একটা কথা কিছুতেই অর্বাচীনের মাথায় ঢুকছে না; এখানে একটা পুকুর ছিল, অমন পেল্লাই বাড়ি হলো কী করে! বাড়ি মানে আকাশছোঁয়া বাড়ি। ছাদে উঠলে মেঘ ছুঁতে পারবে। কথাটা অর্বাচীনের মনে হতেই ভাবতে শুরু করলো। আসলে সে তো এখন বেশ দার্শনিকের মতো ভাবতে পারে। মাথার চুলে সাদা প্রলেপ পড়তেই তার মগজে ভাবনাগুলো শিমুলতুলোর মতো ছড়াতে শুরু করেছে। যেমন, এখন তার ভাবনা—ছিল পুকুর, হয়ে গেল বাড়ি। আবার যেমন-তেমন নয়, আকাশছোঁয়া বাড়ি! তবে যতটা সে ভাবতে চায়, ততটা ভাবতে পারে না। ওই আকাশছোঁয়া বাড়িটার মতো ভাবতে চায়, কিন্তু একতলায়-দোতলায় ওঠার পর পড়ে যায়। তখন ভাবে, যাব্বাবা এ কী হলো!
কী যে হলো, অর্বাচীন ধানডাঙা মাঠের দিকে এগোলো। কতদিন যে ওদিকে যায়নি! আসলে কবে কখন কোথায় যে সে যাবে, সে-সব কি সে নিজেই জানে? সেজন্যেই তো সে ভাবে এক, করে আর এক। কেউ যদি জিজ্ঞেস করে, কীরে তুই যে বললি পুবে যাবি, তা পশ্চিমে এলি কী করে?
সে হলুদ দাঁতে বিড়ির গন্ধছোটা হাসি ছড়িয়ে বলবে, তাই? কী জানি!
সে হাঁটতে-হাঁটতেই খি-খি করে হেসে ওঠে। তবে প্রকাশ্যে নয়, নিজের মধ্যে। বলে, "আমি তো জগা—জগা পাগলা।" আর পাগলা বলেই, নিজের প্রশ্ন নিজের কাছে রেখে দেয়। নিজে-নিজেই অবাক হয়। এই যেমন এখন ধানডাঙা মাঠের দিকে এসে অবাক হয়ে গেল। কোথায় মাঠ! এ তো সব বাড়ি! একতলা, দোতলা, তিনতলা—নাঃ, আর গোনে না। শতকিয়া তার মনে নেই। থাকলে কি আর গুনতে পারতো না? বরং ভাবনাই ভালো। এখন সে ভাবতে শুরু করলো—এখানে একটা মাঠ ছিল। বল খেলা হতো। মাঠের ধারে উই ওদিকে খেজুর গাছ ছিল। সন্ধের সময় ওইসব গাছ থেকে ঠিলি পেড়ে দুষ্টু ছেলেরা রস খেতো। অর্বাচীনও খেয়েছে। তখন তো সে অর্বাচীন কিংবা জগা পাগলা হয়নি, তখন শুধুই জগা। আচ্ছা, খেজুর গাছের ওপারে একটা ধানখেত ছিল না! যাব্বাবা সবাই ভোঁ-ভা?
অর্বাচীন অবাকচোখে দেখছে আর ভাবছে। তার চুলে রুপোরঙ দেখা দেওয়ার পর থেকে তো সে ভাবতে পারে, তাই ভাবছে। এই যে একটা শহরের মধ্যে আরেকটা শহর হয়ে গেল, তার লোকজন কেমন? আচ্ছা, এরা কি বল খেলে? খেজুর-রস গাছ থেকে পেড়ে খায়? বঁইচি চেনে? নাকি শুধু ফুলগাছ লাগায়? সব বাড়িতে শুধু ফুল আর ফুল! একটাও পেয়ারা গাছ নেই। এই যে বাগানে ফুলগাছ লাগিয়েছে, ওখানে ঢেঁড়স লাগাতে পারতো। বরবটি, বিলিতি বেগুন। হে-হে, হে-হে-হে, এরা কিস্যু জানে না। ধুউউউস।
অর্বাচীন দেখছে আর ভাবছে। আরেব্বাপ! এত বাড়ি! ধরণী সইবে? একটা বাড়ি হচ্ছে; কী পেল্লাই, বাপরে বাপ! যেন আকাশ ফুঁড়ে দেবে! একটা কালোকুলো মোটা ছেলে বেরিয়ে এল বাড়িটা থেকে। তার গলায় মোটা সোনালি রঙের দড়ি। হাতে মেয়েদের কাঁকনের মতো বালা। সে অর্বাচীনের দিকে অল্পক্ষণ তাকিয়ে থেকে এগিয়ে এল।
—জগাদা, এখানে কী করছো?
জগা হাঁ করে তাকিয়ে থাকে।
—চিনতে পারছো না? আমি গোকুল মণ্ডলের ছেলে হেবো।
—তা এখেনে কী কচ্চিস?
—এই যে বাড়িটা হচ্ছে, আমি ম্যানেজার।
—ও। তা গলায় দড়ি বেঁধেচিস ক্যানে?
হেবো একগাল হেসে উত্তর দেয়, দড়ি নয়। সোনার চেন। কত ভরি সোনা আছে বলো তো? চল্লিশ ভরি। তা তুমি কাজ করবে জগাদা?
—কাজ?
—হ্যাঁ কাজ । এই ধরো কাঠগুলো গুছিয়ে রাখলে, মিস্ত্রিদের জল দিলে। এই আর কী। এখানেই থাকবে, খাবে। মাস গেলে না-হয় দু-একশো দেবো।
হেবো তার হাতে একশো টাকার একটা নোট দিয়ে বললো, এটা রেখে দাও। আজ থেকেই তাহলে কাজে লেগে পড়ো।
অর্বাচীন ছোঁ মেরে টাকাটা নিয়ে ঘুরিয়েফিরিয়ে দেখে পকেটে রেখে দিল। হেবোর দিকে তাকিয়ে ছুঁড়ে দিল, ধুউউউস।
(চলবে)
Comments
Post a Comment