আমার স্রোতস্বী পত্রিকার প্রকাশ দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে আমার বন্ধু বিকাশ মৈত্র শরৎ নামের আরেকটা ওয়াল ম্যাগাজিন বের করতে লাগলো। পাশাপাশি দুটি ম্যাগাজিন দেওয়ালে টাঙানো হতো। আমি শরৎ-এ লিখতাম, বিকাশও স্রোতস্বী-তে লিখতো। বেশ একটা সুস্থ প্রতিযোগিতা চলতো। ফলে, পত্রিকাদুটির মান বৃদ্ধি পেয়েছিল। আমাদের বন্ধু মধু বিশ্বাসও আমাদের কাগজদুটিতে কবিতা দিত। তার কবিতায় প্রতিবাদী চেতনা ধরা পড়তো।
স্রোতস্বী-র উদ্যোগে, নবশ্রী-র পুজো যেখানটিতে হয় সেই একটুকরো জমিতে সভামঞ্চ করে পরপর তিনবছর রবীন্দ্রজয়ন্তী পালিত হয়েছিল। প্রথম বছর ডক্টর নীরদবরণ হাজরা (প্রয়াত বিখ্যাত লেখক, নট ও আবৃত্তিকার) সভাপতির ভাষণে রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাচিন্তা ও শান্তিনিকেতন নিয়ে বলেছিলেন। উপস্থিত ছাত্রছাত্রী ও রবীন্দ্র-অনুরাগী মানুষ মুগ্ধ বিস্ময়ে তাঁর কথা শুনেছিলেন। ছেলেমেয়েরা রবীন্দ্রনাথের গান গেয়েছিল, কবিতা আবৃত্তি করেছিল এবং নৃত্যনাট্যও উপস্থাপনা করেছিল। এটা ১৯৬৯-৭০ সালের কথা, আমি তখন কৃষ্ণনগর কলেজে প্রথম বর্ষের ছাত্র। পরের বছর সভাপতি হয়েছিলেন আমাদের কলেজেরই অধ্যাপক ডক্টর অজয়কুমার ঘোষ। বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথের গ্রামোন্নয়ন কর্মসূচি প্রসঙ্গে। তার পরের বছর সুধীর চক্রবর্তী সভাপতির ভাষণে রবীন্দ্রনাথের য়োরোপ ও জাপান ভ্রমণ প্রসঙ্গে অসাধারণ বলেছিলেন। ওঁর বাগ্মিতা ছিল হীরকখণ্ডের মতো দ্যুতিময়। আমি জীবনে বেশ কিছু সুপণ্ডিত ও বাগ্মী মানুষের বক্তৃতা শুনেছি। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হরিপদ ভারতী (জনসঙ্ঘ), আবদুল্লা রসুল (ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি মার্কসবাদী), সুশীল ধাড়া (বাংলা কংগ্রেস), কাশীকান্ত মৈত্র, রবীন্দ্রকুমার দাশগুপ্ত এবং সম্প্রতি চিন্ময় গুহ। কাশীকান্ত মৈত্র একাধিকবার কালীনগর হাইস্কুলে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে এসেছেন। স্কুলের অনুষ্ঠানে তিনি দেশীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি, সাহিত্য-সংস্কৃতি ও দর্শন নিয়ে যে-বক্তৃতাগুলো দিয়েছিলেন তা শুনে আমি তো মুগ্ধ হয়েছিই, কৃষ্ণনগরের বুধমণ্ডলী যাঁরা শ্রোতা হিসাবে উপস্থিত ছিলেন তাঁরা সবাই মন্ত্রমুগ্ধ হয়েছিলেন। কালীনগর স্কুলের সামনের প্রাঙ্গন জুড়ে অগণন মনীষীর মূর্তি স্থাপিত আছে। কাশীকান্ত মৈত্র-র সুযোগ্য পুত্র ডক্টর সুব্রত মৈত্র-র অকালপ্রয়াণের পরে কাশীবাবু আর বেশিদিন বাঁচেননি। তাঁর মৃত্যুর পরে তাঁরও আবক্ষ মূর্তি স্থাপিত হয় স্কুলপ্রাঙ্গনে। কাশীবাবুর পুত্রবধূ এবং সুব্রত মৈত্র-র স্ত্রী চৈতালি মৈত্র সে মূর্তির আবরণ উন্মোচন করেন। মঞ্চে আমরা কাশীবাবুকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করি। কলকাতায় তাঁর গাড়ি করে ফেরার সময়ে চৈতালিদেবী আমাকে বাদকুল্লা পর্যন্ত লিফট দেন। পথে যেতে-যেতে তাঁর সঙ্গে আমার অনেক কথা হয়। ইংরেজি সাহিত্যের উজ্জ্বল অধ্যাপক চৈতালিদেবী পত্রপত্রিকায় বেশকিছু প্রবন্ধ লিখে থাকেন। প্রসঙ্গত মনে পড়ে, আমি একবার বাড়িতে রাতে বাথরুমে অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলাম। আমার সহকর্মী, বরেণ্য মানুষ শিবনাথ চৌধুরী আমাকে বেলভিউ হাসপাতালে ডক্টর সুব্রত মৈত্র-র কাছে পাঠিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের এক বিশিষ্ট হৃদরোগ-বিশেষজ্ঞ; লন্ডনেও বছরে তিনমাস চিকিৎসাবিজ্ঞানের পাঠ দিতেন। যাইহোক, তাঁর চিকিৎসায় আমি দ্রুত আরোগ্যলাভ করি এবং আমার কাছ থেকে ফিজ বাবদ তিনি একটি পয়সাও গ্রহণ করেননি।
আমি আমার জেলার কয়েকজন কবি-সাহিত্যিকের কথা বলছিলাম। কৃষ্ণনগরের সুবীর সিংহরায়ের সঙ্গে ১৯৭০ থেকে আমার সংযোগ, কলেজ ক্যাম্পাসেই। অমন সদাহাস্যময়, প্রাণখোলা, বন্ধুবৎসল মানুষ আজকের দিনে প্রকৃতই দুর্লভ। কবি, নাট্যকার, নট, আবৃত্তিকার, ছোটোগল্পকার, আখ্যানরচয়িতা, প্রাবন্ধিক, সম্পাদক ও সাংবাদিক সুবীর প্রধানত কবি-ই। কেঁদুলি মেলায় পরিভ্রমণ ঘিরেই রচিত হয়েছে ওর অনবদ্য আখ্যান বৈরাগী আকাশের তলে । কালকূটের অমৃতকুম্ভের সন্ধানে-র পরে এমন মরমি আখ্যান আমি তো আর পড়িনি! সম্প্রতি সুবীরের অস্ট্রেলিয়ান বান্ধবী এমি-র অনুরোধে বৈরাগী আকাশের তলে-র বেশকিছু অংশ আমাকে ইংরেজিতে অনুবাদ করতে হলো। এমি ভারতবর্ষকে নিয়ে একটা বই লিখছে, সেখানে এই অংশটি যাবে।
রানাঘাটের কবি প্লাবন ভৌমিকের কথা আমি আগেই উল্লেখ করেছি। ওর সঙ্গে প্রজ্ঞা প্রকাশনের সংযোগ আমিই ঘটিয়ে দিই। প্রজ্ঞা প্লাবনের কিছু বই প্রকাশও করে। সম্প্রতি লেখা ওর একটি কবিতা এক লিটল ম্যাগাজিনে পড়ে আমি অভিভূত। লেখাটি এখানে ধরা থাক।
কত সব পাণ্ডুলিপি
কত সব পাণ্ডুলিপি যেন আরও অকস্মাৎ ছিঁড়ে পুড়ে যায়
ধ্বস্ত মাঠে জেগে থাকে অন্ধকার অচলতা, একা।
এই সপ্তনদী মুছে ফের বেদনার দীক্ষা দাও।
ভুল সন্ধ্যা এসে যেন চলে যায় হাওয়ায় হাওয়ায়।
পড়ে থাকে ভিতরের তন্তুজাল, তবু কত দৃপ্ত এই দীপকের সুর
হোমাগ্নি শিখার মতো শুদ্ধ নীল হয়ে জ্বলে ওঠে।
তৃষিত উদ্যানে তার হা হা শূন্য, সর্বনাশা ভয়।
অরণ্য অনল শুধু মন্ত্র হয়ে ঝরে ঝরে পড়ে।
রক্ত হিম স্তব্ধ ঠোঁট দগ্ধ মণিপথে ভেসে যায়।
সমস্ত অনন্ত এই লম্বা আগুনের থেকে হাওয়া ধরে ফিরে আসে জলে।
আমার সময়ে, আমার জীবদ্দশায়, আমার দু-একজন কবিবন্ধু লিটল ম্যাগাজিনের পাতায় যে প্যারালাল লিটারেচার বা সমান্তরাল সাহিত্য রচনা করে চলেছেন তার বর্ণচ্ছটায় বাজারি সাহিত্যকে বড়ো বেশি ম্লান, নিষ্প্রভ মনে হয়। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নিরপেক্ষ পাঠককুল নিশ্চয়ই এসবের সঠিক মূল্যায়ন করবেন।
কৃষ্ণনগরে পৌরসভার অফিসঘরে বসে কাজ করছি, কবি সুবোধ সরকার অলোক বিশ্বাস নামের চাকদহ-র এক উজ্জ্বল তরুণকে সঙ্গে নিয়ে এল। তখন সুবোধের সম্পাদিত একাকী কাগজটিতে আমার একটি কবিতা প্রকাশিত হয়েছে ("...ফসলের মতো তার মুখ নুয়ে পড়ে...সৃজাম্যহম্ শ্লোক অনূদিত হয়ে যাক রক্তে তোমার...")। কবিতাটি পড়ে অলোক আমার সঙ্গে আলাপ করতে চেয়েছে, তাই সুবোধ তাকে নিয়ে এসেছে। আমি ফাইল বন্ধ করে ওদের নিয়ে মহুয়া টি স্টলে আসি। চা-টোস্ট খেতে-খেতে গল্প হয় আমাদের, কবিতা নিয়ে কথা হয়। সেটা বোধহয় ১৯৭৬-৭৭, আর আজ ২০২৪; এই এতদিন ধরে অলোকের সঙ্গে আমার সংযোগ আরও দৃঢ় হয়েছে। সে আমাকে দাদা বলে সম্বোধন করে। আমাদের সম্পর্কের যে-সাঁকো, তা হলো কবিতা, শুধুই কবিতা। অলোক আমার কবিতার যে সৃজনাত্মক সমালোচনা করে, তা আমাকে খুবই প্রাণিত করে। আমার ইংরেজি কাব্যগ্রন্থ Love Songs in Winter -এর এক অসাধারণ ইন্ট্রোডাকশন লিখেছে অলোক। ওর কবিতা সম্পূর্ণ অন্য মাত্রার, অন্য বর্গের। যেমন, যখন কুয়াশা জমে কবিতাটি—
যখন খাবার ও মুখের মাঝখানে কুয়াশা জমে
থালায় সাজানো ভাতকে উইপোকার ঢিবির মতো মনে হয়।
আর বাটিতে সাজানো পদগুলিকে ছোট ছোট কাঁটাঝোপের
মতো লাগে। খাবার ও মুখের মাঝখানে যে মহাশূন্য
জেগে ওঠে, সেখানে এক গ্রাস ভাত নিয়ে হাত
স্তব্ধ হয়ে থাকে।
অথবা বিস্মরণ কবিতাটি—
লেখাটা ওনারই ছিল, অথচ বললেন
ওরকম পদ্য উনি জীবনে লেখেননি।
বইটা ওনারই ছিল, অথচ বললেন
গ্রন্থটির নামই উনি শোনেননি কখনও।
প্রেমিকা ওনারই ছিল, অথচ বললেন
ওকে নাকি জিন্দেগিতে প্রথম দেখলেন।
ওই যে খালপাড় আর আদিগন্ত কাশের
বিস্তার, ওই যে কাঠের ব্রিজ, মুখে মুখে
মেয়েটিকে গ্রন্থস্বত্ত্ব দান...
কী ফালতু ইলজাম দিচ্ছ—
ওরকম অঘটন ঘটেনি কখনও।
চাকদহে অনেকেই দীর্ঘদিন ধরে কবিতা লিখছেন। যেমন—মন্দিরা রায়, অশোক চক্রবর্তী, দেবজ্যোতি রায়, চিরন্তন সরকার, স্বপন মোদক, দীপঙ্কর সরকার প্রমুখ। কল্যাণীতে সন্তোষ মুখোপাধ্যায়, পীযূষ পোদ্দার, রণজয় মালাকার; পালপাড়ায় স্বপন শর্মা। মন্দিরা রায় একালের বোধিসত্ত্ব, স্বপন মোদক বিরোধীপক্ষ এবং স্বপন শর্মা শমী নামের লিটল ম্যাগাজিনগুলি দীর্ঘদিন ধরে সম্পাদনা করে চলেছেন।
চাপড়া থেকে কবি রামপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় বিগত কয়েক দশক ধরে আনন্দম্ লিটল ম্যাগাজিনটি নিরবচ্ছিন্নভাবে সম্পাদনা করে চলেছেন। নানা ঝড়-ঝঞ্ঝা, পত্নীর গুরুতর অসুস্থতা ও মৃত্যু—এসব কোনোকিছুই তাঁকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। তাঁর অফুরান প্রাণশক্তি ও কিছু নিষ্ঠাবান সহযোদ্ধাদের নিয়ে কঠিন এই কাজটি করে চলেছেন তিনি। আনন্দম্ পত্রিকা প্রকাশ ও নিয়মিত সাহিত্যবাসরের ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সুবৃহৎ চাপড়া জনপদে রামপ্রসাদ সৃজনশীল সাহিত্যধারার এক উৎকৃষ্ট বাতাবরণ তৈরি করেছেন। তাঁর নিজের অনেকগুলো কবিতাগ্রন্থ রয়েছে। তাঁর কবিতাগ্রন্থ নতুন করে শুরু হোক সব থেকে ১৩.০৮.২০০৩ তারিখে লেখা একটি কবিতা রহস্যকুমারী এখানে উদ্ধৃত করছি—
কী কাজ তোমার বলো? কেন তুমি মগ্ন নতমুখী?
দিন রাত্রি ফিরে আসে, ফিরে চলে যায়।
সংসারে তো কত কিছু কাজ, কত ফুল উদ্যানে ফুটেছে
ঋতুতে ঋতুতে কত ফুল ঝরে যায়, কত আলো
ঝুল-বারান্দায়, ঘরের একান্তে, এসবেরই মধ্যে আছ তুমি
তবু বুঝি কত দূরে, নীরবতা ঘিরে থাকে
কত যত্নে আমি তাকে স্থাপন করেছি এইখানে
তুমি সেই স্নিগ্ধ মূর্তিময়ী, কী কাজ তোমার বলো?
কেন তুমি এসেছ এখানে রাত্রি মধ্যযামে
কেন তুমি হেঁটে যাও নিশ্চুপ ধুলির পথে, বামে বা দক্ষিণে?
হেঁটে যাও সরলরেখায়
কল্পনালতা, রহস্যকুমারী, তোমাকেই স্বপ্নে নিয়ে
অবশিষ্ট প্রহর কেটে যাবে।
এখানে একটা কথা বলা খুবই জরুরি, তা হলো এই যে, আমি সারাজীবন সবচেয়ে বেশি গদ্য-পদ্য লিখেছি যে লিটল ম্যাগাজিনে, তার নাম আনন্দম্ । আনন্দম্ আমাকে প্রশ্রয় দিয়েছে, লালনপালনও করেছে।
চাপড়া জনপদে আমাকে প্রথম নিয়ে গিয়েছিলেন কবি মজনু মোস্তাফা। বড়ো আন্দুলিয়ার শিবিরে। তখন কবি বিজয়লাল চট্টোপাধ্যায় স্থাপিত লোকসেবা শিবিরে গ্রন্থাগারিক ছিলেন কবি রামকৃষ্ণ দে। রামকৃষ্ণ আনন্দম্ -এর সঙ্গে ওতপ্রোত সংযুক্ত ছিলেন, ঠিক যেমন ছিলেন কবি শেখ রমজান, জয়নাল আবেদিন ও প্রয়াত মহাদেব সাহা। রামকৃষ্ণ দে কবিতা খুব কম লেখেন, প্রকাশ করেন আরও কম। এ-পর্যন্ত তাঁর একটি বই-ই প্রকাশিত হয়েছে— বড়ো আলগাভাবে ছুঁয়ে । সেখান থেকে আমি বাবা যদি ধরতেন হাত কবিতাটি তুলে দিচ্ছি এখানে—
মেয়েটি বাবার হাত ধরেছিল
না-কি বাবা ধরেছিলেন কন্যার হাত?
এই নিয়ে চায়ের দোকানে তর্ক হলো খুব।
মহাদেবদা বললেন, বাবা যদি সত্যিই
ধরতেন মেয়েটির হাত
তাহলে ম্যানহোলের হাঁ
এরকম গিলে ফেলতে পারতো না তাকে।
অন্ধকারের পথে পথে গুপ্ত বিবর
হাত তো ধরতেই হয়, পরস্পরের,
তবু যে কখন চোরাবালি ষড়যন্ত্র জয়ী হয়, আচম্বিতে
পিতা থেকো সাবধান। বড়ো আলগাভাবে
কন্যা তোমার আঙুল ছুঁয়ে আছে
উদাসীন হাতখানা তার
শক্ত মুঠোয় তুমি ধরো।
শেখ রমজান সুগভীর মগ্নচৈতন্যের কবি। তাঁর মগ্নপাথর কবিতাগ্রন্থ থেকে আমি দেবী কবিতাটি এখানে তুলে দিচ্ছি—
তুমি হও প্রবল বৃষ্টির শব্দে খুলে যাওয়া
মেহগনি কপাটের সূক্ষ্ম কারুকাজ। যে পাহাড়
প্রতিদিন দীর্ঘ হয়, ভারী হয়, বিষণ্ণ ফাটলে
তার ঢেলে দাও ঘাসেদের সবুজ আবির।
তুমি হও প্রথম শস্যক্ষেত, সরস জমিন আর
ধানশীষে দুলে ওঠা দুধের প্লাবন। সেই নদী,
ধারা যার অমরাবতীর পথে—মৃত্যুর ভেলা নিয়ে
ছুটে যায় অমৃতের খোঁজে।
তুমি হও বিপর্যয়ে ভেঙে পড়া, অন্ধকারে
ডুবে যাওয়া নাবিকের মুগ্ধতম সেবী
পৃথিবী মন্দির যদি, তুমি তার একমাত্র দেবী।
পরপর প্রকাশিত নানা কাব্যগ্রন্থের পাতায়-পাতায় কবি শেখ রমজান সেই 'অমৃতের খোঁজে'-ই নিয়োজিত রেখেছেন নিজেকে।
জয়নাল আবেদিন মাটির কাছাকাছি থাকা এক বাস্তববাদী কবি। অনেক সম্ভাবনা নিয়ে খুব অকালেই আকস্মিক বিদায় নিলেন তিনি পৃথিবীর এই জল, মাটি, আকাশ থেকে। তাঁর মেঘ কবিতাটি পড়ে নিই আমরা—
তোমাকে একটুকরো মেঘ দিলাম
জল নামিয়ে নিয়ো
না হলে ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিয়ো আকাশে
ওকে জমিয়ে রেখো না।
কখনো আগুনে পুড়িয়ে ফেলো না
ও শুধু ঝরতে পারে, জ্বলতে পারে না।
মেঘ দিলাম বৃষ্টি নামিয়ে চাষ আবাদ কোরো
খেলতে-খেলতে ভুল করে বন্যায় ভেসে যেয়ো না।
আমি আমার মাধো আর শ্যামলীকে বোলো কবিতা-বইটি নদীয়ার দুই তরুণ কবি দেবাশিস সিংহ ও চিরন্তন সরকারকে উৎসর্গ করেছিলাম। এই দুই তরুণের লেখা খুবই সম্ভাবনাপূর্ণ বলে বরাবরই মনে হয়েছে আমার। দু'জনেই ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র। দু'জনের কাব্যভাষা একদম স্বতন্ত্র। আগেই বলেছি, দেবাশিস বাদকুল্লায় থাকে। আমি দেবাশিসের শ্রাবণজাতক থেকে তার বোধিসত্ত্ব কবিতাটি এখানে উদ্ধৃত করছি—
শালের মঞ্জরীতে ঢেকে গেছে বুদ্ধের পথ
সেগুনের ফুলে ওড়ে মেঠো মেটে হাওয়া
মেঘেদের পর্দায় ঢেকে গেছে চাঁদ
বঙ্গের মসলিন অতীব মিহিন কালো দুইহাত দিয়ে
সরিয়ে সরিয়ে তিনি রক্তচীবর
ভিক্ষাপাত্রে ভরে নেন শ্রাবণের আলো
বুদ্ধ নয় স্থবির আঙুল ভাবে
এই রাতে বোধিসত্ত্ব হওয়া ঢের ভালো।
চিরন্তন চাকদহে থাকে। এ-পর্যন্ত প্রকাশিত তার কাব্যগ্রন্থ তিনটি— নিরালোক, আধখানা চাঁদ ও দলীয় পতাকা । আমি শেষোক্ত গ্রন্থটি থেকে সে শীর্ষক কবিতাটি তুলে ধরছি এখানে—
সে এসে দাওয়ায় বসে।
বলে, জল দাও মুড়ি দাও।
বলে, আমি আর যাবো না কোথাও।
পড়াশোনা না শিখলে কী ক্ষতি,
স্বামী-সংসার না থাকলেই-বা কী—
হাঁপাতে হাঁপাতে কোরা কাপড়ের শাড়ি পরে
গ্রীষ্মের খরতপ্ত দিনে এইসব বলে।
আমাদের বাড়িতে সেই থেকে আছে।
পান সেজে দেয়, পাখা দিয়ে হাওয়া করে,
সবাই ঘুমিয়ে পড়লেও সে ঘুমোয় না।
ঝড়বৃষ্টির রাতে বজ্রপাত হয়।
পাতালসিঁড়ির নীচে, ভেতরের আয়নামহলে
দুটো গোক্ষুর চোখ মেলে চেয়ে থাকে।
এখানে নদীয়া জেলার যে-সব কবির কথা ও তাঁদের কবিতার কথা বললাম, তাঁরা ছাড়াও আরও দু-একজন কবির কথা হয়তো-বা উল্লেখ করা চলে। কিন্তু সেক্ষেত্রে এই আত্মজৈবনিক গদ্যটির পরিসর অনেকটাই বেড়ে যাবে বলে, আমি সে-প্রয়াস আর আপাতত করছি না।
(ক্রমশ)
ভালো লাগলো।
ReplyDelete