প্রৌঢ়া পাখির মতো উড়তে পারেন! গল্পটা পাখির পালকের মতো রঙিন ও কোমল।
ঝিরঝির বৃষ্টি হচ্ছিল। গত সারারাত্রি বৃষ্টি হয়েছে। ভেজা মাটি। গাছগাছালির পাতায় জলবিন্দু। প্রকৃতি গাঢ় সবুজ। নিরুপমাদেবী সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখলেন তাঁর স্বামী তখনও ঘুমিয়ে আছেন। তিনি জানালা খুলে দেখলেন তখনও বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টিভেজা সকালের বাতাস তাঁকে স্পর্শ করলো।
আর্থিক বুনিয়াদ তাঁদের সুদৃঢ়। তাঁদের পুত্র-কন্যা প্রবাসে কর্মরত। তাঁর স্বামী কর্মক্ষেত্রে অবসরের পর তাঁদের পৈতৃক বাড়িতে এই মফস্বল শহরে বসবাস করেন। এই শহর ওঁদের দু'জনের-ই নিজের শহর। দু'জনেরই শৈশব, কৈশোর এবং যৌবনের প্রারম্ভিক সময় এখানে কেটেছে। তাঁর স্বামীর বর্তমানে কাজ সকালে বাজারে যাওয়া। মাঝেমধ্যে ব্যাঙ্ক বা পোস্ট অফিসে অর্থ-সংক্রান্ত বিষয়ে যাতায়াত। বন্ধুবান্ধব বিশেষ নেই। বৈকালে তাঁদের বাড়ির কাছাকাছি দিঘির পাড়ের মাঠে হাঁটতে যাওয়া। একঘেয়েমি জীবনে কখনো-কখনো তাঁদের সামান্য বচসা হলেও, আবার তাঁরা সামলে নেন। শুভেন্দু কখনও হয়তো জিজ্ঞাসা করলো, পুত্র-কন্যাদের কোনো খবর নিয়েছে কিনা! নিরুপমার ঝাঁঝালো কন্ঠ—কেন? তুমিও তো ফোন করতে পারো!
এইভাবেই কাটে এই প্রৌঢ় দম্পতির জীবন। শুভেন্দুর ওষুধের প্রতি কড়া নজরদারি করে নিরুপমা। একটু ভুল হলেই দক্ষযজ্ঞ বাধায়।
বিকেলে বৃষ্টি একটু ধরেছে। শুভেন্দু ছাতা হাতে বেরিয়ে পড়েন। নিরুপমা তখন একা। গ্রিলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে।
এইসময় একটা পালকভেজা পাখি বারান্দায় এসে তাঁর পাশে জড়োসড়ো হয়ে বসলো।
তাঁর মনে হলো, পাখিটার দু'চোখে যেন কৌতুকময় হাসি লেগে আছে। পাখিটা ডানা ঝাপটা দিয়ে উড়ে বসলো গ্রিলের ফাঁকে। তারপর তাঁর দিকে তাকিয়ে পালক নাড়িয়ে তাঁকে হাতছানি দিল যেন ওড়ার জন্যে। স্রোতহীন গড়িয়ে যায় নিরুপমার সময়। বছরে এক-দু'বার কন্ডাক্টেড ট্যুরে বেড়ানো হলেও তাঁর মানসিক অবসাদ যেন কাটে না।
তাঁর ইচ্ছে হলো—যদি পাখি হয়ে উড়তে পারতেন! নিরুপমা দেখলেন, পাখিটার একটা পালক ঝরে পড়লো তাঁর হাতের কাছে। কয়েকবার রামধনু রঙের কোমল পালকটি হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করলেন। তারপর কী ভেবে তাঁর ডাই করা চুলের খোঁপায় গুঁজে দিলেন পালকটি। তিনি কিশোরী হয়ে যান।
মেঘলা দিন। স্কুলে শেষ ক্লাসে পড়েন। টিফিন-পিরিয়ডে ছুটি হয়েছে। তার অন্তরঙ্গ বন্ধু পারমিতা ও সে রঙিন ছাতা মাথায় প্যাচপ্যাচে কাদায় রাস্তা ধরে বাড়ি ফিরছে। তারা দু'জনেই লক্ষ করে, কিছুটা দূরে তাদের-ই সমবয়সী একটা ছেলে সাইকেলে বসে টুংটুং ঘন্টি বাজাচ্ছে। বেশ কিছুদিন তাদের নজরে এসেছে, যখন তারা স্কুলে যায়, একটা নতুন সাইকেলে ছেলেটি তাদের পিছনে ঘন্টি বাজিয়ে তাদের স্কুলগেট পর্যন্ত যায়। আবার ফেরার পথেও একইভাবে তাদের অনুসরণ করে। ছেলেটিকে দেখলেই দু'বন্ধু চোখাচোখি করে হেসে গড়িয়ে পড়ে একে অপরের গায়ে।
বৃষ্টিভেজা দিনেও একইরকম অনুসরণ করছিল ছেলেটি। তারা লক্ষ করলো, ধীরগতিতে ছেলেটির সাইকেল তাদের পিছন-পিছন আসছে। পথে বিশেষ লোকজন নেই। ছেলেটি হঠাৎ তাদের সামনে এসে দাঁড়ায়। তারপর সাইকেল থেকে নেমে বুকের পকেট থেকে একটুকরো ভাঁজ করা ভেজা কাগজ নিরুপমার দিকে বাড়িয়ে ধরে।
বিরক্তি দেখিয়ে কাগজটা দলা পাকিয়ে তার দিকে ছুঁড়ে দিয়েছিলেন। জলকাদায় ভেজা রাস্তায় কাগজটা উড়তে পারেনি। অনেকটা একটু আগে আসা পাখিটার মতো রাস্তাতেই জড়োসড়ো হয়ে বসে পড়েছিল।
আজ বাদল দিনে তাঁর বারান্দায় আসা পাখিটা সেই স্মৃতিকে উসকে দেয়। মনে করতে থাকেন—না, আর কোনোদিন ছেলেটিকে তিনি দেখেননি।
রামধনু পালকটি আজ তাঁকে পাখি করে দিয়েছে। তিনি উড়তে থাকেন সাদা-কালো মেঘের মধ্যে। হাত বাড়ালেই হয়তো নিতে পারবেন সেই ভেজা ন্যাতানো চিঠিটি!আকাশের গায়ে রামধনু-পথ। ভেজা চিঠিটা নাগালে আসলেও ধরা দিচ্ছে না। অনেকটা মার্ক সাগালের ছবি! মোরগটি যেন সেই চিঠি!
উড়তে-উড়তে দেখা হয়ে গেল কিশোরীকালের বন্ধু পারমিতার সঙ্গে।
—তুই এখানে কী করছিস?
—তুই যে-কারণে উড়তে বেড়িয়েছিস, আমিও তাই। চল, আবার দু'জনে স্কুলগেটে যাই।
—না রে! আমি সেই নতুন সাইকেলের ছেলেটিকে খুঁজতে বেরিয়েছি...সেই ভেজা চিঠিটা যদি পাই!
—সেই চিঠি তুই আবার কোথায় পাবি! ওই দ্যাখ, ভেজা চিঠিটা রামধনু-পথে উড়ছে।
কিন্তু নাগালের বাইরে সেই কাগজ-টুকরো। উড়ছে অনন্ত পথে! আর দু'টো রঙিন পাখি উড়তে থাকে
সারা আকাশে।
উড়তে-উড়তে ক্লান্ত দু'জন একটা সাদা মেঘের চাঙড়ে বসলেন। নিরুপমার কাছে বিকালে আসা পাখিটা তাঁদের চারপাশ প্রদক্ষিণ করে। সাইকেল-ঘন্টির টিংটিং সুরে গাইতে লাগলো। সেইসময় পারমিতার একটি কথনে কেঁপে উঠলেন নিরুপমা।
পারমিতা বললো—জানিস, তুই যাকে পাত্তা দিসনি...আমি কিন্তু ওর সাইকেল-ঘন্টির জন্যে মুখিয়ে থাকতাম। আমি খুবই ভালোবেসে ফেলেছিলাম ওই ছেলেটিকে! তার নামটাও হয়তো তুই জানিস নে।
নিরুপমা বললো—সত্যিই জানি না।
—আমি আমার ভাইয়ের বন্ধুর কাছ থেকে ওর নাম জেনেছিলাম। নয়ন। কলেজে ফার্স্ট ইয়ারে পড়তো। নদীর ধারে ছিল ওদের বাড়ি। বাড়িটাও চিনে এসেছিলাম। তারপর সুযোগ করে ওর বোনের সাথে আলাপ করে ওদের বাড়িতে একবার গিয়েছিলাম, শুধু নয়নের জন্যে। নয়নের সাথে দেখাও হয়েছিল। ওকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, আপনি আমাকে কি চিনতে পারছেন?
নয়ন অনেকক্ষণ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলেছিল—না তো!
সেদিনই আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে, সে আমাদের দু'জনের পিছু নিলেও তার স্থির লক্ষ্য ছিল তোর দিকেই!
দুই প্রৌঢ়া রমণী রঙিন পাখি হয়ে উড়তে লাগলো নদীর ধারে নয়নের বাড়ির উদ্দেশে। তারা তাদের কৈশোর ও যৌবনের সন্ধিক্ষণের সাইকেলের ছেলেটির নদীর ধারের বাড়িতে পৌছে দেখলো দ্বিতল বাড়িটি ভগ্নপ্রায়, জরাজীর্ণ। আগাছাভরা উঠোনে দাঁড়িয়ে আছে একটা গন্ধরাজ ফুলগাছ। আশেপাশে গড়ে উঠেছে বহুতল।
সেইসময় সেই রামধনু পাখিটা গন্ধরাজ ফুলগাছে বসে টিংটুং টিংটুং সুরে গাইতে লাগলো।
নিরুপমা ফুলগাছে একটিমাত্র ফুল দেখতে পেলেন।
তিনি উড়ে গিয়ে বসলেন ফুলটির পাশে। পরম মমতায় তাঁর ঠোঁট দিয়ে ফুলটি স্পর্শ করতেই ফুলটি একটি ভেজা চিঠিতে রূপান্তরিত হলো!
তিনি উল্লাসে বলে উঠলেন—এই দ্যাখ পারমিতা, আমি চিঠিটা পেয়েছি!
Comments
Post a Comment