সমরেন্দ্র মণ্ডল


অর্বাচীনের আবার কথা! ও জগা পাগলা যা, আমি বা আমরাও তাই। জগা থাকুক এবার জলাশয়ে। নিজের ভাবনায়। এবার থেকে আমরা না-হয় নিজেদের কথা নিজেরাই বলবো। ও হরি! তা'লে জগা অর্বাচীনের কী হবে? হবে আবার কী? আরে, জগা কি একা? ও জগাও যা, আমরাও তাই। এই আমরাও তো এক-একটা অর্বাচীন। আমি তো বটেই। না'লে জগৎজুড়ে এই যে এত কাণ্ডকারখানা, তার হদিশ রাখতে পাচ্ছি কই। ওই যে  ধানখেত মুড়ে খেয়ে আকাশছোঁয়া বাড়ি করতে দেখে জগা যেমন ভিরমি খেতে শুরু করেছিল, তেমনি আমাদেরও তো ভিরমি খাওয়ার মতো অবস্থা হয়, না কি? তা আমরা ভিরমি খেতে-খেতে জলে ভেজানো পাকা বাঁশ হয়ে গিয়েচি। তারই কুলো তৈরি করে পিঠে বেঁধেছি। তা কুলো বাঁধলে কী হবে, শিরদাঁড়া তো আর সোজা হচ্ছে না। অনুরাগের ঠ্যালায় গাঁটগুলো ঢিলে হয়ে কেমন যেন নুইয়ে পড়ছে। মাঝেমাঝে মনে হয়, টিউবওয়েলের হাতল টেপার মতো কেউ বুঝি শিরদাঁড়টাকে নুইয়ে দিচ্ছে। ছেড়ে দিলেই সড়াৎ করে সিধে হয়ে যায়। কিন্তু সে আর কতক্ষণ! কতদিন তো সকালে ঘুম থেকে উঠে সারা বাড়ি তন্নতন্ন করে খুঁজেও হদিশ পাওয়া যায় না। আলমারির তাক, ওয়ার্ডরোব, টেবিলের ড্রয়ার, খাটের তলা, এমনকি বাথরুমেও খুঁজে পাওয়া যায় না ওটাকে। আচ্ছা বিপদ তো!  অর্বাচীন কাতর মিনতি করলো, কোতায় গেলে বাছাধন? ফিরে এসো বাপ, তুমি পিঠে সেঁটে না-থাকলে  কতা কইবো কেমন করে, হাঁটবোই-বা কেমন করে?
নাঃ, কোত্থাও পাওয়া গেল না। অগত্যা শিরদাঁড়াবিহীন অর্বাচীন জুবুথুবু হয়ে ছুটলো বাজারে। পকেটের রেস্ত খসিয়ে একটা নতুন শিরদাঁড়াই কিনতে হবে। কী আর করা যাবে।

কিন্তু সেখানেও হ্যাপা। বাজারের এমুড়ো থেকে ওমুড়ো ছুটে বেড়ালো; নাঃ, শিরদাঁড়ার একটা টুকরো কোথাও পড়ে নেই! ছোটো শপিংমল। নাঃ, নেই। ভ্যালা রে, কোথায় পাওয়া যায় বাপধনকে!  খোঁজ, খোঁজ। জুবুথুবু শরীরটা টানতে-টানতে খুঁজতে লাগলো। ওই তো শহরের একটেরে প্রায়ান্ধকার একটা মান্ধাতা আমলের দোকানের সাইনবোর্ডে লেখা আছে 'সর্ব্বপ্রকার শিরদাঁড়া বিক্রয়ের বিশ্বস্ত  প্রতিষ্ঠান'। সাইনবোর্ড দেখেই সাঁৎ করে দোকানে ঢুকে গেল অর্বাচীন। দোকানের এককোণে আধো-অন্ধকারে একটা হাতল খোয়ানো কালো কাঠের চেয়ারে এক বৃদ্ধ বসে ঝিমুচ্ছেন। যেন ধ্যানস্থ ঋষি।
— দাদা একটা শিরদাঁড়া হবে?
— হবে। 
ব্রহ্মনাদ ভেসে এল।
— কত দাম?
— কী মাপ?
— মাপ? তা তো জানি না!
— দাঁড়ান, আগে মাপ নিতে হবে।
আলো-অন্ধকার থেকে শালপ্রাংশু খাড়া শিরদাঁড়া এক প্রবীণের আবির্ভাব ঘটলো। হাতে কাপড় মাপার ফিতে। বললেন, পিছন ঘুরে দাঁড়ান। 
তিনি জামার মাপ নেওয়ার মতো ঘাড় থেকে পশ্চাদ্দেশের প্রারম্ভ পর্যন্ত মেপে ব্রহ্মনাদ ছাড়লেন, আটচল্লিশ ইঞ্চি। হবে। বসুন।
সামনের পাটাতন তুলে তিনি অন্ধকারে অদৃশ্য হলেন। স্বল্পকাল পরেই দৃশ্যমান হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কোন ব্রান্ড নেবেন?
— মানে?
— মানে ইন্ডিয়ান, চাইনিজ, কোরিয়ান, রাশিয়ান, জার্মানি, ইংল্যান্ড মায় বাংলাদেশি পর্যন্ত।
অর্বাচীন প্রায় বিষম খেল। চোখ দুটো ঠিকরে বেরোচ্ছে। জিভ শুকিয়ে যাচ্ছে। শিরদাঁড়ার আবার ব্রান্ড। ভ্যালারে ভ্যালা।
 —কী হলো, বলুন!
অর্বাচীন ভাবলো, চাইনিজ নিলে কেমন হয়? কম্যুনিস্ট শিরদাঁড়া নিশ্চয় শক্ত হবে। এরকম ভেবেই বললো, চাইনিজ মাল কেমন হবে?
— ভালো। বেশ শক্ত, ঋজু। নিতে পারেন। তবে মালের কোনো গ্যারান্টি নেই।  ইউজ অ্যান্ড থ্রো। স্পেয়ার পার্টস পাওয়া যায় না।
— আচ্ছা, রাশিয়ান মাল কেমন হবে? ওদের তো শিরদাঁড়া শক্তই থাকে।
— আগে ছিল। ওমাল বাজারে আর চলছে না। একপিস পড়ে আছে। অ্যান্টিক বলে রেখে দিয়েছি।
অর্বাচীন ফাঁপড়ে পড়লো। চিন-রাশিয়া যদি বাতিল হয়, তাহলে রইলোটা কী। আচ্ছা, বাংলাদেশের মাল কেমন হবে! ওরা যেভাবে সরকার বদলে নিল...ভাবতেই  জিজ্ঞেস করলো, আচ্ছা দাদা বাংলাদেশের শিরদাঁড়া কেমন হবে?
দোকানি স্মিতঠোঁটে বললেন, ওদের নিজস্ব কোনো প্রোডাক্ট নেই। চিন, আমেরিকা, ভারত এইসব দেশের মাল নিয়েই দেশ চলে। একটা মাল এসছে। দেখাচ্ছি।
ভিতর থেকে একটা শিরদাঁড়া নিয়ে এসে সামনে রাখলেন। বেশ চকচকে। গায়ে লেবেল সাঁটা—বাংলাদেশে উৎপাদিত। কিন্তু জিনিসটা দেখে অর্বাচীনের কেমন সন্দেহ হলো। আসল মাল তো! সে যেই শিরদাঁড়ার গায়ে হাত দিয়েছে , অমনি নুয়ে পড়লো। সে চিৎকার করে উঠলো, চলবে না।
দোকানি মোলায়েম স্বরে বললেন, আমি বলি কী ভাই, আপনি ভারতীয়টাই নিন। ওটাতে স্প্রিং লাগানো আছে। ইচ্ছামতো বাঁকাতেও পারবেন, সোজা করতেও পারবেন। একটা তেল দিয়ে দিচ্ছি। মাঝেমাঝে একটু তেল দিয়ে দেবেন, চমৎকার চলবে।
অর্বাচীন ভাবলো, এটাই নিই। দামটা একটু বেশি। তা হোক। ভারতীয় শিরদাঁড়াই তো। বেশ রামধনু রঙ। এই বেশ। 
(চলবে)


Comments