নিতাই ভট্টাচার্য

"স্টপ বাদল, স্টপ। ডোন্ট মেক মোর স্টোরি।"

"অতনুদা, প্লিজ ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড। আই অ্যাম নট মেকিং স্টোরি। আমার মা ফোন করে কান্নাকাটি করছে। বাবা ভীষণ ভায়োলেন্ট হয়ে উঠেছে। উন্মাদের মতো হয়ে মারধর করছে মাকে, এই অবস্থায়..."

"বাদল, কয়দিন আগেও একই কথা শুনিয়েছিলে তুমি। আমার মনে হয় তোমার এখন বাড়িতেই থাকা উচিত। সবকিছু সামলে নিয়েই না-হয় মার্কেটে নামবে। ততদিন অন্য কাউকে..." লাইন কেটে দেয় অতনু।
স্ক্রিনের দিকে চেয়ে থাকে বাদল। অতনুর কথায় একটা স্পষ্ট বার্তা আছে, বুঝতে অসুবিধা হয় না। কী করবে বাদল! ইচ্ছে করে তো আর মার্কেট থেকে বাড়ি ফিরে যাচ্ছে না। প্রয়োজন। ভীষণ প্রয়োজন। পরে নিশ্চয় কাজ করে পুষিয়ে দেবে কাজের ঘাটতি। আজ অতনুদার কথা গায়ে বিঁধিয়ে মার্কেটে পড়ে থাকলে চলবে না।

কাউন্টার থেকে বেরিয়ে বাসস্ট্যান্ডের দিকে হাঁটা দেয় বাদল। ফোন করে সবিতাকে। টানা রিং হয়ে কেটে যায় ফোন। আবারও ফোন করে। এবারও হতাশ হয় বাদল। ফোন ধরে না সবিতা। একটা উন্মত্ত রাগ দাপিয়ে বেড়ায় মাথার মধ্যে। বাদলকে এই সময় ফোন না-করলেও পারতো সবিতা। জানে, কাজে ব্যস্ত। পাশের বাড়ির রমলা কাকিমাকে ডেকে বাবাকে শান্ত করবার চেষ্টা করতে পারতো। আগেও তো এ-কাজ করেছে সবিতা। তাহলে আজ...
আবার বাড়িতে ফোন করে বাদল। সাড়াশব্দ নেই সবিতার। কে জানে কী ঘটে গেছে! অতুল হয়তো হাতের কাছে পেয়ে গলা টিপে মেরেই ফেলেছে সবিতাকে। অবিশ্বাস্য নয় মোটেই। বাবার এমন ভয়াল চেহারা নিজে চোখে দেখেছে বাদল। হঠাৎ করেই বাদলের হাতের ফোন বেজে ওঠে। মা ফোন করেছে। ফোন ধরে বাদল, "হ্যালো, মা! মা? হ্যালো।" বাদলের কথাগুলোই শুনতে পায় বাদল। কেটে যায় লাইন। ঘুরিয়ে ফোন করে বাদল। নট রিচেবল। ওঃ!

আজ মাসপাঁচেক বিছানায় পড়ে রয়েছে অতুল। নিউরো প্রবলেম। ওঠা, হাঁটা সম্পূর্ণ বন্ধ। যে-কোনো কাজেই সবিতা নয়তো বাদলের সাহায্যের প্রয়োজন পড়ে। ইদানিং আবার নতুন সমস্যা উঁকি দিয়েছে। সকাল-সন্ধ্যা+রাত্রি বুঝতে পারে না। মেজাজ মাথায় চড়ে। সঙ্গে অসংলগ্ন কথা। বহু পুরোনোদিনের বন্ধুর প্রসঙ্গ টেনে নিয়ে আসে। বলে "আজই দেখা হলো, খানিক আগেই।"
সবিতা বলে "নাও, বোঝো। কোন জন্মে মরে ভূত হয়ে গেছে, তিনি নাকি এসে দেখা করেছেন!"
কিছু বলে না বাদল। শোনে বাবার কথা। দুশ্চিন্তা মোচড় দেয় বুকে। 

ছেলেকে দেখলেই হলো, অভিযোগ করে অতুল, "বাদল, তোর মা আমাকে মারধর করে জানিস! জোড়হাত করে বলছি, আমাকে মেরে ফেল তুই। বিষ দে। আমি..."
সবিতা বলে "তোর বাবা কেমন মানুষ দেখছিস বাদল! বলে কিনা আমি গায়ে হাত তুলি! সারাদিন ওর পেচ্ছাপ-পায়খানা ঘেঁটে দিন কাটে আর বলে আমি কিনা মারি! হায় ভগবান আমার মরণ হলে বাঁচি।" 

প্রথম-প্রথম সবিতাকে শান্ত করবার চেষ্টা করতো বাদল। এখন মায়ের মুখে এইসব কথা শুনে চুপ থাকে। অতুলের অসুস্থতার কথা সামনে এনে সবিতাকে শুষ্ক প্রবোধ দেওয়া অর্থহীন। বোঝে বাদল। সারাদিন অতুলকে সামলে সবিতাও খিটখিটে হয়ে উঠেছে দিনে-দিনে। কথায়-কথায় রেগে যায়।


আজ সাতগেছিয়া মার্কেটে কাজ করছিল বাদল। বেশ কয়েক সপ্তাহ এদিকে আসা হয়ে ওঠেনি। গতকাল রাতে ফোন করেছিল অতনু; বলে " সাতগেছিয়া, মেমারি আর শক্তিগড়ের মার্কেট দেখার সময় হবে তোমার? ওদিকের সেল বেশ ডাউন। আসলে তুমি..." বাকি কথাটা না-বললেও বুঝে নিয়েছে বাদল। বর্ধমানের আশেপাশের মার্কেটে সেইভাবে কাজ করে উঠতে পারেনি। সেইকথা মনে করিয়ে দিতেই অতনুদা ফোন করেছিল। আজ বেলা দশটার মধ্যেই মার্কেটে এসে কাজ শুরু করেছিল বাদল। পরপর গোটা দশেক কাউন্টার ভিজিট করে ভেবেছিল বর্ধমান রওনা দেবে এইবার। ফেরবার পথে রসুলপুরের মার্কেটে কাজ করবে। সে-ভাবনা ভাবনাই রয়ে গেলো। সবিতা ফোন করে বলে, "তুই বাড়ি আয় বাদল।" এইভবে আগে কোনদিন কান্নাকাটি করেনি সবিতা। বিষয়টা গুরুতর নিশ্চয়। বাড়ি না-ফিরে উপায় নেই। বাবার কথা অতনুকে বলে বাদল। শুনেই ফোঁস করে ওঠে অতনু। হাজার কথা শুনিয়ে দেয় বাদলকে।

একটা-দশ বাজে। বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে বাদল। মেমারি স্টেশন ফিরবে। দুটো-পঁচিশের বর্ধমান লোকালটা পেলে সুবিধা হয়। ঘণ্টা দেড়েকের মধ্যে বাড়ি পৌঁছে যাবে। না-জানি কী কাণ্ড ঘটে গেছে!
সপ্তাহ দুয়েক আগেও এমনই সমস্যায় পড়েছিল বাদল। অশোকনগর মার্কেটে কাউন্টার ভিজিট করছিল সেদিন। সবিতা ফোন করে বলে, "বাদল তোর বাবা মনে হয় পাগল হয়ে গেছে, জানিস! হাতের কাছে যা আছে ছুঁড়ে মারছে আমার দিকে।"
মায়ের কথা শুনে আঁতকে ওঠে বাদল। কাজ ফেলে বাড়ি ফেরে। মায়ের কথা সত্যি। অতুল উন্মাদের মতো আচরণ করছে। বালিশ, তোষক ছিঁড়ে কুটিকুটি করেছে। দূরে বসে কান্নাকাটি করছে সবিতা। রমলা কাকিমা ব্যস্ত সবিতাকে সামলাতে। অতুলকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায় বাদল। সাইকোসিস হয়েছে অতুলের। দীর্ঘদিন একই পরিবেশে বন্দি থেকে।

পাঁচমাস চার-দেওয়ালের অন্ধকূপে আটকা পড়েছে অতুলের জীবন। পরিচিত পরিজনদের উপস্থিতি ম্লান হয়ে এসেছে মনে। রোগ, যন্ত্রণা, ওষুধ, ডাক্তার, বাদল আর সবিতা। এই শব্দগুলিই ঘুরেফিরে আসে অতুলের কানে, তাই..."আসলে একই পরিবেশে দীর্ঘদিন থাকলে রোগী এমন আচরণ করে। ভায়োলেন্ট হয়ে ওঠে ভীষণ। এমনকি আত্মহত্যাও করে ফেলে। সাইকোসিস হলে।"

বাকরুদ্ধ বাদল। দুশ্চিন্তার ছায়া দুইচোখে।
"ভয় পাবার কিছু নেই। ওষুধ দিচ্ছি, কমে যাবে। হুইলচেয়ারে বসিয়ে আপনার বাবাকে বাইরের পরিবেশে নিয়ে আসুন। পরিচিত মানুষজনের সঙ্গে কথা বললে খুব দ্রুত রিকভারি হবে।" ডাক্তারবাবুর পরামর্শ।

পাড়ার মানুষজনদের বাড়িতে ডেকে এনেছে সবিতা। অনেকের মাঝে অতুলকে রেখে চেষ্টা করেছে স্বামীর মানসিক অবস্থা স্বাভাবিক খাতে ফিরিয়ে নিয়ে আসবার। রোজ-রোজ এসে অতুলের প্রলাপ শোনার গরজ কারই-বা আছে! পড়শিদের সময় নেই। তাই সবিতার সেই চেষ্টা কাজে আসেনি খুব একটা। তবুও চেষ্টার ত্রুটি নেই সবিতার। রমলা কাকিমা বলছিল সেইদিন —"বাদল, তোর মাকে দেখে ভীষণ খারাপ লাগে রে। তোর বাবার কাছে বসে দুটো কথা বলবে বলে কী আকুতিই-না জানায় পাড়ার লোকের কাছে!"

রোজ রাতে মার্কেট থেকে ফিরে বাবার সামনে দাঁড়ায় বাদল। এক সুতীব্র মনোবেদনা বেজে ওঠে অন্তরে। অতুলের অবস্থার উন্নতি নেই বিশেষ। ক্ষয়ে যাচ্ছে দিনে-দিনে। অসংলগ্ন কথা বেড়েই চলেছে। হুইলচেয়ারের প্রয়োজন। বিছানার থেকে নামাতেই হবে বাবাকে। বাইরের আলোয় মন ভালো হয়ে উঠবে। বললেই তো আর হুইলচেয়ার হয় না। হাজার সাত-আট টাকা প্রয়োজন। খোঁজ নিয়েছে। মার্চের স্যালারি পেয়ে ব্যবস্থা করার চেষ্টা করবে বলে ভেবেছে। ওই পর্যন্তই। সংসার, অতুলের চিকিৎসা খরচ সামলে সাশ্রয় কোথায়! 
সবিতা জানে নিম্ন-মধ্যবিত্তের সংসারে টানাপোড়েনের খটখট শব্দ। একটা টাকা বাড়তি খরচ করবার আগে ভাবতে হয় দশবার। বাদলের অবস্থা অনুমান করতে কষ্ট হয়নি সবিতার। ছেলের সাধ অন্তহীন। সীমিত সাধ্য। 

"তাড়াহুড়ো করিসনে বাদল। রয়েসয়ে কিনে আনবি হুইলচেয়ার। অত কিসের তাড়া!" চোখের কোল চিকচিক করে উঠেছে বাদলের। সংসারে মায়েরা বড়ো অদ্ভুতরকমের হয়। জোড়াতালি দিয়ে সব কুল বজায় রাখার প্রচেষ্টায় সবিতাদের জুড়ি নেই। স্বয়ং ঈশ্বরও বুঝি অবাক হয়ে ভাবেন পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার এমন নিখুঁত কৌশল সবিতারা আয়ত্ত করলো কীভাবে! 

ছেলের মাথায় হাত রেখেছে সবিতা। "কষ্ট পাসনে বাদল। আমি তো রয়েছি। আমি রোজই দু-একজনকে ডেকে নিয়ে আসি। তোর বাবা কথা বলে তাদের সঙ্গে। তবে কী জানিস, রোগ যে-হারে বাড়ে সেভাবে কি কমে! সময় লাগবে। সব ঠিক হবে দেখিস। তোর বাবা সুস্থ হবে ঠিকই। তুই চিন্তা করিসনে।"
মায়ের কথা শুনে নিজেকে ধরে রাখতে পারেনি বাদল। সবিতার কাঁধে মাথা রেখে কেঁদেছিল হাউহাউ করে। সবিতা বলে, "ভেঙে পড়িসনে বাদল। ভগবান আছেন।"

সে-রাতে ফোন করেছিল অতনুও। "বাদল সবার জীবনে এমন দিন আসে। কাঁধটা যেনো ঝুঁকে না-যায়। চড়াই-উতরাই ভেঙে এগিয়ে চলাই জীবন। কাজও করতে হয়। আমাদের সবার একটা টার্গেট আছে। চিন্তা না-করে কাজে মন দাও। সামনে সুদিন নিশ্চয় আছে।"  সেদিন অতনুদার গলায় ছিল সমবেদনার সুর। পাশে থাকার আশ্বাস। এই দুই সপ্তাহে বদলে গেছে অতনুর সুর।
মোবাইলে সময় দ্যাখে বদল। বেলা দেড়টা বাজে। এখনও বাসের দেখা নেই। ঠিক কী ল করা উচিত বুঝে পায় না। বিভ্রান্ত। অতনুর কথাগুলো নড়িয়ে দিয়েছে আজ। কানে বেজে ওঠে " ডোন্ট মেক স্টোরি"—মানে বাদল মিথ্যা বলছে! মানে বিশ্বাস নেই বাদলের উপর! আত্মসম্মানে আঘাত লাগে ভীষণ। বাদলের নিষ্ঠার প্রতি প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল অতনু। আজ কতদিন অসুস্থ হয়ে পড়ে রয়েছে অতুল। কথায়-কথায় বাবাকে নিয়ে ছুটেছে ডাক্তারের কাছে। তারপরেও যতটা সম্ভব নিজেকে নিংড়ে দিয়েছে কাজে । তারপরেও!

 
চৈত্রের বেলা। বাসে লোকজন কম। জানালার বাইরে চেয়ে থাকে বাদল। কখনও অতুল কখনও সবিতা কখনো-বা অতনুর কথা ছুঁয়ে যায় বাদলকে। মার্কেট, সেল, টার্গেট শব্দগুলি মাঝেমধ্যে আড়ি পাতে ভাবনায়। শহর ছেড়ে এগিয়ে চলেছে বাস। পাতলা হচ্ছে লোকবসতি। দুইপাশে ধানজমি। বহুদূরে দিগন্তরেখায় গা এলিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে গ্রামগুলি। বৈশাখী খরতা গলা টিপে ধরেছে প্রকৃতির। এক অসহনীয় রুক্ষতা গ্রাস করে বাদলকেও। 
"দাদা ভাড়াটা করে নেবেন।" ভাড়া চাইছে কন্ডাক্টর। ফোনটা বেজে ওঠে আবার। চমকে ওঠে বাদল। ভেবেছিল সবিতার ফোন হয়তো। না। অতনু ফোন করেছে। আবার কী বলবে কে জানে! ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে ফোনটা ধরে বাদল। "তোমাকে টেক্সট করেছি দেখ। বর্ধমানের কাউন্টারের নামগুলি পাঠিয়ে দাও। সার্থক আজ বর্ধমানে কাজ করছে। ওকে বলেছি। আজই ভিজিট করে নেবে কাউন্টারগুলো।" বলে অতনু। গালে থাপ্পড় খেল বাদল। ইচ্ছে যায়, কয়েকটা কথা শুনিয়ে দিতে। দাঁতে দাঁত চেপে সংযত রাখে নিজেকে। অতনুকে কাউন্টারের ডিটেইলস পাঠিয়ে দেয় বাদল। চোখ বন্ধ করে। রগের শিরাগুলো একযোগে দপদপ করছে। মনের তীব্র রাগ সংক্রমিত হয়েছে হৃদয়ে। প্রয়োজনের অতিরিক্ত রক্ত ছুটছে শরীরের উপরের দিকে। মাথার তালু ফুঁড়ে বাইরে আসবে রক্তের ফিনকি। কপালের ডান দিকটায় যন্ত্রণা শুরু হয়েছে ভীষণ। মাইগ্রেন। আজ সারাদিন ভোগাবে। বাস থেকে নেমে একটা ওষুধ খেতেই হবে। নয়তো ভীষণ বাড়াবাড়ি হবে।

জানালার বাইরের দিকে তাকায় বাদল। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই মেমারি পৌঁছে যাবে। মাথার যন্ত্রণা অসহ্য হয়ে ওঠে। ডানদিকের রগের উপর চাপ দেয় জোরে। আরাম লাগে বেশ। আরও জোরে চাপ দেয়। বুড়োআঙুলের চাপ রগের উপর ধরে রাখে বেশ কিছুক্ষণ। নিজেকে পাগল বলে মনে হয় বাদলের। সহ্যেরও তো সীমা আছে। টানা কয়েকমাস ধরে চলছে বাবাকে নিয়ে। অতুলের একটা ভালোমন্দ কিছু হয়ে গেলেই ভালো হয় বোধহয়! মায়ের মুখটা মনে পড়ে। বড়ো মায়াময় সবিতার মুখ। সারাদিন অতুলকে সামলায় সবিতা। সংসারের অন্তহীন ব্যস্ততার মাঝেও ঠিক সময়ে স্বামীর মুখে জল-ওষুধ দেয়। কর্তব্যের খামতি নেই কোনো। নেই কোনো অভিযোগ। আজ হয়তো ভীষণ কষ্ট পেয়েছে অতুলের ব্যবহারে। বাঁধ ভেঙেছে সহ্যের। তাই ফোনে...
স্টেশন পৌঁছে গেছে বাদল। প্লাটফর্মে এসে বসে। বাসস্ট্যান্ড থেকে স্টেশন বেশ অনেকটা পথ। হেঁটেই এসেছে । ঘামে ভেজা জামা লেপ্টে গেছে শরীরে। পাখার হওয়ায় যেন আগুনে হলকা। আকাশের দিকে চেয়ে দেখে। সাদা চকচকে আকাশ। মেঘের লেশ মাত্র নেই। চৈত্র শেষের দিকে। দাবদাহের পরাক্রম ভীষণ। আগুন ঝরছে আকাশ থেকে। রোদের তাতে দু'চোখ পুড়ে যাবার উপক্রম। চোখ বন্ধ রাখে বাদল। স্টেশন মাইকে ঘোষণা হচ্ছে। শক্তিগড়ে মালগাড়ি খারাপ হয়েছে। ট্রেন চলাচল কখন স্বাভাবিক হবে বলা যাচ্ছে না। ওঃ! এই এক যন্ত্রণা। সময়ও যেন সময় বোঝে। কখন কোন ঘটনা সামনে আনলে চরম বিপদের কবলে পড়বে বাদল, এই চক্রান্ত যেন সময়েরই সাজানো। আজ বলে নয়। রোজ-রোজ। মাসের পর মাস এমনিই চলছে।


সাড়ে-তিনটে বাজে। ট্রেনের খবর নেই কোনো। প্লাটফর্মে বেশকিছু মানুষের ভিড়। এত লোকের মধ্যে থেকেও নিজেকে একলা মনে হয় বাদলের। সামনে তাকায় বাদল। মাটির থেকে কেঁপে-কেঁপে উঠে আসে গরম ভাপ। নির্মম দাবদাহের কাছে প্রকৃতির অসহায় আত্মসমর্পণ। তারই করুণ দীর্ঘশ্বাস বুঝি। বাদলের বুকের মধ্যে জমে থাকা বাতাস স্বতঃস্ফূর্তভাবেই বাইরে আসে। অতনুদার কথাগুলো মনে পড়ে আবার। ইচ্ছে যায় ফোন করে অতনুদাকে। থাক। আবারও কড়া কথা শোনাবে অতনুদা। আসলে কোম্পানির বেঁধে দেওয়া মাইলস্টোন ছুঁতে অতনুকেও ছুটতে হয়। ছুট ছুট আর ছুট। প্রত্যেক শ্বাস মনে করিয়ে দিয়ে যায় মার্কেট সেল আর টার্গেটের কথা। বাদল, অতনুদের জীবনের শ্বাসবায়ু। তন্দ্রাচ্ছন্নতায় মুদে আসে বাদলের দুই চোখ। ওষুধের ঘোর। স্টেশনের মাইক বেজে ওঠে। ট্রেন আসবে কিছুক্ষণ পর।


একরাশ দুশ্চিন্তা মাথায় নিয়ে বাড়ি ফেরে বাদল। বিছানায় শুয়ে অতুল। দৃষ্টি থমকে আছে দেওয়ালের দীকে। নির্বিকার। পাশের ঘরে রয়েছে সবিতা। চোখমুখ থমথমে। চেহারা অবিন্যস্ত। দেখলেই মনে হয় ঝড়ঝাপটা সামলে বাঁচিয়ে রেখেছে নিজেকে। মাকে দেখে ভীষণ কষ্ট হয় বাদলের। অতুলের কাছে আসে বাদল। ভীষণ ধমক দেয় অতুলকে , "পাগলামির সীমা আছে। তোমার বোঝা উচিত, তোমাকে নিয়ে মা আমি কত দুশ্চিন্তায় আছি। আমরা এত করছি আর তুমি পাগলামো করে চলেছ। এখন চুপ করে আছো। আমি না-থাকলেই শুরু হয়।"
অতুল চেয়ে থাকে বাদলের দিকে। চাউনিতে অসহায়তা ফুটে ওঠে। আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল বাদল। সবিতা আসে। বলে, " আর বলিসনে বাদল। ছেড়ে দে। অসুস্থ তো।"
অবাক হয়ে মাকে দ্যাখে বাদল। অথচ...

রাতের খাওয়া সেরে কাজের হিসাব নিয়ে বসেছে বাদল। কাল সকালবেলায় আবার সাতগেছিয়া থেকে কাজ শুরু করবে। টার্গেটের থেকে পিছিয়ে আছে বাদল। পরপর কয়দিন সময় দেবে বর্ধমানের দিকে। ঘড়ির দিকে তাকায় বাদল। রাত হয়েছে। বারোটা-দশ বাজে। আলো অফ করে শুয়ে পড়বে। হঠাৎ সবিতার গলা শুনতে পায়। নিচুস্বরে বাদলকে ডাকছে মা। দৌড়ে পাশের ঘরে যায় বাদল। বিছানায় বসে সবিতা। অঘোরে ঘুমাচ্ছে অতুল। বাদলকে দেখে চমকে ওঠে সবিতা। বলে "বাদল আর পারছি না। তোর বাবা আমাকে মারলো দ্যাখ।"
"কখন?"
" এইমাত্র!"
ঘরের আলো জ্বালিয়ে দেয় বাদল। বলে, "দ্যাখো বাবা ঘুমাচ্ছে।" অবাক হয়ে অতুলকে দেখে সবিতা। তারপর চেয়ে থাকে বাদলের দিকে। কী যেন ভাবতে থাকে সবিতা। মায়ের চোখের এমন চাউনি অচেনা বাদলের। মুখের অভিব্যক্তি অন্যকিছুর আভাস দেয়। দুশ্চিন্তা ছেয়ে আসে বাদলের মনে। ঘুমের ওষুধ দেয় সবিতাকে। মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেয় । ঘরের আলো অফ করে বারান্দায় এসে দাঁড়ায় বাদল। একটা ভাবনা এসে ঝাঁকিয়ে দিয়ে যায়। এতদিন অতুলকে নিয়ে লড়াই করেছে বাদল। পাশে থেকেছে সবিতা। এইবার? অমীমাংসিত প্রশ্ন মুচকি হাসে বাদলের দিকে চেয়ে।ভীষণ অনুশোচনা হয় বাদলের। আজ সবিতার কথা শুনে বাবাকে ওইভাবে বলা ঠিক হয়নি। কী করে জানবে বাদল, সবিতার মনের ভিতরেও কবে...

দুশ্চিন্তার খরপ্রবাহ বাদলের মনে। ভাবনা থমকে দাঁড়ায়। হঠাৎ করেই শোনে, "বাদল..." সবিতা এসেছে বারান্দায়। বলে, "বাদল, তোর বাবা যখন-তখন আমাকে মারতে পারে। আমি তোর ঘরে শোবো।"
অন্ধকারে সবিতাকে জড়িয়ে ধরে বাদল। মাথা রাখে মায়ের কাঁধে। হাজার ঝড়ঝাপটায় মাকে ধরে ঘুরে দাঁড়িয়েছে বাদল। আজ বড্ড অসহায় মনে হয় নিজেকে। সবিতা বলে, "বাদল চল, তোর ঘরে চল।"
ছেলের হাত ধরে টানতে থাকে সবিতা। কেঁপে ওঠে বাদলের বুক। পায়ের নিচের মাটি টলোমলো। একরাশ বিপন্নতা আঁকড়ে ধরে বাদলকে। মাকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে বারান্দায় আসে বাদল। দুশ্চিন্তায় নুইয়ে আসে মাথা। অবশেষে সাইকোসিসের কবলে পড়েছে সবিতা। আবার এক নতুন যুদ্ধ শুরু হলো! আকাশের দিকে চায় বাদল। কে যেন তারায়-তারায় অদৃশ্য রেখা টেনে ফুটিয়ে তুলেছে এক চক্রব্যূহ, অনতিক্রম্য গণ্ডি এক। অতুল, সবিতা, অতনু, মার্কেট, সেল, টার্গেট আর সময় এই সপ্তরথী ঘিরে ধরেছে অভিমন্যু-বাদলকে। রথী-মহারথীদের তীরের তীক্ষ্ণ ফলার নিদারুণ আঘাতে জর্জরিত বাদল। নক্ষত্রখচিত গম্ভীর আকাশে চক্রব্যূহের মধ্যে একা বাদলের অসহায় আত্মসমর্পণ প্রত্যক্ষ করতে থাকে বাদল, একরাশ দুশ্চিন্তা মাথায় নিয়ে।

Comments