প্রাণেশ সরকার

ঋতুর প্রসঙ্গ অবতারণা করার আগে আমি আমার জেলার কয়েকজন কবির কথা বলছিলাম। মাঝেমাঝে তাদের দু-একটি কবিতাও উদ্ধৃত করেছি। রানাঘাটে থাকেন আমাদের বন্ধু কবি তপন ভট্টাচার্য। আগে থাকতেন ফুলিয়ায়। সেখানে তপনের দোতলার এক ঘরে সেই ১৯৭৬-৭৭ সময়পর্বে তরুণ কবিদের জমায়েত হতো। রানাঘাট থেকে জয়, চন্দন, বাসবী চক্রবর্তী, আনন্দ প্রামাণিক, গৌতম চট্টোপাধ্যায়; ফুলিয়ার তপন, উৎপল বসাক; শান্তিপুরের স্বপন রায়, ফল্গু বসু; বাদকুল্লা থেকে আমি হাজির হতাম এবং প্রাণ খুলে কবিতা পড়তাম। কবিতাপাঠের ফাঁকে মুড়ি-তেলেভাজা ও লিকার চা-সহ আপ্যায়িত হতাম আমরা। বেশ জমে উঠতো ঘরোয়া এই কবিতা-উৎসব৷ এই তো সেদিন শান্তিপুর ব্রাহ্মসমাজের ব্রহ্মমন্দিরে আমার কবিতাসংগ্রহ ১ প্রকাশ উপলক্ষে এক অনুষ্ঠানে উৎপল তপনের ফুলিয়া ভদ্রাসনের সেই আসরের কথা উল্লেখ করলো। তপনের বেশ কিছু কবিতার বই আছে। সে গদ্যও লেখে। ওর চূর্ণী কবিতাপুস্তিকাটি আমার খুব প্রিয়। সেখান থেকে একটি কবিতা উদ্ধৃত করছি। 

প্রত্যূষ প্রসূন ভোর নেমে আসছে আমাদের গ্রামে, 
তরল কুসুম মেখেছে আকাশ, টলটলে শিশির আর
টুপটাপ শিউলি ঝরে পড়ছে উঠোন সাদা করে; ওই যে
গ্রামের শেষ বাড়িটা, যেখানে টুকরো টুকরো অন্ধকার 
জমে আছে এখনো, ওখানেই ভূমিষ্ঠ হয়েছিলাম 
বড়ো বন্যার বছরে। বাড়িটার পাশ দিয়ে পায়ে চলা পথ,
ভাঁটফুল আর মটমটির জঙ্গল দুপাশে, সেই পথ 
নেমে গিয়েছে নদীর ঘাট অবধি : নদীর নাম চূর্ণী—
অধীনের নাম ছিদাম মালো, সাকিন— মাসুন্ডা গ্রাম।
এই খেয়া পারাপারের মাঝি আমি-ই। 

চূর্ণী পাঠ করে মুগ্ধ হয়ে সুধীর চক্রবর্তী 'শীর্ণ নদীর কুলীন গাথা' শীর্ষক এক অসামান্য গদ্য লিখেছিলেন কবি শ্যামলকান্তি দাশ সম্পাদিত 'কবিসম্মেলন' পত্রিকায়। 

এখন রানাঘাটের এক তরুণ কবির কথা বলবো। তার কত অল্পবয়স থেকেই উজ্জ্বল এই ছেলেটিকে চিনি। কবি প্লাবন ভৌমিক তার সঙ্গে আমার আলাপ করিয়ে দিয়েছিল রানাঘাটে, প্লাবনদের ভবানীগড়ের বাড়িতে। ২০০০ সালে কলকাতা বইমেলায় একুশের ডাক প্রকাশন যে মন কবিতা লেখে শীর্ষক আমার একটি শীর্ণ গদ্যের বই প্রকাশ করেছিল। এই বইয়ের প্রথম গদ্যটিতে আমার পিতামহীর সকরুণ মৃত্যুর বর্ণনা ছিল। সঞ্জয় মৌলিক বইটি পড়ে। ওই গদ্যটি পড়ার তীব্র অভিঘাতে সে একটি কবিতা লিখে আমাকে ডাকযোগে পাঠিয়ে দেয়। কবিতাটি আমি এখানে তুলে দিচ্ছি। 

যে মন কবিতা করে 
(উৎসর্গ : প্রাণেশ সরকার) 
১.
সে খুঁজতে বেরিয়েছে বিগত সব রাত্রিকে, যা সে পার করে এসেছে, যা সে দেখতে পেয়েছে, সে খুঁজতে বেরিয়েছে শুধু কয়েকটা হাড়—তার পিতামহী পাঁচদিন হারিয়ে থাকার পর যেভাবে দেখা দিয়েছিল তাকে—গোটা সভ্যতাকে সেইভাবে দেখবে সে—পাঁজরে নৌকো নির্মাণের শব্দ—করোটি শ্রোণিচক্র ও কশেরুকাগুলো উদোম জোছনায় পড়ে আছে... 
২.
ওই তো গত রাত্রিও তার থেকে আজ বহু বছর দূরে, যে রাত্রে জীবনের শেষদিকে তার ঠাকুমা খুঁজতে বেরিয়েছিল মৃত ছেলেকে এ গ্রাম থেকে ও গ্রাম, তারপর ধানখেতে, হাটে, চড়কতলায়...
৩.
খুঁজতে খুঁজতে সামনে এসে গেছে সরু একটা নদী, নড়বড়ে সাঁকো, তার নীচে শ্যাওলামাখা জল, আরও আরও নীচে অগ্নিজট, এইখানে ভাষা পায় গলিত ধাতুর স্রোত, মাথাভর্তি হিলিয়াম, নোভা ও সুপারনোভারা শব্দের ফাঁকে ফাঁকে ওঁত পেতে থাকে,  হঠাৎই সংকেত পেয়ে কয়েকটা হাড় নেচেকুঁদে প্রাণ পায়, ছুটতে শুরু করে, ঢুকে পড়ে গ্রন্থে গ্রন্থে, ভ্রূণের ভেতর, অমরায়...
৪.
সে আজ বুঝেই নেবে সমূহ জন্মের কথা, অতিমানবিক মৃত্যুও, আজ বলতে পঁচিশ বছর, কিংবা আরো বেশি, কয়েক টুকরো হাড়ের মধ্য দিয়েই সে দেখতে চাইবে ভবিতব্যকে, সরষে-শোভিত মাঠে পৌষ-অঘ্রাণ, সব পদচিহ্নই মনে হবে তার জন্য অপেক্ষা করে আছে আলপথে ফুলের গন্ধ উড়ে যাচ্ছে শ্মশান ও স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে সবই তার জন্য মহাজাগতিক বার্তা মিশিয়ে ফেলেছে সে ভাতের সঙ্গে, গিলে খাচ্ছে সে তেজস্ক্রিয়, পর্বে, পর্বান্তরে...

১৯/০২/৯৫ রাত্রি 
রানাঘাট | নদীয়া 

২৯ বছর আগে লেখা এই কবিতাটির সঙ্গে আমার জীবন জড়িয়ে আছে সে-কথা ঠিক, কিন্তু আরও ঠিক হলো এই যে, এই কবিতাটি একটি মহৎ রচনা। আমার স্থির বিশ্বাস, তরুণ এই কবি আগামীতে বাংলা কবিতার মুখ আরও-আরও উজ্জ্বল করবে।

এবার আমার খুব প্রিয় এক ছাত্র, বাদকুল্লারই বাসিন্দা, সুব্রত সান্যাল (শান্ত)-এর একটা চিঠি উদ্ধৃত করবো। তাকে আমি তার ডাকনামেই ডাকি। শান্ত ছোটোবেলায় আমার প্রতিবেশী ছিল এবং আমার কাছে ইংরেজি পড়েছিল। পরে সে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে মাস্টার্স করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এবং রাজ্য সরকারের এক গুরুত্বপূর্ণ আধিকারিক হয়। ওর কথা আমি পুরুলিয়া ভ্রমণ প্রসঙ্গে বলেছি। ২০০২ সালে আমার ষষ্ঠ কাব্যগ্রন্থ তোমাকে আজ গড়ে তুলবো আমি প্রকাশিত হয়। শান্তকে আমি বইটির দুটি কপি দিই। একটি তার জন্য, অন্যটি আমার কবিবন্ধু অমিতাভ মৈত্র-র জন্য। অমিতাভও রাজ্য সরকারের গুরুত্বপূর্ণ আধিকারিক ছিল। ডব্লিউবিসিএস (এক্সিকিউটিভ) থেকে সে নমিনেটেড আইএএস হয়। চাকরির প্রথমজীবনে অমিতাভ আমার বাড়িতেও এসেছে। ওর আদিবাড়ি মুর্শিদাবাদের বহরমপুরে। এই চিঠিতে 'অমিতাভদা' বলে সে উদ্ধৃত হয়েছে। অমিতাভ চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই গুরুতর অসুস্থ হয়ে মৃত্যুবরণ করে। বাংলা কবিতাকে তার এখনও অনেককিছু দেওয়ার ছিল বলেই আমার বিশ্বাস। এই চিঠিতে শান্ত তোমাকে আজ গড়ে তুলবো আমি-র একটা মূল্যায়ন করার চেষ্টা করেছে। সেদিক থেকে চিঠিটি গুরুত্বপূর্ণ, আর তাই আমি এটি আমার পাঠকের সঙ্গে ভাগ করে নিতে চাই।

                                                    বারাসাত / ৩০.১১.০২
প্রাণেশদা,
আপনার Postcard গতকাল পেলাম। কর্নাটকের সাথে অজন্তা-ইলোরা ঘুরে একটা কাজের কাজ করেছেন। অজন্তা-ইলোরা সমস্ত ভ্রমণ-পিপাসুরই এক স্বপ্নের সফর। আপনি নিশ্চয় খুব উপভোগ করেছেন। দেখা হলে, বিস্তারিত সব শুনবো। আমি 6th December উত্তরবঙ্গ যাচ্ছি। লাভা-লোলেগাঁও-কালিম্পং হয়ে জলপাইগুড়ি। সেখানে অমিতাভদার সাথে দেখা হবে। তখন আপনার বইটা দেব। ইতিমধ্যে অমিতাভদার সাথে ফোনে কথা হয়েছে। আপনার চিঠি অমিতাভদা পেয়েছে। হয়তো আপনার বইটা হাতে পেয়ে উত্তর দেবে।
       'তোমাকে আজ গড়ে তুলবো আমি' সম্পর্কে আমার মতামত জানতে চেয়েছেন। কিন্তু কীভাবে বলবো আমি! যখন কিছু পড়ে অথবা শুনে বা দেখে এক অসম্ভব ভালোলাগার বোধ নিজেকে আচ্ছন্ন করে রাখে তখন সেই বোধকে কি কথায় প্রকাশ করা সম্ভব!  আপনার বইটি সম্পর্কে অন্তত এইটুকু বোধহয় বলতে পারি অনেকদিন এমন কবিতা পড়িনি। আপনার কবিতা আমি প্রায় বালকবয়স থেকে পড়ে আসছি। আপনার ভাষা, চিত্রকর, রূপক ও শব্দস্রোতের সাথে আমার দীর্ঘদিনের পরিচিতি। আপনার আগের বইগুলি—সেই 'অন্ধ করোটির রেখা' থেকে 'বহ্ণ্যৎসব' আমার কাছে পরিচিত প্রাণেশদার কবিতাই ছিল। কিন্তু 'তোমাকে আজ...' আমাকে একেবারে আমূল চমকিত করেছে। এ যেন এক অন্য প্রাণেশদার কবিতা। কবিতাগুলির শরীর নির্মেদ, বক্তব্য স্বচ্ছ, যেখানে যেন যে শব্দটির দরকার সেই শব্দটি-ই রয়েছে। আপনার এই বইটিতে গানের কথা, সুরের কথা বারবার এসেছে। কবিতাগুলি সম্পর্কে বলতে গিয়েও আমার গানের উপমাই মনে আসছে। সেতারের মীড় যেন এই ছোট ছোট কবিতাগুলি। হৃদয়ের কোথায় যেন গিয়ে স্পর্শ করছে। মনে হচ্ছে আরো একটু বাজুক আপনার এই কবিতাগুলি; মনে হচ্ছে আরো অনেকক্ষণ আপনার কথা যেন গান হয়ে ঝরুক আমাদের কানে। কোনো একটি দুটি বিশেষ কবিতার কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। তাহলে অন্যান্য কবিতাগুলি অভিমানী হবে। প্রত্যেকে যেন প্রত্যেকের পরিপূরক হিসেবে এই বই-এ বসবাস করছে। কবি প্রাণেশ সরকার যে আদ্যন্ত এক Romantic পাগল তাই যেন প্রকাশিত এই বই-এ।
       জানি না, আমার ভাল লাগা, কবিতাগুলিকে ভালোবাসা আমি বোঝাতে পারলাম কীনা। আসলে, কবিতা সম্পর্কে লিখতে যাওয়াই মূর্খামি। ভালো কবিতা পড়ে যে আনন্দ সে কথা কখনোই কথায় প্রকাশ করা যায় না।
       আপনি এরকম কবিতা আরো অনেক অনেক লিখুন। এই কামনা করি। ভালো থাকুন।
       শুভেচ্ছা ও শ্রদ্ধা নেবেন। বড় করে চিঠি লিখবেন।
                                                             — শান্ত 


এইসব প্রিয় চিঠিপত্রের উল্লেখ যখন করছি, তখন কেবলই আমার কষ্ট হচ্ছে এই ভেবে যে, কেন আমি আমার লেখা চিঠিপত্রের কপি রাখিনি বা অল্প দু-একটি যা রেখেছিলাম, রক্ষা করতে পারিনি সেগুলি। যাইহোক, গতস্য শোচনা নাস্তি।

আমাকে লেখা জয় গোস্বামী এবং শঙ্খ ঘোষের দুটি চিঠি আমি ক'দিন ধরে তন্নতন্ন করে খুঁজছি, কিন্তু পাচ্ছি না। চিঠি দুটি, মনে হচ্ছে, হারিয়েই গেছে। জীবনে পাঁচবার বাড়ি পাল্টাতে হয়েছে আমাকে। বইপত্র এক ঠাঁই থেকে আরেক ঠাঁইয়ে নেওয়ার সময় কতকিছু যে হারিয়েছি, তার ইয়ত্তা নেই। এখন বাধ্য হয়ে বলতে হয় "যাক যা গেছে তা যাক...।"
জয় তখন রানাঘাটেই থাকে। আমাকে একবার পুজোর আগে-আগে বললো, "প্রাণেশদা, আপনি তো জানেন, মা-র মৃত্যুর পর তাঁর ন্যায্য পাওনা ন্যায্য পাওনা প্রভিডেন্ট ফান্ড, গ্র‍্যাচুইটির টাকাপয়সা কিছুই পাইনি আমরা। যতদূর জানি, মা আমাদের দুই ভাইয়ের নামেই (জয়কৃষ্ণ গোস্বামী ও জয়তিলক গোস্বামী) নমিনি করে রেখেছিলেন। তো, এ-ব্যাপারে আপনি একটু সাহায্য করতে পারেন?"
আমি বললাম, "তুমি সামনের সোমবার আমার স্কুলে (কালীনগর হাই স্কুল, কৃষ্ণনগর) বেলা তিনটে নাগাদ এসো, দেখি কী করা যায়।"
আমি যথারীতি শিবুদা (মাননীয় শিবনাথ চৌধুরী) ও শচীনবাবু (শচীন্দ্রনাথ ঘোষ)-কে বিষয়টি বলাতে শিবুদা বললেন, "সে কী কথা! বিখ্যাত স্বাধীনতা সংগ্রামী মধু গোস্বামীর স্ত্রী সবিতা গোস্বামী, তাঁর টাকা আটকে থাকবে কেন!"
আমি বললাম, "মাসিমার বিরুদ্ধে তাঁর স্কুলের (লালগোপাল হাইস্কুলেই মেয়েদের স্কুল হতো সকালে) পরিচালন সমিতি কী সব মামলা-মোকদ্দমা করেছিল; টাকা আটকে আছে।" আরও বললাম, "প্রয়াত সবিতা গোস্বামীর বড়ো ছেলে জয়কে সোমবার স্কুলে আসতে বলেছি, আপনারা দয়া করে বিষয়টা দেখুন।"
শিবুদা ও শচীনবাবু একযোগে বলে উঠলেন, "ঠিক আছে, ডিআই অফিসে জয়কে সাথে করে নিয়ে যাবো, টাকা আদায় করেই ছাড়বো।"
আমি জানতাম, ডিআই অফিসে ওঁদের যথেষ্ট প্রভাব-প্রতিপত্তি আছে, ওখানকার বড়োবাবু আমাদের স্কুলেরই প্রাক্তন ছাত্র। যথাসময়ে জয় আমাদের স্কুলে সেই সোমবার বেলা আড়াইটে নাগাদ এসে বকুলগাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছে। শচীনবাবু তার কাছে গিয়ে বলেছেন, "কী খোকা, কারও সাথে দেখা করবে?"
জয় বলে, "হ্যাঁ স্যার, আমি একটু প্রাণেশবাবুর সাথে দেখা করতে চাই। উনি আমাকে আসতে বলেছেন। আমার মা-র প্রভিডেন্ট ফান্ড ও গ্র‍্যাচুইটির টাকা ডিআই অফিসে আটকে আছে, সেই ব্যাপারেই আমাকে আসতে বলেছেন প্রাণেশদা।"
শচীনবাবু বলেন, "ও, তুমি জয়, রানাঘাট থেকে আসছো? এসো-এসো, স্টাফরুমে বসবে চলো।" এই বলে জয়কে অফিসঘরে বসিয়েছেন।
আমি ক্লাস করে এসে দেখি, ও বসে আছে। ইতিমধ্যে শিবুদাও এসেছেন ক্লাস করে। যাইহোক, জয়কে নিয়ে শিবুদা ও শচীনবাবু হেডমাস্টারমশাইয়ের ঘরে বসলেন। জয় কিছু কাগজপত্র নিয়ে এসেছিল, সেগুলো সে শিবুদাকে দেয়। সবকিছু দেখেশুনে শিবুদা জয়কে আশ্বস্ত করেন। জয়কে নিয়ে আমি কালীনগর বটতলায় এসে চা খাই। তারপর জয় বাড়ি চলে যায়। একমাসের মধ্যে জয় ও তার ভাই সেই টাকা পেয়ে যায়। জয় ও জয়তিলক স্কুলে এসে শিবুদা ও শচীনবাবুকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে যায় বোধহয়, ঠিক মনে নেই আমার। এই টাকা পেয়ে ওদের প্রভূত উপকার হয়। যে-ভাড়াবাড়িতে ওরা ছিল রানাঘাটের সিদ্ধেশ্বরীতলায়, সেটা ওরা কিনে নেয়।

যাইহোক, এরপর জয় হঠাৎ একদিন সন্ধ্যাবেলায় আমার উত্তর সুরভিস্থানের মিলন সংঘের নিকটস্থ বাড়িতে আসে। ওর হাতে 'দেশ' পত্রিকাবিভাগের একটি চিঠি। চিঠিটি জয়কে লিখেছেন 'দেশ' পত্রিকার প্রবাদপ্রতিম সম্পাদক সাগরময় ঘোষ। জয় তখন সাপ্তাহিক 'দেশ'-এ প্রায়ই কবিতা লেখে। সাগরবাবু এই চিঠিতে সামনের শারদ সংখ্যার জন্য জয়কে একটি উপন্যাস লেখার আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। চিঠিটি পড়ে আমি জয়কে বললাম, "বাঃ, এ তো ভালো কথা। লেখো তুমি উপন্যাস।" জয় এর উত্তরে বললো, "শুনুন প্রাণেশদা, এত তাড়াতাড়ি আমি উপন্যাস লিখে উঠতে পারবো না। কিছু সময় লাগবে আমার। এখন আমার শরীর ভালো যাচ্ছে না। সুনীলদা-র (সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়) কাছে যেতে হবে। আপনি চলুন আমার সঙ্গে। আগামীকাল-ই। সুনীলদাকে বলে, সাগরময়বাবুর সঙ্গে একটা সাক্ষাতের ব্যবস্থা করতে হবে। সুনীলদাকে অনুরোধ করবো, উনি যেন সাগরময়বাবুকে বলে দেন, পুজোর পরে উপন্যাস জমা দেবো আমি। পুজোর আগে পারবো না। বুঝিয়ে বলতে হবে। কবিতার জন্য একমাত্র 'দেশ'-ই আমাকে ক'টা টাকা দেয়। শারদ সংখ্যায় উপন্যাস লিখতে পারবো না বলায় উনি যদি 'দেশ'-এ আমার কবিতা লেখা বন্ধ করে দেন! তাহলে তো না-খেয়ে মরবো! ওষুধও কিনতে পারবো না।"

পরেরদিনই ভোরে আমি কৃষ্ণনগর লোকালে রানাঘাট নামি। তারপর জয় ও আমি ভাগীরথী এক্সপ্রেস ধরে কলকাতা যাই—বালিগঞ্জে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বাড়ি। আমি জীবনে এই প্রথম সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে দেখলাম। জয়ের সঙ্গেই তাঁর জরুরি কথা হলো। উনি বললেন, "জয়, সাগরদাকে আমিই বলেছি তোমায় শারদীয় উপন্যাস লেখার কথা বলার জন্য। ঠিক আছে, তুমি এখন যা বলছো সেই কথাটাই সাগরদাকে বলো। বুঝিয়ে বলো; উনি বিবেচক মানুষ আর তুমি তরুণ লেখক, তোমার কবিতা ছাপা নিয়ে অমূলক উদ্বিগ্ন হচ্ছো কেন! তুমি 'দেশ'-এর অফিসে গিয়ে সাগরদা-র সঙ্গে দেখা করো। আমি দুটো নাগাদ অফিসে পৌঁছে যাবো, তারপর তোমার সঙ্গে দেখা ও কথা হবে।"
আমার সঙ্গেও খুবই চমৎকার আচরণ করলেন আমার স্বপ্নের লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। তাঁর সঙ্গে এই সাক্ষাৎ আমার মনে গভীর একটা ছাপ ফেলেছিল। এই অভিজ্ঞতা নিয়ে আমি একটি কবিতাও লিখেছিলাম। কবিতাটি এখানে তুলে দিচ্ছি। এসব তো আমার জীবনেরই অংশ।

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে মনে রেখে
আমি একদিনই আপনার বাড়ি গিয়েছিলাম
অনেক রাতে বাড়ি ফিরে ঘুমোচ্ছিলেন, স্নান থেকে ফিরে
স্বাতী বৌদি বসলেন আর চা-বিস্কুট দিলেন জয় আর আমাকে।
কিছুক্ষণ পর, সকাল ৯টা তখন, ঘুম থেকে উঠে কী শান্ত ভঙ্গিতে
কথা বললেন আমাদের সঙ্গে, মূলত জয়ের সঙ্গেই, কিন্তু আমার
সঙ্গেও যে উষ্ণ আচরণ করলেন তা শুধু একজন কবিকেই মানায়
আপনি বললেন আমার 'যক্ষের গান'-এর কথা, যে কবিতাটি প্রকাশের জন্য
সম্পাদক হিসাবে আপনি নির্বাচন করেছিলেন। আর স্বাতী বৌদিকে যা বললেন
তা আমার কানে এখনও বাজে—'ছেলে দুটো অনেক দূর থেকে এসেছে
ওদের টোস্ট, মিষ্টি দাও, আর শোনো, কাল আম এনেছি
ওদের আম কেটে দিও।' আজ আপনি আর আমাদের মধ্যে নেই
হঠাৎ ঘুমের মধ্যে চলে গেলেন শোকস্তব্ধ শতসহস্র গুণমুগ্ধ আমাদের রেখে।
ফরিদপুরের একজন মানুষ, কত বড় লেখক আপনি
একজন সামান্য তরুণকে কী আন্তরিক কথায় ও আচরণে
চিরদিনের মতো মুগ্ধ করে রাখলেন।

জয় ও আমি 'দেশ'-এর অফিসে যাই। জয় সাগরময়বাবুর সঙ্গে কথা বলে। আমি ততক্ষণ একটা কাচ দিয়ে ঘেরা ঘরে বসে থাকি। এই ঘরটিতে দেখি, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় বসে কাজ করছেন। আর একটি চেয়ার-টেবিল সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের জন্য নির্দিষ্ট। কিছুক্ষণ পরে তিনি এসে বসলেন সেখানে। এর মধ্যে জয়ও সাগরময়বাবুর ঘর থেকে বেরিয়ে এসে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে কথা বলে, আমাকে নিয়ে আনন্দবাজার পত্রিকার সুবিশাল ভবনটি থেকে নির্গত হলো। একসঙ্গে বাড়ি ফিরলাম দু'জন। ও রানাঘাটে নামলো। আমি তো কিছু পরে বাদকুল্লায় নামবো। ট্রেনে আসতে-আসতে জয় আমাকে সব বললো। আপাতত ও উপন্যাস লিখছে না, কিন্তু দুর্গোৎসবের পরপরই যেন ওর উপন্যাস জমা দেয়—এমনটিই বলেছেন সাগরময় ঘোষ। জয়কে ভারমুক্ত মনে হলো। আমার মনে আছে, জয়ের উপন্যাসটি সম্পূর্ণ প্রকাশিত হয়েছিল 'দেশ' শারদীয় সংখ্যার ঠিক পরের সাধারণ সংখ্যাটিতে।
(ক্রমশ)


Comments