আসামের বাঙালি কবি-সঙ্গীতশিল্পী-বাচিকশিল্পী-সঞ্চালক পারমিতার প্রথম উপন্যাস অন্বেষণ The Quest পড়ার পরে মনে হয়, এ যেন ঠিক প্রথাগত উপন্যাস নয়! গতানুগতিকতার বাইরে গিয়ে বিন্যস্ত হয়েছে এর কাহিনি। যে-কাহিনির মধ্যে লেখা হয়েছে আরও একটি উপন্যাস এবং সেই ঔপন্যাসিক অনিকেত রায়চৌধুরী নিজেই এই অন্বেষণ-এর অন্যতম প্রধান চরিত্র। এছাড়া, ব্যক্তিগত জীবনে বিপর্যস্ত ও ভাগ্যহত কবি নীলাদ্রি এবং তার দূরবাসিনী প্রেমিকা সাঁঝবাতি—আরও দুই প্রধান চরিত্র। সাঁঝবাতি নিজেও একজন কবি। বলা ভালো, নীলাদ্রির পরশে ধীরে-ধীরে কবি হয়ে উঠছে সে। আর এই সাঁঝবাতির গভীরতা অনুভব করে, তার দিকে আকৃষ্ট হতে থাকে অনিকেত। তবুও এ-কাহিনি আরও একটি ত্রিকোণ প্রেমের উপন্যাস নয়। বরং ১০০ পর্বে বিন্যস্ত এই উপন্যাসের নির্মাণ একেবারেই অন্যরকম। লেখাকে অন্যরকম করে তুলতে পারাটাই যে-কোনো লেখকের অন্যতম সার্থকতা। অনস্বীকার্য যে, পারমিতা নিজের প্রথম উপন্যাসেই সার্থকতার সেই বিন্দুকে স্পর্শ করতে পেরেছেন।
যেহেতু উপন্যাসটি অন্যরকম পথের যাত্রী, তাই এর কাহিনিকে খুব বেশি আলোচনায় না-আনাই ভালো। কারণ, তাতে বইটির ভবিষ্যৎ-পাঠকের কাছে এর প্রথমপাঠের রোমাঞ্চ কিছুটা কমে যেতে পারে। কিন্তু ভবিষ্যৎ-পাঠকের জ্ঞাতার্থেই এর লিখনশৈলী নিয়ে কিছু কথা বলা দরকার। পারমিতা অন্বেষণ লিখেছেন বিষাদমধুর এক কাব্যিক ভাষায়। একথা আমি বরাবর বিশ্বাস করে এসেছি যে, একজন কবি যখন গদ্য লেখেন, তখন সেই গদ্যের ভাষা হয়ে ওঠে কবিতার মতো। পেলব এবং লাবণ্যময়। অথবা, রহস্যময় এবং সাংকেতিক। অথবা কবিতার মতো পড়তে লাগে, এমন আরও কোনো আঙ্গিক। পারমিতা আমার সেই বিশ্বাসকে দৃঢ় করে তুললেন। ঠিক সেই কারণেই অন্বেষণ থেকে কয়েকটি লাইন তুলে দেওয়ার লোভ সামলাতে পারছি না—
"ধানের শিষে ভাঙনের রেখা ফুটছে। বাঁধানো ঘাটেও বেলা পড়ে এল। গোধূলির শেষ কমলা আলোয় একঢাল চুল পিঠে ছড়িয়ে মেয়েটি আলপথ বেয়ে হাঁটছে। সন্ধ্যায় তারায় কীর্তনের খোলে তরঙ্গায়িত হচ্ছে অকালবোধন। তুলসিতলার পিদিমের মিটমিটে আলো আরও উজ্জ্বল হচ্ছে সন্ধ্যার শাঁখে। মেয়ে তবু হাঁটছে। এবার আলপথ ডিঙিয়ে গোধূলি শেষ আলো নিভতেই দোল খেল একফালি চাঁদ। জোনাকির পাখায় তৎক্ষণাৎ ফুটল বিন্দু বিন্দু শোকের মেলা। মেয়ে তবু হাঁটছে। হাঁটতে হাঁটতে আঁকছে আকাশ ভরা আয়নায় একটা আস্ত রাত্রির নকশিকাঁথা। আনমনে এক আশ্চর্য বিষণ্ণতার আলো মেখে।"
অনুভবী পাঠক নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, কেন আমি অন্বেষণ-এ পারমিতার লিখনশৈলীর কথা আলাদা করে বললাম। এবার একটু দেখা যাক, সংলাপবহুল কোনো অংশ কীভাবে লিখিত হয়েছে এই উপন্যাসে। সাঁঝবাতি-নীলাদ্রির প্রথম স্পর্শের দৃশ্য এইভাবে এঁকেছেন পারমিতা—
"খুব আদর করতে ইচ্ছে হচ্ছে নীলাদ্রির। তবু নিজেকে সংবরণ করল। মুখ ফুটে বলল—"সাঁঝ আমাদের স্বপ্নপূরণ।" কাঁধে মাথা রেখে সাঁঝ বলল—"হুম। এই স্বপ্নটা আমি প্রতিদিন দেখতাম নীল। প্রতিদিন অনুভব করতাম। তাই তোমার স্পর্শ আমার অচেনা ঠেকছে না। কী ভীষণভাবে তোমায় চেয়েছি নীল। আরাধ্য দেবতার মতো আমার ভালোবাসাকে চেয়েছি..." বলতে বলতে সাঁঝের গলা বুজে আসে। ঠোঁট কাঁপতে থাকে। নীল ওই কম্পিত ঠোঁটে আলতো করে নিজের ঠোঁট ডুবিয়ে দেয়। আর নিজেকে আটকে রাখতে পারল না সাঁঝ। দু'জোড়া তৃষিত ঠোঁটের চুম্বন গভীর থেকে গভীরতর হল...আঙুল আঙুলকে স্পর্শ করল। নীল সাঁঝের হাত শক্ত করে ধরে বলল—"তুমি পারলে সাঁঝ। ভালোবাসার এত শক্তি তোমায় না দেখলে কোনোদিন জানতাম না।""
প্রেমময় এই দৃশ্যের বর্ণনায় কি সেই অর্থে কোনো কবিতার মতো ভাষা আছে? না, নেই; আবার আছেও! খুব আড়ম্বরহীন অথচ তীব্র আন্তরিক বর্ণনার অন্তরালে যে-সুরটি খেলা করছে, একটু কান পেতে শুনলে বোঝা যাবে, সেই সুরটি আসলে কবিতার-ই। কাব্যময় ভাষার কোথাও তীব্র, কোথাও প্রচ্ছন্ন উপস্থিতি এই উপন্যাসকে আরও অন্যরকম হয়ে উঠতে সাহায্য করেছে।
তাহলে কি উপন্যাসটি পড়তে গিয়ে কোথাও ঠোকর খেতে হয় না? হয় বইকি! যেমন ধরা যাক, সাঁঝবাতির সহকর্মী-বান্ধবী প্রতিভা কৌর-এর কথা। প্রতিভা পাঞ্জাবি মেয়ে, এবং তার স্বামীর নাম দীপেন কৌর! কিন্তু আমরা তো জানি, কৌর এমন একটি পদবি যা শুধু পাঞ্জাবি নারীদের (মূলত শিখ নারীদের এবং কিছু হিন্দু নারীদেরও) নামের মধ্যে থাকে, পুরুষদের নামে নয়। অতএব দীপেনের 'কৌর' হওয়ার কোনো সম্ভাবনাই নেই। এছাড়া, সাঁঝবাতির স্বামী সাত্যকি ও শিশুপুত্র অয়নের চরিত্রচিত্রণে পারমিতা আরও একটু সময় দিতে পারতেন বলে কোনো-কোনো পাঠকের মনে হতে পারে। ঠিক যেমন মনে হতে পারে, নীলাদ্রির মা সুরমা অথবা অনিকেতের অসুস্থ মায়ের কথাও আরেকটু লিখতে পারতেন তিনি। যেহেতু এই চারটি চরিত্রের আচার-আচরণ উপন্যাসের প্রধান তিনটি চরিত্রের উপর সরাসরি প্রভাব ফেলে, তাই এমন মনে হওয়াটা অস্বাভাবিকও নয়। তবে একথাও ঠিক যে, এই চারটি চরিত্রকে আরও জায়গা দিতে গেলে অন্বেষণ-এর কলেবর আরও অনেকটাই বেড়ে যেতে পারতো। তাহলে উপন্যাসটির বাঁধন ঠিক এমন-ই থাকতো কিনা, সেটাও একটা বড়ো প্রশ্ন। সেইদিকে থেকে ভাবলে, মূল তিনটি চরিত্রে মনোনীবেশ করে পারমিতা হয়তো ঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছেন। সব মিলিয়ে, পারমিতার ঔপন্যাসিক রূপে আবির্ভাবকে সফল-ই বলা যায়।
বইটিতে ব্যবহৃত কাগজ চমৎকার; ছাপা আর বাঁধাইও সুন্দর। নয়নিকা দে-র প্রচ্ছদ নয়নাভিরাম। ব্লার্বে ব্যবহৃত ফটোগ্রাফের পাশাপাশি প্রচ্ছদের ছবিতেও পারমিতা আছেন, যা প্রচ্ছদকে ব্যতিক্রমী করেছে। শুধু কিছু ভুল বানানের ব্যবহার সচেতন পাঠককে বইটি পড়ার সময়ে উত্যক্ত করবে। এই ত্রুটিগুলো শুধরে নিলে, বইটি সর্বাঙ্গসুন্দর হতে পারতো। আরও যে-কথাটি না-বললেই নয়—একটি বাংলা উপন্যাসের নাম অন্বেষণ The Quest হওয়ার প্রয়োজন কী! অন্বেষণ-ই কি যথেষ্ট ছিল না?
অন্বেষণ The Quest | পারমিতা | দ্য কাফে টেবল | ব্যান্ডেল, হুগলি, পশ্চিমবঙ্গ | ২৫০ টাকা
Comments
Post a Comment