অর্বাচীনের আবার কথা থাকে নাকি! কথা কিসের। কাজেকম্মে ঢেঁড়স। লেখাপড়াতেও এগোতে-এগোতে তেমন এগোতে পারেনি। সেই থেকে ঢু-ঢু। অগাড়ে-পগাড়ে ঘোরে। দিলখুস। দশজনের ফাইফরমাস খেটেই দিন গুজরান। পকেট গড়ের মাঠ হলে মন বলে, চল পানসি বেলঘরিয়া।
অ্যাদ্দিন তার কিছুই মনে হয়নি। মনে হওয়ার মতো কিছু আছে কিনা, তাই সে জানতো না। আসলে সে তো অকাজের ঢেঁকি! অন্তত নিজেকে সে তাই মনে করতো।সেই যে জগন্নাথ নাটকে অরুণ মুখুজ্জে একটা সংলাপ লিখেছিলেন না, যেটা মঞ্চে বেশ রসিয়ে দারোগাবাবু বলতেন, অর্বাচীন অনেকটা তাই। অন্তত নিজেকে তাই মনে করে। হ্যাঁ, সংলাপটা মনে আছে? মনে নেই? দাঁড়ান, বলে দিচ্ছি। "জগন্নাথ করবে ইনফরমারের কাজ? সে তো ভালো করে হাগতে পাদতেই পারে না।" অর্বাচীন খানিকটা তেমনই। সে নিজেকে তাই ভাবে। অবশ্য সে নিজে যত না ভাবে, পড়শিরা ভাবে দ্বিগুণ। আর ভাবে বলেই মাঝেমধ্যে গামছা দিয়ে বুকের ঘাম মুছতে-মুছতে বলে, "আমার কিস্যু হল না গো..."
এমনভাবে বলে যেন সে অনেক কিছু করতে পারতো। সেজন্যই বোধহয় সময় পেলেই কালো তেলচিটে গামছা দিয়ে বুক ঘষতে থাকে, যেন বুকটাকে আয়না করে নিজের মুখ দেখবে!
তা সেই অকম্মার ঢেঁকি অর্বাচীন এখন ভাবতে শিখেছে। মাথার চুলে রুপোলি প্রলেপ পড়ার পর থেকেই তার ভাবের উদয় হলো। তবে ভাবনা মানে ভাবনাই। তার না-আছে উত্তর-দক্ষিণ, না-আছে তল-অতল। সে নিজেই বলে, আমার আবার ভাবনা! ও তো পাগলেও ভাবে। ধুউউউস।
অর্বাচীন ভুলেই গেছে ওর ছোটোবেলায় সবাই ওকে পাগল বলতো। জগা পাগলা। আসলে সে তো জগা-ই। ভালোনাম বাপ দিয়েলো জগন্নাথ। ওর নাকি ছোটো থেকেই মাথায় ছিট ছিল। তবে ও কোনো অন্যায় করে ফেললে দশজন যদি গালাগালি দিত তো তার মা বলতো, "আমার অমন পাগল-ছাগল ছেলেটাকে তোমরা অমন করে বলো কেন গো?"
তা সেই জগাই একদিন হয়ে গেল অর্বাচীন। সে এক বেত্তান্ত। ইস্কুলে পড়ে তখন। ঠেলেঠুলে বোধহয় ছয় ক্লাসে উঠেছিল। তা অঙ্কটা তার মাথায় কিছুতেই ঢুকতো না। একদিন কেষ্টবাবু স্যার বললেন, "তোর মাথায় কিস্যু নেই। ঘিলুটাও মনে হয় নেই। মুর্খ একটা, অর্বাচীন।"
তা শব্দটা তার মনে ধরলো। শুধু ওর কেন ক্লাসের সব্বাইয়ের মনে ধরলো। ওকে সকলে অর্বাচীন-অর্বাচীন বলতে-বলতেই ও পাকাপাকিভাবে অর্বাচীন নামেই খ্যাত হয়ে গেল । এখন আর ক'জন মনে রেখেছে ওর জগাই নামটা? সেটা এখন ভুঁইচাপা।
তা সেই জগাই একদিন হয়ে গেল অর্বাচীন। সে এক বেত্তান্ত। ইস্কুলে পড়ে তখন। ঠেলেঠুলে বোধহয় ছয় ক্লাসে উঠেছিল। তা অঙ্কটা তার মাথায় কিছুতেই ঢুকতো না। একদিন কেষ্টবাবু স্যার বললেন, "তোর মাথায় কিস্যু নেই। ঘিলুটাও মনে হয় নেই। মুর্খ একটা, অর্বাচীন।"
তা শব্দটা তার মনে ধরলো। শুধু ওর কেন ক্লাসের সব্বাইয়ের মনে ধরলো। ওকে সকলে অর্বাচীন-অর্বাচীন বলতে-বলতেই ও পাকাপাকিভাবে অর্বাচীন নামেই খ্যাত হয়ে গেল । এখন আর ক'জন মনে রেখেছে ওর জগাই নামটা? সেটা এখন ভুঁইচাপা।
তবে অর্বাচীন নিজেকে পাগল ভাবলে কী হবে, দশজন তো অন্যকথা ভাবে। সে নানা কথা। অতশত জানার দরকার কী বাপু! অর্বাচীনের সে-সব মনেও ধরে না, মনেও রাখে না। তবে শেফালি বাগদি-র কথাটা বেশ মনে ধরেছিল। দেখা হলেই চোখ ঠেরে বলতো, "পাগল তো নয়, একটা ঢ্যামনা।" কেন বলতো কে জানে! তখন তো তার অত বুদ্ধি ছিল না যে, বুঝবে! তবে শেফালিকে বেশ লাগতো। কিন্তু সে তো পাগল, বুদ্ধু। ওই যে ইস্কুলে একবার বীণা দিদিমণি বলেছিল না, "তুই একটা বুদ্ধু।" ও তো সেটাই বিশ্বাস করে এসেছে এতদিন। সে নিজেকে অকম্মার ঢেঁকি বলেই মেনে নিয়েছিল। কিন্তু কী যে হলো, এখন সে বেশ ভাবতে পারছে। সবকিছু বুঝতে পারে। সেই যেবার মাঠে কাজ করতে গিয়ে বজ্রাঘাতে বাপটা মরে গেল, তখনও সে বুঝতে পারেনি। আবার ক'বছর আগে মা-টাও মরে গেল। কী করে মরলো, কে জানে! অর্বাচীন তখন ঘরে ছিল না। ক'দিন ধরেই ছিল না। কোথায় গেছিল কে জানে! কোন অগাড়ে-পগাড়ে ঘুরছিল তার ঠিক আছে? একদিন পাড়ায় ঢুকতেই হাবু বললো, "অ্যাই শুয়ার কোথায় ছিলি, তোর মা তোকে খুঁজে-খুঁজে হয়রান হয়ে শেষে মরেই গেল।"
অর্বাচীন কিছুক্ষণ চুপ থেকে কাতরস্বরে জিজ্ঞেস করলো, "মা মরে গিয়েচে?"
—হ্যাঁ।
—কী হয়েলো?
—কেউ বলে হেগে-হেগে মরে গিয়েচে, কেউ সাপে কেটে। আমি ঠিক জানিনে রে।
তারপর থেকেই অর্বাচীন কেমন ভাবতে শিখে গেল। তার ঘোরাঘুরিও দিকবদল করে ফেলল। সে প্রায়ই মন্দিরের চাতালে গিয়ে বসে থাকতো। কেউ কিছু দিলে খেতো, না-দিলে, বাতাস আর জল খেয়েই কাটিয়ে দিত। তখন থেকেই তার ভিতর উদাসীন দার্শনিক বোধটা সেঁধিয়ে গিয়েছে। আচ্ছা, ও দার্শনিক হলো কবে থেকে? যেদিন মন্দিরে গেল? না।
ওই যেদিন ও কবরস্থানে গেল। কেন গিয়েছিল, সে জানে না। এখন তো সে আর অগাড়ে-পগাড়ে ঘোরে না; মন্দির, মসজিদ, গির্জায় গিয়ে বসে থাকে। ভিতরে ঢোকে না। সে জানে এইসব দেবস্থানে সাফসুতরো হয়ে যেতে হয়। নইলে দেবতা বড্ড রাগ করে।তার যেমন বেশ— পাছায় তালি মারা, হাঁটুর কাছে ফাটা— কে দিয়েছিল, কে জানে! গায়ে ন্যাকড়াকানি গেঞ্জি পাছার নিচ পর্যন্ত ঝুলে থাকে।এসব পরে কি দেবতার সামনে যাওয়া যায়? তাই সে ফটকের সামনে বসে থাকে। না, সে ভিক্ষে করে না। ভিক্ষে তার দু' চোখের বিষ। সে অর্বাচীন হতে পারে, কিন্তু তার সম্মান নেই? সে করবে ভিক্ষে? তবু কেউ-কেউ, চেনা মুখ হয়তো, ওর হাতের মুঠোয় দু'টাকা দিয়ে বলে, "খেয়ে নিবি।"
অর্বাচীনের তখন মনে হয়, "এটা বোধহয় ভিক্কে নয়, ভালোবাসা।"
'ভালোবাসা' কথাটা মনে হলেই হাসি পায়। ভালোবাসা মানে তো দু'মুঠো মুড়ি দিয়ে বাগানের ঘাস তুলিয়ে নেওয়া। ওসব ভালোবাসায় আর অর্বাচীন ভুলছে না। "হুঁ-হুঁ বাবা, আমি এখন সব বুজি!"
একদিন উঁকিঝুঁকি মারতে-মারতে ঢুকে গেল গির্জার পিছনের কারখানায়। সারি-সারি কবর। উঁচু-উঁচু লম্বা ঢিবি মতন। তার একদিকে যোগচিহ্নের মতো কাঠ, লোহা, সিমেন্টের কী যেন বসানো। অর্বাচীন হাঁ করে সে-সব দেখছে। কী যে ভালো লাগছিল তার। কবরখানায় একটা লোক ঘাস কাটছিল। তাকে জিজ্ঞেস করল, "অ্যাতো ঢিবি কেন গো?"
লোকটা ঘাস কাটতে-কাটতেই উত্তর দিল, "ঢিবির নিচে সব ঘুমুচ্ছে।"
—মানে?
—মানুষ মরে গেলে এখানে মাটির নিচে শুইয়ে দেয়। লোকে যেন বুঝতে পারে তাই উঁচু করে দেওয়া হয়েছে।
—আর এই যোগচিহ্নগুলো?
—ওগুলো যোগচিহ্ন নয়, ওগুলো ক্রুশ।
সে নিজের মনে বললো, ক্রুশ? বাপের জম্মে শুনিনি। কিম্বা শুনিচি হয়তো। কিচুই মনে থাকে না। ধু উ উ উ স।
(চলবে)
খুব সুন্দর
ReplyDelete