প্রাণেশ সরকার

এই ঘটনার মাস ছয়েক পরে জয় একদিন আমাকে কবি শঙ্খ ঘোষের বাড়ি নিয়ে গেল। ওঁর সঙ্গে জয়ের কাজ ছিল। শঙ্খবাবু আমাকেও চিনলেন, কারণ কবি রথীন ভৌমিক এর আগে একদিন আমাকে ওঁর বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিলেন। সকালে গিয়েছি, চা-বিস্কুট দিয়েছেন প্রতিমাবৌদি (শঙ্খবাবুর স্ত্রী)। আমার তো খিদে পেয়েছে।  জয় দুপুরে ওখানেই খাবে। শঙ্খবাবু আমাকেও খেতে বললেন। আমি সবিনয়ে সেই প্রস্তাব খারিজ করে, ওঁর অনুমতি নিয়ে বাড়ির বাইরে এসে এক হোটেলে রুটি-তরকারি খেয়ে, চা-সিগারেট খেয়ে ফিরে এলাম। শঙ্খবাবু জয়কে বললেন, আজ সন্ধ্যায় একটা কবিতাপাঠের আসর আছে। সেখানে অরুণ মিত্র, মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায় ও শঙ্খ ঘোষ কবিতা পড়বেন। বিকালে আমি আর জয় শঙ্খবাবুর সঙ্গে সেই আসরে গেলাম। সেখানে জয় অরুণ মিত্রকে বললো, "রানাঘাটে আপনার একক কবিতাপাঠের আয়োজন করবো আমরা। আপনি কবে যাবেন, বলুন।" অরুণ মিত্র সঙ্গেসঙ্গেই বললেন, "এই রোববারের পরের রোববার যাবো। আমাকে কেউ এসে নিয়ে যেও।" জয় তো খুব উল্লসিত। যাইহোক, কবিতাপাঠের আসর জমে উঠলো। অনেক রাতে বাড়ি ফিরলাম। রানাঘাটে কবিতাপাঠের দিন সকালে অরুণদা-র কুষ্টিয়া হাউজিং এস্টেটের বাড়ি গিয়ে (আমি তো আগেই গিয়েছি কবির বাড়ি এক দ্বিপ্রহর—আমি, রামপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় এবং প্লাবন ভৌমিক; আমাদের প্রত্যেকের জীবনের প্রথম বই ওঁকে দিতে) ওঁকে রানাঘাট নিয়ে আসি। আমার সঙ্গে গৌতম মুখোপাধ্যায়ও (জয়ের একসময়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু) গিয়েছিল। ফাটাফাটি অনুষ্ঠান হয়েছিল। রানাঘাটের চৌরঙ্গী মোড়ে বড়ো একটা বাড়ির বৈঠকখানা-ঘরে অরুণদা কবিতা পড়েছিলেন। ওঁর কবিতাপাঠ শোনা এক বিরল অভিজ্ঞতা। লোক উপচে পড়েছিল। বারান্দায়, রাস্তায় দাঁড়িয়ে, আশপাশের বাড়ির দোতলার ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে মেয়ে-বউরা, অসংখ্য কবিতাপ্রিয় মানুষ আমাদের যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ এক কবির কবিতাপাঠ শুনে ধন্য হয়েছিলেন। বুলা-পর্বের একাধিক কবিতাও সেদিন কী দরদি কন্ঠে যে পড়েছিলেন তিনি! সারাজীবনের এক মহার্ঘ স্মৃতি আমার! কবির জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে আমি একটি কবিতা লিখেছিলাম। কবিতাটি আমার বাংলাভাষার জাদু রোদে ছলকায় কাব্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত। আমাকে রানাঘাট নজরুল মঞ্চে (আহেলি) যেবার মদনমোহন তর্কালঙ্কার সার্ধশতবর্ষ সম্মানে সম্মানিত করলেন স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া, সেদিন আমি কবিতাটি পাঠ করেছিলাম। মঞ্চে উপস্থিত স্বনামধন্য লেখক সুধীর চক্রবর্তী, কথাসাহিত্যিক স্বপ্নময় চক্রবর্তী ও বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক আশীষ লাহিড়ি এবং প্রেক্ষাগৃহে হাজির শ্রোতৃ-দর্শকবৃন্দ কবিতাটির উচ্চপ্রশংসা করেছিলেন মনে আছে। কবিতাটি এখানে তুলে দিচ্ছি।


শতবর্ষে, অরুণ মিত্র-কে
[রানাঘাটের কবিতা পাঠ মনে রেখে]


বজাইদের বাড়ির সামনের বাড়ি, মাঝখানে রাস্তা, সেই বাড়ির
বাইরের ঘরের মেঝেয় কবিতা পড়ছেন, বুলাকে ডাকছেন
এই সব কবিতায় এই সব ডাকে আছড়ে পড়ছে সমুদ্রের জল
আকাশে উড়ে যাচ্ছে হরেক রঙের পাখি, খোলকরতাল
পিয়ানো এ্যাকোর্ডিয়ান, হাল আমলের ব্যান্ডের গান
একসঙ্গে ছুটে যাচ্ছে রোদ্দুরে আর শিশিরের শেষ ফোঁটায়
কমলালেবুর কোয়ায়, আতাফল আর নোনাফলের সুগন্ধি ক্ষীরে।
আর আপনি আপনার কবিতায় দুহাতে করতালি বাজিয়ে
পায়রা ওড়াচ্ছেন আমাদের জং ধরা গলিতে, উপাসনাগৃহে
তরুণ কবিদের শীর্ণ কাঁপা কাঁপা আঙুলে আর ওই চূর্ণি নদীর
খেয়া নৌকার ছেঁড়াখোড়া পালে। আপনার কবিতার গন্ধে
স্ট্র‍্যান্ড রোড থেকে চন্দন, সিদ্ধেশ্বরীতলা থেকে জয়, সিঁথির মোড় থেকে
ভাস্কর চক্রবর্তী, পুরনো কালো বাড়ি থেকে গৌতম
পাগলের মতো ছুটে আসছে এই রাস্তার মোড়ে
আর মিশে যাচ্ছে বুলার হাসির ঝকঝকে পর্দার অন্তরমহলে।
রাস্তায় জড়ো হচ্ছে লোক, দোতলার জানালাদরজা সব খুলে যাচ্ছে
ব্যালকনি ছাপিয়ে উঠছে কিশোরী, তরুণী আর এয়োতির হাসির দমক। আহা
গুমোট অন্ধকারের দিন ও রাত পেরিয়ে তারা সব কবিতার আলোর মধ্যে
প্রাণের ঝরনার মধ্যে প্রবেশ করছে মুহুর্মুহু।
ক্যামেরার ফ্ল্যাশ নেই, চ্যানেলের বাইট নেই, বিরিয়ানি নেই
শুধু এক থালা সাদা ভাত কী আনন্দে নেচেকুঁদে
আপনাকে শ্রী জানাচ্ছে মঁসিয়ে মিত্র।

কবি অরুণ মিত্র-কে আমি কেন জানি না প্রথম সাক্ষাতের পর থেকেই 'অরুণদা' বলে ডাকতাম। আমার প্রথম বই অন্ধকরোটির রেখা-য় একটি কবিতা আছে, 'মোহর' নামে। কবিতাটি পড়ে উনি বলে উঠলেন, "প্রাণেশ এই মোহর কি আমাদের মোহর, অর্থাৎ কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় (প্রখ্যাত রবীন্দ্রসংগীত গায়িকা)?" আমি "না" বলায় সে কী হাসি অরুণদার! এই বয়সে পৌঁছেও কী অনাবিল প্রাণোচ্ছল হাসি যে হাসতে পারতেন কবি অরুণ মিত্র, সর্বজনশ্রদ্ধেয় ও সর্বজনপ্রিয় আমাদের অরুণদা! 


কবি অরুণ মিত্র-র কবিতাপাঠের প্রায় দু'সপ্তাহ পরে কবি শঙ্খ ঘোষ রানাঘাটে কবিতাপাঠ করতে এলেন। জয়ের-ই উদ্যোগে আর চন্দন, অতুল, গৌতম, বজাই, আমি ও জয়ের আরও দু-একজন বন্ধুর ব্যবস্থাপনায়। কবিতাপাঠের ব্যবস্থা হলো চূর্ণী নদী-তীরবর্তী পালচৌধুরী হাইস্কুলের একটি হলঘরে। শঙ্খবাবু নিজেই লোকাল ট্রেন ধরে রানাঘাটে সোজা জয়দের সিদ্ধেশ্বরীতলার বাসায় চলে আসেন। আমরা সবাই একসঙ্গে মেঝেয় বসে ভাত খেলাম দুপুরে। অলোকার (অলোকা ছোটোবেলা থেকেই জয়দের বাড়িতে নিজেদের মেয়ের মতোই লালিতপালিত হয়েছিল মাসিমার তত্ত্বাবধানে) হাতের রান্না চমৎকার। জয়তিলক রানাঘাট বাজার থেকে পদ্মার ইলিশ নিয়ে এসেছিল। অন্যান্য তরিতরকারি, ডাল, ভাত সহযোগে সেই ইলিশ ভাজা, ইলিশের ঘন সর্ষে ঝোল খুবই তৃপ্তি করে খেলেন কবি। অলোকার রান্নার প্রশংসাও করলেন। 


মধ্যাহ্নভোজনের আগে আমাদের সঙ্গে কবিতাপাঠের জন্য নির্দিষ্ট সেই বিশাল হলঘরটিতে আমাদের সঙ্গে গেলেন, মাটির ভাঁড়ে চা খেলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখি, পশ্চিমদিকের বড়ো জানালার শিক ধরে একমনে চূর্ণীকে নিরীক্ষণ করছেন কবি। তাঁর কি পৈত্রিক ভিটার (বরিশাল, অধুনা বাংলাদেশ) নদীর কথা মনে পড়ছিল? তাঁর প্রগাঢ় তন্ময়তা লক্ষ করে আমরা তাঁর পাশ থেকে সরে আসি। তাঁকে বিরক্ত করি না। বেশ কিছুক্ষণ পরে তিনি ঘুরে দাঁড়িয়ে বলেন, "চলুন আমরা বাড়ির দিকে যাই।" তারপর তো দুপুরের খাওয়াদাওয়া সেরে একটু বিশ্রাম করেন। 


বিকাল তখন শেষ প্রহরে গড়িয়ে চলেছে। সন্ধ্যার একটু আগে কবিতাপাঠ শুরু করেন শঙ্খবাবু। কী তন্ময়তার মধ্যে একের পর এক কবিতা পড়তে থাকেন তিনি। তাঁর কবিতাপাঠে বুঁদ হয়ে যাই আমরা সবাই। সুবিশাল হলঘর। পিনপতনের শব্দ শোনা যায়, এমন নৈঃশব্দ্য চারপাশে। তাঁর মগ্ন উচ্চারণে অসামান্য কবিতাপাঠের মূর্ছনা শুধু ভেসে চলে যাচ্ছে ওই ওই চূর্ণী নদীর ছোটো-ছোটো ঢেউ লক্ষ্য করে, নদীতে ভাসমান খেয়াপারাপারের নৌকো লক্ষ্য করে। নদীয়া তো বটেই; সন্নিহিত জেলাগুলি থেকে, এমনকি কলকাতা থেকেও অনেক কবি-সাহিত্যিক ও লিটল ম্যাগাজিনের বন্ধুরা এসেছিলেন শঙ্খ ঘোষের সেই বিরল একক কবিতাপাঠ শুনতে। প্রায় দু'ঘন্টা ধরে তাঁর শ্রেষ্ঠ কবিতাসমূহ পাঠ করেন কবি। মাঝখানে শুধু দশ মিনিটের চা পানের বিরতি। 


রাত আটটা সাড়ে-আটটা নাগাদ আমরা তাঁকে ট্রেনে তুলে দিয়ে আসি। খুব সম্ভবত অতুল কবির সঙ্গে গিয়েছিল তাঁর বাড়ি পর্যন্ত পুষ্পস্তবক, মিষ্টান্ন—এইসব নিয়ে। রাতে সে রানাঘাটে ফিরেও আসে। আমি শঙ্খবাবু চলে যাওয়ার পরপরই আপ কৃষ্ণনগর লোকাল ধরে বাদকুল্লা ফিরে আসি—কী এক ঘোরের মধ্যে, অভূতপূর্ব এক তন্ময়তার মধ্যে। 


রানাঘাটের জন্য জয় এই দুটো ভালো কাজ করেছিল, এখনও মনে হয় আমার। কবি অরুণ মিত্র এবং শঙ্খ ঘোষের একক কবিতাপাঠের আয়োজন। তারপর তো সে স্থায়ীভাবে কলকাতা চলে যায়। আমাদের সঙ্গে তার যোগসূত্র ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে আসে। এর অনেক-অনেক বছর পরে একবার সে রানাঘাটের কোর্টমোড়ে 'কবিমিলন' উৎসবে এসেছিল। কবি ও রানাঘাট মহকুমা শাসক নবীনচন্দ্র সেনের সঙ্গে তরুণ কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যেদিনটিতে দেখা করতে এসেছিলেন মহকুমা শাসকের সরকারি বাসভবনে, সেইদিনটিতে ওই ভবনেই কবিমিলন উৎসব উদযাপিত হতো কবিদের কবিতাপাঠের মাধ্যমে। আমি শ্রোতা হিসাবে ছিলাম একেবারে পিছনের সারিতে। জয় তার রানাঘাটে থাকাকালীন যে-সব কবি-সাহিত্যিক বন্ধুর সঙ্গলাভ করেছিল, তাঁদের উল্লেখ করে তার ভাষণে। যথারীতি আমিও উল্লেখিত হওয়ায় পার্থ চ্যাটার্জি (একসময়ে রানাঘাট পৌরসভার চেয়ারম্যান ও পরবর্তীতে এমএলএ) জয়কে বলেন, "হ্যাঁ, প্রাণেশদা তো আছেন এই সভায়।" পার্থ তার লোকজন দিয়ে আমাকে মঞ্চের কাছে নিয়ে যায়। নিজনদাও (কবি নিজন দে চৌধুরী) সেখানে ছিলেন। আমি নিজনদা-র পাশেই বসি। সভা শেষ হলে জয় নিজনদা ও আমাকে ওর গাড়িতে করে ওদের সিদ্ধেশ্বরীতলার বাড়িতে নিয়ে যায়। অনেক রাত পর্যন্ত গল্প হয়। আমি শেষ আপ কৃষ্ণনগর লোকাল ধরে বাড়ি ফিরি।


সুধীরবাবুর কথা আগেই উল্লেখ করেছি। কৃষ্ণনগর কলেজে আমি ওঁর ছাত্র। অধ্যাপক ও প্রথিতযশা লেখক, লোকগবেষক এবং গান-বিষয়ক একাধিক গ্রন্থপ্রণেতা বরেণ্য এই মানুষটি আমাকে খুব স্নেহ করতেন। তাঁর বাড়িতে আমার অবাধ যাতায়াত ছিল। বৌদিও স্নেহ করতেন আমাকে। সুধীরবাবুকে নিয়ে একটা কবিতা আছে আমার। নাম 'পথে পথে রৌদ্রঝলক'। কবিতাটি স্তম্ভগাথা ও অন্যান্য কবিতা শীর্ষক কবিতাগ্রন্থটিতে অন্তর্ভুক্ত আছে। এ-গ্রন্থটি তাঁকেই উৎসর্গ করেছি। আমি তাঁর প্রথম অনুবাদক। 'লোকায়তের অন্তরমহল' ও 'সে আগুন ছড়িয়ে গেল' শীর্ষক দুটি গদ্য ইংরেজিতে অনুবাদ করি এবং এই অনুবাদ নিয়ে গড়ে ওঠে On Folk-Cult & Rabindrasangeet শীর্ষক বইটি। কলকাতার সোপান পাবলিশার্স বইটি প্রকাশ করে। বইটি আমি উৎসর্গ করি স্যারের স্ত্রী নিবেদিতা চক্রবর্তী-কে। এ-বই প্রকাশের অনেক আগে স্যার তাঁর কবিতার বিচিত্রপথে (সপ্তর্ষি প্রকাশনা) গ্রন্থটি আমাকে উৎসর্গ করেন। উৎসর্গপত্রে লেখা আছে : "কবিতাজীবি শ্রীমান প্রাণেশ সরকার স্নেহভাজনেষু—সুধীর চক্রবর্তী ৮.৭.২০০৬।" আমি এখনও বিস্মিত হই একথা ভেবে যে, এক বরিষণমুখরিত মধ্যাহ্নে রিকশা করে স্যার আমাদের কালীনগর স্কুলে এসে বইটি আমার হাতে তুলে দেন। এর চেয়ে বড়ো পুরস্কার আমি এ-জীবনে পাইনি। ২০১১ সালের মধ্যবর্তী সময়ে 'কবিসম্মেলন' পত্রিকার সম্পাদক কবি শ্যামলকান্তি দাশের অনুরোধে স্যার কুড়ি-বাইশজন বাঙালি কবির জীবন ও কাব্যবিষয়ে 'কবিতার খোঁজে' শিরোনাম দিয়ে বাইশটি প্রবন্ধ লেখেন। ওই প্রবন্ধসমূহের মধ্যে 'অন্ধপাহাড় আর স্মৃতিময় করোটি' আমাকে নিয়ে লেখা। ওই লেখাগুলি নিয়ে কবিতার খোঁজে নামেই একটি বই প্রকাশিত হয় (পত্রলেখা, কলকাতা) ২০১২ সালে। বইটির ভিতরের কভারে লেখা আছে—'কবিতার খোঁজে' শিরোনামে প্রকাশিত 'কবিসম্মেলন' পত্রিকার বাইশটি রচনা থেকে কুড়িটি লেখা নিয়ে এই বইয়ের বিন্যাস। আলোচিত কবিদের নাম শীতল চৌধুরী, প্রণবকুমার মুখোপাধ্যায়, আনন্দ বাগচী, অরবিন্দ গুহ, সুনীলকুমার নন্দী, সঞ্জয় ভট্টাচার্য, সুধেন্দু মল্লিক, সুজিত সরকার, অনির্বাণ ধরিত্রীপুত্র, হেমচন্দ্র বাগচী, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, সুকুমার ঘোষ, প্রাণেশ সরকার, তপন ভট্টাচার্য, জলধি হালদার, কুমুদরঞ্জন মল্লিক, ফরহাদ মজহার, রাজা মিত্র ও শিশিরকুমার দাশ। বিচিত্রস্বভাবী ও নানাবয়সী এই সব চেনা, আধোচেনা আর না-চেনা কবি ও কবিতার কথা এত অন্তরঙ্গ ভাষায় ও মরমি অবলোকনে আগে পাওয়া যায়নি। দুই মলাটের বন্ধনে উদভাসিত বাংলা কবিতার এক অনাস্বাদিত অন্তর্বার্তা।

এও একটা বড়ো পুরস্কার আমার সামান্য লেখালেখির জীবনে। সুধীর চক্রবর্তীর ৭৫ বছর বয়স পূর্তি উপলক্ষে 'অক্ষরেখা' পত্রিকা একটি বিশেষ সম্মাননা সংখ্যা প্রকাশ করে। সম্পাদক নীলকমল সরকার বাদকুল্লার-ই মানুষ। স্যারের বিশেষ স্নেহধন্য তিনি। এই পত্রিকায় স্বভাবতই স্যারকে নিয়ে অনেক স্বনামধন্য কবি ও লেখক কবিতা ও প্রবন্ধ লেখেন। পত্রিকার প্রথমদিকে চারটি কবিতা আছে। কবিতাগুলির লেখক যথাক্রমে প্রাণেশ সরকার, দিনেন্দ্র চৌধুরী, জহর সেন মজুমদার ও অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত। জহর আমার দীর্ঘদিনের বন্ধু। কবি ও অধ্যাপক। আমার চেয়ে বয়সে কিছু ছোটো। কিন্তু অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত, দিনেন্দ্র চৌধুরী—এঁরা তো অনেক সিনিয়র। সবার আগে আমার কবিতা! সম্পাদককে জিজ্ঞেস করতেই সে হেসে বলে, "কবিতাগুলো স্যারের সাজানো। আমার কোনো হাতযশ নেই এখানে।" এটাও এক পুরস্কার তো বটেই। আমি কবিতাটি এখানে তুলে দিচ্ছি। 

পথে পথে রৌদ্রঝলক
[শ্রী সুধীর চক্রবর্তী-কে]

পথে পথে রৌদ্রঝলক। পথে পথে বৃষ্টির তান। এর মধ্যে হাসিখুশি মুখে
ঘুরে যাচ্ছ এ-পাড়া সে-পাড়া।
তোমার মাথার মধ্যে গান। তোমার বুকের মধ্যে গান। গানের এ-পাশে
ও-পাশে বেজে উঠছে চেনা একতারা।
আমাদের চেনা পথ থেকে। আমাদের কোলাহল থেকে। তোমার দিগন্ত
বহু দূর।
কাঁকরের পথ থেকে পথে। আখড়ার পথ থেকে পথে। বেজে ওঠে
লালনের সুর।
কত পাখি কাটুম-কুটুম। কত নদী ছলাৎ-ছলাৎ। নদীতীরে এয়োতির দল
কোলেকাঁখে মঙ্গলঘট।
বটের ঝুরির নিচে মেলা। পাকুড়ের ছায়া যত দূর। আলোছায়া গায়ে
মেখে নিয়ে কারা যেন সাজিয়েছে পট।
ধুলোপথ বাঁশঝাড়ে মেশে। পথে পথে মহোৎসব কত। ঝিকিমিকি
তারাদের হাতে সেজে ওঠে পৌষালি রাত।
মাটির দাওয়ায় এসে বসো। ফকিরের কথা নোট করো। লম্ফের শিখা
কেঁপে ওঠে। আদরের ডাল আর ভাত।
পথে পথে কত দিন গেল। ধুলিমাখা রাত যায় কত। শিশিরের টুপটাপ ঝরে
ফসলের মাথায় মাথায়।
আজ সেই বাদলসন্ধ্যার বোল ওঠে দেশে দেশে আর রৌদ্রঝলক মায়াময়
তোমাকেই ঘিরে গান গায়।

কবিতাটি পড়ে স্যার ও বৌদি দু'জনেই খুশি হয়েছিলেন। স্যারের ঘরে বসে চা খাচ্ছিলাম তিনজন। স্যার, বৌদি ও আমি। স্যার চা খেতে-খেতেই কবিতাটি শুনে আনন্দ প্রকাশ করলেন। কবিতাটি যে-গ্রন্থে সন্নিবেশিত হয়েছে, অর্থাৎ স্তম্ভ-গাথা ও অন্যান্য কবিতা এবং আমার প্রথমদিকের আরও ছ'টি বই অর্থাৎ মোট সাতটি বই নিয়ে অতি সম্প্রতি আমার কবিতাসংগ্রহ ১ প্রকাশ করেছেন 'ধানদূর্বা' পত্রিকার সম্পাদক তথা শান্তিপুর কলেজের বাংলা বিভাগের তরুণ অধ্যাপক শ্রীমান অসীম সরকার। তাঁকে প্রকাশনার কাজে সাহায্য করেছেন আর এক তরুণ কবি, শান্তিপুরের-ই বাসিন্দা, শ্রীমান অভিমান্য পাল। 'একালের কবিকণ্ঠ' পত্রিকার সম্পাদক। আমার দুঃখ, বইটি আমি স্যারের হাতে তুলে দিতে পারলাম না।
(ক্রমশ)

Comments