নিতাই ভট্টাচার্য

ডোরবেলের শব্দে চিড় ধরে মনোসংযোগে। ঘড়ির দিকে তাকাই। সবে সন্ধ্যা সাতটা, অন্যদিনের চেয়ে আজ একঘন্টা আগে হাজির হয়েছেন অবনীবাবু। ঘড়ির কাঁটা আটটার ঘরে গা মেলালেই অবনীবাবু আসেন আমার ঘরে, রোজ। বাড়িতে সবাই নাকি টিভি সিরিয়াল দেখতে ব্যস্ত থাকে। বাড়ির আশেপাশের বন্ধুবান্ধবরাও ব্যস্ত নিজেদের মতো; কথা বলার লোক নেই।

হাজারো সোশ্যাল প্রবলেম নিয়ে নিজের মনেই নানাকথা বলেন অবনীবাবু। পুকুর বুজিয়ে ফ্ল্যাট তৈরি করছে কারা, কাটমানির উৎপাত, চাকরি বিক্রি হয়ে যাচ্ছে, নারীপাচার, রেশন দুর্নীতি,  গণতন্ত্র বলে কিছু নেই—এইসব। আর মাঝেমাঝেই বলেন, "এইসব নিয়ে কিছু লিখুন মশাই। কী যে হাবিজাবি লেখেন আপনি, বুঝি না! নিজে নেশায় ডুবে আছেন আর সমাজটাকে নেশাগ্রস্ত করে তুলছেন।" শুনতে খারাপ লাগে আমার, তবুও চুপ থাকি।

শেষ কয়দিন ধরে বিমর্ষ অবনীবাবু, মুখে কথার খরা। যেন কাছের মানুষ চলে গেছে চিরতরে না-ফেরার দেশে, ভেঙে পড়েছেন তাই। বড্ড সংবেদনশীল মানুষ। কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না ঘটনাটা। আমার ঘরে এসে বসে থাকেন চুপ করে আর মাঝেমধ্যে বলে ওঠেন, "মেয়েটার মৃত্যু! অসহনীয়!"

দিনকতক আগের ঘটনা। একটি মেয়ে খুন হয়েছে। সংবাদমাধ্যমের সৌজন্যে সে-ঘটনার কথা শুনেছে সকলে, ছবিও দেখেছে। প্রতিবাদে দেশজুড়ে পথে নেমেছে সাধারণ মানুষ। "জাস্টিস চাই" ধ্বনিতে কেঁপে উঠেছে আকাশবাতাস। বুদ্ধিজীবীদেরও দেখা গেছে পথে। আমাদের টেলি-ইন্ডাস্ট্রির অভিনেতা, অভিনেত্রী, পরিচালক, প্রযোজক সবাই হেঁটেছেন মিছিলে। "উই ওয়ান্ট জাস্টিস", মুষ্টিবদ্ধ ডানহাত আকাশে তুলে। বড়োপর্দার তারকারাও বাদ যায়নি। অন-ক্যামেরার সামনে নিজেদের মনের সুতীব্র যন্ত্রণা উগরে দিয়েছেন অনেকে। প্রায় সকলেই প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ন্যায় বিচার না-পাওয়া পর্যন্ত তাঁরা মাঝেমধ্যেই পথে নামবেন, অন্যায়ের বিরুদ্ধে এককাট্টা সবাই, "দাবি এক, দফা..."। আমাদের প্রোডিউসার রেড্ডিসাহেব তো রীতিমত উত্তেজিত হয়ে মিডিয়ার সামনে অনেক কথা বলেছেন।  টিভি সিরিয়ালের গল্পের মাধ্যমে এই ঘটনার প্রতিবাদ বাঙালির ঘরে-ঘরে পৌঁছে দেবেন, এমন প্রতিশ্রুতিও তিনি দিলেন। হিন্দিতে বলেছিলেন সবটাই, বাংলা ভালো জানেন না রামপ্রকাশ রেড্ডি। সেই মিছিলে আমিও ছিলাম। প্রতিবাদমুখর সেলিব্রেটিদের কাছ থেকে দেখেছি। অবাক হয়েছি নিশিপ্রিয়া মিত্রকে দেখে। টেলি-ইন্ডাস্ট্রির নামী নায়িকা নিশিপ্রিয়া। এই নির্মম ঘটনায় ভীষণ আপসেট হয়ে পড়েছেন। করুণ কান্নার সংযমী সংকেত গলায় নিয়ে কোনোমতে কয়েকটি কথা বলতে পারলেন, "আই ক্যান্ট সে এনিথিং, রিয়েলি প্যাথেটিক। সামনেই ফেস্টিভ্যাল। এই ইয়ারে আমি কোনো উৎসব..."


ডোরবেল আবারও জানান দিল, অবনীবাবু বাইরে অপেক্ষারত। আমিও ব্যস্ত। আজ রাতের মধ্যেই সাতকিস্তি স্ক্রিপ্ট মেইল করে পাঠিয়ে দিতে হবে। ছয়টা কিস্তি পাঠিয়ে দিয়েছি আগেই। সপ্তম কিস্তি নিয়ে নাস্তানাবুদ হচ্ছি। ভীষণ রোমান্টিক এপিসোড, তাড়াহুড়ো চলে না। আর এই সময়! নামী চ্যানেলের সঙ্গে চুক্তি পাকা হয়েছে আমার, দিনদুই আগে। আমার লেখা গল্প 'সজনে ফুলের বাসর'। কাহিনি মন দিয়ে শুনেছেন প্রোডিউসার। পরিচালক, চ্যানেলের গণ্যমান্য লোকজনও গল্প শুনেছেন। কাহিনি আঁচড় কেটেছে সবার মনে। বাংলার ঘরে-ঘরে সান্ধ্য বিনোদনে এইবার আমার কাহিনি আগতপ্রায়।


"এক্সট্রা-ম্যারিটাল অ্যাফেয়ার ইজ এসেনশিয়াল। আপ ইসকো অউর ভি ঠিকসে দিখাইয়ে সুমনজি। আপ কা ইয়ে কাহানি বহত আচ্ছা হ্যায়।" বলেছেন রেড্ডিসাহেব। কথার মান্যতা দিতেই হয়, তাঁর সুবাদেই বাংলার ঘরে-ঘরে সান্ধ্য সিরিয়ালের গাঢ় বিনোদনের জমাট আসর। স্টোরি কনটেন্ট, ঘটনার ওঠাপড়া শুনে খুশি ডিরেক্টরও। লিডরোলে নিশিপ্রিয়া মিত্রকে ভেবেছেন তিনি। কথাও বলেছেন নায়িকার সঙ্গে। পুজোর পরপর শুটিং শুরু হবে। "কাহিনি কা নাম আপনে আচ্ছা সে চুনা। একটা গ্রামের গন্ধ আসছে। পরকীয়ার ব্যাপারটা আরও একটু লাউড করুন, জমে যাবে।" বলেছিলেন পরিচালক। বাংলা সিরিয়ালের টিআরপি ভেবে কিছু বিষয় লাউডলি আমদানি করতেই হয়, জানি। ডোরবেল আবারও জানান দিল...

কিছুটা বিরক্ত হয়েই দরজা খুলি। মন্থরপায়ে ভিতরে এলেন অবনীবাবু। বসেছেন আমার সামনের চেয়ারে। অবিন্যস্ত চেহারা, থমথমে মুখে বিষণ্ণতার পুরু প্রলেপ বোঝা যায় স্পষ্ট। দৃষ্টি থমকে দাঁড়িয়ে রয়েছে আমার লেখার টেবিলের উপর। এইবার হয়তো আমাকে বলবেন, "কলমটা বিক্রি করবেন না মশাই। সমাজের কথা ভাবুন। সমরেশ বসুকে কাছ থেকে দেখেছি। চরম দারিদ্র্যের মধ্যেও..."

এই সময় পরিচালকের ফোন আসে। আগের ছয়টা এপিসোড পড়ে ফেলেছেন তিনি। অভিভূত হয়েছেন স্ক্রিপ্ট পড়ে। পরের ঘটনা জানতে চেয়ে ভীষণ উদগ্রীব। কৌতূহল নিরসনে এই ফোন। সংক্ষেপে সপ্তম এপিসোডের বিষয়বস্তু শোনাই  আমি।

গ্রামের সুন্দরী মেয়ে প্রতিমা। শহুরে ছেলে অলীক। প্রতিমা আর অলীকের মধ্যে দ্বিতীয়বার দেখা হচ্ছে। সেই নিয়েই সপ্তম এপিসোড। নিজের-নিজের মনের অবস্থা সাজিয়েগুছিয়ে বলা। প্রেমহীন জীবনে প্রেম পেতে তীব্র ব্যাকুলতা। প্রতিমার স্বামী পাশে থেকেও অনেক দূরের মানুষ আজ। গ্রামের মেয়ের মোহ উবে গেছে তার। প্রতিমাকে মনে ধরে না আর। প্রতিমার সঙ্গ ছেড়ে সংগোপনে অন্য এক নতুন সম্পর্কে ভেসে চলা। ডুব দেওয়া। জল খাওয়া। সাঁতার কাটা। মেসেজ করা। অফিস যাওয়া। এবং শত কথা বলার পরেও হাজার কথা বাকি রেখে বাড়ি ফেরা। সব মিলে, আহা কী আনন্দ সকালে-বিকালে। ট্রেনে-বাসে, পাশে বসে, কত কথা চাপাস্বরে।

ওদিকে প্রতিমার ভালোবাসার ফুলটিও পাপড়ি মেলেছে। স্বামীর খুব কাছের বন্ধু অলীককে মনে ধরে প্রতিমার। সাড়া দিয়েছে অলীক। প্রতিমার আকাশে কে যেন আবির ছড়িয়ে দিল আর মনে ফাগুন এল গুনগুনিয়ে। আজ প্রথম অলীককে একলা পেয়েছে প্রতিমা। শুনিয়ে দিতে হবে মনের গোপনতম কথাটি, অতি গোপনে। গ্রাম্য মিষ্টতা প্রতিমার সংলাপে। হৃদয়জুড়ানো সে-সংলাপ। আহা মরি-মরি, বলিতে-বলিতে, উথলি হৃদয়, অশ্রু চোখের কোলে। তারপর...সবটা শুনে পরিচালক খুশি হয়ে বললেন, "এক্সিলেন্ট! দারুণ, দারুণ!"

কথা শেষ করে চেয়ারে বসি আমি। দেখি অবনীবাবু অপলকে চেয়ে রয়েছেন আমার দিকে। কিছু ভাবছেন হয়তো। কিছুটা অস্বস্তি গ্রাস করে আমাকে। স্বাভাবিক হতে জিজ্ঞাসা করি, "কিছু বলবেন?" 

"না। কী আর বলবো!" সংক্ষিপ্ত উত্তর এল। দুইহাতে মুখ ঢেকে বসে রয়েছেন চুপ করে।

যথাযথ শব্দ বাক্যে সাজাতে হবে সংলাপ, ভাবছি সে-নিয়ে। প্রতিমার সংলাপ নিয়ে চিন্তা নেই বিশেষ। গ্রাম্য কথা, অসুবিধা হবে না। অলীকের মুখে শব্দ বেশ ভেবে বসাতে হবে। কলকাতার ছেলে অলীক। বাংলা, ইংরেজি, কখনও হিন্দি শব্দও আনতে হবে ডায়লগে; নয়তো চরিত্রের সঠিক চিত্রায়ণ হবে না। ভাবনা নড়ে ওঠে আমার। 

"ওঃ কী অবস্থা!" বলে উঠলেন অবনীবাবু। কোন অবস্থার কথা বলছেন, আমি জানি। নতুন করে সে-প্রসঙ্গ উত্থাপন করতে চাই না। "এমন নৃশংস ঘটনা! আর সেটা নিয়ে..." যন্ত্রণাকাতর স্বরে কথাগুলো বললেন অবনীবাবু। চশমার কাঁচ ঝাপসা হয়ে এসেছে। গালের কুঞ্চনে ধরা পড়েছে দু-চারফোঁটা অশ্রুবিন্দু। যে-কোনো সামান্য বিষয় লম্বা ছায়া ফেলে ওনার মনে, এর আগেও দেখেছি। মাসখানেক আগে শহরের এক নামী শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের হোস্টেলে এক ছাত্রের মৃত্যু হয়। কেউ-কেউ বলেছিলেন, সেটি নাকি আত্মহত্যা। সেবারও আমাদের ইন্ডাস্ট্রির লোকজন মোমবাতি নিয়ে মিছিলে হেঁটেছিল। ব্যাপারটা তারপর প্রশাসনের হাতে চলে গেছে। আমরাও নিশ্চিন্ত হয়ে যে-যার মতো কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছি। অবনীবাবু বহুদিন পর্যন্ত গুম হয়ে ছিলেন। রোজ আমার ঘরে এসে বলতেন, "মানুষ যে কীভাবে মানুষকে মেরে ফেলে!" আর দু'চোখের কোল টলটলে হয়ে উঠতো জলে।

এই মুহূর্তে টেবিলে মাথা নামিয়ে বসে রয়েছেন অবনীবাবু। মনের তীব্র যন্ত্রণা বাইরে আসতে উন্মুখ। শরীরটা কেঁপে-কেঁপে উঠছে। মাঝেমাঝে মাথাটা নাড়ছেন। কাঁদছেন ভদ্রলোক। এই পরিস্থিতিতে ঠিক কী বলা উচিত, বুঝে উঠতে পারছি না। এক অদ্ভুত অবস্থার মধ্যে পড়েছি। কিছু-কিছু মানুষ যে কেন এত ঠুনকো মনের হয়!


ফোনটা বেজে ওঠে। ওপ্রান্তে প্রোডিউসার রেড্ডিসাহেব। "সুমনজি শুনিয়ে না, ও জো লেডি ডক্টর কা..." 

কী বিপদে পড়লাম! আবার গল্পে মোচড় আনার ফরমায়েশ। একটা রোমান্টিক কাহিনি 'সজনে ফুলের বাসর', সেখানে এমন একটা সেনসিটিভ ঘটনা কীভাবে আনবো! প্রেম, ভালোবাসা, গান—সেখানে খুন আসবে কীভাবে? চিন্তায় জেরবার হয়ে উঠেছি। দেখি অবনীবাবু আবারও মুখ তুলে চেয়ে আছেন আমার দিকে। ওনার দৃষ্টি বিদ্ধ করেছে আমাকে। দুইচোখের ভিজে পাতায় শ্লেষ ঘন হয়ে এসেছে, আমার সঙ্গে রেড্ডিসাহেবের কথপোকথন শুনে।


অবনীবাবুর উপস্থিতি ভুলে ভাবনায় ডুব দিতে চাইছি আমি। কাহিনী কীভাবে সাজাবো ভাবছি। বললেই তো আর গল্প ডানা মেলে না! সূত্র লাগে। সেদিনের মিছিল, টিভিতে দেখা বিভিন্ন মুহূর্ত, মেয়েটির বাবার কান্না, মায়ের আর্তনাদ, নিশিপ্রিয়ার কান্না ইত্যাদি দৃশ্যগুলি দুই চোখ বন্ধ করে মনে করবার চেষ্টা করছি; যদি নতুন এপিসোডের খেই খুঁজে পাই। 

হঠাৎ করেই ঘরের নীরবতা ভঙ্গ হয়। অবনীবাবু বলে ওঠেন, "ছিঃ, মানবতার এমন মৃত্যু!" 

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চলে গেলেন আমার ঘর থেকে। কথাটার অর্থ ভাববার সময় এই মুহূর্তে আমার নেই।ইতিমধ্যে অষ্টম এপিসোডের সূত্র খুঁজে পেয়েছি আমি। একটা নতুন দৃশ্য ফুটে উঠেছে আমার মনে।

একা-একা বসে টিভি দেখছিল প্রতিমা। অলীকের সঙ্গে কথা হয়নি একবেলা, তাই কিছুটা আনমনা হয়েই চেয়ে রয়েছে টিভির দিকে। হঠাৎ খুন হওয়ার খবরটা একটা রক্তাক্ত ছবি সঙ্গে নিয়ে ভেসে আসে পর্দায়। সেই ভয়াবহ দৃশ্য দেখে মাথা ঘুরে জ্ঞান হারানোর উপক্রম হয় প্রতিমার। অলীক আসে সেই মুহূর্তে। ভ্যাগিস, নয়তো মেঝেতে পড়ে গিয়ে বিপদ হতে পারতো। হয়নি, অলীকের দুইহাতের বন্ধনীতে ধরা পড়েছে প্রতিমা। এক্কেবারে দেখবার মতন দৃশ্য তৈরি হবে। প্রতিমাকে প্রথমবারের জন্য স্পর্শ করছে অলীক। কাহিনি সুরভিত হবে আরও, আমি নিশ্চিত। সবটা শুনে রেড্ডিসাহেব তারিফ করলেন আমার দৃশ্যভাবনার কল্পনাশক্তির। চাপমুক্ত লাগছে এইবার। এরই মাঝে পরিচালকের মেসেজ আসে। শুটিং পিছিয়ে যাবে দিন দশেক। নিশিপ্রিয়া মিত্র কয়েকদিনের জন্য ব্যাংকক আর কোথায় যেন ঘুরতে যাবেন। কিছুদিন বাড়তি সময় পেয়ে গেলাম আমি, গল্পটা এগিয়ে নিয়ে যেতে সুবিধা হবে।


রাত হয়েছে বেশ। বারান্দায় পায়চারি করছি। রেড্ডিসাহেব খুশি হয়েছেন ভেবে ভালো লাগছে। আফটাল অল, ক্যামেরার সামনে সেদিন ওনার কমিটমেন্টের কথা মনে রেখে 'সজনে ফুলে বাসর' সিরিয়ালের কাহিনিতে বর্তমান সময়ের একটা ছাপ রাখতে পেরে ভীষণ খুশি আমি। এক অপরিমেয় তৃপ্তির মৌতাত ছেয়ে এসেছে মনে। হঠাৎ করে নজর গেল সামনের রাস্তায়। দেখি শুনশান রাস্তায় ধীরপায়ে ঘোরাফেরা করছেন অবনীবাবু। হয়তো হতাশার করুণ সুরে নিজেকেই শোনাচ্ছেন, "ছি-ছি-ছি! মানবতার এমন মৃত্যু! অসহনীয়, অসহনীয়!"

Comments