সোমা দত্ত

হাতড়ে-হাতড়ে দেওয়াল ধরে-ধরে এগোচ্ছি। কালো সুড়ঙ্গ। অন্ধকার...প্রাচীন অন্ধকার। গুমোট, গন্ধহীন শূন্যতা। শরীর হালকা এবং বহুধাবিভক্ত। দিকগ্রাহ্যতা নেই। ডাইমেনশন নেই। সলিডিটি নেই সলিডারিটিও নেই। একটি নন-ডিরেকশনাল হাইপোথিসিস। অনুমান—যার কোনো প্রামাণ্য শর্ত নেই। যেন এক ভাসমান সান্দ্র অবস্থা। পারদের কেরামতি। কেন্দ্রাতিগ বলের টান বিচ্ছিন্ন এক ভারসাম্যহীনতা। গতি আছে কিন্তু অগ্রগামী অস্তিত্বের চেতনা নেই। পিছিয়ে পড়ার বোধ নেই। অগ্র অথবা পশ্চাৎ পুরোটাই যেন এক সমাবর্তনের উদ্যোগে সামিল হওয়া মহাবিশ্বের স্ট্যাটিক অস্থিরতা। প্রবল বেগবান ক্যাওস। 
এই কি পিশাচতন্ত্র তবে? 

বহুদূরে একটি দেহ পড়ে আছে। বহুদূরে হাতছানি। মায়াবিহ্বলতা। ব্যথা-রঙ। দৃশ্য, যা মনোজাগতিক চেতনা। মন, যা এ-মুহূর্তের ভাষাহীন অবস্থার নাম এবং ঠিকানা। দৃষ্টি গিলে বয়ান করছে ঘটনা। যেন সমগ্র আমি দৃশ্যের ভিতর থেকে বাইরে যাতায়াত করছি। যেন সমগ্র আমি দৃষ্টিগত উপলব্ধি। সে-দৃষ্টির সীমাহীনতা আমাকে অপার করে তুলেছে। কোনো ভেদ্য বা অর্ধভেদ্য পর্দার আড়াল আমাকে সীমিত করতে পারবে না। পৃথিবীর ব্যাসার্ধ এবং আমার কাঙ্ক্ষিত উচ্চতার সোনালি অনুপাত ভেঙে গেছে।অভিকর্ষজ ত্বরণ আমার গতিকে নির্ণয় করতে পারে না। অদূরে পড়ে থাকা দেহটি আমার অথচ আমার না। দেহের উপরে যন্ত্রণার চিহ্ন, যার প্রতি আমি নিরাসক্ত। দেহ কী দিয়েছিল আমাকে? নিপাট সীমাবদ্ধতা। স্বৈরাচার। লটারির খেলা। উৎকৃষ্ট এক দেহবল্লরী নির্ধারণ করে তোমার সৃজনভঙ্গিমা। দেহ তোমার বিক্রয়মূল্য নির্ণীত হওয়ার সারসত্য। দেহহীন মুক্ত অবয়ব বিপ্লবের স্ব-নির্ণীত ফলাফল। 

ওই দেহ তোমাদের অনুপমা। তোমাদের সমাজসন্ধানী সুযোগ্য দৃষ্টির ফাঁকি ওই দেহ। ওই দেহ তোমাদের পাশবিক গোষ্ঠীচেতনা, ভোটব্যাঙ্ক; ওই দেহ তোমাদের মৃত মন, শর্তসাপেক্ষ কান্না। এতদূর এসে এই গতিশূন্য সাবেক নিরাকার অবস্থান থেকে তোমাদের কালো পিঁপড়ের মতো সমাবেশ আলোকিত করে এক মহান ইউটোপিয়া। আমি দেখি তোমাদের নৃত্যতাৎপর্যের শৈলী। আমি দেখি তোমাদের জীবনমুখী বসন্ত। আমি দেখি শুধুমাত্র জন্ম দেবে বলে তোমাদের আকিঞ্চন ভালোবাসা, কামনাপ্রবৃত্তি। দেখি মানুষ ও পশুর সহাবস্থানের উপরেই তোমরা নিয়ন্ত্রণ রেখেছো। আমি দেখি নিরীহ শুয়োরের দল তোমাদের ডিঙিয়ে যাত্রা করেছে বনজ সম্পদের দিকে। তোমরা শহর ভেঙে ফেলছো দুইহাতে। দলগত বিস্ফোরণ তৈরি করে উড়িয়ে দিচ্ছ ক্ষুদ্রস্বার্থ। ভেঙে দিচ্ছ সুস্থ লগারিদম, ভেঙে দিচ্ছ যুগ্মসংখ্যা। এই অন্ধকার সুড়ঙ্গ থেকে ঢের বেশি কালো তোমাদের নেতৃত্বহীনতা। অনুপমা ব্যক্তির স্বাধীনতা ধারালো দাঁতে চিবোয় তোমাদের রাষ্ট্রের জন্তুপ্রবণতা। আমি অনন্ত কুয়োর অন্ধকার থেকে দেখি, ওই খর্বাকৃতি, কৃশকায়, স্থূলবুদ্ধিসম্পন্ন শুয়োরের দল থেকে জন্ম নিচ্ছে বিপরীত বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন অজস্র শুয়োরের বাচ্চা।

এইখানে স্মৃতিবিহ্বলতা স্পর্শ করে মহাজাগতিক অঙ্কে। এইখানে প্রবল ঘূর্ণন। সাঁতরে ফিরে চলেছি নিজের আদি অস্তিত্বের লগ্নে। জরায়ুর ভাঙন এবং নাড়ির কৃচ্ছসাধনা। পুষ্টি এবং জন্মগত কান্না। মানুষের অবনতি পৃথিবীর মাটিকে ছোঁয়ামাত্র জেগে ওঠে। সম্পৃক্ত হতে চায় দ্রবণে। আমি তার উপলব্ধ এক বেবাক জন্মকণা। জন্মক্ষণে  আমাকে ঘিরে ছিল সংবেদনশীল মাতৃরেণু। একটি ইউটোপিয়ান ভঙ্গুর প্রাণের অবয়বে আমি একটি দেহগত ভারসাম্য রক্ষা করতে শিখেছিলাম। তারপর ধীরে-ধীরে সমাজ এবং সামাজিক অর্ধচেতন অবস্থান আমাকে চেনালো সংখ্যার তাৎপর্যগণিত। মানুষ থেকে উন্নততর মানুষ হওয়ার মধ্যবিত্ত তাড়না। প্রাথমিক সত্য এবং মিথ্যার প্রভেদ। ন্যায় এবং অন্যায়ের পাশাপাশি টিকে থাকার যৌক্তিক অবস্থান। জনারণ্যের ভিড়ে একটি একক ফুল হয়ে ফুটে থাকা। এবং আমি দেখতে পাচ্ছি আমি এবং ফুটে থাকা অগণিত শতদল-জীবনের প্রাইমারি প্রয়োজন ছিল জীবনকে উন্নত করা। দেহগত ওই জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল একটি গণতান্ত্রিক সমাজচেতনার উন্মেষ রক্ষা করে চলা। যাতে কোনো অনুন্নত অভিযোজন মানুষকে বিকৃত করতে না-পারে। অথচ যথারীতি প্রবৃত্তি পরাস্ত করেছে মানুষকে। যথারীতি উন্মেষের পেটে লাথি মেরে পুঁজিবাদ, মৌলবাদ আর মানুষের চেতনার খুন...

হেমন্তের অরণ্যে আমি একা পোস্টম্যান হয়ে চিঠি বিলি করেছি মানবিক সৌজন্যে। এবং এই সৌজন্যবাদ আমাকে দুর্ঘটনায় পর্যবশিত করেছে ধীরে-ধীরে। একটি সাল-তারিখ আর স্মৃতির পাশে আজীবন কিলবিল করে যাবে তোমাদের অরাজনৈতিক সন্ত্রাসহীনতা। তোমরা স্বীয় দুঃসময়ের বুকে জ্বলে ওঠা মোমবাতি। 

দুর্ভাগ্যজনিত কারণে লিঙ্গসমতা পৃথিবীতে একটি হাস্যকর তত্ত্বের অবতারণা। যে-হাঁস মেরে মাংস খাবো, আমি তাকে সমতা দেব কোন প্ৰকরণে! অতএব এই বৈষম্যসৃষ্টিকারী রাজনীতি ওরা তৈরি করেছিল প্রাণের নির্দিষ্টকরণে। ডিভাইড অ্যান্ড রুল আসলে একটি জেন্ডার পলিটিক্স। বিনাশবুদ্ধি এবং ধ্বংসচেতনা। সেখানে আমি একটি তুলনামূলক জীববিদ্যাজনিত কারণে দুর্বল অথচ অতি-প্রয়োজনীয় সেক্সুয়াল উপকরণ। তাই দুর্ঘটনার সঙ্গে জুড়ে গেছে ধর্ষণ এবং খুনের ঘটনা। ওই দ্যাখো আমার নিষ্ক্রিয় নারীদেহ জুড়ে কারা অবতারণা করতে চাইছে নতুন যুগের। দেখা যায় মিশ্র অভিযোজনের সম্ভাবনা। সুড়ঙ্গের গভীরে প্রাচীন অর্থহীনতার সত্যে আমি মিশে যাই সমষ্টিগত চেতনার ব্রহ্মে লীন হতে!

Comments

  1. এক স্বয়ংক্রিয় মনন বিদ্রোহ stream of consciousness এর প্রতিফলন ঘটেছে। তা লেখাটি চুম্বকের মতো স্পর্শতুর ও মগ্নতা দাবি করে।

    ReplyDelete

Post a Comment