তাহার পর যাহা হইল:
ভবভূতি এক অন্ধকার সুড়ঙ্গের মধ্য দিয়া পথ চলিতেছেন। সূর্যোদয় গত হইয়াছে এ-বোধ তাঁহার আছে কিন্তু সূর্যাস্ত হইতে তিনি আগাইয়া রহিয়াছেন না পিছাইয়া, সে-জ্ঞান তাঁহার নাই। অতীব ক্ষুদ্র আকৃতির কতিপয় বিদ্যুৎশিখা তাঁহার সম্মুখে মাঝেমধ্যে জ্বলিয়া উঠিয়া ফের নির্বাপিত হইয়া যাইতেছে। তিনি স্পষ্ট টের পাইলেন বহু পিছনে তাঁহার পিতার আমলের টেবিলের উপর জলের গ্লাসখানি ঢাকা দেওয়া রহিয়াছে। সম্মুখের দেওয়ালঘড়ির পেন্ডুলাম একটি সম্পূর্ণ দোলনকাল চিহ্নিত করিতেছে। টেবিলের উপর হইতে তাহার খাতাপত্র, পুস্তক ইত্যাদি সরাইয়া ফেলা হইয়াছে। ভবভূতি দেখিতে পাইতেছেন সে-ঘরের দরজা খুলিয়া গেল। পায়ে-পায়ে কতজন প্রবেশ করিল ঘরে। তাহাদের কাহারো পায়ের পাতা তিনি ইতিপূর্বে দেখেন নাই। তাহাদের চলনের শব্দ নাই, বাক্য বিনিময়ের শব্দ নাই। ভবভূতি অনুভব করিলেন সমকাল এবং ভবিষ্যত তাঁহার দুইদিকে বিস্তৃত। তিনি যতখানি আগাইতেছেন, ততখানি পিছাইতেছেন। গতির সম্ভাব্য সরণ সম্পর্কে তাঁহার অধিগত বিদ্যা এ-সম্বন্ধে কিছু ধারণা দেয় না। তিনি শুধু বুঝিলেন তাঁহার চলন স্বয়ংক্রিয় এবং কালের অতীত। তিনি দেখিলেন সারিবদ্ধ পায়েরা ঘর ছাড়িয়া বার হইল। বেশ কিছু বয়স্ক, মধ্যবয়স্ক, যৌবনপ্রাপ্ত এবং শিশুর পায়ের সঙ্গে ভবভূতি ঘর হইতে বাহিরে আসিলেন। পায়েরা সংঘবদ্ধ থাকিতে পারিল না। ভিন্ন-ভিন্ন পথে কতিপয় পাগুলি চলিতে লাগিল। প্রতিটি পথের শুরুতে এক-একটি চিহ্নযুক্ত পতাকা। চিহ্নগুলি বিচিত্র। যুদ্ধরত, ভয়াল সব দেবতার মুখ। সকলই সাদা-কালো। অগুনতি পা প্রতিটি পথে চলিতেছে আর তাহাদের প্রত্যেকের হাতে ছোটো-ছোটো পতাকা। স্বাধীনতা দিবসে ছোটো ছেলেরা এইসব পতাকা লইয়া কুচকাওয়াজ করিতে বাহির হইত। ভবভূতি একইসঙ্গে সেইসকল পথের সঙ্গে চলিতে লাগিলেন। কোনো পথ বিদ্যালয়ে পৌঁছায়, কোনো পথ লোকালয়ে, কোনো পথ খামারের দিকে গিয়াছে। যাহারা চলিতেছে তাহাদের প্রত্যেকের হাতে ছোট ছোট পতাকা। সেইসব পতাকার কোনোটিতে ভয়ংকরের কঙ্কাল চিহ্ন, কোনোটায় খড়্গের চিহ্ন, কোনোটায় আবার বীভৎস কোনো দেবদেবীর। ভবভূতি দেখিলেন পায়েরা পায়ের থেকে বিচ্ছিন্ন হইয়া নতুন পায়ের সঙ্গে মিলিত হইল। ভবভূতি দৃশ্যের সহিত দৃশ্যের সম্পর্ক বুঝিলেন, কিন্তু দেখিতে পাইলেন না। তাঁহার দৃষ্টি শরীরের কাঁধ বুক মাথা দেখে না। তাঁহার কান শব্দ শোনে না, তাঁহার চোখ সাদা-কালো ব্যতীত রং দেখিতে পায়না। ভবভূতি যেন বুঝিলেন যাহা থাকিলে কিঞ্চিৎ সুবিধা হতো, তাহা না-থাকায় তাঁহার কী এক প্রকার অসহ্য বোধ হইতেছে, কিন্তু সেটি দুঃখ না আনন্দ না যন্ত্রণা তাহা স্পষ্ট বোঝা যায় না। দৃশ্যের বদল হইল। ভবভূতি দেখিলেন তাঁহার সম্মুখবর্তী কয়েকজোড়া পা আগাইয়া আসিল অত্যন্ত কাছে। পুনরায় ফিরিয়া গেল। কয়েক মুহূর্তের জন্য তাঁহার মনে হইল, একজোড়া কোমল সুবিন্যস্ত পদ্মের ডাঁটার মতো আঙুলসমন্বিত পা এত কাছে আসিয়া পড়িল যে মনে হইল, কেউ যেন তাঁহার শরীরের উপর ঝুঁকিয়া পড়িয়াছে। মুহূর্তের জন্য ওই দু'খানি পায়ের প্রতি কেমন এক টান অনুভূত হইল। কিন্তু পরক্ষণেই সেই পা দু'খানি বিলীন হইল। ভবভূতির ভিতরে এক তৎপরতা জাগিল। যেন তিনি যাহা দেখিতে চাহিতেছেন তাহা দেখিতে পাইতেছেন না। তাঁহার দেখার দৃষ্টিকে তিনি কিঞ্চিৎ উপরে তুলিতে চাহিলেন প্রাণপণ চেষ্টায়। ব্যর্থ হইলেন। তাঁহার কোনো শারীরিক স্বাধীনতা নাই। ভবভূতি থামিতে চাহিলেন, কিন্তু পারিলেন না। তাঁহার দৃষ্টি তাঁহাকে যেন সীমিত পরিসরে চক্রাকারে আবর্তন করাইতে উদ্যত হইয়াছে। তিনি বলিতে চাহেন, ডাকিতে চাহেন, নাম খুঁজিয়া চলেন মানুষের; কিন্তু দেখেন শুধু পায়ে-পায়ে হেঁটে চলা অগুনতি মানুষের অস্থিরতা এবং অসহনীয়তা। জল, জঙ্গল, শহর, গ্রাম অতিক্রম করিয়া সহস্র পদচালনা তাঁহাকে বিপর্যস্ত করিতে থাকে। তিনি দেখিতে না-চাহিলেও তাঁহাকে দেখিতে হয় গলিপথে কাহারো রক্তাক্ত পায়ের ছাপ। চতুর্দিকে বিক্ষিপ্ত আঘাতপ্রাপ্ত মানুষের শরীরের প্রত্যঙ্গ। তাঁহাকে দেখিতে হয় পাদুকা পরিহিত তীব্র একটি পা অন্য একটি করুণ-ক্লিন্ন, কোমল পায়ের উপর চাপ দিয়া তাহাকে ভাঙচুর করিতে চাহে। একে-একে অসংখ্য পাদুকা ওইরূপে দরিদ্র মলিন পাগুলিকে দলিয়া চলে। জীর্ণ পায়েরা ধীরে-ধীরে গলিত রক্তাক্ত শবের মতো ঘিরিয়া ধরে ভবভূতিকে। যেন মৃতের দল তাঁহাকে আক্রমণ করিয়া মৃত বানাইতে চাহে। কিন্তু তিনি যে মৃত নন, তিনি যে সম্পূর্ণ বুঝিতে পাইতেছেন, সচেতন-সজাগ পায়ের চলাফেরা, অস্থিরতা, সেকথা কেমন করিয়া বুঝাইবেন উহাদের! হঠাৎ দৃশ্যের বদল হইল। যেন স্বপ্নঘোর ভাঙিয়া যাইবার পরের মুহূর্ত। ভবভূতি নিজেকে একটি কক্ষের মধ্যে খুঁজিয়া পাইলেন। একটি মুখ যেন নিচু হইয়া তাহার সমুখে আসিল। এক অপরূপ নারীর মুখ। নিটোল মায়াবী। মানুষ এমন সুন্দর হয় বুঝি? ওই মুখখানি কাহার তিনি বুঝিতে পারিলেন না, কিন্তু বোধ হইল যেন পরম আপনার জন। দুই ভ্রু-এর মাঝখানে একটি ছোট্ট বিন্দু। হরিণীর ন্যায় কালো দুটি চোখ টলটল করিতেছে জলে। সে যেন তাহার খুব নিকটে আসিয়া মুখ নাড়িয়া প্রবল আবেগে কিছু বলিতেছে। ভবভূতি শুনিতে পাইলেন না। এখানে শব্দ শোনা যায় না। কিন্তু কোমল দুটি ওষ্ঠের সঞ্চালনায় সে-নারীমুখ যেন তাঁহাকে শুনাইতে বদ্ধপরিকর। তাঁহার খুব ইচ্ছা হইল দুটি কথা কন ওই মেয়ের সাথে। তাঁহার এলোমেলো চুল সরাইয়া মাথায় হাত বুলাইয়া দেন। মনে হয় মেয়েটির প্রবোধ পাওয়া দরকার।
ভবভূতি আপ্রাণ চেষ্টা করিলেন কথা কইবার। কহিলেন কিনা তাহা বুঝিবার উপায় নাই। ওই কোমল মুখাবয়ব তাঁহার হৃদয়ে আন্দোলন তুলিল। আরো কতিপয় মুখ যেন নিচু হইয়া তাঁহার দৃষ্টির সমতলে আসিয়া কিছু কহিতেছে। সকলেই নারী। ভিন্নবয়সী নারী এবং বিচলিত। ভবভূতির আবেগ আসিল। কী এক অদ্ভুত অনুভব। ইহাকেই কী দুঃখ বলে! এরপর ইহাদের মধ্য হইতে এক যুবকের মুখ আবির্ভূত হইল। সেও আপ্রাণ যেন কিছু বলিতে চায় তাহাকে। ভবভূতি স্পষ্ট বুঝিলেন যুবকের মুখ তাহার চলনের গতিতে কম্পন যোগ করিয়াছে। সম্মুখে যে সরলরেখা বরাবর তিনি চলিতেছেন সে যেন গতি হারাইতে বসিয়াছে। শুধু যেন পিছনের পথ তাঁহাকে টানিতেছে। হঠাৎ তাঁহার শ্রুতি বোধ হইতে লাগিল। দৃষ্টিতে রঙের ছোঁয়া আসিল। ভবভূতি দেখিলেন ওই যুবক বহুদূর থেকে যেন কথা কহিতেছে।
– বাবা, বাবা একবার তাকাও বাবা।
ভবভূতির হৃদয় আর্দ্র হইয়া উঠিল। তিনি টের পাইলেন ওই ব্যক্তি তাঁহার জ্যেষ্ঠ সন্তান। পাশে যে-সকল নারীগণ দাঁড়াইয়া আছে তাহাদের অনেকেই তাঁহার পরিচিত। তিনি ফের শুনিতে পাইলেন–বাবা চোখ মেলেছে, দিদি বাবা তাকিয়েছে দ্যাখ।
ভবভূতির চোখে চারদিক হইতে নানারঙের আলো প্রতিফলিত হইতে লাগিল। একলহমায় তাঁহার পরিবার, প্রিয়জন, সন্তান, সকলে তাহার স্মৃতিতে সজল হইয়া উঠিল। তিনি পুলকিত হইলেন। বুঝিতে চেষ্টা করিলেন সময়ের কোন মুহূর্তে বসিয়া তাঁহার এমন পুনর্জন্ম। তাঁহার স্ত্রী, যিনি দূরের একটি চেয়ারে বসিয়া একমনে ঠাকুরের নাম নিতেছিলেন, তিনি এবারে কাছে আসিয়া একহাতে ফুল-বেলপাতা লইয়া সকলকে "সরো, সরো" বলিয়া ভবভূতির একদম নিকটে আসিয়া হাঁটু ভাঙিয়া, কানের কাছে মুখ নিয়া বলিলেন–ওগো, রাধামাধবের মন্ত্র জপ করো একমনে। রাধামাধবই ফিরিয়ে দিয়েছেন তোমাকে। ওগো শুনছো...ও।
অধিক ব্যস্ত হইয়া পড়িলে পাছে শরীর খারাপ হয়, এই ভেবে কয়েকজন আসিয়া ঠাকরুন-কে ধরে। কেউ একজন বলে— মা জননীকে এইবার ঘরে নিয়ে গিয়ে কিছু মুখে দাও গো ওঁর। গত দু'দিন ধরে একভাবে রাধামাধবকে ডেকে যাচ্ছে উপাস করে।
ভবভূতির দুই চোখ তাহার পুত্রকে খুঁজিতে লাগিল। এরপর ঘরে ব্যস্তসমস্ত হইয়া দুই-তিনজন লোক প্রবেশ করিল। তাহাদের মাথায় লাল সিঁদুরের তিলক কাটা। পরনে গেরুয়া বসন। ওদের একজনকে দেখিয়া ভবভূতির মনে পড়িল সেই চরম ধাক্কার কথা, যাহার পর তাঁহার গতির মাত্রার বদল হইয়াছিল। এ তো সেই লোক, যে তাঁহাকে প্রবল কিছুতে আঘাত করিয়াছিল। পাশে সেই উন্মত্ত পুরোহিত যে দেবতার মহিমা বর্ণনা করিয়া তাঁহার সমগ্র এস্টেটের মানুষকে বিভ্রান্ত করিতেছে। ভবভূতি প্রবল আবেগে অঙ্গুলি নির্দেশ করিলেন, উত্তেজনায় তাঁহার শরীর থরথর করিয়া কাঁপিয়া উঠিল। তিনি ডাকিলেন–খোকা, খোকা!
অপর তিনজন সশব্দে বলে উঠলেন, জয় শ্রীরাম!
ভবভূতি আতঙ্কিত হইয়া উঠিলেন। এরপর অকস্মাৎ তাঁহার কন্ঠ রুদ্ধ হইয়া গেল। তিনি স্থির হইয়া গেলেন। দেখিলেন ফের শ্রুতি হারাইয়াছেন তিনি। দৃষ্টির সম্মুখ হতে রং মিলাইয়া গেল। অন্য সকলের মুখ যেন ধীরে-ধীরে হালকা হইতে-হইতে মিলাইয়া যায়। যেন সহস্র জলের বিন্দু একলহমায় কেউ শুষিয়া লইল। ভবভূতি অনুভব করিলেন তাঁহার নিকট হইতে সকলই হারাইবার উপক্রম হইতেছে। তিনি বিরোধ করিবার নিমিত্ত শরীরকে ঝাঁকাইয়া-বাঁকাইয়া তীব্রভাবে ইন্দ্রিয়ে ফিরিতে চাইলেন। কিন্তু দেখিলেন ধীরে-ধীরে তাঁহার চতুর্দিক সাদা হইয়া উঠিল। ধোঁয়াটে সাদা রং যেন তাঁহার গতি হ্রাস করিবার নিমিত্ত সক্রিয় হইয়া উঠিয়াছে। ভবভূতির দুঃখবোধ ধীরে-ধীরে সরল হইয়া পড়িল। তিনি দেখিলেন, যে-সুড়ঙ্গের মধ্য দিয়া তিনি যাত্রা শুরু করিয়াছিলেন তাহা শেষ হইয়াছে। সম্মুখে তীব্র শাদা আলো। তিনি পিছনে দৃষ্টি নিক্ষেপ করিতে চাহিলেন। সেখানেও তীব্র শাদা। ভবভূতি ধীরে-ধীরে এক প্রবল শাদা কুয়াশার আবর্তে মিলাইয়া গেলেন। তাঁহার যাত্রা সম্পূর্ণ হইল। দিগন্তের কিছু নিচে সূর্যোদয় হইল।
বহুদূর হইতে শ্রীরামের বানরসেনা প্রভুর জয়গান করিতে-করিতে ততক্ষণে ভবভূতির সাম্রাজ্যের দখল নিয়াছে।
আখ্যানটি মনোগ্রাহী। সাধু ভাষার ব্যবহারে একটি ধ্রুপদী ঘোর নির্মাণ করিয়াছে। শাদা বানানটিও তাহার ঐতিহ্য রক্ষা করিয়াছে আপন মহিমায়।
ReplyDelete