প্রাণেশ সরকার


কবি বীরেশ ঘটক সোদপুরে থাকেন। আগে বিরাটিতে থাকতেন। কলকাতা কর্পোরেশনে চাকরি করতেন। বীরেশদা আমাদের গ্রামের জামাই। আমার বন্ধু অমরেন্দ্রনারায়ণ সান্যালের ছোটোবোনকে বিয়ে করেছেন। বীরেশদা-ই 'একুশের ডাক' প্রকাশনার কর্ণধার কেশব মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে আমার আলাপ করিয়ে দেন। 'একুশের ডাক' আমার গদ্য-পদ্যের একাধিক বই প্রকাশ করেছে। কবি প্লাবন ভৌমিকের সঙ্গে আমি বীরেশদা-র আলাপ করিয়ে দিই এবং 'একুশের ডাক' প্লাবন ভৌমিকের অনেক কবিতার বই প্রকাশ করে। বীরেশদা-র কর্পোরেশন অফিসে বিকেলের দিকে কবিতাপাঠের জমাটি আড্ডা হতো। সেখানে প্লাবন, আমি, কবি সোমনাথ ভট্টাচার্য, কবি উত্তর বসু এবং বীরেশদা চুটিয়ে কবিতা পড়তাম। একদিন বীরেশদা ও আমি দু'জন কথা বলছিলাম। আর কেউ সেদিন আসেননি। বীরেশদা একটা ফাইল থেকে একগুচ্ছ কবিতার ফটোকপি বের করে আমাকে পড়তে দিলেন। কবির নাম কমলেশ পাল। এক-এক করে কবিতা পড়ছি আর মুগ্ধ হচ্ছি। বাংলা ভাষায় এ-ধরনের কবিতা এর আগে কখনও পড়িনি। পড়তে-পড়তে মনে পড়লো, দু-একটি লিটল ম্যাগাজিনে (বিশেষত 'নৌকো'-তে) কমলেশ পালের কিছু কবিতা বিচ্ছিন্নভাবে পড়েছি। কিন্তু একসঙ্গে একগুচ্ছ কবিতা পড়ার ইমপ্যাক্ট-ই আলাদা। এর কিছুদিনের মধ্যেই কমলেশ পালের বই পাঁজর পুরাণ  আমার হাতে আসে। বইটি পড়তে-পড়তে আমার মনে পড়ে, এ-বইয়ের বেশ কিছু কবিতা আমার আগেই পড়া হয়ে গেছে বীরেশদা-র কল্যাণে। এরপর কলকাতা বইমেলায় কবির সঙ্গে আমার আলাপ হয় এবং সেই আলাপ-পরিচয় ক্রমশ ঘনিষ্ঠতায় পর্যবসিত হয় পোস্টকার্ডে চিঠিপত্রের মাধ্যমে। মধ্যমগ্রামে ওঁর বাড়িতেও বেশ কয়েকবার গিয়েছি চিত্রশিল্পী-কবি-প্রাবন্ধিক স্বপনকুমার মল্লিকের সঙ্গে। খুবই বড়োমাপের কবি কমলেশ পাল, মানুষ হিসাবেও তিনি অনেক বড়ো। ওঁর বিচিত্র জীবন, জীবন ও জীবিকার লড়াই, জিওলজিকাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ায় কর্মরত অবস্থায় ভারতবর্ষের নানাপ্রান্তের পাহাড়ি ও আদিবাসীদের সঙ্গে আন্তরিক মেলামেশা ওঁর জীবন ও লেখালেখিতে এক সুগভীর সদর্থক ছাপ রেখেছে। ওঁর মৃত্যুর একমাস আগে আমি ও স্বপন গিয়েছিলাম মধ্যমগ্রামে। ওঁর সঙ্গে সেই আমার শেষ দেখা। কত কথা হলো, কবিতাপাঠ হলো, আমাকে ওঁর গল্পের বইটি দিলেন, ওঁর আত্মজীবনী আমার আয়নাকথা  কোথায় পাওয়া যাবে তার ঠিকানা ইত্যাদি দিলেন, স্বপনের আন্তরিক আগ্রহে ওঁর অণুকবিতা নিমফুল-এর পাণ্ডুলিপি স্বপনকে দিলেন প্রকাশের জন্য; কত স্মৃতি ভিড় করছে চারপাশে। হ্যাঁ, বেশ কিছুদিন অসুস্থ ছিলেন, বারকয়েক হসপিটালেও যেতে হয়েছিল, কিন্তু তবু, তবুও...চলেই গেলেন কমলেশদা। নিমফুল বেরিয়েছে ইতিমধ্যে, স্বপন ফোন জানিয়েছে। কিন্তু স্বপন কবির হাতে বইটি তো আর তুলে দিতে পারলো না! এই আক্ষেপ থেকে যাবে আমাদের। বইটির কথামুখে উনি লিখেছেন—"যাদের ভালোবাসা ঘাস থেকে আকাশ পর্যন্ত—কখনও যার সম্ভাবনার কথা মাথায় আসেনি, এই কণাকবিতাগুলি নিয়ে বই হওয়ার কথা, কী আশ্চর্য, দুই বন্ধুর ভালোবাসার যাদুতে তা সম্ভব হয়ে বসল। নানা ডায়েরির কোণাচে এরা ধুলোমাখা পথশিশু হয়ে ছিল তো ছিলই একেবারে অনাদৃত। বন্ধু চিত্রশিল্পী ও কবি স্বপন মল্লিক এবং আমার প্রাণের আপন কবি প্রাণেশ সরকার এদের আদর করে দু'মলাটের ফ্রক পরিয়ে দিল। ভালোবাসা সুন্দর করে দিল। আমি চিরদিনের মতো তাঁদের কাছে অকৃতজ্ঞ হয়ে রইলাম তো রইলামই।"

কমলেশ পাল তাঁর আত্মকথা আমার আয়নাকথা-য় (ইতিকথা পাবলিকেশন, কলকাতা) শেষের দিকে আমার কথাও লিখেছেন—"একটা একাত্মতা অনুভব করি কবি প্রাণেশ সরকারের সঙ্গে। প্রাণেশ অত্যন্ত সমঝদার কবি। অনেক প্রস্তুতি না থাকলে ওর মতো লেখা সম্ভব নয়। দেখাসাক্ষাৎ হওয়ার আগেই চিঠিতে চিঠিতে আমাদের প্রেম। এর পিছনে একটা রামধনু রঙের চক্রান্ত আছে কবি বীরেশ ঘটকের।" (পৃ: ১৯৯) লেখা বাহুল্য, কবি বীরেশ ঘটকের কী চক্রান্ত, সেকথা পূর্বেই উল্লেখিত হয়েছে। 

কৃষ্ণনগরে বসবাস করেন কবি স্বপনবরণ আচার্য। আমার চেয়ে বয়সে অনেক ছোটো। আমাকে 'প্রাণেশদা' বলেই সম্বোধন করে। আমি তাকে 'স্বপন' বলেই ডাকি। স্বপনবরণ প্রগাঢ় ব্যক্তিত্বসম্পন্ন এক ভার্সাটাইল লেখক। প্রধানত কবি। কিন্তু ছোটোগল্প, উপন্যাস, নাটকও সে লেখে। এবং অনুবাদক। শেক্সপিয়রের কিং লিয়র, ম্যাকবেথ, হ্যামলেট এবং সনেট অনুবাদ করেছে। অসাধারণ অনুবাদ। আমি তার প্রায় সব লেখাই পড়েছি।

স্বপনের সঙ্গে আমার দীর্ঘদিনের সংযোগ। আমার তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ সারারাত আলোর চিৎকার-এর প্রুফ দেখে দিয়েছিল সে এবং এই গ্রন্থটির ব্লার্বও সে লিখেছিল। ব্লার্বটি আমি তুলে দিচ্ছি এখানে—"চল্লিশ-ছোঁওয়া, পেশায় ইংরেজির শিক্ষক, দীর্ঘদেহী, অকৃতদার মানুষটি সম্বন্ধে একথা বলাই বুঝি সবচেয়ে ঠিক যে, প্রাণেশ সরকার একজন কবির নাম। কাব্যসৃষ্টিতে অকুন্ঠ কবির এক রহস্যময় কুন্ঠা ছিল কাব্যপ্রকাশে। তাই, ১৯৯২-এ, একটু দেরিতেই, কিন্তু সুদীর্ঘ চর্চার সুফলে, আমরা তাঁকে প্রথম গ্রন্থেই (অন্ধ করোটির রেখা ) পাই আশ্চর্য পরিণতিতে। ১৯৯৩। দ্বিতীয় বই; আমার আগুন এখনও নেভেনি । বাংলা কবিতার পাঠকমহল চিনতে পেরেছিলেন একজন কবিকে যিনি কবিতার ভিতর কখনও কোনো লঘুতাকে স্বীকার করেন না। মুগ্ধ হয়েও তাই কেউ কেউ অনুযোগ করেছিলেন তাঁর কবিতাজাত এক দুঃসহ সুন্দর শ্বাসকষ্ট নিয়ে। এই বইটি যেন তারই উত্তর। না, কবি লঘুতাকে স্বীকার করেননি এখানেও, কিন্তু শৈলির পরিণতির পথে এমন এক পদ্ধতির আবিষ্কার করেছেন চরণে চারণে, যা গভীরতম উপলব্ধিকে রৌদ্রের মতো সরলরেখায় উদ্ভাসিত করে। সুন্দর তেমনই ভারী, শুধু ভারটুকু নেই। বইটির অধিকাংশ কবিতাই বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত। রচনাকাল ১৯৯৩-৯৪। প্রসঙ্গত, এই বইয়েই এল 'বহ্ন্যুৎসব'-এর পনেরটি কবিতা। পত্রপত্রিকায় প্রকাশের মাধ্যমে, অগ্রন্থিত অবস্থাতেই, সচেতন কবিতা পাঠক ইতিমধ্যেই স্বীকৃতি দিয়েছেন 'বহ্ন্যুৎসব' সিরিজকে।"

প্রথাবিরুদ্ধ, মাথা উঁচু করে বাঁচতে চাওয়া এই মানুষটি প্রাইভেট টিউশন করে এবং সংবাদপত্রে কলাম লিখে জীবিকা নির্বাহ করে। অত্যন্ত ভালো শিক্ষক। তার ছাত্ররা তাকে হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও মনে করে। তার আপোষহীন মানসিকতাকে আমি গভীর শ্রদ্ধা করি। আমার সামনে এই মুহূর্তে স্বপনবরণের কুড়ি বছরের কবিতা  শীর্ষক কাব্যগ্রন্থটি রয়েছে। নতুন করে পড়ছিলাম আবার। এ-গ্রন্থের প্রতিটি কবিতাই আমার প্রিয়। আমি এখানে 'জলসত্র' কবিতাটি তুলে দিচ্ছি। 

পিসী বসেছিল দাওয়াতে 

দারুণ চেষ্টা পাওয়াতে 

কে-একটা লোক জল চেয়েছিল 

কি-একটা মনে হওয়াতে।

বিধবা পিসীর বয়ে গিয়েছিল 

যাকে-তাকে জল খাওয়াতে।

পিসী একটুও নড়েনি

কেননা খেয়ালই করেনি

যে লোকটা জল চেয়েছিল, তার

চোখের পলক পড়েনি।

মরুভূমি চাটে বিধবা আকাশ 

পিসী তো খেয়ালই করেনি! 

খেজুরের বীজ বালিতে

মাথাচাড়া দিল অঙ্কুর

ক্রমে উদ্যানে বালি ঢেকে গেল 

রসে মেঘ টই-টম্বুর।

দাওয়া থেকে উঠে পিসী উঁকি দিল,

চলে গেল? কেন? কদ্দুর?

ও! মরীচিকা ভাবলে?

বুকের মাংস খাবলে 


রক্ত চেখেও বুঝলে না? জল

পেতে আরেকটু নাবলে।

পিসী বসে থাকে দাওয়াতে

দস্যুকে জল খাওয়াতে 

বুকের ভিতর আবডালে ফুল

ঝরে অশ্লীল হাওয়াতে।


কবি সুবীর সিংহরায়ের কথা আগেই উল্লেখ করেছি। ১৯৯১ সালে সুবীরের বয়েৎগুচ্ছ  কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করেছিল প্রজ্ঞা প্রকাশন। ওই একই বই ২০১২ সালে গাঙচিল প্রকাশ করে নবকলেবরে, আমার ইংরেজি অনুবাদ-সহ। বয়েৎগুচ্ছ থেকে একটি স্তবক (শীতকালীন বয়েৎগুচ্ছ : ২) উদ্ধৃত করছি। ইংরেজি অনুবাদটিও থাকলো।

২.

উত্তরে বায় হাঁকায় চাবুক

একলা চাঁদের বিষণ্নতায়

ছড়িয়ে যায় কঠিন অসুখ 

সব খোয়ানো মনস্কতায়

দুপুর রাতের জমাটব্যথা

জড়িয়ে গায়ে এই পৃথিবী

গাইছে বিষাদ মৃত্যু গাথা

পুরনো দিন আর পাব কি?

_________________________

2.

The north wind lashes on.

Woes unbearable stretch their arms

while the lone moon is despondent. 

The earth dons the intense pang

of the midnight in an absolute defeat. 

Melancholy sings the ballad of death.


Should I ever get back my old days?

__________________________

নৈহাটির বৈদ্যনাথ চক্রবর্তী আমার কয়েকদশকের বন্ধু। কবি, প্রবন্ধকার, সম্পাদক। আমি ওর কবিতার ভক্ত। ১৪২৫-এর ভাষাদিবসে নৈহাটির সমরেশ বসু মঞ্চে কবিতাপাঠের জন্য পাঁচজন কবি আমন্ত্রিত ছিলেন। কবিতাপাঠের শেষে বৈদ্যনাথ ওর কাব্যগ্রন্থ ডিহিবাংলার কথকতা  আমার হাতে দিল; লিখে দিল—"প্রাণেশ সরকার প্রীতিসহ। বৈদ্যনাথ চক্রবর্তী, ফাল্গুন, ১৪২৫—ভাষাদিবস, ১৪২৫"। আমার খুবই প্রিয় কবিতার বই। মাঝেমধ্যেই পাঠ করি। এর 'প্রবেশক' কবিতাটি নিম্নরূপ :


অন্তিমে আগুন ছিল

জন্মে ছিল জল

গড়নে আলাপ ছিল

মননে প্রলাপ 

মাঝে ছিল গড়িমসি 

কোথায় গড়াব

কোন কোণে ঠেক্কা খেয়ে 

কোন কেন্দ্রে পা

কোথায় পেলব ছোঁয়া 

প্রায়শ কর্কশ 

যদি বা প্রণয় এল

প্রয়াণ দু-দিনে

যদি বা বন্ধুতা এল

বিলয় ছ-দিনে

এই সাতদিন পরমায়ু

মজায় রগড়ে

বেশ ভালো কেটে গেল—

দু-হাত বাড়াও

আমার নিজস্ব হাতে 

মিশে যেতে দাও...


বক্ষ্যমান এই গদ্যরচনাটি, অর্থাৎ আমার আত্মজীবনী, যাকে আমি আমার ভাঙাচোরা জীবন  নামে অভিহিত করেছি; তার একেবারে শুরুতেই মৃত্যুর কথা আছে। বাবা-র মৃত্যু, ঠাকমা-র মৃত্যু, মায়োইমা-র মৃত্যু, কলেজের শেষপর্বে মা-র মৃত্যু...এইসবের বিবরণ আছে। এমন আরও কিছু মৃত্যুর কথা তো বলতেই হবে। প্রিয়জনের মৃত্যুতে শুধু অনড় পাথর হয়ে থাকলে তো চলবে না! 

সেবার দীঘায় বেড়াতে গেছি। সঙ্গে দুই তরুণ বন্ধু—শিক্ষক বিটুল রায়চৌধুরী ও বিটুলের বন্ধু সিইএসসি-তে কর্মরত অসীম। গিয়ে দেখি প্রচণ্ড ভিড়। হোটেল ঘর ফাঁকা নেই। শেষে শ্মশানের ডোম ছোটো একটা ঘরের ব্যবস্থা করে দিল। অনেক রাত। ঘুমিয়ে পড়েছি। ঘুম ভেঙে দেখি ছেঁড়াখোড়া তোষক, বালিশ। আমি বিটুলকে বলি, "ও ভাই, এ যে মরা-র সঙ্গে ফেলে দেওয়া বিছানাবালিশ। সারারাত এইসবের মধ্যে ঘুমিয়েছি, হায়-হায়!" অসীম বলে, "ও কিছু নয় দাদা; চলুন স্নান করি, সব শুদ্ধ হয়ে যাব।" মনে-মনে বলি—হে সমুদ্রললনা, তোমার এত প্রেম! যাইহোক, পে অ্যান্ড ইউজ-এ স্নানটান সেরে হোটেলে খাওয়াদাওয়া করে নিয়ে আমরা সমুদ্রসৈকত ও আশেপাশের আরও এলাকায় ঘোরাঘুরি করে, বিকালের দিকে বাস ধরি এসপ্ল্যানেডের উদ্দেশে। তারপর শিয়ালদহ থেকে শেষ আপ কৃষ্ণনগর লোকাল ধরে বাদকুল্লায় নামি। বিটুল ও অসীম কৃষ্ণনগর চলে যায়। 

আমি বাড়ির পথে হাঁটা দিয়ে দূর থেকে দেখি, আমাদের বাড়ির বাইরে সব আলো জ্বলছে। কী ব্যাপার, এত আলো জ্বলার তো কথা নয়! নিশ্চয়ই কিছু একটা হয়েছে। আমি দ্রুত পা চালাই। বাড়ির উঠোনে পা দিতেই কান্নার রোল ওঠে। দিদি, টুনু (আমার ছোটোবোন), রাজু (আমার ছোটোভাগ্নে)— সবাই কাঁদছে। নেটু (আমার বড়োভাগ্নে জয়ন্ত) বলে, "মামা চলো, শক্তিনগর হাসপাতালে যেতে হবে; বাবা সন্ধ্যাবেলা মারা গেছে। আমি গাড়ি ভাড়া করেছি। মৃতদেহ আনতে হবে।" দাদাবাবুর আকস্মিক এই মৃত্যুতে বিহ্বল হয়ে পড়ি আমি। হাতমুখ ধুয়ে ঘরে ঢুকে টাকাপয়সা সঙ্গে নিয়ে গাড়ি করে শক্তিনগরের দিকে রওনা হই। শীতকাল। দোতলায় মেল-ওয়ার্ডের বেডে শুয়ে আছেন আমার দাদাবাবু অর্জুন শিকদার। মৃত। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ডেথ-সার্টিফিকেট দিয়ে দিলেন আমার বড়ো ভাগ্নে জয়ন্তকে। আমরা খাটিয়া, ফুল ইত্যাদি সংগ্রহ করে, গাড়িতে সেই শীতের রাতেই দুটো নাগাদ বাড়ি পৌঁছলাম। সকালে ফটোগ্রাফার এসে ছবিটবি তুললো। কান্নার রোলের মধ্যে হরিধ্বনি দিতে-দিতে আমরা বাদকুল্লা শ্মশানে পৌঁছলাম। চিতা প্রজ্জ্বলিত হলো। দাদাবাবুর নশ্বর দেহ পুড়তে থাকলো। নদীর কিনারায় বসে ভাবতে থাকলাম, বর্ষাকালে রাস্তায় কাদার কারণে তিনি আমাকে গোপালনগর স্টেশন থেকে তাঁর বাড়ি যে-গ্রামে, সেই বেলতা পর্যন্ত কাঁধে করে নিয়ে যাচ্ছেন; রাস্তায় পাকা নারকেল পড়ে আছে, কুড়িয়ে নিচ্ছেন। বাড়ি পৌঁছেই, বাড়ির কাছে বিশাল যে-জলাশয়, সেই বিলে গিয়ে মাছ ধরে আনছেন, শাপলা তুলে আনছেন। দিদি মাগুরমাছের সঙ্গে কাঁচকলা দিয়ে ঝোল করে আউশচালের ভাত-সহ আমাকে, দাদাবাবুকে আর মায়োইমাকে খেতে দিচ্ছে। সেই মাগুরমাছের কী যে স্বাদ, আহা! মুখে যেন এখনও লেগে আছে! আমাদের খাওয়াদাওয়া হলে দিদি সব বাসনকোসন মেজে, ঘরটর লেপে, স্নান করে ভাত নিয়ে বসে আমার সঙ্গে গল্প করছে আর খাচ্ছে। মা আর টুনুর কথা বলছি আমি। সবকিছু মনে পড়ে যাচ্ছে এক-এক করে; একটা চলচ্চিত্র দেখছি যেন! ওদিকে চিতা দাউদাউ করে জ্বলছে। একটা সময়ে চিতাবহ্নি স্তিমিত হয়ে আসে। দেহ পুড়ে শেষ। পঞ্চভূতে বিলীন। অস্থি সংগ্রহ করে বাড়ি ফিরি আমরা। আর একপ্রস্থ রোল ওঠে কান্নার। 

বড়োভাগ্নে জয়ন্ত ও ছোটোভাগ্নে সামন্ত (রাজু) পারলৌকিক কাজ নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করে। একে-একে ক্ষৌরকর্ম, কামান, শ্রাদ্ধশান্তি ও মৎস্যমুখের অনুষ্ঠান শেষ হয়। আত্মীয়স্বজনে বাড়ি গমগম করে। দিদির বৈধব্যদশা দেখে বুক মুচড়ে ওঠে আমার। মনে পড়ে, মৃত্যুর তিন-চারবছর আগে দাদাবাবুকে কলকাতার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছিলাম।  পেটে অস্ত্রোপচার হয়েছিল। প্রায় চারমাস ভর্তি থাকার পরে ছুটি পান। উনি ভর্তি থাকাকালীন আমি আমার কর্মক্ষেত্র কৃষ্ণনগর পৌরসভা থেকে টানা আর্নড লিভ নিয়েছিলাম। মান্থলি টিকিট কেটে নিয়েছিলাম ট্রেনে যাতায়াত করার জন্য। প্রায় রোজই যেতাম। ডাক্তারবাবুরা খুবই যত্ন করে চিকিৎসা করতেন। নার্সদের কর্তব্যপরায়ণতাও ছিল দেখার মতো। ওঁর প্রিয় খাবার এটা-ওটা নিয়ে যেতাম। ভিজিটিং আওয়ার শেষ হলে, কলেজ স্ট্রিটের কোনো হোটেলে ভাত খেয়ে কলেজ স্কোয়ারের বেঞ্চে বসে কাটিয়ে দিতাম কয়েকঘন্টা। বই পড়তাম বা ডায়েরিতে কবিতা লিখতাম। চমৎকার জায়গা। যে-যার মতো বসে আছে। কেউ কাউকে বিরক্ত করছে না। একদিন তো ঘুমিয়েই পড়েছিলাম! বিকালে আবার যেতাম ভিজিটিং আওয়ার শুরু হল। খোঁজখবর নিতাম, পরেরদিন কিছু লাগবে কি না, বা জানিয়ে দিতাম পরেরদিন আসছি না। জামাকাপড় কিছু লাগবে কিনা, খোঁজ নিতাম তারও। তারপর সন্ধ্যায় ট্রেন ধরে রাত ন'টা নাগাদ বাদকুল্লায় পৌঁছতাম। হাসপাতাল থেকে দাদাবাবুকে ছুটি দেওয়ার সময় আমাকে সবিস্তারে জানিয়ে দেওয়া হলো, ওষুধগুলি যেন যথাসময়ে খাওয়ানো হয় রোগীকে এবং পর্যাপ্ত বিশ্রামে থাকতে হবে তাঁকে; কোনোভাবেই যেন উত্তেজিত না-হন তিনি। আমাকে দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, যে-কোনো একটা ব্যাপারে বাড়িতে উত্তেজনা সৃষ্টি হওয়াতেই কিন্তু শেষ পর্যন্ত মৃত্যু হলো এই সহজ-সরল পরোপকারী সংগ্রামী মানুষটির এবং তা হলো আমার অনুপস্থিতিতে। আমার যেন দ্বিতীয়বার পিতৃবিয়োগ হলো। হ্যাঁ, দাদাবাবু আমার কাছে পিতার মতোই তো ছিলেন। পিতৃহারা বালকটিকে আজীবন পিতৃস্নেহই তো দিয়েছিলেন। আমার বড়োভাগ্নে জয়ন্ত, যে সবার কাছে 'নেটু' ডাকনামেই সমধিক পরিচিত, নতুন যে-বাড়ি করেছে সুরভিস্থানে, ভুবনমোহিনী বালিকা বিদ্যালয়ের কাছে—অবসরগ্রহণের পরে যে-বাড়িতে আমিও থাকি; আমি, নেটু এবং ওর মেয়ে ত্বিষা—সেই বাড়িটির নাম রেখেছে ওর বাবার নামে— 'অর্জুন ভবন'।

দাদাবাবুর মৃত্যুর পর বেশ ক'বছর অতিক্রান্ত হলে, নেটু বিবাহ করে চাকদহের এক তরুণী দুর্গাকে। আমিই খোঁজখবর নিয়ে ওর বিয়ে দিই ধুমধাম করে। মেয়েটির সন্ধান দিয়েছিল আমার ভ্রাতৃপ্রতিম বন্ধু, শিক্ষক ও কবি—চাকদহেরই অলোক বিশ্বাসের স্ত্রী শ্রীমতি চন্দ্রলেখা বিশ্বাস। দুর্গা অলোক ও চন্দ্রলেখার কাছে পড়েছিল। সেই বিয়েতে বরযাত্রী হিসেবে আমার বন্ধু ও কবি ইংল্যান্ডের জো উইন্টার-ও আমার সঙ্গে চাকদহে গিয়েছিলেন। এই জো উইন্টারের কথা পরে সবিস্তারে বলবো, কারণ তিনিও আমার জীবনের একটা বড়ো অংশ জুড়ে আছেন। 

(ক্রমশ)

Comments