নিতাই ভট্টাচার্য

"একজন ভদ্রলোক ওই চেয়ারটায় বসেছিল একটু আগে। এখন দেখছি নেই। ওনাকে বাইরে যেতে দেখেছেন আপনি?" গ্রাউন্ড ফ্লোরে এসে অতীনকে দেখতে না-পেয়ে গেটের সিকিউরিটিকে জিজ্ঞাসা করে তিতাস।
"কোথায় বসেছিল?" জিজ্ঞাসা করে সিকিউরিটি।
"ওই সামনের চেয়ারে। হাতে এমআরআই রিপোর্টের প্যাকেট ছিল।"
"কী পরে আছে বলতে পারবেন?"
"সাদা পায়জামা আর পাঞ্জাবি।" সিকিউরিটিকে বলে তিতাস।
"না দাদা, স্যরি। সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবি পরে রয়েছে এমন কাউকে বের হতে দেখিনি। তবে কত মানুষ আসছে-যাচ্ছে, সবার খেয়াল রাখা তো সম্ভব নয়! আমার ভুল হতেই পারে।" সিকিউরিটি ভদ্রলোক নরম গলায় বলে। 
"মানে? ডিউটি করছেন, এইটুকু খেয়াল করবেন না! একজন অসুস্থ মানুষ একলা ক্লিনিকের বাইরে চলে যাচ্ছে; আপনি জিজ্ঞাসা করবেন না, সে কোথায় যাচ্ছে? আশ্চর্য!" ভীষণ উত্তেজিত হয়ে কথাগুলো বলে তিতাস। সিকিউরিটি ভদ্রলোক কয়েক মুহূর্ত চেয়ে থাকে তিতাসের দিকে। বলে, "আপনাকে দেখে ভীষণ টেন্সড মনে হচ্ছে। শান্ত হয়ে আশপাশের লোকজনকে জিজ্ঞাসা করুন ভাই; একটা মানুষ কি হারিয়ে যাবে! দেখুন এখানেই কোথাও আছেন।"
"আমি শান্ত আছি। ঠিকভাবে ডিউটি করুন আপনি।" মেজাজ হারিয়ে গলা তুলে বলে তিতাস।
সামনের চেয়ারে বসে আছেন এক ভদ্রমহিলা। এইবার তাঁকে জিজ্ঞাসা করে তিতাস।
"হ্যাঁ, এখানেই ছিল। পরনে সাদা পাঞ্জাবি। কে হন উনি?"
"আমার বাবা", বলে তিতাস।
"চেয়ার ছেড়ে উঠে লিফটের গেটের দিকে হাঁটা দিল বলে মনে হলো। আপনি লিফটম্যানকে জিজ্ঞাসা করুন প্লিজ।"
মহিলার কথা শুনে উদভ্রান্ত হয়ে ছুটে যায় তিতাস লিফটের দিকে। জিজ্ঞাসা করে লিফটম্যানকে সাদা পাঞ্জাবি পরা কেউ একটু আগে লিফটে উঠেছিল কিনা।
"হ্যাঁ, সম্ভবত ফার্স্ট ফ্লোরে গেলেন।" তিতাসকে বলে লিফটম্যান। "চলুন না ভাই ফার্স্ট ফ্লোরে", বলে তিতাস।
খানিক আগেই অতীনকে দেখেছেন ডাক্তারবাবু। তারপর ওষুধ নিতে ফার্স্ট ফ্লোরের ফার্মেসিতে এসেছিল তিতাস। অতীন তিতাসের সঙ্গেই ছিল। সেই সময় ফোন করেছিল সুমন। অতীনকে দেখে ডাক্তার কী বললেন, জানতে চাইছিল। তিতাসের কথা বলার ধরন শুনে সুমন বলে, "তুই অত টেনশন করিস না। কুল। সময় লাগবে একটু। কাকু সুস্থ হয়ে উঠবে। আই অ্যাম অন দ্য ওয়ে। আসছি।"
শেষ মাস দুয়েকের চিকিৎসায় কোনো উন্নতি হয়নি অতীনের। সেই জন্যই কলকাতায় নিয়ে আসার পরামর্শ দিয়েছিল সুমন। আজ এই পলিক্লিনিকে অতীনকে ডাক্তার দেখানোর ব্যবস্থা সুমনই করেছে।
সুমনের সঙ্গে কথা বলতে-বলতে ওষুধের বিল পেমেন্ট করে তিতাস। ওষুধগুলো নিয়ে নেয় ব্যাগে। তারপর গ্রাউন্ড ফ্লোরে এসে মনে পড়ে অতীনের প্রেসক্রিপশনটা ফেরত নেওয়া হয়নি ফার্মেসির কাউন্টার থেকে।
"তুমি এইখানে বসো। আমি ফার্মেসি থেকে তোমার প্রেসক্রিপশনটা নিয়ে আসি।"
অতীনকে গ্রাউন্ড ফ্লোরে রিসেপশনের সামনে বসিয়ে দিয়ে ফার্মেসির কাউন্টারে গিয়েছিল তিতাস। প্রেসক্রিপশন নিয়ে ফিরে এসে দেখে অতীন নেই। 
ফার্স্ট ফ্লোরে আসে তিতাস। ভালো করে দেখে চারপাশ। না, অতীন নেই। টয়লেটে যায়। সেখানে সাদা পাঞ্জাবি পরা এক ভদ্রলোক রয়েছেন, তিনি অতীন নন। 
সেকেন্ড ফ্লোরে পেশেন্ট দেখেন পলিক্লিনিকের সমস্ত ডাক্তার। পরপর বেশ কয়েকটি ঘরে নিউরো-মেডিসিন, নিউরো-সাইক্রিয়াটিক বিশেষজ্ঞ ডাক্তার বসেন। আজ সকাল থেকে প্রায় ঘণ্টা দেড়েক অতীনকে সঙ্গে নিয়ে সেখানে বসেছিল তিতাস। ফার্স্ট ফ্লোরে অতীনকে খুঁজে না-পেয়ে সিঁড়ি দিয়ে তাড়াতাড়ি সেকেন্ড ফ্লোরে উঠে আসে। দু'জন সিস্টার বসে রয়েছেন সেখানে। অতীনের কথা জানতে চায় তিতাস তাঁদের কাছে। না, এখানেও আসেনি অতীন। তাহলে? সেকেন্ড ফ্লোরের টয়লেটে যায় তিতাস। সেখানেও নেই অতীন। দুশ্চিন্তার মেঘ জমে মনে। ভারী হয়ে আসে মাথা। এইবার কোথায় খুঁজবে? ফিরে আসে রিসেপশনে। প্রচুর লোকের ভিড়। চেয়ে দেখে চারপাশ। কোথাও নেই অতীন। মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যে কোথায় চলে গেল! বুঝতে পারে না তিতাস। হতবুদ্ধি অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ। তিতাসকে দেখে দ্রুত এগিয়ে আসে লিফটম্যান। বলে, "আপনার বাবার সঙ্গে ফোন নেই দাদা? ফোন করলেই তো মিটে যায়।"
তাই তো, কথাটা মাথাতেই আসেনি! আজকাল এমন হয় মাঝেমধ্যেই। পরিস্থিতি অন্যরকম হলেই স্বাভাবিক বোধবুদ্ধি কেমন স্থবির হয়ে আসে তিতাসের। অস্বাভাবিক টেনশনে সব কিছু তালগোল পাকিয়ে যায়।অতীনকে ফোন করার কথাটা মাথায় আসা উচিত ছিল আগেই।
অতীনের সঙ্গে ফোন আছে। ফোন করে তিতাস। রিং হচ্ছে। বেজেই চলে ফোন। ফোন ধরছে না অতীন। আবারও ফোন করে। একটানা রিং হয়ে চলে। পরপর বেশ কয়েকবার অতীনের নম্বরে ফোন করে তিতাস। কোনো উত্তর নেই অতীনের তরফে। একরাশ উদ্বেগ বুকে নিয়ে নিজের ফোনের দিকে তাকিয়ে থাকে তিতাস। বুকের ভিতর কে যেন হাতুড়ি পিটাচ্ছে। রগের শিরাগুলো একযোগে দপদপ করেছে, শিরা ছিঁড়ে রক্ত বাইরে আসবে বুঝি। দু'চোখে শুরু হয়েছে যন্ত্রণা। মাইগ্রেন। কাল রাতেও ঘুমাতে পারেনি তিতাস। সপ্তাহ দুয়েক ঘুম নেই তিতাসের চোখে। পাগল-পাগল লাগছে নিজেকে। নিজের উপর নিজের রাশ কেমন যেন পলকা হয়ে আসছে।
ইদানিং রাত হলেই অতীনকে নিয়ে দুশ্চিন্তার প্রহর গোনা শুরু হয় তিতাসের। রোজ রাতে জেগে থেকে এমন-এমন কাণ্ড বাঁধাবে অতীন, সেইসব দেখে সারা রাত জেগেই কাটায় তিতাস।
গতকাল রাতে খাওয়াদাওয়ার পরে খাতা দেখতে বসে ছিল তিতাস। স্কুলের টেস্ট পরীক্ষার খাতা জমা দেবার শেষদিন এগিয়ে আসছে। ক্লাস টেন আর টুয়েলভ মিলে খাতার সংখ্যাও কম নয়। একমনে উত্তরপত্র মূল্যায়নে ব্যস্ত ছিল তিতাস। খেয়াল ছিল না রাত দুটোর ঘরে পা রেখেছে ঘড়ির কাঁটা। কিসের একটা শব্দ আসে কানে। মনসংযোগ ছিন্ন হয়। ড্রইংরুমে কেউ যেন রয়েছে। ঘরের বাইরে আসে তিতাস। আলো জ্বেলে দেখে টিভির রিমোট হাতে নিয়ে সোফায় বসে অতীন। "অন্ধকারে কী করছো তুমি?" জিজ্ঞাসা করে তিতাস। 
"বাইরে ভীষণ ঝোড়ো হাওয়া দিচ্ছে বাবু। মনে হচ্ছে, নিম্নচাপ তৈরি হয়েছে। খবরে কী বলে একটু শুনবো।" বলে অতীন। 
"কোথায় ঝোড়ো হাওয়া? ওঃ, তুমি যে কী করো না বাবা! চলো, শোবে চলো।" অতীনকে সঙ্গে নিয়ে বড়োঘরে আসে তিতাস। বলে, "দ্যাখো, মা ঘুমাচ্ছে। তুমিও শুয়ে পড়ো। কাল সকালে খবর শুনবে।"
শুয়ে পড়ে অতীন। ড্রইংরুমের আলো অফ করে নিজের ঘরে ফিরে আসে তিতাস। 
অতীন আর তিতাসের কথার চোটে বিপাশার ঘুম ভেঙে গেছে। "তোমাদের জ্বালায় রাতেও ঘুমাতে পারবো না একটু। সারাদিন চলছে! রাতেও শান্তি নেই!" বিপাশার গলায় অভিযোগের সুর। মিথ্যা নয় সে-অভিযোগ। সারাদিন চাকরি করে সংসার সামলানো, কম কথা নয়। যতই কাজের লোক থাকুক না কেন। তার উপর পিকলু রয়েছে। পাঁচ বছরের বাচ্চা। তার ঝক্কিও যথেষ্ট। আর তিতাসের মা সারাদিন ব্যস্ত অতীনকে সামলাতে। বিপাশার কথা ভেবে খারাপ লাগে তিতাসের।                
"স্যরি, তুমি ঘুমাও।" বলে তিতাস। ঘরের আলো অফ করে জানালার সামনে এসে দাঁড়ায়। এলোমেলো ভাবনাগুলো রাতজাগা পাখির মতো উড়তে থাকে অন্ধকারে, দিশাহীন। আজ মাস দুয়েক বাবাকে নিয়ে মনের দুর্ভাবনা সারাদিন তাড়িয়ে নিয়ে চলে তিতাসকে। আতঙ্ক হয়েছে সর্বক্ষণের ছায়াসঙ্গী। ভীষণ টেনশন হয় বাবা আর মায়ের কথা ভেবে। মাঝেমাঝে নিজের উপর নিজেরই নিয়ন্ত্রণ থাকে না। সামান্য কথাতেই মেজাজ হারিয়ে ফেলে। অহেতুক বিতর্ক-বিবাদ ডেকে আনে। নিজেকেই মানসিক রোগী মনে হয় আজকাল। নিজের কথা বলেছিল সুমনকে। "অত ভাবিস না তিতাস। সব ঠিক হয়ে যাবে। বিশ্রাম নে ভালো করে।" কয়দিন আগেই বলেছিল সুমন। সুমন প্রায়ই ফোন করে তিতাসকে। খবর নেয়। সবসময় শান্ত থাকতে বলে। বাবার জন্য মনের শান্তি কবেই উবে গেছে তিতাসের। মাও অসুস্থ হয়ে পড়েছে। শান্ত থাকবে কীভাবে!
মানসিক সমস্যায় ভুগছে অতীন। ব্রেইনের সিটি স্ক্যান, এমআরআই—সব করা হয়েছে। সমস্যা আছে। শ্রীরামপুরের একজন ডাক্তার দেখেছেন অতীনকে। তবে এই কয়মাসে অবস্থার উন্নতি নেই কোনো। 
অতীন এখন বাষট্টি। হঠাৎ করেই নিউরো-সাইক্রিয়াটিক সমস্যা জাপটে ধরেছে। কথা মনে রাখতে পারে না। অসংলগ্ন কথা বলা প্রায়শই। ইদানিং আবার মাঝেমধ্যেই সারারাত না-ঘুমিয়ে কাটায়। কিছুক্ষণ পরপর টয়লেটে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে চুপটি করে। কী যেন ভাবে। নয়তো  টিভির সামনের সোফায় বসে থাকে চুপটি করে। চেয়ে থাকে বন্ধ টিভির দিকে। নিম্নচাপ আসছে, কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই নাকি বৃষ্টি হবে, ঝোড়ো হাওয়া আর ভারী বর্ষণে বিপর্যস্ত হবে জনজীবন। সেটাই শুনবে অতীন খবরে। কাল রাতেও বসে ছিল অন্ধকারে।
জানালার সামনে থেকে সরে এসে চেয়ারে বসে তিতাস।গোটাচারেক খাতা বাকি ছিল তখনও। সেগুলোর দিকে মনোযোগী হয়েছিল। বিপাশা ঘুমাচ্ছে পিকলুকে পাশে নিয়ে। হঠাৎ কানে আসে, "বাবু"। চমকে উঠেছিল তিতাস। অতীনের গলা। দ্যাখে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে রয়েছে অতীন। "আবার উঠে এলে কেন?" নিচুগলায় জিজ্ঞাসা করে তিতাস। 
"বলছি তুই শুয়ে পড় বাবু। নয়তো তোর মায়ের ঘুম ভেঙে যাবে।" বলে অতীন। 
"ঠিক আছে। তুমি উঠলে কেন? মাকে ঘুমের ওষুধ দিয়েছি। সকালের আগে উঠবে না।" বলে তিতাস। অতীনকে সামলাতে-সামলাতে সুরমাও অসুস্থ হয়ে উঠেছে। ডাক্তার বলেছে বিশ্রামের প্রয়োজন সুরমার। রাতের দিকে ঘুমের ওষুধ খেতে হয় সুরমাকে।
"তুমি শোবে চলো", বলে তিতাস। অঘোরে ঘুমাচ্ছে সুরমা। সুরমার পাশে শুয়ে পড়ে অতীন। "ঘুমাও", বলে বাইরে আসে তিতাস। "বাবু", আবার তিতাসকে ডাকে অতীন। ঘরের ভিতরে আসে তিতাস। হাত রাখে অতীনের মাথায়, বলে "তুমি ঘুমানোর চেষ্টা করো বাবা।" 
নিজের হাতের মুঠোয় তিতাসের হাতটা চেপে ধরে অতীন। বলে, "কাল যেন বাইরে কোথাও যাস না বাবু। ঝোড়ো হাওয়া দিচ্ছে খুব। নিম্নচাপ উঠবে। তুই কোথাও গেলে আমার চিন্তা হয় বড্ড।" চোখে জল আসে তিতাসের, বাবার আচরণ দেখে। এমন কথা আজ বেশ কয়মাস ধরে বলে আসছে অতীন। শোনে তিতাস। অতীনের মানসিক ভারসাম্যহীনতার সুস্পষ্ট বহিঃপ্রকাশ। খারাপ লাগে শুনে। কী আর করা যাবে! শান্ত থাকবার চেষ্টা করেছে এতদিন। ইদানিং আর নিজেকে ধরে রাখতে পারে না তিতাস। অতীনের এমন কথা শুনলে যন্ত্রণার চোরাস্রোতে ভেসে যায়। তুমুল বিপণ্ণতা গ্রাস করে। অমন সুন্দর মানুষটা কেমন হয়ে গেল এই কয়মাসে! কয়দিন আগে এই নিয়ে কথা হয়েছিল সুমনের সঙ্গে। "তুই দিন-দিন মনোরোগী হয়ে উঠছিস তিতাস। নিজের মন শক্ত রাখ। ঝড়ঝাপটা তো আসবেই জীবনে। নিজে ঠিক না-থাকলে সবাইকে নিয়ে চলবি কীভাবে? যা হবার হবে। তুই ভেবে কী করবি! ভাবিস না বেশি।" পরামর্শ সুমনের। চেষ্টা করে তিতাস নিজেকে শক্ত রাখবার। পারে না আর। অতীনকে দেখলেই উবে যায় মনের জোর। অতীনের গায়ে-মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় তিতাস। ঘুমিয়ে পড়েছিল অতীন। নিজের ঘরে ফিরে আসে তিতাস। বিছানায় এপাশ-ওপাশ করে। এরপর আর ঘুম আসেনি গতকাল রাতে। 
"আপনার বাবাকে পেলেন দাদা?" জিজ্ঞাসা করে লিফটম্যান। 
"না, ফোন বেজেই চলেছে। ধরছে না।" বলে তিতাস। "আপনি গেটের বাইরে গিয়ে একবার দেখুন দাদা। হয়তো আশেপাশেই কোথাও আছেন।"
দ্রুত পলিক্লিনিকের বাইরে আসে তিতাস। হাজার মানুষ আর গাড়ির প্রবাহ। কে রাখে অতীনের খবর। রাস্তার ওপাশে একটা চায়ের দোকান। দোকানদারকে অতীনের কথা জিজ্ঞাসা করে তিতাস। "না দাদা, ওইভাবে কারোর খেয়াল রাখা সম্ভব নয়।" রাস্তা ধরে সামনে এগিয়ে যায় তিতাস। মনের মধ্যে ঝড় ওঠে। অতীনকে নিয়ে এক অদ্ভুত সমস্যায় পড়েছে তিতাস। জানে না, এর হাত থেকে মুক্তি মিলবে কীভাবে। অতীন কি আদৌ সুস্থ হবে আর? কে জানে! ডাক্তার বলেছে সময় লাগবে সুস্থ হতে।
রাস্তার দু'পাশে অনুসন্ধানী দৃষ্টি রেখে পথ হাঁটে তিতাস। ডানদিকে একটা বাঁক নিয়েই বড়োরাস্তার মোড়ে পৌঁছায়। একটা গাড়ি ঘিরে বেশকিছু লোকের জটলা। অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে। একজন বয়স্ক পথচারীকে পিষে দিয়েছে গাড়িটা। অ্যাম্বুলেন্সে হাসপাতাল নিয়ে গেছে সেই পথচারীকে। বাঁচবে না হয়তো। শুনে হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসে তিতাসের।  হিমশীতল স্রোত নামে মেরুদণ্ড দিয়ে। অতীনের মুখটা ভেসে ওঠে চোখের সামনে। এরপর? কোথায় যাবে? হাজারো প্রশ্নের ঝোড়ো হওয়া বয়ে চলে মনে। ধকধক করছে বুক। নিজের হৃদস্পন্দনের শব্দ নিজেই শুনতে পাচ্ছে । ফোনটা বেজে ওঠে হঠাৎ। কাঁপাহাতে ফোন ধরে তিতাস। সুমন ফোন করেছে। "কোথায় তুই?"  জিজ্ঞাসা করে সুমন। কথা আসে না তিতাসের মুখে। চৌরাস্তায় অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে। অনেক কষ্টে কথাগুলো বলে তিতাস। "আমি জানি। একটু আগেই হয়েছে। তুই কী করছিস ওখানে?" জিজ্ঞাসা করে সুমন। 
"না মানে, বাবা..." তিতাসের কথা থমকে দাঁড়ায়।
"তুই তাড়াতাড়ি রিসেপশনে আয়। আমি কাকুর কাছেই রয়েছি।"
"কী বলছিস?" অজান্তেই প্রশ্নটা ছিটকে বাইরে আসে তিতাসের মুখের থেকে।
ফেলে আসা পথে পা ফেলে তিতাস। এই বুঝি পড়ে যাবে হুমড়ি খেয়ে। পলিক্লিনিকের রিসেপশনের গেটে এসে দাঁড়ায়। হাঁপিয়ে গেছে বেশ। সিকিউরিটি জিজ্ঞাসা করে অতীনের কথা। কোনো উত্তর দেয় না তিতাস। গেট পার হয়ে এগিয়ে যায় সামনে। সুমন হাত তুলে জানান দেয় নিজের অবস্থান। সুমনের সামনে গিয়ে দাঁড়ায় তিতাস।
"বাবা কোথায়?" জিজ্ঞাসা করে তিতাস। 
"ওই তো বসে রয়েছে।" ডানপাশের কোণের দিকে একটা চেয়ারে বসে অতীন। রিসেপশনের জায়ান্ট টিভি চলছে নিঃশব্দে। সেইদিকে চেয়ে অপলক অতীন। নিজেকে ওজনশূন্য মনে হয় তিতাসের। 
"তুই বাইরে গিয়েছিলি কেন?" জিজ্ঞাসা করে সুমন। 
"বাবাকে খুঁজতে।" বলে তিতাস। 
"মানে?" প্রশ্ন সুমনের। উত্তর দেয় না তিতাস। এগিয়ে যায় অতীনের দিকে। 
"ফোন ধরছিলে না কেন?" জিজ্ঞাসা করে তিতাস। 
" খবরটা দেখছি বাবু। নিম্নচাপ উঠেছে বোধহয়। ঝোড়ো হাওয়া দিচ্ছে।" টিভির দিকে তাকিয়ে থেকে বলে অতীন। অতীনের পকেট থেকে ফোনটা বের করে তিতাস। সাইলেন্ট মোডে রয়েছে অতীনের ফোন। ডাক্তারের চেম্বারে ঢোকার আগে নিজের আর অতীনের দুটো ফোনই সাইলেন্ট করেছিল তিতাস। মনে ছিল না সেকথা।
তিতাসকে দেখে এগিয়ে আসে লিফটম্যান। "আপনার বাবার খোঁজ পেলেন দাদা?" জিজ্ঞাসা করে।
"হ্যাঁ, এই তো।" বলে তিতাস। 
"আমি তো তখন থেকেই দেখছি হলুদ পাঞ্জাবি পরা এই ভদ্রলোক এখানেই বসে তাকিয়ে রয়েছে টিভির দিকে। আপনি বলেছিলেন সাদা পাঞ্জাবি পরে আছে আপনার বাবা। তাই কিছু বলতে সাহস হয়নি আপনাকে।" চলে যায় লিফটম্যান। অতীনের পরনে হলুদ পাঞ্জাবি। এতক্ষণে খেয়াল করে তিতাস। তিতাসের অবস্থা অনুমান করতে কষ্ট হয় না সুমনের। বলে, "তুই ভীষণ টেন্সড।" তিতাসের কাঁধে হাত রাখে সুমন। "সময়ে সব ঠিক হবে, কেন ভাবছিস, আমি তো আছি। টেনশন করিস না।"
অতীনকে চেয়ে আছে টিভির দিকে। ঝোড়ো হাওয়ার আগাম সংবাদের কথা ভেবে। বাবাকে দেখতে থাকে তিতাস, মনের মধ্যে ঝোড়ো হওয়ার দাপটে বড্ড অসহায় মনে হয় নিজেকে।
"সব ঠিক হয়ে যাবে।" বলে সুমন।
বাবার কাঁধে মাথা রেখে দু'চোখ বন্ধ করে তিতাস। নিজেকে বড্ড অবিন্যস্ত মনে হয় আজ, এই মুহূর্তে। অতীন বলে, "তাড়াতাড়ি বাড়ি চল বাবু। ঝোড়ো হাওয়া বইছে। বৃষ্টি নামবে হয়তো।"
যন্ত্রণাকাতর দৃষ্টি নিয়ে বাবার দিকে চেয়ে থাকে তিতাস।
"রিল্যাক্স তিতাস, রিল্যাক্স। অত ভাবিস না। লেট লাইফ ফ্লো। ডোন্ট বি সো টেন্সড।" তিতাসের কাঁধে হাত রাখে সুমন। 
সুমনের হাত চেপে ধরে তিতাস বলে, "কী জানি! হয়তো সব ঠিক হবে একদিন।"
সুমন বলে, "সিওর। সময় বদলাবে বন্ধু। ভরসা রাখ নিজের উপর।"

Comments