ময়ূরী মিত্র


পর্ব ১
সাদা বাচ্চা হাতিটা বাবা-মায়ের হাত ধরে লাফ দিয়ে পড়েছিল জব্বলপুর স্টেশনে৷ ট্রেনে আসতে-আসতেই পাহাড় দেখতে পাচ্ছিল কামরার জানলা দিয়ে৷ তখন সম্ভ্রান্ত মধ্যবিত্তের একমাত্র ক্লাস স্লিপার ক্লাস। মেয়েটারও ভারী পছন্দ হয়েছিল স্লিপার ক্লাস। দু- লএকটা 'কুটকুট' পোকা কামড়ালেও জানলা দিয়ে হু-হু হাওয়া আসছিল৷ পাতলা চুলের ঝুঁটি সেট করতে-করতে স্টিলের থালায় ঠাকুমার করে দেওয়া পাঁঠার মাংসের ঝোল আর লুচি খাচ্ছিল বাবার সঙ্গে৷ কখনও মায়ের সঙ্গে—কখনও নিজের নির্দিষ্ট থালা থেকে৷ বউ-মেয়ে নিয়ে বেড়াতে যাচ্ছেন বলে তিনটি স্টিলের থালা কিনেছিলেন সেবার৷ মেয়েটা মাছ ভালোবাসে বলে ঠাকুমা দু'পিস রুই ভেজে দিয়েছিলেন৷ পেটির দিকের মাছ। দুটো মাছ নির্ভুল তিনভাগ করছিল যখন—চারপাশের যাত্রীরা হাসছিলেন৷ কেউ-বা মাছের টুকরো তুলে খেয়ে ফেলার অভিনয় করেছিলেন৷ তখনকার ট্রেন যাত্রা এমনই ছিল—ক্ষণেক জেনেও প্রত্যেক যাত্রী আত্মীয় হতো এবং প্রত্যেকে প্রত্যেকের কাজের বা কথার উত্তর করতো৷ হয়তো আত্মীয় হবার কোনো পরিষ্কার শর্ত ছিল না ৷

স্টেশনে নেমে সাদা হাতি ছাড়তে চায়নি তাই পাশে বসা যে-কোনো এক যাত্রীকে। যাত্রী হেসে বলেছিলেন—মা, এবার আমাদের আলাদা হতে হবে। ওই দ্যাখো, তোমার পাহাড় এসে গেছে৷ তোমার থেকেও সাদা পাহাড়৷ 
হাতি বললো—পাহাড়ের হাত-পা আমার থেকেও মোটা? এত কাছে এসে গেল কেন পাহাড়? আমার থেকেও হাতি দেখাচ্ছে কেন পাহাড়টাকে! 

পাহাড়ের কাছে হাতি সেদিন হারল গোহার৷

পর্ব ২
বাবা উঠেছিলেন তাঁর বন্ধু শ্যামলকাকুর বাড়ি৷ বিহারি রসুইকর সবরকম মশলা দিয়ে মোটা রুই রাঁধতো। পাঁচফোড়োন থেকে আমচুর—সবের গন্ধে সব অধিবাসীর বাস লাগতো। রাতের বেলা মা আর মেয়েকে নিয়ে সে বেড়াতে যেত৷ জব্বলপুর শহরের রাস্তায় তখন দূরে-দূরে রাস্তার আলো জ্বলতো। এক-একটা ল্যাম্পপোস্টের আলো আঁধার-রাস্তায় আলোর গোল তৈরি করতো৷ ছায়াআলোয় মেয়ে-মা দেখতো—ফার্নিচারের দোকানে ভগবানের  নানারকম সিংহাসন তৈরি হচ্ছে। প্রদেশভেদে ভগবানের চেহারা আলাদা হয় বোধহয়৷ সিংহাসনগুলো দেখতে অদ্ভুত ছিল—পশ্চিমবঙ্গের মতো নয়৷ এক রাতে পূর্ণজোছনা এল৷ বাবা তার হাতিমেয়েকে মার্বেল পাথরের হাতি কিনে দিলেন সেদিন৷ পুতুল হাতি পেয়ে বাবার মেয়ের কী আনন্দ! নৌকোয় নাচতে-নাচতে সে দেখলো—বাবা বউকে মার্বেল পাহাড় দেখাচ্ছে কাছে বসিয়ে৷ পাহাড় আর জোছনার বদমায়েসি৷ হাতিমেয়ের চোখের সামনে মা-বাবা রাধাকেষ্ট হয়ে গেল৷ সাদা মার্বেলে হলুদ চাঁদ—মানবের জীবনে তখন কোনো কষ্ট নেই !

পর্ব ৩
ফেরার পথে ট্রেনে কেউ রেডিও চালিয়েছিলেন৷ তখন মধ্যবিত্ত বাঙালির এও এক দস্তুর—ট্রেনে রেডিও শোনা৷ রেডিও বললো—প্লেন চালাতে উঠে মাঝআকাশে মারা গেছেন সঞ্জয় গান্ধী। সবার মুখ গম্ভীর৷ যাত্রীরা, বাবা-মা  বারবার বলছিলেন—এত ভালো প্লেন চালাতো—এত অল্পবয়সে মরে গেল! কেউ বিচার করেনি, সঞ্জয় গান্ধী কোন পার্টির। শুধু তার মৃত্যুটা ঘুরছিল ট্রেনের বাতাসে৷ যাবার কালের হু-হু বাতাসে খাঁ-খাঁ ভাব৷ বিষাদ বড়ো অদ্ভুত—তার শর্তও অগোছালো ৷

Comments