প্রাণেশ সরকার


জীবনে আমি বরাবরই বিবিধ সংকটের ভিতর দিয়ে চলেছি এবং এর ফলে আমি মনে-মনে সংকল্প গ্রহণ করি যে, আমি বিবাহ করবো না। আমার মাতৃসমা দিদির এ-বিষয়ে যথেষ্ট ক্ষোভ ছিল, কিন্তু আমি আমার সিদ্ধান্তে অটল ছিলাম। কিন্তু একা থাকার এ-ধরনের সিদ্ধান্তের ফলে এমনটি কখনও ঘটেনি যে, মেয়েদের সঙ্গে আমার সহজ ও স্বাভাবিক সম্পর্ক ব্যাহত হয়েছে। কৈশোরে পাড়ারই এক কিশোরীর সঙ্গে বড়ো মধুর এক সম্পর্ক দানা বেঁধে উঠতে-না-উঠতেই তার বিবাহ হয়ে যায়। এটা একটা ধাক্কা ছিল আমার জীবনে, সেকথা অকপটে স্বীকার করি। কয়েকবছর আগে স্বামী-সন্তান রেখে সে ইহলোক ত্যাগ করেছে। দুরারোগ্য ক্যান্সারে ভুগছিল সে। কষ্টও পেয়েছে। কলেজ-জীবনেও এক সতীর্থ তরুণীকে খুবই পছন্দ করতাম। সেও আমাকে পছন্দ করতো বলেই আমার ধারণা; কিন্তু হঠাৎই বুঝতে পারি, সে অন্য এক যুবকের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে। সে-সম্পর্কও অবশ্য থিতু হয়নি শেষ পর্যন্ত। মেয়েটিই একদিন আমাদের বাড়িতে এসে বলেছে সেকথা। এরপর সে আমাকে তার জীবনে জড়িয়ে নিতে চেয়েছে, কিন্তু আমি ততদিনে মানসিকভাবে তার কাছ থেকে সরে এসেছি। এরপর মেয়েটি চাকরি নিয়ে কলকাতায় চলে যায়, বিবাহ করে, তার একটি মেয়েও আছে। মেয়েটি আমেরিকায় থাকে, তার স্বামীর সঙ্গে। আর সে এখন একা; মদ্যপ স্বামীর সঙ্গে তার কোনো সংযোগ নেই শুনি। দমদমের দিকে একা এক ফ্ল্যাটে থাকে। 

যে-সময়ের কথা বলছি, সে-সময়ে আমি কৃষ্ণনগর পৌরসভায় কাজ করি। কৃষ্ণনগর রবীন্দ্রভবনে এক কবিতাপাঠের আসরে শহরের এক অসামান্য সুন্দরী লাবণ্যময়ী তরুণীর সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। তার নাম ঋতু। বোধহয় আমার কবিতা তাকে মুগ্ধ করে থাকবে। 'পরবাসী ঢেউ' শীর্ষক একটা সিরিজ পড়েছিলাম আমি। সভা শেষে সে আমার সঙ্গে অনেকক্ষণ কথা বলে। আমি কোথায় থাকি, কী করি, সব জেনে নেয় এবং এক শনিবার অফিস ছুটির পরে আমার অফিসে এসে দেখা করে। তার অনুরোধে আমরা দু'জন হেঁটে-হেঁটে কালেক্টরেট মোড় ছাড়িয়ে শংকর মিশনের দিকে চলে যাই। সেখানে একটা ফাঁকা চায়ের দোকানের বাইরে বাঁশের চটা দিয়ে তৈরি বেঞ্চিতে বসে, চা খেতে-খেতে তার কবিতা শুনি। ডায়েরি থেকে কবিতা পড়ছিল ঋতু। তার পড়া শেষ হলে, আমিও তাকে আমার নতুন লেখা কবিতা শোনাই। পরপর কয়েক রাউন্ড চা খাই। আমি কেক, টোস্টও খাই। কারণ, খিদে পেয়েছিল— সেই সকাল পৌনে-ন'টায় বাড়ি থেকে ভাত খেয়ে বেরিয়েছি। ঋতু শুধু চা খায়—দু'বার। এবার একটা রিকশায় উঠে ওকে সদর হাসপাতালের মোড়ে ছেড়ে দিয়ে আমি কৃষ্ণনগর রেলস্টেশনে চলে আসি, বাদকুল্লাগামী ট্রেন ধরবো বলে। এইভাবে ওর সঙ্গে বন্ধুত্বের সূত্রপাত হয়। আর এই বন্ধুত্বের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল কবিতা। খুবই অভিজাত পরিবারের কন্যা। ওদের বাড়িতেও গিয়েছি বেশ ক'বার। ওর মা আমাকে স্নেহ করতেন খুব। ওদের চিলেকোঠা ছিল ওর স্টাডি, সেখানেই গল্প করতাম আমরা। মনে পড়ে, ওকে কেন্দ্র করে একটি একাঙ্ক কাব্যনাটক লিখেছিলাম। আমার বন্ধু স্নেহাশিস শুকুলের পছন্দ হয়েছিল নাটকটি। আর জনৈক খর্বাকৃতি কবি নাটকটি পড়ে কীরকম ছ্যা-ছ্যা করেছিল। সেই থেকে আমার কোনো লেখা যাকে-তাকে পড়াতাম না আর। যাইহোক, হচ্ছিল ঋতুর কথা। সেকথাই হোক। ওর বিএ ফাইনাল পরীক্ষা মিটে যাওয়ার পরে বাড়ি থেকে ওর বিবাহ স্থির হয়। ও যেমন রূপবতী, তেমনই গুণবতী। ওর বিয়েও হয় এক গুণবান, রূপবান রাজপুত্রের সঙ্গে। ঋতু নিজে আমার অফিসে এসে বিয়েতে যাওয়ার নিমন্ত্রণ করে গিয়েছিল। আমি গিয়েছিলাম ওর বিয়েতে। উপহার দিয়েছিলাম বুদ্ধদেব বসু-র কাব্যনাটক 'তপস্বী ও তরঙ্গিণী', জাঁ পল সার্ত্র-র 'দ্য ওয়র্ডস' এবং হেরমান হেস-এর 'সিদ্ধার্থ'। আমার উপহার পেয়ে খুব খুশি হয়েছিল ঋতু। ওর অভিভাবকগণ যথারীতি আমাকে আপ্যায়ন করেন। ঋতু ওর স্বামীর সঙ্গে আমার আলাপ করিয়ে দেয়। সন্ধ্যারাতেই আমি নিমন্ত্রণ রক্ষা করে বাড়ি ফিরে আসি। ঋতুর বিয়ের পরেও যখনই ও কৃষ্ণনগরে আসতো, আমাকে ডেকে পাঠাতো এবং আমি যেতাম। গল্পগুজব করতাম। নতুন কী লিখছি, কী-কী বই পড়লাম, কথা হতো এসব নিয়ে। ওর স্বামীর সঙ্গেও আমার আলাপ-পরিচয় ভালোই হয়েছিল। ঋতুর বিয়ে হয় ১৯৭৭-৭৮ সালে। ও তখন প্রবাসী, ওর স্বামীর কর্মসূত্রে। স্বাভাবিকভাবেই ওর কৃষ্ণনগর আসা কমে যায়। এরই মধ্যে দুটি পুত্রসন্তানের জননী হয়েছে ও। সুতরাং যা হয় আর কী,  আমার সঙ্গে সংযোগ ক্ষীণ হয়ে আসে। তখন তো আর মোবাইল ফোনের যুগ নয়। আমরা চিঠিপত্রের মাধ্যমে যোগাযোগ রেখে চলতাম। আজ এই এতদিন পরে, ঋতুর দুটি মাত্র চিঠি রয়ে গেছে আমার কাছে। আর, আমার চিঠির কপি তো কোনোদিনই আমার রাখার অভ্যাস ছিল না। আমি এখানে ঋতুর লেখা দুটো চিঠি তুলে দিচ্ছি। পাঠক ওর সুসংস্কৃত ও শুদ্ধ মনের পরিচয় অন্তত খানিকটা পেতে পারেন, এই চিঠি দুটি থেকে। এখানে দেওয়া প্রথম চিঠিটি ঋতু লিখেছিল ৯ ডিসেম্বর ১৯৮৮ তারিখে—
"প্রাণেশ, 
        তোর দু'খানা চিঠি পেলাম। তারপর চুপচাপ। চিঠি দিস না কেন? প্রতি সপ্তাহে দিতে পারিস না? প্রতিদিন, প্রতি ঘন্টায়?

        আমি তোকে একদিক থেকেই দেখেছি। পশ্চাৎপট জানা হল, আরো কিছুটা ছুঁতে পারলাম তোকে। তোর গভীর আস্তিক্যবোধ আর ঈশ্বরবিশ্বাসের মূল কোথায় খানিকটা জানা গেল। তোর মধ্যে একধরণের আশ্রয় আর নির্ভর আছে যা ছায়া দেয়, যার ওপর হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে নিঃশ্বাস নেওয়া যায়। এর শেকড় ছড়িয়ে আছে তোর গোটা ছেলেবেলা জুড়ে। সমস্যার সঙ্গে লড়াই করে যারা বেড়ে ওঠে একমাত্র তারাই বোধহয় জীবন আর জীবনদেবতা সম্বন্ধে এমন গভীর বিশ্বাসে আত্মস্থ থাকতে পারে। আমাকে ছোটবেলা থেকে কোনদিন কোন সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়নি। বাড়ির আর্থিক অবস্থা ভালো ছিল, সবার আদরের ছিলাম, পড়াশোনায়ও খারাপ ছিলাম না, বন্ধুত্ব-আদর-ভালোবাসা-প্রেম-বিশ্বাস-স্নেহ সবই পেয়েছি অঢেল। যা কিছু চাইবার মত, সবই অনায়াসে দু'পায়ের তলায় জড়ো হয়েছে, দু'চারটে তুলে নিয়েছি, কিছু বা ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছি। আজ জীবনের তিনদশকের বেশী সময় কাটিয়ে এমনকিছু আকাঙ্ক্ষার মুখোমুখি হয়েছি যা চাইলেও পাওয়া যায় না। তবু চাওয়া থেকেই যায়। সেই চাওয়া আমায় অবিরত ক্ষয় করছে। আমার শান্তি আমার স্বস্তি, আমার আরাম, আমার উৎসাহ উদ্দীপনা এমনকি নিজের প্রতি মনোযোগ পর্যন্ত ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে ঐ এক তীব্র আকাঙ্ক্ষায়। এ অভিজ্ঞতা আমার কোনদিন হয়নি। এতখানি বয়স জুড়ে কোথাও এর প্রস্তুতি ছিল না। তাই এর অকস্মাৎ আক্রমণ আমায় বিপর্যস্ত করে দিচ্ছে। আমার ভিতরে জমা হচ্ছে পরস্পর বিরোধী সব আবেগ আর অনুভূতি, জন্ম নিচ্ছে আশ্চর্য সব চেতনা। আমি বড় বিপর্যস্ত। 

        আবেগ সর্বস্ব মানুষের এই এক জ্বালা। এতটুকু এদিক ওদিক হলে গোটা পৃথিবী টলে যায়। আমার পৃথিবী টলছে, প্রচন্ড আলোড়নে টলমল করছে। কিছুতেই আমি ভারসাম্য বজায় রেখে সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছি না। কখনো হেলছি এদিকে, কখনো ওদিকে, জীবনে এত জটিলতা থাকতে পারে জানতাম না। কি আশ্চর্য সহজ ছিল সেইসব দিন যখন কলেজে পড়তাম। সেই স্বচ্ছ চেতনা হারিয়ে ফেলেছি আমি, নিজেকে কেমন যেন অশুচি মনে হয়। 

        আমি কিছুতেই পরিষ্কার করে বলতে পারছি না প্রাণেশ। অবিশ্বাস্য এক জটিলতা এসেছে আমার জীবনে। কিভাবে কোথায় এর শেষ হবে আমি জানি না। বলবো, তোকেই বলবো কোনদিন সব কথা, কেননা আর কোন বন্ধু আমার নেই।

        মানুষ কি চায়? কি পেলে পরিতৃপ্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলতে পারে, আর কিছু চাইবার নেই? কোথায় সেই সবুজদ্বীপ যেখানে বনলতা সেনের সঙ্গে দেখা হয়েছিল একজন মানুষের? কতদিন ঘুমাই না যেন, কবে ফিরে পাবো শৈশবের সেই নির্ভার স্বপ্নহীন ঘুম? নিজেকে ঘেন্না করেছিস কোনদিন? ঘৃণা নয় ঘেন্না? কোন মানুষের বিদ্রূপভরা মুখ দেখে মনে হয়েছে তোর বিশ্বাস তোর আবেগ তোর সততা তোর মালিন্যহীন সহজ অনুভূতি সবই ঠাট্টা তামাশার ব্যাপার? অন্যের উপহাসের খোরাক? সেই মুহূর্তে নিজেকে অচেনা বলে মনে হয়, পারিপার্শ্বিক কেমন যেন ধোঁয়াটে আবছা লাগে, মনে হয় আমি এই গ্রহের কেউ নই, এখানে যারা বসবাস করে তাদের ভাষা আমি বুঝি না। তাদের আবেগ আমার অপরিচিত, আমার অনুভূতিও তারা পড়তে পারে না। সেই সময় অবচেতনের গভীর থেকে উঠে আসে নিজের ওপর সুতীব্র এক ক্রোধ আর ঘেন্না। নিজের অস্তিত্ব দুঃসহ হয়ে ওঠে নিজের কাছে। তখন ভাঙতে ইচ্ছে করে। ভাঙতে ইচ্ছে করে সমাজের নিয়মগুলো, নীতিবোধ, পারস্পরিক সম্বন্ধগুলো আর পারিপার্শ্বিকতার এই দেয়ালকে। সেই সঙ্গে সবথেকে বেশি, সবথেকে প্রবল ইচ্ছে হয় নিজেকে ভাঙতে। 
                ভালোবাসা নিস।
                                           তোর ঋতু"

স্বভাবতই ঋতুর এই চিঠিটি পড়ে আমি বেশ ঘাবড়ে যাই। কী এমন ঘটলো মেয়েটির জীবনে যে, এইসব কথা বলছে ও! চিঠিতে তো রক্তক্ষরণের দাগ স্পষ্ট লেগে আছে। ওর জীবনে কী এমন ঘটলো, যাতে এই যন্ত্রণা শুরু হয়েছে ওর? আমি ওকে চিঠি লেখা ছাড়া আর কীই-বা করতে পারি? চিঠিতে বন্ধুকে ভালো থাকার চেষ্টা করা ছাড়া অন্য কথা কীই-বা বলতে পারি? দু-একমাস সময় আমি চুপচাপ থাকি। তারপর ওকে চিঠি লিখি; চিঠির সঙ্গে আমার কবিতাও পাঠাই। এবার ওর চিঠি পাই ১৩ জুলাই ১৯৮৯। সেই চিঠিটিই হুবহু তুলে দিচ্ছি এখানে। 
                                              "১৩ই জুলাই। বিকেল।
                                            অল্প অল্প বৃষ্টি পড়ছে —
প্রাণেশ,
          ওভাবে নয়। খুব আকস্মিক হয়ে গেল কথাটা, নয়? বুঝিয়ে বলি।নিজের মধ্যে ডুবে যাওয়া যে কোন সময়েই যেতে পারে কিন্তু আমি ওভাবে আশ্রয় চাই না। তোকে লিখেছি মানুষ ছাড়া আমার কাছে জীবনের কোন অর্থ নেই—একথা শুধুই শাব্দিক নয় আমার চেতনাজগতে। যখন তোর সঙ্গে মেলামেশা ছিল তখন সেই কম বয়সেই লক্ষ করেছিলাম 'অপরিচিত' মানুষের কাছে তুই অসহজ বোধ করিস। এই 'অপরিচিত' অর্থ যারা তোর বোধ বা চেতনাস্তরের নয় সেইসব মানুষ। আমি কিন্তু ছোটবেলা থেকেই সবরকম মেধা-বুদ্ধি-বোধ-শিক্ষাস্তরের মানুষের সঙ্গে মিশতে পেরেছি এবং সবার ভালোবাসা পেয়েছি। এ কারণে আমার বন্ধুগোষ্ঠীতে নানা মাপের মানুষ আছে। সামান্য বড় যখন হলাম তখন লক্ষ করলাম (আমার সর্বদাই নিজেকে বিশ্লেষণ করার এক প্রবণতা আছে) যে আমার মধ্যে এক ঈশ্বরদত্ত আশ্চর্য ক্ষমতা আছে তা হল মানুষকে উদ্দীপ্ত করার ক্ষমতা। আমার সাহচর্যে যেকোন ধরনের মানুষ সঞ্জীবিত হয়, আমার প্রাণশক্তির স্পর্শে প্রাণ পায়, শক্তি পায়, প্রেরণা পায়; আর এ জন্যে আমার সচেতন কোন প্রয়াস দরকার হয় না। আমার মনে হল এর মূলে আছে আমার মানুষের প্রতি ভালোবাসা। এই ভালোবাসা আমার সমস্ত সত্তা-বোধ-চেতনা ও প্রাণশক্তির মূলে। আমি মানুষকে ভালোবাসি, ভালোবাসি তার সমস্ত অসহায়তা-অসম্পূর্ণতা-দোষ-গুণ-ভালোমন্দ মিশিয়ে। আমার মনে হল ঈশ্বর আমায় এই যে এক ক্ষমতা দিয়েছেন একে মানুষেরই জন্যে ব্যয় করাই আমার নিয়তি। আমার এই ভালোবাসা আমি সবার মধ্যে ছড়িয়ে দিই, দিতে চাই, নইলে তা ছাপিয়ে ওঠে আমার বুক। তাই আমি কাজ করি—নানা কাজ—মানুষের মধ্যে। এখানে আমাদের একটা group আছে, আমরা নাটক করি, গান গাই, নাচ করি, নানারকম social workও করি। আমাদের groupএ এক প্রচন্ড বড়লোক বেনিয়ার ছেলে আছে, আবার এক police inspector এর যে ঘর থেকে চলে এসেছে, এসে আজ কারখানায় খেটে খায়, চারজন বস্তির মজুর আছে যারা শুধু নিজের নাম সই করতে পারে, যুক্তাক্ষর পড়তে পারে না, আছে একজন পানওয়ালা, আরো অনেক আমাদের মত ছেলেমেয়ে যারা স্বপ্ন দেখে মানুষকে ভালোবাসার। বস্তির মানুষগুলো বিশেষ করে মেয়েরা এত অসহায় এত অন্যায় তাদের ওপর হয় প্রাণেশ তুই ধারণাও করতে পারবি না। আমি মানুষকে ভালোবাসি, তাদের বুঝতে চেষ্টা করি, আমার প্রাণের কিছু অংশ তাদের দিই যারা হতাশ। যারা শুধু অন্ধকার দেখতে পায় তাদের জন্য আমি প্রদীপের মত জ্বলতে চাই। আমার বাবা বলতেন, প্রদীপ হয়ে জ্বলো, সবাইকে আলো দাও, কালিটুকু নিজের বুকে জমা করে রেখো। তাই রাখতে চাই, তবু মাঝে মাঝে কোন বন্ধুর কাছে একান্ত আপন কোন বন্ধুর কাছে সেই কালির বোঝা নামাতে ইচ্ছে করে কারণ আমি বড় দুর্বল, ঈশ্বর অফুরন্ত ভালোবাসা দিয়েছেন—শক্তির বেলায় কিছু কম হয়ে গেছে। তাই কালির বোঝাই তোর কাছে আগের চিঠিতে নামিয়েছিলাম খানিক। মানুষের কাছে আঘাত পেয়ে আবার মানুষের কাছেই ভালোবাসার জন্য হাত পাতি আমি। এই-ই আমার চরিত্র। যাক্ ভাবিস না, আমি এখন আবার সুস্থ, কাজ করছি। 

          এখানে একটা নাচের ক্লাস খুলেছি, বাড়িতে, ছোট ছোট বাচ্চারা আসে, ভালো লাগে। আঘাত আমায় কখনো শেষ করতে পারবে না, সারাজীবন ধরে আমি মানুষকে ভালোবাসব, মানুষ আমার কাছে আসবে ছায়ার জন্যে, প্রেরণার জন্যে, আমার প্রাণশক্তির স্পর্শ পাবার জন্যে, আমার আত্মার শিখা থেকে জ্বালিয়ে নেবে তাদের প্রাণের প্রদীপ, কত মনে আশা জাগাবো, কত হতাশ প্রাণে এনে দেব প্রেরণা, এই-ই আমি। অন্যরকম লাগছে? কিছু মনে করিস না, শুধু নিজের মধ্যে ডুবে যাওয়াকে আমি স্বার্থপরতা মনে করি। এই পৃথিবীতে জন্মেছি—কত যুগের মানবসভ্যতার  উত্তরসূরীত্ব পেয়েছি—এর কোন দাম নেই? এর দাম চুকিয়ে দিতে হবে না? আমি গান গাই—কবিতা পড়ি—লিখি—এগুলো সবই নিজেকে ফুটিয়ে তোলার জন্যে—আমার গাছে ফুল ফোটানোর জন্যে—হতাশ মানুষ অসহায় দুঃখিত দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মানুষ আমার ছায়ায় এসে বসবে, ফুলের গন্ধে তাদের মন ভরে যাবে, খুশী হবে—আনন্দ পাবে, তাই এই ফুল ফোটানো। আমার আত্মার প্রদীপকে উজ্জ্বলতর করার জন্যই আমার এসব প্রস্তুতি—মূলে সেই বিশ্বমানবের প্রতি ভালোবাসা। এ অনুভূতি আমায় আশ্চর্য এক তৃপ্তি দেয় প্রাণেশ—এ ভালোবাসা ঈশ্বরকে ভালোবাসার চেয়েও সুস্বাদু। 

           অনেকদিন তোকে দেখি না। পূজোর সময় আসবি? আমার স্বামী কিন্তু খুব ভালো মানুষ—আমার নানা পাগলামী সহ্য করেন। তোর কথা অনেক শুনেছেন, তোদের আলাপ হলে ভালো লাগবে। আমার দুই ছেলে ভারী বাঁদর। পরের চিঠিতে আমাদের সবার ফটো পাঠাব। পূজোয় আসবি?
                                 অনেক প্রীতি আর ভালোবাসা।
                                           ঋতু।। 
পুঃ খুব শীগগীর চিঠি দিবি আর খুব বড় করে। ভারি ভালো লাগে তোর চিঠি পেলে।"  

এই চিঠির পরেও অনেক-অনেকদিন পর্যন্ত আমাদের পত্রালাপ বজায় ছিল। না, আমার কখনও যাওয়া হয়নি ওদের ওখানে। একদিন ওর এক আত্মীয়া আমার স্কুলে এসে বলেন, "ঋতু কৃষ্ণনগরে এসেছে, আপনি যাবেন একদিন তাড়াতাড়ি। ঋতু খুব করে বলেছে।" গিয়েছিলাম আমি। ওকে দেখে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলাম। ওর শরীর ও মন সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছে। আমাকে দেখে খুব খুশি হলো। অনেক কথাই হলো, কিন্তু কী হয়েছে ওর—সেকথা জিজ্ঞেস করে উঠতে পারিনি। মনে হলো, ওর জীবনে ঝড় বয়ে গিয়েছে। কিছুক্ষণ বসে, আমি উঠে পড়ি। নিচে নেমে দরজায় দাঁড়িয়ে আমাকে বিদায় জানায়। ওর সঙ্গে সেই আমার শেষ দেখা। দু-একটা চিঠি দিয়েছি। কোনো উত্তর পাইনি—যা আমাকে খুবই আশ্চর্য করেছে। অনেক পরে বিশ্বস্ত সূত্রে  জেনেছি, ও উত্তর ভারতের কোনো একটা বড়ো শহরে এক স্কুলে পড়াচ্ছে। একাই থাকে। স্বামী ও সন্তানদের সঙ্গে সংযোগ নেই। অনেক চেষ্টা করেছি, ওর ঠিকানা সংগ্রহ করতে পারিনি। আমার অনুমান, ও পুরোনো জীবনের কারও সঙ্গেই কোনো যোগাযোগ রাখতে চায় না। কৃষ্ণনগরে ওর আত্মীয়স্বজন কেউ-ই ওর সম্বন্ধে কিছুই জানাতে পারেনি। 

আমার এই সুদীর্ঘ জীবনে ওর মতো সুন্দর মনের মানুষ খুব কমই দেখেছি আমি। সম্পূর্ণভাবে emancipated মানুষ। ওর লেখা অসংখ্য চিঠি আমার কাছে ছিল। ২০০০ সালের বিধ্বংসী বন্যায় আমার অন্যান্য বইপত্র ও পাণ্ডুলিপির ফাইলের সঙ্গে সেইসব চিঠিপত্রও নষ্ট হয়ে গিয়েছে। এই চিঠিদুটিই শুধু বাঁচাতে পেরেছি আমি—যা পড়ে একজন আধুনিক, শিক্ষিত ও সংবেদী মানুষের হদিশ পাবেন আমার শ্রদ্ধেয় পাঠককুল—এ-বিশ্বাস আমার আছে। 
(ক্রমশ)

Comments

Post a Comment