প্রাণেশ সরকার

আমার ভাঙাচোরা জীবন 

নবম পর্ব

কলেজে ভর্তি হওয়ার কিছুদিন আগে আমরা যারা বাদকুল্লায় একটু-আধটু লিখি তারা একজায়গায় বসে সিদ্ধান্ত নিই, আগামী পঁচিশে বৈশাখে একটা সাহিত্যপত্রিকা (লিটল ম্যাগাজিন) বের করবো বাদকুল্লা থেকে। আমরা অর্থাৎ আমি, পবিত্র বসু, বিশ্বজিৎ চক্রবর্তী (বাবলা), বিকাশ দত্ত (তিনু), দেবপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় ও আমাদের কিছু তরুণ সহযোগী (যারা লেখে না, অথচ সাহিত্য ভালোবাসে) আড়বান্দি যাই প্রবীণ কবি সুকুমার ভট্টাচার্য-র কাছে। তিনি আমাদের প্রস্তাব শুনে খুবই আনন্দিত হলেন এবং সঙ্গে-সঙ্গে পত্রিকার নামকরণ করলেন—'কবিকলম'। বললেন, "তোমরা কবিতা জমা দাও। আমার কাছে কবি বিজয়লাল চট্টোপাধ্যায়ের কবিতায় লেখা একটি আশীর্বাণী আছে। সেটাও আমরা প্রথম সংখ্যায় প্রকাশ করতে পারি।" সর্বসম্মতিক্রমে সুকুমার ভট্টাচার্য-কেই সম্পাদক করলাম আমরা। ওঁর আড়বান্দির মাটির ঘরের উঠোনে বসেই এসব আলোচনা হলো। পঁচিশে বৈশাখ বিকালে ওঁর বাড়িতেই পত্রিকার শুভ উদ্বোধন হলো। প্রথম সংখ্যায়, আজ এই সত্তরোর্ধ বয়সে যতদূর মনে পড়ে, কবিতা লিখেছিলেন— রেবতীকান্ত রায়, বিজয়লাল চট্টোপাধ্যায়, সুকুমার ভট্টাচার্য, প্রাণেশ সরকার, পবিত্র বসু, তন্ময় ভট্টাচার্য, বিকাশ দত্ত, সবিতা দত্ত, বিশ্বজিৎ চক্রবর্তী, নীহারেন্দু মজুমদার প্রমুখ। ২০০ কপি পত্রিকা (ফোল্ডার) তিনদিনে বিক্রি হয়ে গেল। ৫০ পয়সা প্রতি কপি। লেখক কপি, সৌজন্য কপি গোটা চল্লিশেক গেল। ১৫০ টাকা হলো বিক্রিলব্ধ। খরচ হয়েছিল ৮০ টাকা। ফান্ডে জমা হলো ৭০ টাকা। সবাই বেশ উৎসাহ বোধ করলো। বাদকুল্লা জনপদের সাহিত্য-সংস্কৃতিমনস্ক মানুষ আমাদের বললেন, আগামীতেও 'কবিকলম' চাই। আমরা এই সদর্থক সাড়ায় কোমর বেঁধে পত্রিকার কাজে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। খবর পেলাম, মামজোয়ান গ্রামে শারীরিক প্রতিবন্ধী কবি অসিতবরণ হাজরা থাকেন। তিনি সত্যজিৎ রায় সম্পাদিত 'সন্দেশ' পত্রিকায় ছড়া লেখেন। একথা শুনে 'কবিকলম'-এর প্রথম সংখ্যাটি বগলদাবা করে আমরা পায়ে হেঁটে এবং শেষে চূর্ণী নদীতে নৌকোয় চড়ে ওপারে মামজোয়ান গ্রামে পৌঁছে গেলাম এক সকালে। মামজোয়ান এক ঐতিহ্যমণ্ডিত বর্ধিষ্ণু গ্রাম। কথাসাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মাতুলালয়। নৌকা করে চূর্ণী নদী দিয়ে এখানে আসতেন তিনি। যাইহোক, অসিতবাবুকে দেখে তো আমরা থ' সকলেই। মারাত্মক প্রতিবন্ধী! দুটো পা-ই বাঁকা, হাতদুটোও তাই। খুব কষ্ট করে মাটিতে ছেঁচড়ে-ছেঁচড়ে চলেন। এই অবস্থাতেও হাতের কাজ কী একটা যেন তিনি করেন ক্ষুন্নিবৃত্তির জন্য। এই মানুষটি ছড়া লেখেন, কবিতা লেখেন! সত্যজিৎ রায় তাঁর ছড়া ডাকযোগে পেয়ে 'সন্দেশ' পত্রিকায় ছাপেন এবং কবিকে সেই লেখার জন্য মানি-অর্ডারে পাঁচ টাকা পাঠান। আমি তাঁকে দেখে অভিভূত, রোমাঞ্চিত। তিনি ওই অবস্থায় আমাদের পাঁচ-ছয়জনকে চা করে খাওয়ালেন। বিস্কুট দিলেন কৌটো থেকে বের করে। জনতা স্টোভে চা করেছিলেন, মনে পড়ে। আমরা চা খেলাম খুব তৃপ্তি করে। ওঁর জন্য আমরা সন্দেশ নিয়ে গিয়েছিলাম। আমি তাঁর হাতে সন্দেশের প্যাকেট দিয়ে বললাম, "'সন্দেশ'-এর কবির জন্য সামান্য সন্দেশ।" কী অনাবিল, নির্মল হাসি! এক্সারসাইজ বুকে লেখা কবিতা ও ছড়া শোনালেন। একটি কবিতা কপি করে 'কবিকলম'-এর জন্য সম্পাদকমশাইকে দিলেন। এই প্রথম সাক্ষাতের পর থেকেই ওঁর সঙ্গে নিবিড় প্রাণের সম্পর্ক রচিত হলো। আমি যেতাম ওঁর বাড়ি। কবিতা শুনতাম, গল্প করতাম, আমার দু-একটা লেখাও ওঁকে শুনিয়ে দিতাম। পূঙ্খানুপুঙ্খ আলোচনা করতেন। ওঁর কাছে গেলে, মোহনলালের মন্দির-কাম-বাসস্থানেও যেতাম। স্কুল ও কলেজ-জীবনের খুব প্রিয় সতীর্থ আমার। মোহনলাল দাস ব্রহ্মচারী। গৌরনিতাইয়ের উপাসনালয় ওর। মন্দিরে বসে ওর নামগান শুনতাম, পূজার্চনা দেখতাম। মন্দিরের বাৎসরিক উৎসবেও আমি গিয়েছি। ওখানে আমাদের কলেজ-জীবনের সতীর্থ দিলীপ সান্যাল-ও একাধিকবার এসেছে। শক্তিনগরের দিলীপ, কবি পরেশনাথ সান্যালের ছেলে। দিলীপের মতো সাদা মনের মানুষ আজকের দিনে বিরল। দিলীপের কথা পরে সবিস্তারে বলার ইচ্ছে রইলো। কবি অসিতবরণ হাজরা-র কথা বলতে-বলতে মোহন ও দিলীপের কথায় চলে এসেছিলাম। আবার অসিতদা-র কথায় ফিরে আসা যাক। 'কবিকলম'-এ বেশ কিছু ছড়া ও কবিতা লিখেছেন অসিতদা। পত্রিকা প্রকাশিত হওয়ার পরে আমরা মামজোয়ান গিয়ে ওঁকে পত্রিকার কপি দিয়ে এসেছি। 'কবিকলম' হাতে পেয়ে কী যে খুশি হতেন শিশুর মতো সরল এই মানুষটি! মনে আছে, মৃত্যুর দিন দশেক আগে একটা ভ্যানরিকশায় চেপে মামজোয়ান থেকে সোজা বাদকুল্লা রেল স্টেশনের কাছে 'মিলন সংঘ'-সন্নিহিত আমার যে-বাড়ি, সেখানে এক শীতের সকালে দশটা নাগাদ চাদর-মাফলার মুড়ি দিয়ে এসেছিলেন। আমাদের বাড়ির যে-আমগাছটা ছিল, তার নিচে ভ্যানচালককে ভ্যানটা রাখতে বললাম। ছায়া আছে। ওখানেই বসে থাকলেন, কারণ ওঁর পক্ষে নামা-ওঠা তো অসম্ভব! কাউকে পাঁজাকোলা করে নামাতে হবে। দিদি অসিতদা-কে গরম-গরম পরোটা, আলুভাজা, রসগোল্লা খেতে দিলেন। ভ্যানচালক মানুষটিকেও দিলেন। অসিতদা-র খুবই খিদে পেয়েছিল, মনে হলো ওঁর খাওয়া দেখে। দিদি ওঁকে আরও খানদুই পরোটা ও গুড় দিলেন। খাওয়া শেষ হলে, কাঁসার গেলাসে জল দিলাম। খেয়ে আমাকে বললেন, "ভাই, কৃষ্ণনগরের রবি বিশ্বাস আমার একফর্মার একটা কবিতার বই প্রকাশ করেছেন।" সাইডব্যাগ থেকে একটা বই বের করে, আমার নাম লিখে, আমাকে দিলেন। আমি বইটি হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখে বললাম, "দাদা, রবিদা একটা কাজের কাজ করেছেন। খুব ভালো হয়েছে বইটি। আমি পড়ে আমার মতামত জানাবো।" তারপর উনি বললেন, "আজ তাহলে চলি, প্রাণেশ।" আমি গেট পর্যন্ত তাঁর ভ্যানরিকশার সঙ্গে গেলাম। দিন দশেকের মাথায় খবর এল, অসিতদা মারা গেছেন। ওঁর জ্ঞাতিভাইরা ওঁর শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী চূর্ণী নদীর পাড়েই দাহকার্য সম্পন্ন করেছেন। আমি 'কবিকলম'-এর সবাইকে খবর দিলাম। ওঁর স্মরণে শোকসভা করলাম।

২০০০-এর বিধ্বংসী বন্যায় আমাদের বাড়ির ঘরগুলোতে  (একতলা; দোতলায় একটা ছোটো ঘর ও বারান্দা ছিল) বন্যার কাদাগোলা জল ঢুকে অনেকটা উপরে উঠেছিল। ফলত, আমার বইয়ের কাঠের র‍্যাকে রাখা প্রায় সমস্ত বইপত্র, লেখার পাণ্ডুলিপির ফাইল, অসংখ্য লিটল ম্যাগাজিন চার-পাঁচদিন জলকাদায় ভিজে থাকায় সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে যায়। সামান্য কিছু বই শুধু সিঁড়িতে রাখতে পেরেছিলাম আমি ও আমার ভাগ্নেরা—নেটু ও রাজু। নষ্ট হওয়া বইয়ের মধ্যে অসিতদা-র বইটিও ছিল। এইভাবে বই নষ্ট হওয়ায় দীর্ঘদিন মনোকষ্টে ভুগেছিলাম আমি। কলেজ স্ট্রিটে, প্রেসিডেন্সি কলেজের ফুটপাথ থেকে সংগ্রহ করা অমূল্য সব পুরোনো বই একনিমেষে ধ্বংস হয়ে গেল। এই ক্ষতি পূরণ করা আর কখনও সম্ভব হয়নি আমার পক্ষে।

'কবিকলম' পত্রিকাটি লিটল ম্যাগাজিন হিসাবে নদীয়া জেলা ছাড়াও পশ্চিমবঙ্গের অন্যান্য জেলাতেও জনপ্রিয় হয়েছিল। এই কাগজে নদীয়ার কবি-লেখককুল তো লিখেছেনই; কলকাতা ও অন্যান্য জেলার লেখককুলও কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ লিখেছেন এবং পত্রিকার শ্রীবৃদ্ধিতে সহায়ক হয়েছেন। গোবিন্দ চক্রবর্তী, নিজন দে চৌধুরী, সুধীর চক্রবর্তী, কার্তিক মোদক, স্বপন রায়, মজনু মোস্তাফা, দেবদাস আচার্য, সুবীর সিংহরায়, স্নেহাশিস শুকুল, শিখা বিশ্বাস (শুকুল), পরেশনাথ সান্যাল, গণেশ সাহা, জয় গোস্বামী, তরুণ গোস্বামী, রবি বিশ্বাস, চন্দন মুখোপাধ্যায়, হরিপদ দে, সমরেন্দ্র মণ্ডল, রামপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, রামকৃষ্ণ দে, সেখ রমজান, রথীন ভৌমিক, সুবোধ সরকার প্রমুখ লিখেছেন এই কাগজে। এছাড়াও কলকাতার সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, শৈবাল মিত্র, পবিত্র মুখোপাধ্যায়, শুভেন রায়, শুদ্ধসত্ত্ব বসু, কবীন্দ্র হালদার, অগ্নি রায়, শিশির দাশ এবং আরও অনেকে গল্প ও কবিতা লিখেছেন। সে এক স্বর্ণোজ্জ্বল সময় ছিল 'কবিকলম'-এর। আর বাদকুল্লা নিবাসী আমরা—সুকুমার ভট্টাচার্য, প্রাণেশ সরকার, পবিত্র বসু, তন্ময় ভট্টাচার্য, তপোব্রত ভট্টাচার্য (অকালপ্রয়াত; খুবই শক্তিশালী তরুণ কবি), বিকাশ দত্ত, সবিতা দত্ত, দেবপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়, বিশ্বজিৎ চক্রবর্তী (কোভিডকালে প্রয়াত), অসিতবরণ হাজরা প্রমুখ তো লিখতামই। প্রায় দশ বছর 'কবিকলম' প্রকাশিত হয়েছিল পর্যায়ক্রমে, অনিয়মিত হয়েই চলছিল তার আত্মপ্রকাশ। খুবই পরিশ্রম হতো আমার, অন্তত প্রথমদিকে। পরবর্তীতে পবিত্র বসু অনেকটাই হাল ধরেছিল। কলকাতা থেকে লেখা সংগ্রহ, বিজ্ঞাপন সংগ্রহ ইত্যাদি কাজ পবিত্র করতো। নিজে খুব ভালো কবিতা লিখতো। খুব ছড়িয়ে-ছিটিয়ে অনেক কাগজে সে লিখতো না; কয়েকটি পছন্দের কাগজেই বরাবর লিখতো। একটিই কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে ওর— 'স্বোপার্জিত বধ্যভূমি' (অফবিট পাবলিশিং, কলকাতা-৮৯) ২০০১ সালে। অদ্ভুত হলেও সত্যি, এই গ্রন্থটি প্রকাশ হওয়ার পরে অদ্যাবধি সে আর কোনো কবিতা লিখে উঠতে পারেনি। অনেকদিন হলো সে কলকাতায় থিতু হয়েছে। বাদকুল্লায় ওর দাদা আশিস বসু আমার বাল্যবন্ধু এবং বর্তমানে সুরভীস্থান ভুবনমোহিনী বালিকা বিদ্যালয়ের কাছেই বাড়ি করেছে। আদি বাড়ি অঞ্জনগড়ে। আমার বাড়ির কাছেই। পবিত্র দাদার কাছে কখনও এলে, আমার বাড়ি এসে দেখা করে যায়। আমি তাকে কবিতায় ফিরে আসতে বলি। সে স্বভাবসিদ্ধ মৃদু হেসে বলে, "কবিতা আমাকে ছেড়ে চলে গেছে, প্রাণেশদা।"

একটা সময় আমি বৈঠকখানা মার্কেট থেকে পত্রিকার জন্য একরিম-দু'রিম কাগজ কিনে আনতাম। খরচ বাঁচানোর জন্য বৈঠকখানা মার্কেট থেকে শিয়ালদহ স্টেশন পর্যন্ত মাথায় করেও সেই কাগজের ভারী বোঝা বয়ে আনতাম। একবার শিয়ালদহে কাগজের বড়ো প্যাকেট ট্রেনে তুলতে যাবো, এক টিটি ধরলেন। বললেন, "বুক করেছেন প্যাকেট?" আমি সবিনয়ে বললাম, "শুনুন, লিটল ম্যাগাজিনের জন্য কাগজ কিনে নিয়ে যাচ্ছি। বুক করতে গেলে আর বের করতে পারবো না! এই দেখুন আমাদের কাগজ।" আমার কাপড়ের সাইডব্যাগ থেকে 'কবিকলম'-এর আগের সংখ্যাটি ওঁর হাতে দিলাম। উনি নেড়েচেড়ে দেখে বললেন, "এই নিন পত্রিকার দাম দশ টাকা। আমি এটা পড়বো।" তারপর একটা কুলি ডেকে বললেন, "এই শোনো, এই বাবুর প্যাকেটটা ট্রেনের বাঙ্কারে তুলে দাও। পয়সা নিও না, আমি দেবো তোমাকে।" কুলিটি তাই করলো। কৃষ্ণনগর লোকাল। জানালার পাশে জায়গা পেয়েছি। আমার সামনে উপরের বাঙ্কারে কাগজের মোটাসোটা বান্ডিল। টিটি ভদ্রলোকের ব্যবহারে আমি তো একেবারে থ'! সত্যিই লিটল ম্যাগাজিনের প্রকৃত আত্মজন কোথায়-না-কোথায় ছড়িয়ে আছে। সরাসরি কৃষ্ণনগর স্টেশনে নেমে শেয়ার-রিকশায় সোজা হাইস্ট্রিটের বঙ্গরত্ন মেশিন প্রেসে, যেখানে আমাদের পত্রিকা ছাপা হবে। কাগজ বুঝিয়ে দিয়ে আবার স্টেশনে এসে, তারপর বাদকুল্লায়—বাড়িতে। পরেরদিন সব ঘটনা বলতে বাবলা (বিশ্বজিৎ চক্রবর্তী), তিনু (বিকাশ দত্ত) আর পবিত্র তো অবাক। পবিত্র বারবারই বলতে লাগলো, "দু'টাকা বাঁচানোর জন্য ঠেলারিকশা না-নিয়ে মাথায়-কাঁধে করে কাগজ আনলেন স্টেশনে?" আমি বললাম, "মাল বহন করার অভ্যাস আমার আছে। আর, পত্রিকার তো দুটো টাকা বাঁচলো।" একথা বলে, টিটি ভদ্রলোকের পত্রিকাক্রয় বাবদ দশ টাকা পবিত্রকে বুঝিয়ে দিলাম। সে তখন একাধারে পত্রিকার সহ-সম্পাদক ও কোষাধ্যক্ষ। কিছুদিন পরে সে ও আমি যুক্ত-সম্পাদক হই। পত্রিকাকে কেন্দ্র করে সুকুমারবাবুর একগুঁয়েমি আমাদের প্রত্যেকের সহ্যের সীমা অতিক্রম করেছে ততদিনে। সুকুমারবাবু অবশ্য যুক্ত ছিলেন উপদেষ্টা হিসাবে। কবিতাও দিতেন পত্রিকার জন্য। বিকাশ দত্ত একদম প্রথাবিরুদ্ধ ও চমৎকার কিছু কবিতা লিখে তিন-চারবছরের মধ্যেই লেখা ছেড়ে দিল। অবশ্য পত্রিকা যতদিন চলেছিল, সে সক্রিয়ভাবেই যুক্ত ছিল। সবিতা দত্ত ভালো কবিতা লিখতো। আমাদের একমাত্র মহিলা সদস্য। সেও কলকাতা মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশনে চাকরি পেয়ে কলকাতায় চলে গেল। চাকরি পাওয়ার পরে সে কবিতা লেখা ছেড়ে দেয়। কিন্তু 'কবিকলম' পড়তো, কিছুদিন চাঁদাও দিয়েছিল। বিশ্বজিৎ চক্রবর্তী খুবই মেধাবী তরুণ লেখক। সেন্ট জেভিয়ার্সে ইংরেজি অনার্স পড়তো কলেজ হোস্টেলে থেকে; কলকাতায় ওর বড়দা (চিকিৎসক)-র বাড়ি থাকা সত্ত্বেও।  বিশ্বজিতের ঠিক আগের যে-দাদা অর্থাৎ বাপ্পাদা (বাপ্পাদিত্য চক্রবর্তী) নিজে কিছু লিখতেন না; কিন্তু দেশি-বিদেশি সাহিত্য পড়তেন খুবই ব্যাপকভাবে। বাপ্পাদা আমাদের পত্রিকার খুব অ্যাক্টিভ প্যাট্রনাইজার ছিলেন। তিনি মজা করে আমাকে 'মহাকবি' বলে ডাকতেন। 

বিশ্বজিৎ খুবই অন্যধরনের কবিতা লিখতো। আর লিখতো অন্য-গদ্য। তার অনবদ্য গদ্যশৈলীর ভক্ত ছিলাম আমি। প্রায় প্রতিটি সংখ্যাতেই সে লিখেছে। স্কুলে ওর সতীর্থ জ্যোতির্ময় বিশ্বাস (সবুজ) আমাদের পত্রিকার নিয়মিত পাঠক ছিল। সে তখন কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ অ্যান্ড হসপিটালে ডাক্তারি-ছাত্র। নিয়মিত ডাকযোগে ওখানে 'কবিকলম' যেত সবুজের কাছে। সবুজ চমৎকার কবিতা আবৃত্তি করতো। ডাক্তারি পাস করে সে একবার আমাদের বাড়িতে (উত্তর সুরভিস্থানে, মিলন সংঘের কাছে) এসেছিল। সবুজ অর্থাৎ ডাক্তার জ্যোতির্ময় বিশ্বাস বর্তমানে চেন্নাইয়ে শঙ্কর নেত্রালয়ের ডিরেক্টর। দেশে-বিদেশে প্রায়ই তাকে ঘুরতে হয় তার গবেষণা ও পেপার পড়ার কাজে।

বিশ্বজিতের সঙ্গে তার মৃত্যুর আগে পর্যন্ত আমার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। বিশ্বজিৎ কলকাতা পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টর হিসাবে যোগদান করে। কলকাতা পুলিশের অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার হয়েছিল সে। যদিও কর্মজীবনে নানা বাধাবিঘ্নর সম্মুখীন হতে হয়েছিল; সেই কারণেই পদোন্নতিতে অহেতুক বিলম্বও হয়েছিল। খুবই সৎ, ডাকাবুকো পুলিশ অফিসার ছিল সে। বন্দর এলাকার অনেক দুর্ধর্ষ মাফিয়াকে সে কোণঠাসা করে রেখেছিল। ভারত সরকার তাকে ইউএনও-র পিস কিপিং অফিসার হিসাবে কোস্টারিকা, বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা  এবং আফ্রিকাতে পাঠিয়েছিল। ভালো কাজের স্বীকৃতিতে সে ইউএনও-র সেক্রেটারি জেনারেলের হাত থেকে স্বর্ণপদকও লাভ করেছিল। বাদকুল্লায় যখনই সে তার পৈত্রিক ভদ্রাসনে আসতো, আমাকে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করতো। যেতাম আমি। ওর স্ত্রী চৈতালিও লালবাজারে গুন্ডাদমন শাখার ইন্সপেক্টর। চৈতালি খুবই অতিথিপরায়ণ। আমাকে বরাবর সে 'দাদা' বলে ডেকে এসেছে। বাড়ি গেলে, দুপুরে ভাত না-খাইয়ে ছাড়তো না। আমি আর বাবলা একসঙ্গে খেতাম। পাতে খাসির মাংস থাকবেই। বাবলা বাদকুল্লায় এলে খাসির মাংস খেতো, অথচ কলকাতায় খেতো না! বলতো, কলকাতার খাসির মাংস খাওয়া যায় না। ওর বাড়ির পুবের বারান্দায় বসে এক শীতকালে ওর সঙ্গে কফি খেতে-খেতে ওকে বললাম, "তোমার সারাজীবনের লেখালেখি সব বই হিসাবে তো প্রকাশ করা যেতে পারে। পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত করো। একটা বাংলা গদ্য-পদ্যের, আর একটা ইংরেজি কবিতা ও প্রবন্ধের।" 'The Statesman' কাগজে মানবাধিকারের উপরে অনেক মূল্যবান প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে ওর। আমার কথায় অনুপ্রাণিত হয়ে সে দুটো ফাইলের কাজ শেষ করে ফেলেছিল প্রায়। একটা ইংরেজি, অন্যটা বাংলা। আমাকে বললো দুটো ভূমিকা লেখার জন্য—একটা বাংলা, অন্যটা ইংরেজি বইয়ের জন্য। আমি একমাসের মধ্যে লেখাদুটো দিই ওকে। আমার সামনেই সংশ্লিষ্ট ফাইলদুটিতে আমার লেখা ভূমিকা ও Introduction সে সযত্নে রেখে দেয়। এরপরেই যে-ঘটনা ঘটে, তা অত্যন্ত মর্মান্তিক। কোভিডে আক্রান্ত হয়ে বাবলা নাকি দু'দিন লেক টাউনের বাড়িতেই ছিল; তারপর শ্বাসকষ্ট বেড়ে যাওয়ায় ওকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার কয়েক ঘন্টার মধ্যেই ওর মৃত্যু হয়। ডাক্তাররা চিকিৎসা করার কোনো সুযোগ-ই পাননি। আমি অনেকবার ভেবেছি, কলকাতার মতো জায়গায় বাবলার ক্ষেত্রে এটা হলো কী করে! সে বেশিদিন রিটায়ার করেনি,  তার স্ত্রী চৈতালিও লালবাজারের পদস্থ অফিসার। ওকে বাড়িতে ফেলে রাখা হলো; ওর তো কো-মর্বিডিটি ছিল! হাই ব্লাড সুগার, দু'বার ইনসুলিন নিতে হতো। অথচ দু-দুটো ভাইটাল দিন, মানে ৪৮ ঘন্টা বাড়িতে রাখা হলো, হাসপাতালে নিয়ে গেল না কেউ— এ তো মারাত্মক গাফিলতি! কত সাধ করে ওদের পুরোনো বাড়ির এক্সটেনশন করলো। দুটো বড়ো-বড়ো শোওয়ার ঘর, স্টাডি, ডাইনিং, নতুন মডেলের কিচেন ও বাথরুম। এসব করলো কেন বাবলা? বারবার বলতো, "প্রাণেশদা, বাদকুল্লাতেই পাকাপাকি থাকবো। আমার এই বইদুটো বেরিয়ে গেলেই ২৪ ঘন্টার লেখক হয়ে যাবো।" হ্যাঁ, ওকে আমি বলতাম, "এত চমৎকার ইংরেজি লেখো তুমি; এবার ইংরেজিতে একটা অটোবায়োগ্রাফি লেখো। কত উপাদান রয়েছে তোমার জীবনে।" কত স্বপ্ন, সব মুহূর্তে শেষ হয়ে গেল! 

বাদকুল্লায় এসে চৈতালি এখানকার আশ্রমে বাবলার পারলৌকিক কাজ সেরেছে। কাজকর্ম মিটে যাওয়ার পরে সে আমাকে ফোন করে ওদের বাড়িতে যেতে বললো। আমি পৌঁছলে আমাকে বললো, "দাদা, ওর বইদুটো প্রকাশ করবো আমি। ওর শেষ ইচ্ছা। আপনি আমাকে সাহায্য করবেন।" আমি বললাম, "অবশ্যই। ফাইল দুটো সাবধানে রেখো তুমি।" কিন্তু এসব কথার পর তো দেড়-দুইবছর অতিক্রান্ত হয়ে গেল। চৈতালির দিক থেকে কোনো সাড়াশব্দ নেই। জানি না, শেষ পর্যন্ত কী সিদ্ধান্ত নিয়েছে ও।

(ক্রমশ)

Comments