একা বলে, একাই শোনে। সব কথা পাঁচকান করতে নেই। সবাইকে সব কথা কি বলা যায় নাকি? যাঃ!
সব কথা যেমন সকলকে বলতে নেই, তেমনি শুনতেও নেই। অর্বাচীন অবশ্য শোনে, কিন্তু বলে না। সে এখন একা-একা কবরখানায় চলে যায় মাঝেমধ্যেই। কবরগুলোর সঙ্গে চুপিচুপি কথা বলে। কী বলে, কাউকে বলে না। সে অবশ্য শ্মশানেও যায়। দ্যাখে আধপোড়া চিতাকাঠ আর ছড়িয়ে থাকা ছাই। দু-একটা মড়ার খুলিও তার দৃষ্টি এড়ায় না। ওদের শহরের—শহর না ছাই, শহরের মতো গ্রাম, তা সেই শহরের ধারে নদীর পাড়ে শ্মশান। অর্বাচীনের মনে হলো, শ্মশান বড্ড ফাঁকা-ফাঁকা লাগে। এখানে এলেই ভয়-ভয় করে। আধপোড়া চিতাকাঠ দেখলেই তার আরও ভয় করে। সে ভাবে, এখন সে ভাবতে পারে, তাই ভাবে—আমি ম'লে আমাকেও ওমনি জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেবে! না বাপু, থাক তবে, মরে আর কাজ নেই।
সব কথা যেমন সকলকে বলতে নেই, তেমনি শুনতেও নেই। অর্বাচীন অবশ্য শোনে, কিন্তু বলে না। সে এখন একা-একা কবরখানায় চলে যায় মাঝেমধ্যেই। কবরগুলোর সঙ্গে চুপিচুপি কথা বলে। কী বলে, কাউকে বলে না। সে অবশ্য শ্মশানেও যায়। দ্যাখে আধপোড়া চিতাকাঠ আর ছড়িয়ে থাকা ছাই। দু-একটা মড়ার খুলিও তার দৃষ্টি এড়ায় না। ওদের শহরের—শহর না ছাই, শহরের মতো গ্রাম, তা সেই শহরের ধারে নদীর পাড়ে শ্মশান। অর্বাচীনের মনে হলো, শ্মশান বড্ড ফাঁকা-ফাঁকা লাগে। এখানে এলেই ভয়-ভয় করে। আধপোড়া চিতাকাঠ দেখলেই তার আরও ভয় করে। সে ভাবে, এখন সে ভাবতে পারে, তাই ভাবে—আমি ম'লে আমাকেও ওমনি জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেবে! না বাপু, থাক তবে, মরে আর কাজ নেই।
একদিন হাঁটতে-হাঁটতে একটা মসজিদের সামনে চলে গিয়েছিল। দেখলো, মসজিদের পিছনদিকে পাঁচিলঘেরা সুন্দর একটা বাগান। বাগানে লোহার শিক দিয়ে তৈরি দরজা। বন্ধ। সে উঁকিঝুঁকি মেরে দেখলো। কিছুই বুঝতে পারলো না। উপরের দিকে তাকালো, দেখলো সাদা টিনের উপর কালো রঙ দিয়ে লেখা 'গোরস্থান'। সে ভাবতে শুরু করলো, যা বাব্বা গোরস্থান আবার কী? এ তো কোনদিন শুনিনি! সে কিছুক্ষণ ভাবলো, তারপর থই না-পেয়ে ছেড়ে দিল। নিজেকেই বললো, ধুউউউস।
কিন্তু ধুস বলে উড়িয়ে দিলে হবে? সবকিছুতেই ছাড়ান পেয়ে যাবে নাকি! এমনি-এমনি সব হয় না ভাই, মাগনা দিতে হয়। তা অর্বাচীনকে আর মাগনা দিতে হয়নি। সে মাগনা পেয়ে গেল। গোরস্থানের সামনে থেকে এগিয়ে মসজিদের সামনে এসে যখন সে পিছমোড়া হয়েছে, তখনই তার বয়সী একজনের আবির্ভাব। পরনে ধোপদুরস্ত প্যান্ট-শার্ট। হাতে ঝকমকে সাইকেল। সে যাচ্ছিল সাইকেলে চড়ে। বেশ যাচ্ছিল। কেন যেন হঠাৎ নেমে পড়লো অর্বাচীনের সামনে। অর্বাচীনও থমকে গেল। সাইকেল-আরোহীর দিকে নজর ফেললো। সাইকেল-বাহক কপাল কুঁচকে জিজ্ঞাসা করলো, "কীরে, অর্বাচীন না?"
অর্বাচীন হাঁ করে তাকিয়ে আছে। বাপকালে দেখেছে কিনা মনে করতে চেষ্টা করছে। তখনই সাইকেল-আরোহী বললো, "কীরে চিনতে পারলি না? আমি সিরাজ। তোর সঙ্গে ক্লাস এইটে পড়তাম।"
অর্বাচীন অনেকক্ষণ তার মুখের দিকে চেয়ে থেকে অবাক স্বরে বললো, "ইস্কুলে? কী জানি! মনে নেই। আমার কিছু মনে থাকে না।"
—তা এখানে কেন?
—এমনি। আচ্ছা, ওই গোরস্থানটা কী?
—গোরস্থান? যারা মারা যায় তাদের ওখানে গোর দেওয়া হয়। মানে মাটির নিচে শুইয়ে দেওয়া হয়।
—অ। তা আমি মলেও ওখানে শুইয়ে দেবে?
—না, তোকে দেবে কেন? যারা মুসলমান শুধু তাদেরই ওখানে গোর দেওয়া হয়। তোকে তো শ্মশানে পুড়িয়ে দেবে।
—পুড়িয়ে দেবে? আমাকে? ইস, ইয়ার্কি নাকি? আমি পুড়বো না ।
কথাটা বলেই অর্বাচীন বিড়বিড় করতে করতে এগিয়ে গেল। সিরাজ সেদিকে কয়েকমুহূর্ত তাকিয়ে থেকে মৃদু হেসে বললো, "ব্যাটা বদ্ধ পাগল হয়ে গিয়েছে।"
অর্বাচীন কিছুদূর এগিয়ে পিছন ফিরে সিরাজকে খুঁজলো।তার একটা কথা মনে পড়েছে; ভাবলো সিরাজকে জিজ্ঞেস করবে, কিন্তু কোথায় সিরাজ? সে ততক্ষণে ধাঁ। অর্বাচীন সিরাজকে না-দেখতে পেয়ে সামনের পথে এগোতে-এগোতে নিজেকেই প্রশ্ন করলো, আচ্ছা, আমি হিন্দু না মুসলমান বুঝবো কী করে? লোকেই-বা বুঝবে কী করে? আমার গায়ে তো কিছু লেখা নেই। লোকে যদি ভুল করে ভুল জায়গায় দিয়ে দেয়! তা'লে? কাকে যে জিজ্ঞেস করে! আজ বাপটাও নেই, মা-টাও নেই। ওরা থাকলেও না-হয় জিজ্ঞেস করা যেত। যদ্দিন সে ইস্কুলে পড়েছে, তদ্দিন কেউ তাকে বলে দেয়নি। এখনও তো কেউ...অর্বাচীন থমকে গিয়ে কী যেন ভাবলো, তারপর তুড়ি মেরে বললো, পেয়েছি, পেয়েছি। আমি তো আসলে জগা পাগলা...পাগলা...পাগলা...
নাচতে-নাচতে সে ঘরের দিকে এগিয়ে গেল। আজ আর কোথাও যাবে না সে। ঘরের কাছেই যে-পুকুর, এখন ডোবা হয়ে গিয়েছে, ওখানে দুটো ডুব দিয়ে একবাটি মুড়ি খেয়ে শুয়ে থাকবে। আজ তার খুব আনন্দ। একটা কথার জবাব পেয়ে গিয়েছে সে। আসলে তার কোনো জাত নেই। সে তো পাগল বলো পাগল, অর্বাচীন বলো অর্বাচীন।
হঠাৎই তার মাথায় টং করে একটা শব্দ হলো। তখনই তার মনে হলো, আরেএএএ, আমি পাগল হলেও তো মানুষ। আমি তো মানুষের মতোই সব কিছু করি। তা'লে আমার যদি জাত না-থাকে, মানুষেরও তো জাত নেই। তা'লে?
(চলবে)
Comments
Post a Comment