প্রাণেশ সরকার

ওদের বিয়ের বেশ কিছুদিন পরে একদিন স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে লক্ষ করি, বাড়িতে এক থমথমে পরিবেশ। কী ব্যাপার জিজ্ঞেস করতেই দিদি আমাকে বলে, "কীরকম মেয়ে দেখেশুনে নির্বাচন করলি! দুর্গা তো অসুস্থ, ওর হার্টের অসুখ আছে।" আমি তো শুনে থ'। মেয়েটির লক্ষ্মীশ্রী দেখে আমার পছন্দ হয়েছিল আমার পুত্রসম বড়োভাগ্নের স্ত্রী হিসাবে। ও যে অসুস্থ, কলকাতায় ওর যে হার্টের নিয়মিত চিকিৎসা হয়, একথা তো চাকদহের কেউ আমাকে বলেনি! যাইহোক, পরেরদিনই নেটু দুর্গাকে সঙ্গে করে চাকদহে গিয়ে ওর চিকিৎসা-সংক্রান্ত কাগজপত্র সব নিয়ে আসে এবং অতি দ্রুত কলকাতার পিজি হসপিটালে হার্ট-স্পেশালিস্ট ডক্টর গৌতম সেনগুপ্ত-র সঙ্গে যোগাযোগ করে। এই ডক্টর সেনগুপ্ত প্রথমজীবনে বাদকুল্লা গ্রামীণ হাসপাতালে কর্মরত ছিলেন এবং নেটুর সঙ্গে ওঁর ভালো সম্পর্ক ছিল। ডক্টর সেনগুপ্ত-র তত্ত্বাবধানে দুর্গার চিকিৎসা শুরু হয় এবং উনি ওর ওপেন হার্ট সার্জারির সুপারিশ করেন। আসলে, জন্ম থেকেই দুর্গার হার্টের ভালভে ছিদ্র ছিল। ওপেন হার্ট সার্জারি ছাড়া আর  অন্য কোনো উপায় ছিল না। দিনক্ষণ ঠিক হয়, ব্যয়সাধ্য এই শল্যচিকিৎসার সাজসরঞ্জাম কেনার টাকাও সংগ্রহ করি আমরা এবং ডক্টর সেনগুপ্ত তাঁর সহকারীদের নিয়ে হসপিটালের কার্ডিও-থোরাসিক ডিপার্টমেন্টে ১২ ঘন্টা ধরে জটিল এই অপারেশন করেন। বিধ্বস্ত চেহারায় অপারেশন থিয়েটার থেকে বেরিয়ে উনি নেটুকে বলেন, "আমরা আংশিক সফল হয়েছি। এখন ওষুধপত্র চলুক, কিছুদিন পরে আবার অপারেশন করতে হবে।" কিছুদিন হসপিটালে থাকার পরে দুর্গা বাড়ি আসে, ওষুধপত্র-পথ্য ইত্যাদি নিয়মিত চলে এবং ক্রমে-ক্রমে বেশ ভালোই হয়ে ওঠে সে; এমনকি চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়েই কনসিভ-ও করে। কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হসপিটালে এক ফুটফুটে কন্যাসন্তানের জন্মও দেয় দুর্গা। বাড়িতে আনন্দের ঢল নামে। ধুমধাম করে বাচ্চাটির (ওর ভালোনাম ত্বিষা, ডাকনাম মন্টাই; আমি মনা বলে ডাকি—সে এখন নার্স, আসানসোলের এক বড়ো হাসপাতালে চাকরি করছে) অন্নপ্রাশন হয়। সবকিছু ঠিকঠাক চলে। কিন্তু মনা যখন ক্লাস ফাইভে পড়ে, তখন থেকে আবার দুর্গার হার্টের সমস্যা বাড়তে থাকে। কত দামি ওষুধপত্র চলতে থাকে, কিন্তু দিনদিন সে অসুস্থ হয়ে পড়ে। নেটু সামান্য ঠিকাদারির কাজ করে, কিন্তু স্ত্রীর চিকিৎসার কোনো ত্রুটি সে রাখেনি। আবারও পিজি হসপিটাল। ডক্টর সেনগুপ্ত ক্রিটিকাল ইনটেন্সিভ কেয়ার ইউনিটে ভর্তি করেন দুর্গাকে। ক'দিন পরে ওর আবার ওপেন হার্ট সার্জারি হবে। আমি মনাকে নিয়ে হাসপাতালে যাই। নেটুরা তো হাসপাতালেই থাকতো; কখন কী দরকার হয়! মনা ওর মা-কে কাচের বাইরে থেকেই দ্যাখে। আমাকে দেখা করতে দেয় না কর্তৃপক্ষ। নিয়ম তো মানতেই হয়। মনাকে নিয়ে ট্রেনে করে আমি বাড়ি ফিরি। ট্রেনে মা-র কথা ভাবতে-ভাবতে, মনা একটু অসুস্থও হয়ে পড়ে। আমাদের কম্পার্টমেন্টের একজন ভদ্রমহিলা ওকে সামলে নেন। আমি একটু বিমূঢ় হয়ে পড়ি। যাইহোক, ভালোয়-ভালোয় ওকে নিয়ে বাড়ি ফিরে আসি। আমরা হসপিটাল থেকে ফিরে আসার ঠিক একদিন পরে দুর্গা মারা যায়। অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়া হয়নি ওকে। সিসিইউ-তেই এক্সপায়ার করে ও। আমি স্কুলে, ক্লাস নিচ্ছি নাইন-এর; পিওন শ্যামলদা এসে বলে, "স্যার, হেডমাস্টারমশাই ডাকছেন।" গিয়ে দেখি, ভাগ্নের কাঠের দোকানের দু'জন কর্মচারী দাঁড়িয়ে। ওরা কিছু বলার আগেই তো বুঝে যাই আমি। হাউহাউ করে কেঁদে উঠি। শিক্ষকরা, ছাত্রছাত্রীরা আমাকে এভাবে ভেঙে পড়তে তো দেখেনি কোনোদিন। সবাই বিমূঢ়বিহ্বল হয়ে আমাকে সান্ত্বনা দিতে থাকে। ওরা গাড়ি এনেছিল, আমি সেই গাড়ি করে বাড়ি পৌঁছই। মনাকে কেউ ওর মা-র মৃত্যুর কথা বলেনি তখনও। নিষ্ঠুর এই দায়িত্ব আমাকেই পালন করতে হয়। কী কঠিন সেই কাজ! কিন্তু বলতে তো ওকে হবেই। দোতলায় ছোটোবৌমা (শুক্লা, ছোটোভাগ্নে রাজুর স্ত্রী)-র কাছে বসেছিল মনা। আমি ওকে ডাকি; সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসার পরে আমি অতি সাবধানে ভয়ঙ্কর সংবাদটা ওকে দিতেই উচ্চৈঃস্বরে কেঁদে ওঠে ও। বাড়িতে উপস্থিত আত্মীয়রা সামলাতে চেষ্টা করে ওকে, সান্ত্বনা দিতে থাকে। আমি ওর মুখের দিকে তাকাতে পারি না। দুপুরের একটু পরে ফুলে-ফুলে সাজানো শববহনকারী গাড়িতে দুর্গা কলকাতা থেকে বাড়ির উঠোনে এসে পৌঁছয়। হাসিখুশি মুখের দুর্গা নয়; মৃত্যুতে নীল, নিঃসাড় আমাদের বাড়ির পরম আদরের বড়োবৌ দুর্গা। প্রথমে মনাকে ওর কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। মা-র মুখ আঁকড়ে ধরে ডুকরে কেঁদে ওঠে মনা। আমি বলি, "তোমরা কেউ ওকে ধোরো না, কাঁদতে দাও।" এরপর নেটু এসে মেয়েকে সামলায়। বাবার বুকে মুখ গুঁজে পড়ে থাকে ও। অনেক পরে শান্ত হয়, পাথরের মতো নিশ্চুপ হয়ে থাকে। শ্মশানযাত্রার জন্য দুর্গাকে সাজিয়ে দেওয়া হয়। শ্মশানবন্ধুরা হরিধ্বনি দিতে-দিতে শ্মশানের দিকে চলে যায়। আমি বাড়িতেই থাকি। মনাকে ছেড়ে যেতে পারি না। ওর বাবা, কাকা—সবাই তো শ্মশানে চলে গেল। যেতেই হয়। দুর্গার দাদা গোবিন্দও শ্মশানে যায় যথারীতি। দুর্গার দিদিরাও এসেছিল; ওরা বাড়িতেই থেকে যায় মনার কাছে।

জয়ন্ত-দুর্গার বিয়ের পরপরই কলকাতা থেকে এসে জো উইন্টার দুর্গার হাতে চমৎকার ফ্রেমে বাঁধানো একটা কবিতা দিয়েছিল; দুর্গাকে নিয়েই লেখা। কবিতাটি এখানে পাঠকদের জন্য তুলে দিচ্ছি আমি। 


Garden

    for Durga


Into the night the song goes on

    of grass and stars, of leaf-shapes, breeze;

and through the night and day remain 

    the gods and goddesses of the trees.


Inside the gate in my new home 

    the mango-tree's dark loveliness 

counts all the past, and all to come 

    of all that's rounds me, more and less.


The purple m-seeded tulsi-plant

    of tender properties, can fit

my presence into its intent 

    at evening, when the lamp is lit.


The durba grass shaped on the ground,

    the pattern of leaves against the sky,

the jack-fruit, lychee, guava send

    a word to know this garden by.


O I am married now, and hear

    a welcome in the very air

of my new home. For many more

    are here, befriending with their care.


Into the night the song goes on

    of grass and stars, of leaf-shapes, breeze;

and through the night and day remain 

    the gods and goddesses of the trees.


                                           — Joe Winter, April 22nd 1997


কবিতা-সহ সেই ফ্রেমটি মনার ঘরের বুকশেলফে রয়েছে। মনা মাঝেমাঝেই পড়ে কবিতাটি। রাইটার্স ওয়ার্কশপ প্রকাশিত জো উইন্টার-এর কবিতা গ্রন্থাবলী সিরিজে এই কবিতাটি অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। 


দুর্গার মৃত্যুর আগেই অবশ্য আমার দিদির মৃত্যু হয়। আমি সেবার আমার ভ্রমণসাথি কৃষ্ণনগরের ত্রিনাথ ঘোষের সঙ্গে যমুনোত্রী, গঙ্গোত্রী ও আরও কয়েকটি স্থানে যাবো বলে মনস্থ করেছি। প্রতিবারই বাড়ির সবাইকে বলে, বিশেষত দিদির অনুমতি নিয়েই এবং সব ব্যবস্থা করে রেখেই বাইরে যাই আমি। সেবারও দিদিকে বলার সঙ্গে-সঙ্গেই দিদি সোৎসাহে সম্মতি জানালো। যাত্রা শুরু করবো সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি। দিদি মুড়ি-মুড়কি, নাড়ু—সব কৌটোয় ভরে দিল ট্রেনপথে খাওয়ার জন্য। আমরা যথারীতি হাওড়া থেকে দুন এক্সপ্রেসে রওনা দিয়ে নির্দিষ্ট দিনে হরিদ্বার পৌঁছলাম। তারপর হরিদ্বার থেকে প্রথমে যমুনোত্রী গেলাম, তারপরে গঙ্গোত্রী। গঙ্গোত্রীতে আবহাওয়া খুব খারাপ ছিল, তাই গোমুখ যেতে পারিনি। গঙ্গোত্রী মন্দির দর্শন করে, বৃষ্টিতে ভিজে প্রবল ঠান্ডায় কাঁপতে-কাঁপতে একতলার ছোট্ট একটা ঘরে ফিরে আসি। গঙ্গোত্রী পৌঁছেই আমরা ওখানে ঘর পাই, অন্য সব জায়গায় যাত্রীতে সব ঘর বোঝাই। এত ঠান্ডা, তার উপর প্রবল বৃষ্টি চলছে একটানা। অত উঁচুতে পাহাড়ের উপর গঙ্গোত্রী মন্দির, প্রচণ্ড ঠান্ডা। ভিজে জামাকাপড় ছেড়ে শুকনো জামাকাপড় পরে, কম্বল জড়িয়ে আমি ও ত্রিনাথদা ভাবছি—কী খাওয়া যায়, বাইরে বেরোবো কীভাবে। এদিকে খিদেয় তো পেটে ছুঁচোয় ডন মারছে। মা গঙ্গার অশেষ করুণা, আমাদের পাশের ঘরটিতেই চারজন বাঙালি পর্বতারোহী রয়েছে, খুব খারাপ আবহাওয়ার কারণে ট্রেকিং স্থগিত রাখতে বাধ্য হয়েছে ওরা। ওরাই জানালো, উপরে পাহাড়ে ধস নেমেছে গোমুখের কাছে ভুজবাসায়। কিছু পর্বতারোহী নিখোঁজ; হেলিকপ্টার সকাল থেকে চক্কর মারছে ওদের উদ্ধার করার জন্য। আরও বললো, "কোথায় যাবেন খেতে এর মধ্যে! আমাদের ঘরে আসুন, আমাদের রান্না হয়ে গেছে, খেয়ে নিন আমাদের সঙ্গে।" পরক্ষণেই সিদ্ধান্ত পাল্টে ওদের দলপতি বললো, "না, বসুন আপনারা, আমরা খাবার দিয়ে যাচ্ছি আপনাদের।" ওরা কাগজের থালায় গরম খিচুড়ি, ওমলেট আর পাঁপড়ভাজা দিয়ে গেল। আহা, অমৃত! চেটেপুটে খেলাম দু'জন। সেদিন রাতেও খেলাম ওদের সঙ্গে, রুটি আর আলুর দম। আমরা কিছু টাকা দিতে চাইলাম। নিয়েছিল ওরা। পরদিন সকালে বৃষ্টি মাথায় বাসে উঠলাম। ওদের দলটিও উঠলো একই বাসে। মিলিটারি ক্যান্টনমেন্ট ছাড়িয়ে ঝালা পয়েন্টের কাছে বাস দাঁড়িয়ে গেল হঠাৎ। কী ব্যাপার? বাস থেকে নেমে আমরা দেখি, সার দিয়ে পরপর সব গাড়ি দাঁড়িয়ে রয়েছে। এপারে, ওপারেও। মাঝখানে ন্যাশনাল হাইওয়ের বেশ কিছুটা অংশ ধসে পড়েছে। পাহাড়ের একটা চূড়া ধসে গিয়ে সরাসরি পথের উপর নেমে ধসিয়ে দিয়েছে পথ। বেলা ১২টা মতো হবে। খবর নিয়ে জানা গেল, রাস্তা আংশিক মেরামতি হতেও ৩০-৩৫ ঘন্টা লেগে যাবে। পর্বতারোহী দলটি পথের সামান্য একটু অংশ—যা বিপজ্জনকভাবে ঝুলছে তখনও, তার উপর দিয়েই অতি-সাবধানে ওদের ব্যাগপত্তর নিয়ে ওপারে চলে গেল। এখন আমরা কী করি? ঝালা পয়েন্টের এক হোটেলের দোতলায় একেবারে কোণার দিকে একটা ঘর পাই। সামনে আপেল-বাগানে অজস্র লাল আপেল ধরে আছে; তার পাশ দিয়েই গঙ্গা প্রবাহিত হয়ে চলেছে। 


হোটেলে গরম জলে স্নান করে নিচে একটা পছন্দমতো রেস্তোরাঁয় খেতে গেলাম। বেলা দুটো। আমাদের টেবিলের ওপাশেই খুব সুন্দরী এক মহিলা, সঙ্গের পুরুষটিও (পরে জেনেছি, মহিলার স্বামী) অতীব সুদর্শন। দু'জনেরই বুদ্ধিদীপ্ত চোখমুখ। আলাপ হলো। মহিলার নাম ইসাবেল, পুরুষটি পিয়েরে। ওরা ফরাসি, প্যারিসে থাকে। ইসাবেল ইন্টেরিয়র ডিজাইনার, পিয়েরে ফিজিক্সের অধ্যাপক। অতি খোলামেলা ও আলাপচারী স্বভাবের। খাবার শেষে কফির কাপে চুমুক দেবো, মোবাইল বেজে উঠলো। আমি যে-স্কুলে পড়াই, সেখানকার প্রধানশিক্ষক পার্থপ্রতিম কুণ্ডু (ও একসময় আমার ছাত্রও ছিল) জানালো, "আপনার দিদি কিছুক্ষণ আগে মারা গেলেন। জেলা হাসপাতালেই আছেন। যত দ্রুত সম্ভব বাড়ি ফিরুন।" হ্যাঁ, ফিরতে তো আমাকে হবেই। কিন্তু কীভাবে? রাস্তা চালু হবে, এখান থেকে ঋষিকেশ হয়ে দেরাদুন স্টেশন যেতে হবে—সবটাই তো নির্ভর করছে ইন্দো-টিবেটান বর্ডার পুলিশ এবং উত্তরাখণ্ডের পিডব্লিউডি ইঞ্জিনিয়ার ও তাদের কর্মীদের কাজের উপর। ওরাই তো যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে সারাই করছে ভেঙে যাওয়া রাস্তা। ফোন রাখার পরে, আমার বিষণ্ণ মুখ দেখেই বোধহয় কিছুটা আঁচ করে থাকবে ইসাবেল ও পিয়েরে। দু'জনেই প্রায় একসঙ্গে জানতে চাইলো, কী হয়েছে। আমি বললাম সব। ইসাবেল বললো, "শোনো, আমি খবর নিয়েছি, আগামীকাল সকাল ১১টা নাগাদ ছোটো গাড়ি চলার মতো কিছুটা রাস্তা (ওয়ান ওয়ে) চালু হয়ে যাবে। আমাদের একটা গাড়ি সকাল ১০টায় এখানে পৌঁছে যাবে। তোমরা সেই গাড়িতে দেরাদুন চলে যাবে, সেখান থেকে ট্রেন ধরবে।বাড়ি তো তোমায় যেতেই হবে।" এই কথা শুনে আমি তো থ' হয়ে গেছি। অভিভূত! কত বড়ো হৃদয় ওদের! 


পরদিন সকাল সাড়ে-দশটা নাগাদ ছোটো গাড়ি চলার মতো পথ তৈরি হলো। ওদের গাড়ি পৌঁছে গেছে এপারে। আমি ও ত্রিনাথদা ওদের বিদায় জানিয়ে রওনা দিলাম। গাড়িতে উঠতে যাবো, পিয়েরে একটা প্যাকেট ধরিয়ে দিল আমার হাতে। বললো, "শুকনো খাবার আছে, পথে খেয়ে নিও তোমরা।" ড্রাইভার ছেলেটি ঋষিকেশে থাকে। গায়ে জ্বর নিয়েই সে আমাদের দেরাদুন পৌঁছে দিল। স্টেশনে এসে জেনারেল কম্পার্টমেন্টের টিকিট কেটে, কুলির সাহায্যে প্রচণ্ড ভিড় ঠেলে কোনোমতে গাড়িতে উঠলাম। আমাদের রিটার্ন-জার্নির যে রিজার্ভেশন টিকিট কাটা আছে, সে তো তখনও সাতদিন পরের তারিখের। যাইহোক, অতিকষ্টে ট্রেনযাত্রা করে বর্ধমানেই নেমে পড়লাম। ওখান থেকে ধাত্রীগ্রাম, নবদ্বীপ হয়ে বাড়ি। বাড়িতে ঢুকতেই কান্নার রোল পড়ে গেল। মনা আমাকে কী ঘটেছিল, সবটাই সবিস্তারে জানালো। ডাক্তারও বলেছেন, ম্যাসিভ কার্ডিয়াক অ্যাটাক। ভাগ্নেরা কাঠের বড়ো বাক্সে বরফ দিয়ে এই প্রায় তিনদিন দিদির মরদেহ রেখে দিয়েছিল। আমি বাড়ি পৌঁছনোর দশ মিনিটের মধ্যেই বাদকুল্লা শ্মশানের উদ্দেশে রওনা দিলাম। শ্মশানে যাওয়ার আগে, আমি দিদির মুখে গঙ্গোত্রী থেকে আনা গঙ্গাজল দু-একফোঁটা দিলাম। 


দিদির মৃত্যুর পর আমি দ্বিতীয়বার মাতৃবিয়োগের ব্যথা অনুভব করলাম। হ্যাঁ, সে তো আমার মায়ের মতোই ছিল; আগলে রেখেছিল আমাকে, আমাদের গোটা পরিবারকে। কত ঝড়-ঝঞ্ঝা বয়ে গিয়েছে আমাদের পরিবারের মাথার উপর দিয়ে। সমবেতভাবেই আমরা সে-সব সামলানোর চেষ্টা করেছি; কিন্তু দিদি ছিল আমাদের সকলের ক্যাপ্টেন। প্রকৃত অভিভাবক-ই ছিল সে। তার মৃত্যুর পরে, শ্রাদ্ধশান্তি মিটে যাওয়ার আগেই দিদিকে নিয়ে একটা কবিতা লিখেছিলাম আমি—


দিদির মৃত্যুতে

কাঠের কফিনে শুয়ে চিরনিদ্রায়। উপরে নিম আর কাঁঠালগাছের

অদ্ভুত ছায়া তার শ্রান্ত কপাল ছুঁয়ে আছে প্রশান্ত নীরবতা দিয়ে। 

ছোট ছোট পাখি এসে গান করে যায়। ছোট্ট নাতনি এসে চোখ মুছে যায়

আর চলে শোকালাপ গৃহপ্রাঙ্গণে। ঝালা পয়েন্টে তার মৃত্যুসংবাদে

ছুটে আসি তড়িঘড়ি দুন এক্সপ্রেসে। বর্ধমান, ধাত্রীগ্রাম, নবদ্বীপ হয়ে 

বাড়ি ফিরি, দেরি হয়, খুব দেরি হয়। অগ্নিদেবতা তাঁর পরমশিখায়

কোল দেয় সস্নেহে এই মানবীকে। নদী দেখে, গ্রাম দেখে তাদের সন্তান 

সন্তানসন্ততি  প্রিয়জন ছেড়ে চলে যায় দূর দেশে মেঘের ভেলায়।


আমার বন্ধু, ইংল্যান্ডের কবি জো উইন্টার আমাকে লেখা তাঁর ৮ মার্চ ২০০৮-এর চিঠিতে দিদির মৃত্যুসংবাদে শোকস্তব্ধ হয়ে কিছু কথা লিখেছিলেন। চিঠিটির প্রাসঙ্গিক অংশটুকু এখানে তুলে দিচ্ছি। 


March 8th '08 

                         

                                                       130 Victoria Road 

                                                     Portslade, Brighton,

                                                  E. Sussex BN 41 IX B


Dear Pranesh, 

                          I have your letter before me of 01.02.07 and apologise for the year's delay in replying. 

                 I was shocked and grieved to hear of Didi's dying. I'm very glad to have met her several times and to have felt the warmth of her broad understanding. She was blessed in having you as a brother. 

...  ...   ...   ... 

                Returning to Didi — my awareness of her, knowing her she has gone, confirms the deep reality to me of my time in India. I understand more how it is part of the texture of my life. And regardless of India or England or names at all, I am glad to have known her and still feel she knows me.

                                                           With love,

                                                                             Joe


এবার আমি জো উইন্টার সম্পর্কে আমার প্রিয় পাঠককুলকে বিশদে কিছু বলতে চাই। বলা আমার কর্তব্য; কারণ এই  বিদেশি এই কবি, লেখক, অনুবাদক ও শিক্ষক আমার জীবনে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছেন। 

(ক্রমশ) 

Comments