জাকিয়া শিমু

আমার বাবার রাতা মোরগের ঝোল-তরকারির সাথে আমচুর দেওয়া পাতলা মসুরডাল খুব পছন্দের খাবার। তিনি দাওয়ায় বসে ডাল-ঝোলে হাতের কবজি ডুবিয়ে ভাত খান, আর মা তালপাতার পাখায় শরীরের সবটুকু জোর নিংড়ে তাঁকে হাওয়া দেন! “তরকারিতে আলু কম হয়েছে”—বাবা অভিযোগ তোলেন। অর্থাৎ তিনি ছলচাতুরি খুঁজছেন! বাবা অবান্তর মায়ের গায়ে সদা হাত তোলেন! পথঘাটের বেনামি কুকুরকে মানুষ যেমন অযথা লাথি-গুঁতা মারে, অনেকটা সেরকম! আমার বুকটা কেঁপে ওঠে। আড়চোখে মায়ের মুখখানা দেখি—ভারি অসিত মলিন! বাবা মিথ্যে অভিযোগের পাহাড় তেলেন! মা বাধ্যগত ভৃত্যের মতো মাথা নত করে শুনে যান!

বাবার মৃগীরোগ। বাবার এই ব্যামো নিয়ে মা অস্থির থাকেন। তবে বাবার প্রতি মায়ের ভালোবাসার সরেস প্রকাশ সবসময় গোপনে হয়! কারণ প্রকাশ হলে এই উছিলায় বাবা পশুর মতো মায়ের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েন! বাবা নদীর ঘাটে নাইতে গেলে আমি সাবানদানি হাতে তাঁর পিছুপিছু হেঁটে যাই। নদীপাড়ে, শিমুলগাছে দাঁড়কাক বাবার সাবান চুরি করার ধান্দায় থাকে! আদতে, মা সাবানের উছিলায় আমাকে বাবার সাথে পাঠিয়ে, মৃগীরোগী বাবার ঘরে ফেরা নিশ্চিত করেন! বাবা জলেরবতলে পানকৌড়ির মতো ঝুপ করে ডুব দেন, আমি শকুনচোখে তাকিয়ে দেখি, পানির তলা থেকে বাবা উঠল কিনা!

বাবার নাওয়াশেষে আমি আর দাদা, মায়ের চুলার পাড়ে বসে সকালের জলখাবার খাই। মা ধুঁয়াওঠা খুদভাতে ভর্তা আর বাসি তরকারির ঝোল আমাদের পাতে তুলে দিয়ে, বাবার জন্যে দাওয়ায় শীতলপাটি বিছাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন! আমাদের বাড়িতে বাবার জন্যে খাবার, শোয়া-বসার পৃথক ব্যবস্থা থাকে। মা সবার আগে তুলে-রাখা খুদভাত, ডিমভাজা দিয়ে বাবাকে পরিবেশন করেন।        

শনিবারে আমাদের তল্লাটে হাট বসে। সপ্তাহ ধরে দাদা এবং বাবা মিলে তাঁতকলে লুঙ্গি বুনেন। দাদা লুঙ্গি বেচতে হাটে যান। আমার পাড়ার বন্ধুরা অনেকে শখ করে বাপ-দাদার সাথে গঞ্জের হাটে যায়। আমারও খুব ইচ্ছে করে হাটে যাই। কিন্তু মায়ের দুশ্চিন্তা ঘুচাতে বিনা অভিযোগে নদীর ঘাটে বাবার সাবানদানি হাতে দাঁড়িয়ে থাকি। বাবা ধবল বকরঙের বাসনা-সাবান গায়ে মেখে গোসল করেন। তিনি বিশেষ দিনে শঙ্খশুভ্র জমিনের উপর হালকা নীলপাড়ের লুঙ্গি এবং সাদা লন্ড্রি করা হাওয়াই-শার্টটা গায়ে জড়ান। আর হাতের কব্জিতে সোনালিরঙের সিকো ফাইভ ঘড়িটি! বেলিফুলের ঘ্রাণযুক্ত সুগন্ধি মাখতেও ভুল করেন না এদিনে। বাবা গুনগুনিয়ে গান ধরেন! মায়ের চোখে এসময় কষ্ট-অপমানের একপাহাড় জল টলমল করে! আমি মায়ের পাশে চুপচাপ বসে থাকি! বাবা, আমাদের দীর্ঘশ্বাসকে মাড়িয়ে দু’গ্রাম দূরের শেখপাড়ায় রওনা হন, সেথায় বাবার রাজকন্যা থাকেন। শুনেছি, যার কাছে আমার বাবার সমস্ত সুখ বন্ধক রাখা আছে!


আমাদের টিনের দু’চালা ঘরটার অবস্থা, অনেকটা বাবার সাথে মায়ের বর্তমান সম্পর্কের মতো—পলকা, ঠুনকো! তারপরও ঘরখানা মাজা ভেঙে আমার বাবা-মায়ের সংসারের মতো দাঁড়িয়ে আছে! ঘরের মাঝ-বরাবর বাঁশের চিরল ফালির চতুর্ভুজ আকৃতির ফাঁকফাঁক বেড়া টানা। আমি আর দাদা একপাশে তক্তপোশ ফেলে থাকি, অন্যপাশে বাবা-মা। শীতের রাত বড়ো দীর্ঘ হয়, নিস্তব্ধতাও সমান তালে পাল্লা দিয়ে বাড়ে। এ-সময় রাতের নিজস্ব শব্দগুলো নির্বিঘ্নে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ঘরের টিনের চালায় লাগোয়া নারিকেলগাছের চিরলপাতা চুঁইয়ে টুপটাপ শিউলিফুলের বোঁটা খসে ঝরার শব্দে, শিশির ঝরে পড়ে। ঘরঘেঁষা কদমগাছটাতে দিনেদুপুরে বাদুড় ঝুলে থাকে আর রাত হলে দৌরাত্ম্য বাড়ে শতগুণে! বাদুড়ের পাখা ঝাপটানির শব্দে আমার ছোট্ট বুকটায় ভয়সমুদ্রের ঢেউ ওঠে! তাঁতিপাড়ার ল্যাংড়া কুকুরটা বুকভাঙা কষ্টে কুঁকড়ে কাঁদে। এসব থেকে নিস্তার পেতে আমি দাদার লোমশবুকে মুখ গুঁজি। দাদার ঘুম পাতলা। প্রায় সারারাত জেগে থাকেন। দাদা আমাকে দু’হাতে বুকের কাছে ঝাপটে ধরে নির্ভরতার আশ্বাস দেন। মায়ের সিথানের কাছে পিতলের পিদিমটা নিভুনিভু জ্বলে। বাবার অপেক্ষায় রাত জেগে মা বসে আছেন, যা মায়ের প্রতিদিনকার আটপৌরে কাজ! 

সেদিনও প্রতিদিনের মতো মধ্যরাতে বাবা বাড়ি ফিরলেন। বাবার সাথে মা গলা উঁচিয়ে কথা বলেন না। কিন্তু সেদিন মায়ের গলায় আওয়াজটা একটু বেশিই বাড়তি ছিল। লুকানো কষ্টরা বোধকরি জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরির লাভার আদলে একঝটকায় বেরিয়ে এসেছিল! বাবার গলায় সবসময় বাড়ন্ত গর্জন থাকে। কিন্তু মা-কে কেন জানি তাতে দমানো গেল না সেদিন! বাবা মায়ের উপর পশুর মতো ঝাঁপিয়ে পড়লেন! এবং এর পরপরই মায়ের গোঙানির শব্দটা বেরিয়ে এল। আমি চৌকোনা বেড়ার ফাঁক দিয়ে দেখি—বাবা দু’হাতে মায়ের গলা শক্ত করে চেপে ধরেছেন! দাদা ছুটে যেয়ে বাবার হাত থেকে মা-কে ছাড়াতে চেষ্টা করলেন এবং মা হাত-পা ছুঁড়াছুঁড়ি করছেন! কিন্তু জোঁকের মতো খামচে ধরা গলা কোনোভাবেই ছাড়ানো গেল না! একসময় মায়ের শেষনিঃশ্বাসটা দেহ থেকে খসে গেল, ঝরে-পড়া নক্ষত্রের মতো! শেষরাতে কৃষ্ণপক্ষের খণ্ডচাঁদটা যখন আকাশে শেষ জ্যোতি ঢেলে প্রস্থানের আয়োজন করছিল, তখন দাদা-বাবা মিলে মায়ের গলায় শাড়ি পেঁচিয়ে তাঁকে আত্মহত্যার তকমা দিয়ে ঘরের আড়ায় লটকে দিল!

মা চলে যাওয়ার মাসখানেক পর, বাবা রাজকন্যাকে ঘরে তুললেন! এরপর থেকে অবশ্য বাবার ঘরে প্রতিদিন শনিবার হয়। মানে উৎসবের দিন! বাসনা-সাবান গায়ে ঘষেমেজে ঘনঘন গোসল করেন! সুগন্ধিও মাখেন আগের চেয়ে বেশি মাত্রায়। রাজকন্যাকে নিয়ে ঘটা করে বেড়াতে যান। মায়ের সেই কামরাতে রাতভর ভালোবাসার গল্পের আওয়াজ ভেসে আসে। আমি রাত হলে দাদার বুকে গুটিসুটি হয়ে শুয়ে থাকি। দাদা আর আমার দিন কেটে যায় কোনোমতে। আমি দাদার বুকে মুখ গুঁজে মধ্যরাতে নিঃশব্দে কাঁদি। দাদা নিজহাতে মায়ের লাশ ফাঁসিতে ঝুলানোর অনুতাপে জ্বলেপুড়ে নিঃশেষ হন! 


আজ মায়ের চলে যাওয়ার একবছর পূর্ণ হল! অভ্যাসবশত হয়তো, বাবা গা ধুতে গেলে আজও সাবানদানি হাতে তাঁর পিছুপিছু নদীর ঘাটে যাই! শিমুলগাছের ডালে শিশিরভেজা দাঁড়কাকটা একটানা ডেকে যায়! বাবা সাবানফেনার শরীর ধুতে শীতের ধোঁয়া-ওঠা উষ্ণ-গাঙে গলাজলে নামেন। এ-সময় দাঁড়কাকটা ভেজাডানায় ভর করে উড়ে আমার সামনে চলে আসে! বাবা সহসা জলের নিচে মাথা গুঁজেন। আমি অপলক সেদিকে তাকিয়ে থাকি। দাঁড়কাকটা আমার হাতের সন্নিকটে চলে আসে। আমি হাত বাড়িয়ে সাবানদানিটা এগিয়ে ধরি। বাবার শেষ নিঃশ্বাসের বুদবুদ পানি ফুঁড়ে জলের ছাদে ভেসে ওঠে। দাঁড়কাক নির্ভারে সাবান ঠোঁটে গুঁজে শিমুলগাছে ফেরে। এবং বাবার নিথর দেহটা ধীরে-ধীরে জলের তলে তলিয়ে যায়!

Comments

Post a Comment