। 
" তাও বলে দিতে হবে? একটা দু'বছরের বাচ্চা মেয়ের জ্বর এলে কী বলতে হয়..." বলে লতিকা।
সুবলের মা গলা তুলে বলে "আমার ব্যথার ওষুধ আনবি সুবল।" 
বাড়ির বাইরে পা রাখে সুবল। ঘর থেকে মেয়েটা বায়না ধরে সুবলের সঙ্গে যাবে। লতিকা ধমক দিয়ে চুপ করায় মেয়েকে। 
ওষুধ নিয়ে বাড়ি ফেরে। রতন বিশ্বাস ফোন করে। "আমার কথার দাম আছে সুবল। ব্যবসায় কম্পিটিশন প্রচুর। সময় মতো অর্ডার সাপ্লাই করতে না-পারলে বদনাম হবে। তুই না পারলে বল, কত লোক বসে আছে কাজ করবে বলে।" রতনের কথায় মৌমাছির হুল। গায়ে জ্বলন ধরে ভীষণ। কিছু বলার উপায় নেই। ভ্যান নিয়ে দৌড় দেয় সুবল। অর্ডারের জল নিয়ে যেতে হবে বামনগাছি। তারপর আবার কোথাও। তারপর...
ছুটি পেতে সন্ধ্যা পেরিয়ে যাবে। বছর-বছর চলছে এইভাবে। সংসার সরস রাখতে নিজেকে নিংড়ে নিরস হয়ে উঠেছে সুবল।
বেলা ঢলে এসেছে। বাড়ির পথ ধরে সুবল। বামুনপুকুরের পাড়ে এসে দাঁড়ায়। দূরে দাসেদের তালগাছের মাথায় লাল সূর্যটা আটকে রয়েছে। একমনে তাকিয়ে থাকে। মনে-মনে একটা খুশির হাওয়া বয়ে যায়। আরও কিছুক্ষণ চেয়ে দেখে দিনান্তের সূর্যটাকে। প্যাডেলে চাপ দেয় এইবার। বাড়ি গিয়ে জিনিসপত্র গুছিয়ে নিতে হবে। রাত নয়টার মধ্যে...
"তুমি জ্বরের কথা বলেছিলে ডাক্তারকে?"  উঠানে পা রাখা মাত্র জিজ্ঞাসা করে লতিকা। 
" কেন? বলেছি তো।" বলে সুবল।
"বলেছো তো জ্বর কমে না কেনো? কেমন ওষুধ এনেছ কে জানে!"
সুবলের মা বলে," হতচ্ছাড়া হারুর ওষুধে কোনো কাজ হয় না। শালা হাতুড়ে। আমার ব্যথা এক ছিদিম কমেনি।"
মেয়ের জ্বর কমেনি শুনে হতাশ হয় সুবল। যাওয়া হলো না তবে আর। 
"তুমি আর একটিবার ডাক্তারের কাছে যাও। বলো, জ্বর ছাড়েনি। তুমি থাকবে না। বিপদ হলে আমি কোথায় যাবো বলো?"  চিন্তিত লতিকা।
হারু ডাক্তারের কাছ থেকে ফিরে এসেছে সুবল। বাচ্চা না-দেখে আর ওষুধ দিতে পারবে না। তেমন হলে হাসপাতাল নিয়ে যা। বলেছে হারু। সন্ধেবেলায় মেয়ে নিয়ে বাইরে যাবে না লতিকা। বামুনপুকুরের পাড়ে অপদেবতার বাস। মেয়ের শরীর শুকিয়ে যাবে। যদি যেতেই হয়, কাল যাবে হাসপাতাল। তাতে মেয়ের যা হয় হবে। মাথার উপরে ধর্মরাজ আছে।
 
রাত হয়েছে। সুবল অনেক আগেই সুধীর মাস্টারকে খবর দিয়েছে, মেয়ের জ্বর ছাড়েনি। দুয়ারে বসে রয়েছে সুবল। ঘুম-ঘুম চোখে ছেলেটা বলে, "বাবা যাবে না তুমি?" চুপ থাকে সুবল। 
লতিকা বলে, "কী করে যাবে? সব কপাল! নয়তো দু'হাজার টাকা আসতো সংসারে। এমন দিনেই মেয়ের জ্বর আসতে হয়! ধর্মরাজের চোখ নেই।"
কাপড়ের খুঁটে চোখের জল মোছে লতিকা। 
কোলের কাছে মেয়েকে নিয়ে শুয়েছে লতিকা। সুবলের পাশে ছেলেটা। গাজন সন্ন্যাসীদের চিৎকার শুনতে-শুনতে ঘুমিয়ে যায় সুবল।

ভোর হয়েছে। সমুদ্রের সামনে দাঁড়িয়ে সুবল। পাশে সুবলের ছেলেটা। টকটকে লাল সূর্য ভাসছে সমুদ্রের বুকে। "দুচোখ ভরে সূর্য দ্যাখ। এই হলো সমুদ্দুর।" ছেলেকে সমুদ্র দেখায় সুবল। আনন্দে লাফাচ্ছে একরত্তি ছেলেটা। খুব খুশি সুবল। শেষমেষ পিছুটান কাটিয়ে নিজের ইচ্ছে পূরণের জন্য বাইরে আসতে পেরেছে সুবল। 
পশ্চিমপাড়া থেকে ঢাক বাজিয়ে ধর্মরাজের পুজো নিয়ে যাচ্ছে কারা। ঢাকের ভীষণ শব্দে ঘুম ভেঙে যায় সুবলের। এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিল । উঠে বসে বিছানায়। সুবলের মা উঠোনে গোবরজল ছিটিয়ে দিচ্ছে। গতকালকের অসহনীয় ব্যথা আজ উধাও! লতিকা চান করে তৈরি হয়েছে; পুজো দিতে যাবে। মেয়েটা কাঁথা ভিজিয়ে শুয়ে রয়েছে। তাড়াতাড়ি করে মেয়েকে কোলে তুলে নেয় সুবল।
"তুমি কাঁথাটা বদলে দাও। আমি চান করেছি আর ছোঁবো না।" বলে লতিকা। 
মাটির সরায় পুজোর উপকরণ নিয়ে মন্দিরে যাচ্ছে লতিকা। দেরি হয়ে গেছে। তাড়াহুড়ো করে ঘর থেকে বাইরে যায়। ফিরে আসে আবার। প্রণামীর ষোলো আনা নেওয়া হয়নি। কুলুঙ্গির দিকে হাত বাড়ায়। বেতের ছোটো ঝাঁপিটা উল্টে পড়ে। কয়েকটা সিকি, আদুলির সঙ্গে চারটে ট্যাবলেটও পড়ে ঘরের মেঝেতে। ভীষণ অবাক হয় সুবল। ভালো করে দেখে। হারু ডাক্তারের দেওয়া জ্বরের ওষুধ চারটে পড়ে রয়েছে! যেমন দিয়েছিল তেমনই রয়েছে ওষুধগুলো। কুলুঙ্গির পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে লতিকা। চেয়ে আছে মেঝের দিকে। সুবলের দৃষ্টি গেঁথে রয়েছে লতিকার মুখের উপর। এক বোধ্য নীরবতা জমাট হয়ে থমকে দাঁড়িয়েছে ঘরে। "মেয়েটার জ্বর ছিল না?" একরাশ বিস্ময় নিয়ে প্রশ্নকরে সুবল। 
নির্বাক লতিকা। সজল চোখে সুবলের প্রশ্নের জবাব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে সুবলের সামনে।

Comments